কোনো_এক_শ্রাবণে পর্ব- ১২

কোনো_এক_শ্রাবণে

পর্ব- ১২

শাহাজাদী মাহাপারা (জোহুরা খাতুন)

স্প্রিং চলে গিয়ে সামার আসতে চলেছে । ফাউন্টেন লেকের পানি শীতল ভাবে বয়ে চলেছে। ম্যাপল ট্রি গুলো আবার পাতায় পাতায় সজীব হয়ে উঠেছে। বেঞ্চে বসে আছে মাহাপারা, তার হাতে কফি মগ৷ বসে বসে লেকের ভিউ দেখছে বলা চলে। আশেপাশে প্রায় সবাই হাঁটতে বেড়িয়েছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো।সারাদিন গরম থাকলেও এখন প্রায় ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে৷বেগুনি রঙের শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে বসলো মাহাপারা। দুবছর হতে চললো সে দেশে ছেড়েছে। বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে আছে নিজের পরিবার আপনজনদের ছেড়ে। দেশে থেকেই বা কি হতো কেউতো নেই ওর সেখানে। কফির মগে চুমুক দিলো মাহাপারা। আজ মনটা হঠাৎ করেই খারাপ লাগছে৷ মাস্টার্সটাও শেষ হয়ে এলো। আর বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা এখানে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। উঠে হাঁটা দিলো মাহাপারা সামনে এগুতেই শ্যালির সাথে দেখা হয়ে গেলো। শ্যালি মাহাপারার বন্ধু এবং বান্ধবিও।শ্যালি বাই সেক্সুয়াল। হয়তো ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই দেখা করতে এসেছিলো। ফিরতি পথেই দেখা। শ্যালি মাহাপারাকে দেখে উজ্জ্বল হাসি দিলো ” শেষ লেক ভ্রমণ?” ” হ্যাঁ! আজ এতটুকুই।”
“সময়তো প্রায় ফুড়িয়ে এলো এরপর কি ভেবেছো?”
“না। তবে দেশে ফিরতেতো হবেই।এই ভিনদেশে একা একা আর কতদিন!”
“হুম। তবে তুমি যে বলেছিলে তোমার ফুফু আর ফুপাতো ভাই থাকে এখানে?”
“হ্যাঁ। তা থাকে তবে আমি কারো বোঝা হতে চাই না শ্যালি। আমার জীবনটা এমনিতেই ভঙ্গুর। সেই জীবনে পুরোনো স্মৃতিগুলোকে জড়িয়ে আর সমস্যা বাড়াতে চাইনা। ফিরে যাওয়াটাই উত্তম। তবে যদি এখানে কিছু একটা হয়ে যায় তবে আর ফিরবো না।”
“ঠিকাছে। ঈশ্বর তোমার সহায় হোক। ”

হাঁটতে হাঁটতে মাহাপারা আর শ্যালি ডোমের কাছে চলে এলো৷ মাহাপারাকে বিদায় জানিয়ে নিজের ডোমের দিকে রওনা হলো শ্যালি।
রুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় ছাড়তেই হোয়াটসঅ্যাপে কল এলো। মাহাপারা ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলো। অপর পাশ থেকে আশা খবর আর কন্ঠ দুটো শুনেই মাহাপারার পাগল হবার জোগাড়৷ গত দুবছরে এতো আনন্দিত হয়েছিলো কবে খেয়াল নেই তার।
দরজা ক্র‍্যাক আওয়াজ হতেই মাহাপারা ফিরে তাকালো। রুমের ভিতর একজন বিশাল দেহি নর্থ আমেরিকান এসে দাঁড়ালো। মাহাপারা মেয়েটিকে জাপটে ধরে হাসতে লাগলো৷ “কি হয়েছে সুইটি? তুমি আজ বেশ খুশি মনে হচ্ছে তবুও এই কান্না কেনো?” ” ও এলিফ!” ” কি হয়েছে সুইটমিট? ” ” আমার বড় আপা প্রেগন্যান্ট এলিফ! এইট উইক্স এন্ড কাউন্টিং।”
” হলি মাদার! ওহ গুডলর্ড! দারুণ খবর এতো। তোমার অনাগত নিস বা নেফিউ এর জন্য শুভকামনা সুইটি।” মাহাপারার খুশিতে এলিফও বেশ খুশি হয়ে গেলো। বহুদিন পর হয়তো মাহাপারাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছে তাই৷

—————————————————

গোধূলির আলোয় নিপার চোখ বেয়ে পড়া একফোঁটা জল কে টুপ করে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করলো আবরার৷ গরমের শুরু হয়ে গিয়েছে কিন্তু সিলেটে এই রোদ এই বৃষ্টি৷ কিছুক্ষণ আগেই রোদ উঠেছিলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘের গর্জন শুনে নিপা ক্রন্দনরত কন্ঠে গেয়ে উঠলো –
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে
রিমিঝিমি রিমিঝিমি রিমিঝি।।

মগ্ন হয়ে নিপার গান শুনছিলো আবরার৷ কি দারুণ গান টা কি করুণ কন্ঠে গেয়ে চলেছে নিপা। আজ প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো নিপা আবরারের বিবাহিত জীবনের। হয়তো আর ১০ টা বিয়ের মতো আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ে হয়নি তাদের। এক কাপড়ে বেড়িয়েছিলো নিপার হাত ধরে। তার পরিবার তার সাথে থাকলেও নিপার মানসিক অবস্থা ছিলোনা তামঝাম করে বিয়ে করার। একটা অফইয়োলো কালারের শাড়ি পরেই বিয়ে হয়েছিলো নিপার। আবরারের এখনো মনে আছে সেদিন কবুল বলতে গিয়ে কান্নার দমকে কিরকম কেঁপে উঠছিলো নিপা। বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে ঝিরিঝিরি নিপার একবার মন চাইলো এই বোকা লোকটাকে বলে যে সে আজীবন এই লোকটার বাহুবন্ধনে থাকতে চায়। তার সাথে জীবনের শেষ বর্ষা পর্যন্ত ভিজতে চায়। কিন্তু বলে কি লাভ? বৃষ্টিতে ভেজার কথা বললেই সে গভীর ভাবে তার দিকে চেয়ে বলবে ” ভিজলে চশমা ঝাপসা হয়ে যায়, তারপরতো কিছুই দেখতে পারিনা। বার বার কি করে চশমা মুছবো? তার চেয়ে ভালো আপনিই ভিজুন।” কি অদ্ভুতভাবে আবরার আজও নিপাকে আপনি বলেই ডাকে। সে তার অর্ধাঙ্গিনী কিন্তু এতদিনেও তাদের মাঝে স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক অবর্তমান। নিপা জানে আবরার তাকে ভালোবাসে। এতো ভালোবাসা তার ভাগ্যে আদৌ ছিলো এ কথা ভাবতেই অবাক লাগে তার। জীবন সমুদ্র তাকে কত দূর ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে। সাতার না জানা নিপার জীবনে ভেলার মতো আবরার যাকে একমাত্র আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় সে। আর কিচ্ছু প্রয়োজন নেই তার শুধু এই মানুষটাকে ছাড়া। তাই সে ঠিক করেছে আর অপেক্ষা না এবার এই বোকা লোকটাকে সে তার প্রাপ্য ভালোবাসাটুকু অবশ্যই দিবে।

জানালার পর্দা সড়ানো ছিলো৷ বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে নিপার শাড়ি। আবরার মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিপার চেহারায় থাকা ফোঁটাফোঁটা বৃষ্টির জল। আবরারের খুব করে ইচ্ছে করছে নিপার গালে গাল ছোঁয়াতে৷ কিন্তু সে তা করবে না। বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছে। নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয় এও সম্ভব এক বাড়িতে থেকেও কি করে তারা এতো দূরে ছিলো এত গুলো মাস! পায়ের দিকে চেয়ে আছে আবরার হঠাৎ নিজের পায়ের উপর আরো একজনের পায়ের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো আবরার। তাল সামলাতে না পেরে পড়েই যেতে নিচ্ছিলো নিপা চট করে তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো আবরার। আবরারের গালে নিজের গাল স্পর্শ করলো নিপা। স্পর্শ গুলো জেনো আজ গভীর থেকে গভীরতম হতে চাচ্ছে। ভালোবাসায় মাতামাতি চলছে একজোড়া হলদে পাখির সংসারে। চলুক ভালোবাসা অবিরাম গতিতে। কিছু গল্পের পথচলা শুরু হোক নতুন করে।
দূরে কোথাও আবার শোনা যাচ্ছে সেই দারুণ গান কিন্তু এবার আর তা করুণ শোনাচ্ছেনা।
মন মোর মেঘের সঙ্গী,
উড়ে চলে দিগ দিগন্তের পানে……

—————————————————————-
দোলার শাশুড়ী চুলায় রান্না চড়িয়েছে। দোলা রান্না করতে পারছেনা বেশ কিছু দিন ধরে। খেতেও পারছেনা ঠিকমতো। মর্নিং সিকনেস তো আছেই। আজ প্রায় পোনে ছ’মাস হলো দোলার প্রেগ্ন্যাসির। পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছে৷ স্কুলে যাচ্ছে বাচ্চাদের ক্লাস নিচ্ছে। সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। প্রেগ্ন্যাসির জন্য অস্থির লাগে। পেট দেখা যায় এখন। সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সময় ছাত্রী ভরপুর সিড়িটা হঠাৎ খালি হতে শুরু করে সবাই সরে তাকে জায়গা করে দেয়। “আপা আপনি আগে উঠুন ” চিৎকার করে ক্যাপ্টেন কিংবা আসিস্টেন্ট হ্যেডগার্ল জানান দেয় এই মুহুর্তে সিড়ি থেকে সবাই কে একটু দূরে সড়তে হবে জেনো আপা সেইফলি উঠতে পারে। এবং ক্লাস শেষেও কেউ একজন তার সাথে নিচে নামবেই। বাকি শিক্ষকরাও তার প্রতি কেয়ারিং। এর পেছনের কারণ খুব বেশি না। সারাজীবনের কামাই হিসেবে সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ আর ভালোবাসা। শিক্ষক হিসেবে দোলা সার্থক। বাসায় তার শাশুড়ী, স্বামী সবাই তাকে বেশ যত্ন করে। ইদানীং তার খুব করে মাকে দেখতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু সে দেখতে যায় না। রুবাবাও তার মেয়েদের দেখতে আসেন না। তার ধারণা তার সন্তানেরা তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি। জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় যাদের পেছনে খরচ করেছেন তারাই তাকে অপমান, অপদস্ত আর লানছনা বঞ্চনা ছাড়া কিছুই দেননি। তাই আর তিনি তার কোনো সন্তানের সাথে যোগাযোগ রাখতে চান না৷ নিতান্তই অভিমানে করা অভিযোগ যা তাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে৷

রুবাবা বেশ কিছুদিন যাবত বিছানায় পড়ে থাকে উঠতে ইচ্ছে হয় না। খেতে ইচ্ছে হয়না। তার ধারণা সে কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সে কারো সেবা নিতে নারাজ। সেদিন শরীর ছেড়ে দেয়ায় বাথরুমে যাবার আগেই পড়ে গিয়ে কেলেংকারী করলেন। কিন্তু ঋতুকে তার ধারে ঘেঁষতে দিবেন না তিনি৷ রাগ করেই ঋতু তার শাশুড়ীর সেবা করতে লাগলো। যদিও রুবাবার ভালো লাগছিলো কিন্তু মুখে প্রকাশ করলেন না। মুখে বিরক্তি ধরে রাখলেন। কড়া ডোজের মেডিসিন নেয়ায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।অদ্ভুৎ সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলেন তিনি। হ্যাঁ স্বপ্নই তো।

“পিছনের বাগানটায় বসে আছেন রুবাবা বাচ্চারা সামনে খেলছে। সবার চোখেমুখে হাসি আর দুষ্টুমি খেলা করছে। তাদের ডাকলেন রুবাবা। ওইতো তার সন্তানেরা নিপা নাফি দোলা মাহাপারা দৌড়ে আসছে তার কাছে…!”

————————–

রুবাবা তার বিয়ের শাড়ির দিকে চেয়ে আছে। পুরোনো একটা স্মৃতি মনে পড়ছে তার। নিপা তখন অনেক ছোট পাঁচ কি ছয় বছরের। রুবাবা তাদের ফ্যামিলি এলবাম দেখছিলেন ঘরে বসে হঠাৎ নিপা এসে তার কোলে বসে বলতে লাগলো –
লাল বউটা কি তুমি আম্মু?
“হ্যাঁ ওটা আমি৷ আর পাশে সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটা তোমাদের বাবা।” “আমাকে তোমার শাড়িটা পরতে দিবে আম্মু?” “অবশ্যই মা” ” আমিও আমার বিয়ের দিন এই শাড়িটাই পরবো” রুবাবা হেসেছিলেন সেদিন নিপাকে বুকে জড়িয়ে।

হঠাৎ সেই স্মৃতি মনে পড়তেই তার মনে পড়লো নিপার জন্যই কিভাবে তার সন্তান মারা গিয়েছে। কিভাবে সে মাহাপারার জীবন বাঁচিয়েছে৷ সব তিক্ত অনুভূতিগুলো আবার গ্রাস করলো রুবাবাকে।

তিনি তখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের কামরা উপরে থাকায় সিড়ি বেয়ে উঠতে নামতে হতো। সেদিনটাও বাকি দিনগুলোর মতোই ছিলো। নাফি দোলা স্কুলে। নিপার স্কুল ছুটি হতেই সে বাসায় চলে এসেছে। গোসল করে সারাঘরময় ছুটোছুটি চলছিলো তার। বুয়া ঘর মুছতে ব্যস্ত ছিলো। বহুবার নিপাকে বারণ করার পরও সে ছুটোছুটি করে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে নিপা পানি ভরতি বালতির সাথে ধাক্কা খেয়ে বালতি সমেত সিড়ি থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিলো। বুয়া নিপাকে ধরলেও রুবাবাকে ধরতে পারেনি। রুবাবা দৌড়ে নিপাকে ধরতে এসেই পানিতে পা ফসকে সিড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে এবং জ্ঞান হারায়। নিপা নিরব দর্শক হয়ে চেয়ে ছিলো শুধু। রুবাবাকে হাসপাতালে নেয়া হয়৷ জানা যায় সিড়ি থেকে পড়ায় ড্যামেজ হয়েছে অনেকখানি। একটা বাচ্চার হার্টবিট পাওয়া যাচ্ছে না এবং আরেকজনেরটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ডাক্তাররা সি সেকশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন শফিককে৷ মাহাপারাকে অর্ধমৃত অবস্থায় পৃথিবীতে এনেছিলেন রুবাবা। আর তার অন্য সন্তানকে তিনি কখনোই দেখতে পারেন নি। সর্বক্ষণ ভয়ে থেকেছেন কবে না জেনো মাহাপারাও তার থেকে দূরে চলে যায়। এই ঘটনা তার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে এরপর থেকেই তিনি নিপার প্রতি উদাসীন। তিনি বহুবার চেষ্টা করেছেন সব আগের মতো করতে কিন্তু পারেন নি। একসময় নিপা তার থেকে অবহেলা পেতে পেতে আগ্রাসী হয়ে উঠলো। একটা বয়সে নিপা বুঝে গেলো তার মা তাকে দেখতে পারেনা এবং এরপর একদিন সে দোলাকে টিভির রিমোট ফিকে মাথায় কপালের এক পাশে কেটে দাগ বসিয়ে দিলো। এই দাগ এখনো আছে দোলার কপালে। নাফির ডিবেট জিতে বিদেশে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিলো নাফির ক্ষতি হলে রুবাবা কষ্ট পাবে এই ভেবে তার ফাইল গুলোও নিপা টুকরো করে পানিতে চুবিয়ে দিয়েছিলো। মাহাপারা বাদে নিপা সবার সাথে বৈরি ভাবে আচরণ করতো। নিজের মাঝেই সে এক দেয়াল তৈরি করে নিয়েছিলো যেখানে প্রবেশাধিকার শুধু মাহাপারার। এরপর থেকে নিপার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন তিনি তার বাকি সন্তানদের। তবুও মাহাপারাকে কষ্ট পাওয়া থেকে বাঁচাতে পারেন নি তিনি। স্মরণের সাথে বিয়ের কথা উঠেছিলো নিপার এখানেও মাহাপারাকে বলি হতে হয়েছে। এত কিছুর পরও হয় নি একটা বিবাহিত এক বাচ্চার বাবার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলো। এবং সেই লোক তাদের ঘনিষ্ট মূহুর্তের ছবিগুলোও বাড়িতে পাঠিয়েছে যার জন্য শফিকের হার্ট এট্যাক হয়েছে। এরপরই রুবাবা নিপাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কে জানে কোথায় আছে নিপা। শুনেছেন আবরারের সাথেই বিয়ে হয়েছে তার। ভালোই আছে নিশ্চই সবাইকে শেষ করে।

বাতাসের তোরে জানালাটা ঠক করে বাড়ি লাগতেই রুবাবার ধ্যান ভাঙলো। সামনে তাকিয়ে দেখলেন নির্ভান তার পায়ের কাছে এসে বসেছে। রুবাবা তার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করতেই নির্ভান খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তার হাসি দেখে রুবাবাও হাসলো৷ ওমনি নির্ভান যেনো আষ্কারা পেয়ে তার কোলে চরার বায়না করলো। আজ বহু বছর পর রুবাবার মনে হলো সেই ছোট্ট নাফিকে কোলে তুলেছেন। আচ্ছা দোলারও তো সন্তান আসবে কিছুদিন পর৷ তার খুব করে মন চাইছে একবার দোলাকে দেখুক। কিন্তু তা হয়তো সম্ভব না আর।

———————————————————-
দরজায় কলিং বেল বাজতেই হুমায়রা দরজা খুলে দিলো।
“কামাল মামু ভালো আছেন?” “আছি ভালা মামু। তুমি কেমন আছো?” “ভালো।ভেতরে আসেন মামা।মামণিতো তার ঘরে।” ” চলো আম্মা তোমার আম্মার কাছে যাই।” কামাল দোলার ঘরে যাবার আগে দোলার শাশুড়ীর সাথে দেখা হলো। কুশল বিনিময় করে সবাই দোলার ঘরের দিকে রওনা হলো।কামালের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে বললেন দোলার শাশুড়ী।
“বড় আপা। এই লন আচার আর এইখানে বড়ি আছে কুমড়ার। আর চালতার আচার, আর নারকেলের বিস্কুট ও আছে। ওইটাতে জাদিদ ভাইয়ের জন্য হাস আর খিচুড়ি রান্না করা আছে ঝাল দিয়া। আর ছোট আম্মার জন্য এইটাতে সেয়ই পিঠা আর ডালের বড়া আছে খালি ভাজতে হইবে। আম্মাজানের জন্য এই ব্যাগে চিতই, খেজুরের গুড়ের পায়েস আর রসমালাই আছে। এগুলা সব আপনাদের জন্যি।” দোলা মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো -” এগুলো নিয়ে যাও কামাল ভাই। ভাবি কেমন আছে?” ” আপা আপনার ভাবি ভালো আছেন। এগুলা আপনার ভাবি খুব স্বাধ কইরা পাঠাইছে। মানা কইরেন না আপা। আপনার আম্মা কিছু পাঠায় নাই। হাসের মাংস আর সেয়ইটা খালি ঋতু ভাবি পাক করছে।বাকি গুলা নসিমা পাকাইছে। ” ” কেন যে কষ্ট করে এগুলা করতে যায় ভাবি! ” ” আপনেরে সবাই ভালোবাসে আপা এরজন্যই তো।” ” মেঝ আপা আর ছোট আপারেতো আর কাছে পায় না। তাই আপনার জন্যই সব করে।” ” আম্মা কি নিপাকে মাফ করবেনা কামাল ভাই?” ” করবে আপা নিশ্চই করবে। আপনে কষ্ট পাইয়েন না আপা।” ” মাহাপারার কথা ভাবলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায় কামাল ভাই৷ ” ” আমরা সবাইতো কাছের কাওকে নিয়ে ভালো আছি কামাল ভাই। আমার মাহাপারাটার কি দোষ ছিলো বলতে পারো! কেনো ওর উপর দিয়েই সব ঝড় বয়ে যায়!” বলতেই দোলা ডুকরে কেঁদে উঠলো। দোলার শাশুড়ী দোলার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল “কামাল ওর এই অবস্থায় ওকে এইসব স্ট্রেস দেয়া যাবে না৷ তুমি বাবা নাস্তা করে নাও। দুপুরে খেয়ে যাবা বাবা। জাদিদকে ফোন করে দিয়েছি ও দুপুরে আসতেছে। দোলার আম্মার শরীর এখন কেমন? আর দোলার আব্বার?” ” ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ। খালাম্মাতো মাহাপারা আপার কাছে যাইতে চাইতাছে কয়দিন ধইরা তয় ভিসা হইতাছে না তাই যাইতে পারতাছে না৷ ভিসা অফিস থিকা পাসপোর্টও ফেরত দিতাছে না আশায় আছে হইয়া যাবে কয়েকদিন লাগবে।” “দোলা চোখ মুছে বলল এখন আবার এই শরীর নিয়ে এত দূর ভ্রমণে যাওয়ার দরকার আছে? একা একা কতদূর সামলাবে? আম্মা যে মাঝে মাঝে কি করে না! ” ” চিন্তা কইরেন না আপা সবাই যাইতাছে মনে হয় আমরাও যাবো।” ” দোলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো তোমরা মানে? তুমি আর ভাবিও যাচ্ছো নাকি!” কামালের চোখ জলজল করে উঠলো। সে লজ্জা পেয়ে বলল “জ্বি আপা৷ ” ” দোলা উচ্ছাসিত হয়ে বলল ” কামাল ভাই তোমার এত বছরের অপেক্ষা অবশেষে ফুরাবে বলো। তুমি তাহলে ইউ এস যাচ্ছো! এবার ইউ এস থেকে আসলে সত্যি সত্যিই লোকে তোমাকে ফরেন রিটার্ন বলবে। নসিমা আপার সাথে বিয়ে না হইলে তোমাকেতো ফরেন রিটার্ন বলে বিয়ে দেয়া যাইতো। ” দোলার কথায় দোলার শাশুড়ি আর বাসার কাজের মেয়েটা পুষ্প হেসে ফেললো৷ কামাল লজ্জায় পড়ে গেলো।

দুপুরে সবার সাথে টেবিলে খেতে বসলো কামাল জাদিদ হাসের মাংস আর খিচুড়ি দেখে আহ্লাদ করে দোলাকে বলল তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তোমাদের বাসায় সেদিনও হাসের মাংস আর খিচুড়ি ছিলো মেনু তে হাহা৷ বাটি ভরে নিয়েও এসেছিলাম খিচুড়ি। দোলা জাদিদের হাতে চিমটি কাটতেই জাদিদ আহ করে উঠলো। কামাল ওদের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছে৷ বিদায় নেয়ার আগে দোলা এত্তগুলো শপিং ব্যাগ ভর্তি জিনিস কামাল মারফত পাঠালো ও বাড়ির সবার জন্য৷

গাড়িতে বসে কামাল ভাবতে লাগলো কি হতো সে যদি এই বাড়ির ভৃত্য না হয়ে অন্য কোথাও থাকতো তো! এত ভালোবাসা আর মিল মহোব্বত কি দেখতে পেতো যেখানে এক বোনের সাথে অন্যায় এর জন্য মায়ের সাথে অভিমান করে সন্তানেরা। ভাইবোনদের মাঝে এতটাই ভালোবাসা যে কারো দেয়া কষ্টই কাওকে ছুতে পারে না। এত সুন্দর একটা পরিবার যেখানে ভালোবাসা কানায় কানায় পূর্ণ সম্পর্কে দূরত্ব এলেও ভালোবাসায় দূরত্ব নেই। তার মত একজন চাকর শ্রেণির লোককেও এতটাই সম্মান করে যে বাড়ির মালিকের সাথে এক চেয়ার টেবিলে বসে খেতে দেয়। নিজের ভাইয়ের মতো করে ভালোবাসে শ্রদ্ধা করে। কামালের কখনো মনেই হয় না তার পরিবার নেই। এটাইতো তার পরিবার মা বাবা ভাই বোন সব রয়েছে। কামাল গাড়িটা সাইড করে থামালো তেজগাঁও ফ্লাই ওভারের সামনে সামনে। ট্রেন যাচ্ছে ব্রিজের নিচ দিয়ে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে পরম করুণাময় স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করছে এরকম পরিবার তাকে দেয়ার জন্য।
———————————————————–

কাবার্ডের দরজাটা দুম করে বন্ধ করে দিলো বেয়াজিদ। সামনে সূচি দাঁড়িয়ে৷ প্যাকিং শেষ বেয়াজিদের। সাড়ে আটটায় চলে যাবে সে৷ সূচি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে বেয়াজিদের গতিবিধি। সালেহা বহুবার বলেছে সূচিকে নিজের অধিকার যদি সে নিজে বুঝে না নেয় তাহলে অন্য কেউ তার যায়গা কেড়ে নিবে।
ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় গেলো বেয়াজিদ তার পিছন পিছন সূচিও গেলো। পেছন থেকে বেয়াজিদকে জড়িয়ে ধরলো সে। এত কাছে থেকেও তার কাছের মানুষটা হতে পারেনি বেয়াজিদ। নিরবে সব সহ্য করে গিয়েছে। এই শক্ত কঠোর মানুষটাকে কখনো হাসতে দেখেনি সূচি। না দেখেছে এ বাড়ির দেওয়াল গুলোতে যে ছবিগুলো আছে। সেই সব ছবিতে তার হাস্যজ্জল ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ে হয়ে এই বাসায় আসার পর তাকে হাসতে দেখেনি সূচি। সূচি মাঝে মাঝে একাকিত্ব সময়ে ভাবে বেয়াজিদ তাকে স্ত্রী হবার সম্মান সহ সকল অধিকার দিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা হবার অধিকারটা পায় নি সে৷ সালেহার কথা শুনে এখন সে হাসে শুধু৷ জোর করে চাইলে অধিকার পাওয়া যায় ভালোবাসা কি পাওয়া যায়! ওই অধিকারটাতো বেয়াজিদ একজনকেই দিয়েছে। তার খুব ইচ্ছে করে বেয়াজিদের ভালোবাসা হবার তার হৃদয়ে একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করার। কিন্তু নিরুপায় সে। না জানি কতযুগের অপেক্ষা সে নিজের জীবনে বয়ে বেড়াবে। আদৌ এই তৃষ্ণা মিটবেতো! উত্তর জানা নেই তার। কিংবা কিজানি হয়তো আছে কিন্তু ঝাপসা।

চলবে….!
Shahazadi Mahapara’s Inscription
Shahazadi Mahapara

বিঃদ্রঃ আমার গল্পের পাঠক সংখ্যা খুবই নগন্য৷ ইদানীং এই বিষয়টা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছি৷ বিভিন্ন লিংক গ্রুপ গুলোতে নিজের লিংক নিজেকে শেয়ার করতে হচ্ছে৷ এমন কথাও শুনেছি “লেখক এতই ফেমাস নিজের লেখা নিজেই প্রচার করে বেড়ায় কেউ পড়ুক আর না পড়ুক।” ভাবুন কথাটা কতটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে আমার উপর। অনেকেই লাইভ হয় তাদের লেখা নিয়ে আলোচনা করে।আমি হই না কারণ আমার কথা গোছানো না। নিজের প্রচারণাও করি না তাতেই এগুলো শুনি। তাই আমার হাত দিয়ে আর লেখাও আসছে না। লেখকের বড় শক্তি গুলোর মধ্যে একটি হলো পাঠক। পাঠকরা যদি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় তবে লেখালেখির কোনো মানে নেই।আমার মনে হয় এই ধরনের লেখা বন্ধ করে ওয়েবটুন বা মাংগা থেকে কপি করে উচ্ছিষ্ট লেখাই ভালো এতে অরাজক হোক পাঠকতো পাওয়া যাবে। তারা প্রতিক্রিয়াও জানাবে৷ সবাই বলে নিশ্চুপ পাঠকরা নাকি আসল পাঠক। না,কোনো নিশ্চুপ পাঠকই আসল পাঠক না৷ একটা গল্প ফেইসবুকে দেয়া হয় শুধু বিনোদনের জন্য না। গঠন মূলক কিছু আলোচনা, সমালোচনা আর প্রতিক্রিয়ার জন্য। এতে লেখকের ঝালাই হয়। সে শক্ত হয়৷ বই বের করতে আগ্রহী হয়। আমার পাঠকদের কথা আমি রেগুলার না অলস৷ অথচ তারা প্রতিক্রিয়া জানায় না তাহলে আমি রেগুলার হবো কি করে? লেখার তো মনই থাকে না। যাই হোক। আমি এখন থেকে আর কারও থেকেই কিছু আশা করবো না। চেয়ে চেয়ে প্রতিক্রিয়া নেয়া আমার ধাতে নেই। লজ্জা লাগে। এতদিন চেয়েছি নিরুপায় হয়ে। আজ থেকে সব বন্ধ। পাঠকদের জন্য শুভ কামনা। তাদের সুস্থতা কামনা করছি। ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here