কোনো_এক_শ্রাবণে পর্ব-০৬

কোনো_এক_শ্রাবণে

পর্ব-০৬

শাহাজাদী মাহাপারা (জোহুরা খাতুন)

ঋতুর চাকরিটা হয়নি।স্বাভাবিকভাবেই না হওয়ারই কথা।৮মাসের প্রেগন্যান্ট মহিলাকে কেউ চাকরি দিবেও না এই সময়। ঋতু কিছুটা আশাহত হলেও বাচ্চার কথা চিন্তা করেই আরো কিছু ইন্টারভিউ দিয়ে দিলো। গত দুমাসের বাসা ভাড়া গায়েবী ভাবেই কেউ পরিশোধ করেছে।বাড়ির মালিক বলেছেন বিকাশে কেউ টাকা পাঠিয়েছে।তারা যেই দু রুম নিয়ে থাকে তার ভাড়া প্রতিমাসে ১১ হাজার।ঢাকায় এখন সস্তায় বাসা পাওয়াটা কঠিন ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে।এই ভাড়া মিটিয়ে ঋতুর কাছে থাকে প্রায় ৯ হাজার টাকা।সেই টাকা দিয়েই সারা মাস চলতে হয়।ব্যাংকে আকাউন্ট খোলা আছে তাতেও কিছু রেখে রেখে টাকা জমাচ্ছে। আর বাসায় একটা মাটির ব্যাংকে কিছু টাক জমাচ্ছে বাবুর জন্য।ডাক্তার বলেছে কম হলেও ১০ হাজারের মতো লাগবে সিজারিয়ান করতে।কারণ তার কিছু কম্পলিকেশন আছে। এছাড়াও আরো অনেক খরচই হবে। ভাতের নলা মুখে তুলতে তুলতেই ভাবলো ঋতু।

আজ বহুদিন জাবত তার স্বামী ঘরে আসে না।সে জানে সে কোথায় থাকে।কিন্তু তবুও খোঁজ নেয়না।প্রথম প্রথম এই সন্তানের প্রতিও তার ঘৃণা জমেছিলো তবুও মা তো তাই বেশিদিন ঘৃণা টিকতে পারেনি।সন্তান যারই হোক সে তো মা।নিজের সন্তানকে ঘৃণা করা সহজ কথা না।
ঋতু ঠিক করেছে অন্য কোথাও চাকরি হলেই সে এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। সে জানে তার নামে গায়েবী টাকা গুলো কে দিচ্ছে। এগুলো সেই ভদ্রলোকের কাজ।ঋতু নাফির অনুভূতি গুলো বুঝে তার প্রতি।কিন্তু সে নিরূপায়। সে চায়না এমন কিছু হোক।তাই সে এই লোকের ছায়া থেকেও নিজেকে আড়াল করে ফেলব।
—————————————————————–

বাড়ির পিছনের দিকের কলপারে কামাল গোসল করছিলো গামছা পরে।সাবান দিয়ে শরীর ঘসে ঘসে। সাবানের ফেনায় তার শরীর ফেনাময়। হঠাৎ আকাশ থেকে ঝপ করে এক বালতি পানি তার গায়ে পড়লো। কামাল চমকে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো। মুখে পানি ছিটিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলো নসিমা খিক খিক করে হাসছে।সে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত না। জেনো সে বেশ মজা পেয়েছে এমন কাজে। কামাল নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার গায়ে কি ঢালা হয়েছে।কিন্তু সে নসিমার উপর একটুও রাগ করলো না। আবার শরীরে সাবান মেখে পরিষ্কার পানি ঢেলে গোসল সারলো। নসিমা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সে ভেবেছিলো বালটি ভর্তি ঘরমোছার পানি কামালের গায়ে ঢাললে সে ভীষণ ভাবে রেগে যাবে।কিন্তু উলটো কামাল ঠান্ডা মেরে গেলো।নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস হতে লাগলো। ব্যথাতুর দৃষ্টি নিয়ে সরে গেলো।

—————————————————————–

আবরারের পথ আটকে দাড়ালো নিপা।
– অনেক সহ্য করছি আর না।কি সমস্যা? দেখলেই রাস্তা পাল্টায় ফেলেন কেন?
আবরার ভয়ে ঢোক গিললো।
আল্লাহর নাম নিয়ে সাহস করে বললো –
আমার অনেক কাজ থাকে।ব্যস্ত থাকি দেখেনই তো তাহলে কেনো বিরক্ত করেন?
– আমি বিরক্ত করি? ঠিকাছে আর করবোনা।আপনার চেহারাও দেখবোনা। আমারটাও দেখাবোনা।ওকেই বাই।

বলেই নিজের রুমের দিকে এগোয়।
আবরার হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে।
কিছুক্ষনের মাঝেই তার খারাপ লাগা শুরু করে।বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হয়।সত্যিই কি নিপা আর চেহারা দেখাবে না? তাহলে সে থাকবে কি করে?

নিপা ফাইল ঘাটতে ঘাটতে নিলয়ের কল এলো মোবাইলে।ধরবে না ধরবেনা করেও ধরলো শেষ অব্দি।
– নিপা কবিতা শুনবে?
– না এখন ইচ্ছে নেই।
– তুমি ভালো আছোতো খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে? শুনলাম নতুন প্রজেক্টের জন্য নাকি নতুন একজন অফিসার জয়েন হয়েছে অফিসে?
– ঠিক শুনেছো।
– তুমি কি আমার উপর রাগ? কি হয়েছে?
নিপা একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে কিন্তু কি মনে করে যেনো আর বললো না।

নিলয় ফোন রাখতেই।নিপার মেসেঞ্জারের টোন বেজে উঠলো।ওপেন করতেই চোখে পরলো সেদিনের বিদেশী মহিলার আইডি।কিছু ছবি দিয়েছেন তিনি।তাতে নিলয়ের সাথে ওইদিনের রেস্টুরেন্টে দেখা মহিলা এবং ছোট বাচ্চাটা।
নিপার শরীর কাপঁছে। চোখের কোণে পানি জমেছে।সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।কান্নার বেগ আটকে রাখার যেনো আপ্রাণ চেষ্টা।

—————————————————————–

রুবাবা আর দোলা মিলে পিঠা বানাচ্ছে আর ৬দিন বাকি মাহাপারার দেশে ফিরতে।
শুকনো পিঠাগুলোই বানাচ্ছে আপাতত।রোদে শুকিয়ে রাখবেন।
দোলা রুবাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো –
মা আজ জাহিদ সাহেব আছেন না? ওই যে নাফি ভাইয়ের বন্ধু? ওনাকে দাওয়ার করেছি।
– হঠাৎ? রান্না কে করবে? আমি একটু শপিং এ যাবো ভাবছিলাম আগে জানাবি না?
– মা আমিই রাধঁবো চিন্তা করোনা তুমি। উনি যা যা পছন্দ করেন তা সব আনিয়ে রেখেছি কামালকে দিয়ে।
রুবাবা শান্ত দৃষ্টিতে দোলার দিকে তাকালেন। তার বড় কন্যা।জীবনের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার করে এতোদূর এসেছে। প্রথম সংসার জীবনটাও সুখকর হয়নি।এতো কষ্ট বুকে চেপে দিনাতীত করেছে হাসিমুখে। ইদানীং তিনি লক্ষ্য করেন তার এই কন্যাটি বেশ হাসি খুশি থাকে। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন এ হাসি যেন না সরে তার চেহারা থেকে। এ হাসির কারণ কি?তিনি তা বের করবেন এবং সেই কারণকে তার কন্যার আচঁলে গিট্টু দিবেন।যেনো তা কখনো দূর না হয়।

_____________________

দেশের মাটিতে পা রাখতেই হালকা বাতাসের দোলা লাগলো মাহাপারার সমস্ত শরীর জুড়ে।কি দারুণ সে অনুভূতি ! আজ ৪বছর পর দেশের মাটিতে পা দেয়া।দোলা আপার বিয়ের পরেই সেই যে গিয়েছিলো বিদেশ বিভূয়ে আর আজ ফিরলো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেই ফেরা।মাস্টার্সটাও করতে চেয়েছিলো।কিন্তু মায়ের মুখটা দেখতে মন ছুটে গিয়েছিলো মাহাপারার। আর তাছাড়া এখনতো আর কেউ নেই সেই ভীনদেশে,তবে আর কেনো থাকবে সে সেখানে? কিশের টানে? আচ্ছা সত্যিই কি কিছু নেই সেখানে? সব ঝামেলা মিটিয়ে মাহাপারা এসে বসলো লবিতে কিছুক্ষণের জন্য।বড্ড খারাপ লাগছে তার।প্রায় ২৪ ঘন্টার জার্নির ধকল।
টায়ার্ড?
অপরিচিত কন্ঠ শুনে পাশে ফিরলো মাহাপারা।
-আপনাকে চিনতে পারছি না।
– তবে আমি আপনাকে চিনি।
– কি করে?
– একিই প্লেনে আসার শুবাদে।
– ওহ।
– আমি মিশনে গিয়েছিলাম সেখান থেকেই ফিরলাম আজ।আপনি মনে হয় ভালো নেই। আপনার কি সিকনেস হচ্ছে?
– জ্বি কিছুটা। আসলে এরকম জার্নির অভ্যাস নেই।
– আচ্ছা ঠিকাছে আর কতক্ষণ থাকবেন? বেরুবেন না?
-এক্সকিউজ মি! আমি নিশ্চই আপনার সাথে যাবোনা।প্লিজ বিরক্ত করবেন না এখন।
বমি চেপে রেখে কোনো রকম বললো মাহাপারা।
রেস্টরুমটা ওইদিকে। আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলো তাকে। বমির বেগ চাপতে না পেরে ব্যাগ রেখেই সেদিকে দৌড় দিলো মাহাপারা।
রেস্টরুম থেকে বের হবার পর তার মাথায় এলো সে কি করেছে? ব্যাগ গুলো লবিতেই আছে তবে তার সামনে একজন গার্ড দাড়ানো।
মাহাপারা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। ব্যাগ গুলো হাতে নিতেই লোকটা প্রশ্ন করলো এগুলো আপনার?
-জ্বি।
-পাসপোর্ট দেখি। আর আপনি আমার সাথে চলুন।
-কিন্তু কেনো?
– চলুন। আপনার ব্যাগটা সার্চ করতে হবে।
মাহাপারা বুঝে গিয়েছে কিসের পাল্লায় পরেছে সে।এ আর নতুন কিছুনা। অহরহই হচ্ছে যাত্রী হেনস্তা আর টাকা হাতানো।এবং এদের সাথে জড়িয়ে আছে পুরো সিস্টেম।তবে মাহাপারা তার সাথে যেতে নারাজ।এক পর্যায়ে লোকটা তার উপরের কর্মকর্তাদের জানানোর কথা বললো।
– এই নিন ধরুন।
পানির বোতলটা আগন্তুক তার দিকে এগিয়ে দিলো মাহাপারা তা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাড়িয়ে রইলো।
গার্ডটা মাহাপারাকে যেতে পায়তারা করলে আগন্তুক তার কার্ডটা বের করে গার্ডের হাতে দিতেই সে স্যালুট করে চলে গেলো।মাহাপারা হাপ ছেড়ে বাচঁলো।
আগন্তুক কে ধন্যবাদ জানিয়েই ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পরলো।
———————————————————————–

জাদিদ রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে দোলার জন্য।
আজ সে তার মনের কথা দোলাকে বলবেই।
জীবনে একবার ভালোবাসা হারিয়েছে আর না।
সে জানে দোলা তাকে অস্বীকার করবেনা তবুও তাকে জানাতেই হবে।
দোলা আসতে এতো দেরি করছে কেনো? বারবার ঘড়ি দেখছে জাদিদ।
অপেক্ষায় অপেক্ষায় তার সময় পার হয় কিন্তু দোলার দেখা নেয়।ফোন দিচ্ছে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছেনা।ভয়ে ভয়েই জাদিদ নাফির নাম্বারে কল করলো।তারপর যা শুনতে পেলো তার জন্য সে প্রস্তুত ছিলোনা।এক মুহূর্ত কাল বিলম্ব না করে সে বের হয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে।
————————————————————————

দোলা বেগুনি রঙা শাড়ি পরেছে আজ।এই মুহুর্তে সে পার্লারে বসে আছে।বাবা বলেছে তার আহ জাদিদের সাথে দেখা করার কথা ছিলো।কিন্তু আজই পাত্রপক্ষ আসার কথা।বাবার কথার অবাধ্য হয়নি সে।তাই জাদিদকে ফোন ও করতে পারছেনা বেচারা কষ্ট পাবে তাই। আর তার ফোনও ধরছেনা।

রুবাবা নাস্তা পানি রেডি করে রেখেছে। শফিক সাহেব বলেছেন আজ তার মেয়েকে দেখতে আসবে। তাই এত আয়োজন।তিনি দোলাকে রেডি হতে বলেছেন।মনমরা হয়েই বলেছেন।কারণ তিনি জানেন দোলা এই বিয়েতে খুশি না আর দোলা নিজেও তার বাবা কে মানা করেনি।তবে এবার আর তিনি তার কন্যার জীবনে কষ্ট দেখতে চান না।এবার তিনি দোলাকে সুখী দেখতে চান।পাত্র পক্ষ গেলেই তিনি শফিক সাহেবের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবেন।
———————————————————————–

আবরার তার পুরো পরিবারকে নিয়ে আজ দোলাদের বাসায় এসেছে। শুধু মাত্র চাচার দেয়া কথা রাখতে নিমরাজি হয়েই আসা।সে ঠিক করেছে বাসায় গিয়ে মানা করে দিবে।কারণ তার মনের দোলনায় দোলা না অন্যকেউ দোল খাচ্ছে। সে জানে হয়তো তাকে পাবেনা তবুও এখানে বিয়ে অসম্ভব।

ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে পাত্রী দেখার পালা শফিক সাহেবের মনে আজ অন্য কিছুই খেলা করছে বড্ড ইচ্ছে করছে তার খেলাটা খেলতে।নাটকীয়তা তার বেশ পছন্দ।যদিও তার তিন কন্যাই এবং পুত্র এ ব্যাপারে অবগত। তবুও দারুণ মজা হবে।

মাহাপারার গাড়িটা বাসায় না গিয়ে প্রথমে অন্য কোথাও গেলো। বাবা ফোনে বলেছেন তাকে কোথায় যেতে হবে।কামালকে মাহাপারা সেই ঠিকানায় নিতে বললো।
—————————

-আবরার বাবা তোমার জন্য আজ একটা চমক রয়েছে।এই সদর দরজা দিয়ে তিনজন নারী ঢুকবে।তোমাকে এদের মাঝে থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে। যাকে বেছে নিবে সেই হবে তোমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী।
শফিক সাহেবের কথা শুনে সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো।
আবরার মনে মনে বললো বুড়োটার মাথা সটকে গিয়েছে নাকি? এমনিতেই চশমা ছাড়া চোখে দেখিনা।এরপর যদি উল্টা পাল্টা হয় ক্যালেংকারী কান্ড ঘটবে।
-ভয় পেয়োনা বাবা তবে কাজটা তোমার করতে হবে চশমা ছাড়া।
-যাহ বাব্বা যার ভয় পেয়েছিলাম তাই হলো।যাইহোক এই পাগলের কোনো মেয়েকেই আমি বিয়ে করবোনা। মেয়েগুলোও নিশ্চই এমন।

ড্রয়িং রুমের এক পাশে তিনজন ঘোমটা দেয়া নারী দাড়িয়ে আছে। একজন বেগুনী রঙা শাড়িতে, একজন হলুদ, আরেকজন ধূসর।
আবরার চোখ থেকে চশমা খুলে এগিয়ে যাচ্ছে তিনজনের দিকে ঝাপসা চোখে। আল্লাহ মালুম কোন মসিবতে পরতে যাচ্ছে সে!
———————

জাদিদ জ্যামে আটকে আছে।উফফ এই জ্যামের শহরে আর না।দোলাকে বলতে হবে চাকরিটা ছেড়ে দিতে তাহলে এই জ্যামের শহর ছেড়ে চলে যাবে তারা দূরে কোথাও।কিন্তু আগেতো তার জন্য দোলাকে পেতে হবে। তারও আগে এই জ্যাম থেকে ছাড়া পেতে হবে।দেরি হয়ে না যায় তবে আর দোলাকে পাওয়া যাবেনা।
জ্যামে বসে বসেই এইসব ভাবছে জাদিদ।কি হতে যাচ্ছে তাদের জীবনে তার কোনো ধারণা নেই তার। বড্ড দেরি না হয়ে যায়।

চলবে…!

Shahazadi Mahapara’s Inscription

(কমেন্ট বক্সে আপনাদের মন্তব্য জানাবেন প্লিজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here