কৌমুদিনী পর্ব-৬

0
2016

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া মেঘলা
#পর্বঃ ছয়

১১
কনস্টেবল ইকবালের মৃ’ত দেহের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়াস৷ মুখে তার গম্ভীর্য নাকি বিস্ময়ের ছাপ বোঝা গেলো না৷
লা’শের অবস্থা করুন চোখ উ’পরে ফেলা হয়েছে হাতের কবজি কে’টে নেওয়া হয়েছে পা দুটো অর্ধ পুরে আছে৷ এসিডে পা ডুবিয়ে রাখা হয়েছিলো বোঝা যাচ্ছে৷
চারোদিকে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান ছিলো নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে আহসান মীর মুখ খুললেন এবার গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন কমিশনার আশরিফ কে,
” শাহনেওয়াজ এর খবর পাওয়া যায়নি কোনো? কোথায় শাহনেওয়াজ?”
আশরিফ মাথা নিচু করে লাশের দিকে দৃষ্টি রেখে স্বভাব সুলভ কন্ঠে উত্তর দিলেন,
” তার মুঠোফোনটাই শুধু পাওয়া গেছে নবাব তাকে পাওয়া যায়নি৷ শাহনেওয়াজ এখন আমাদের সন্দেহের তালিকায় প্রমাণ বলছে ইকবালের খু’ন সে করেছে৷
খু’ন করে গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও৷”
আহসান মীর প্রশ্ন বোধক চাওনি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন সূচক কন্ঠে বললেন,
“প্রমাণ? কি প্রমাণ? ”
আশরিফ একটা কনস্টেবল এর হাত থেকে ব্যাগ নিলেন অতঃপর ব্যাগ থেকে একটা রিভলবার আর র’ক্তা’ক্ত ছু’ড়ি বের করে আহসান মীর কে দেখিয়ে বলেন,
” এটা শাহনেওয়াজ এর গোপন রিভলবার এটা থেকেই বুকের মাঝে গুলি চলেছে বুলেটের গন্ধ এখনো তীব্র একটা গুলিও এখান থেকে চলেছে৷ আর এই ছু’রিতে শাহনেওয়াজ এর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে৷”
আহসান মীর ভাবুক হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন গভীর ভাবে তার মুখ দেখে বোঝা গেলো না কি ভাবছেন তার দৃষ্টি লা’শের দিকেই৷ শ্রেয়াস ও কিছু বলছে না চুপ করেই আছে৷ তার মুখশ্রী দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না কি চলছে তার মাঝে হয়তো বন্ধুর করা কাজ দেখে পাথর হয়ে আছে৷ শ্রেয়াস এবার নিরবতা থেকে নিজেকে দূর করলেন ছিন্ন করলেন নিরবতা বেশ ধাতস্থ কন্ঠেই উত্তর দিলেন,
” শাহনেওয়াজ যদি ইকবাল কে খু’ন করতো তাহলে কি লা’শের পাশে নিজের মুঠোফোন টা রেখে যেতো? আর এত দিনই বা মুঠোফোন বন্ধ ছিলো কেন? আজ হঠাৎ খোলা পাওয়া গেলো কেন?”
কমিশনার আশরিফ ভাবলো কিছুক্ষণ অতঃপর ফের বললো,
“ছোট নবাব, প্রমাণ এখন সব শাহনেওয়াজ কে ইশারা করছে এসব কি হেলায় ফেলা যায়? তদন্ত আরম্ভ হয়েছে দেখা যাক কি হয়৷ ”
থামলো একটু তারপর আহসান মীরের পানে তাকিয়ে আশরিফ বলেন,
“নবাব আপনি অনুমতি দিলে লা’শটা নিয়ে যাবো আমরা৷ বেশিক্ষণ থাকলে গন্ধ বেরিয়ে যাবে৷”
আহসান মীর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন অতঃপর ইকবালের নিথর দেহটা ল্যাবের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হলো৷
আহসান মীর সে দিকে দৃষ্টি দিয়ে ছেলেকে বললেন,
“রাজ্য যেন রহস্যপুরী তে পরিনত হচ্ছেন৷ ”
শ্রেয়াস প্রশ্ন সূচক চাওনি দিয়ে বাবার পানে তাকালেন আহমদ মীর ছেলের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে বললেন,
” প্রথমত রাফসানের মৃ’ত্যু, তারপর রাজকন্যা মিফতা তার টা না হয় কাকতালীয় ভাবেই ছেড়ে দিলাম৷ এরপর শাহনেওয়াজ এর নিরুদ্দেশ হওয়া শাহনেওয়াজ কে খুঁজতে গিয়ে কনস্টেবল ইকবালের লা’শ পাওয়া সব যেন ঘোলাটে হচ্ছে৷ আমি থাকতে আমার রাজ্যে দূর্নীতি হচ্ছে একের পর এক অথচ ঘুনাক্ষরে টের পাচ্ছি না এর কারণ ও বুঝতে পারছি না৷
তবে কি আমি ব্যার্থ শাসক?”
শ্রেয়াস এবার মুখ খুললো বললো,
“আব্বু জান আপনি অকারণে নিজেকে দোষী ভাবছেন৷ ঠি ক হয়ে যাবে সব দেখছি আমি৷”
বলেই শ্রেয়াস স্থান ত্যাগ করেন৷

১২
শুভ্র সাদা কাপড়ের আবৃত করে পট্টি বেধে রাখা হয়েছে চন্দ্রিকার শিরে৷ পরনে ঘিয়ে রঙের ওরনাটা লাল র’ক্তে মাখো মাখো৷ পাশেই ডঃফারহান বসে আছে হাতে তার প্রাথমিক চিকিৎসার বক্সটা৷ ডঃফারহান সম্পর্কে চন্দ্রিকার চাচাতো ভাই হয় এ বাড়িতেই তার বসবাস৷ আহসান মীরই ফারহান কে ডাক্তারি পরিয়েছে৷

হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথম বারের মত দু’তলা বাড়িটিতে প্রবেশ করলো শ্রেয়াস৷ তখন চন্দ্রিকার মা রসুই ঘরে চুলা বন্ধ করতে ব্যাস্ত ছিলেন৷ মেয়ে সিরি থেকে পা পিছলে পরার পর উনুনে তরকারি রেখেই সেখানে ছুটেছিলেন এখন এসে দেখেন তরকারিটা পুরতে পুরতে বেচেছে৷
রসুই ঘর থেকে বাড়ির প্রবেশ পথ স্পষ্ট দেখা যায়৷ ছোট নবাব কে দেখে চমকে উঠলেন সে৷ প্রথম বার ছোট নবাব বাড়িতে এলেন৷ সে কি ঠিক দেখছে নাকি ভুল বুঝতে পারছে না৷
উনুন নিভিয়ে শাড়ির আচল ঠিক করে রসুই ঘর ছেরে হন্তদন্ত হয়ে বেরোলেন৷ হ্যাঁ ঠিকই দেখছেন৷ ছোট নবাব এসেছেন৷
চকচক করে উঠলো চোখ সাথে সাথেই বড় জা কে ডেকে উঠলেন আনন্দিত হয়ে,
” ভাবি ছোট নবাবের পদ ধুলি পরেছে আমাদের নিবাসে দেখে যাও৷ ”
মারজিয়া বেগম শুনলো না ঠিক মতো তবে ডাক শুনেছে উনি৷ নিজের ঘর থেকে পান চিবতে চিবতে বের হলেন হাতের তর্জনী থেকে চুন মুখে পুরে প্রশ্ন ছুড়লেন চন্দ্রিকার মার পানে,
” চিল্লাস কেন? ডাকাইত পরছে নাকি বাড়িতে?”
চন্দ্রিকার মা ফের উৎকন্ঠিত হয়ে বলেন,
“ভাবি ডাকাত পরে নাই৷ ছোট নবাবের পদ ধুলি পরেছে৷”
মারজিয়া বেগমের চোখ পরলো এখন সে কিছু বলবে এর আগেই শ্রেয়াস বলে,
“ব্যাস্ত হবেন না৷ চন্দ্রিকা কোথায়? তার উচ্চ কন্ঠ শুনলাম কিছুক্ষণ আগে কি হয়েছে?”
মারজিয়া বেগমের পছন্দ হলো না শ্রেয়াসের কথা খানা সে মুখ পানসে রেখেই উত্তর দিলেন,
“ওই মাইয়ার কথা বলবেন না আর জনাব, ধিংগি মাইয়া সারা বেলা লাফায়৷ এমন দুরন্ত মাইয়া আমি জন্মেও দেখি নাই৷ নিজের দোষেই নিজে সিড়ি থেইকা পরছে৷ পইরাও মাইয়ার তেজ কমে নাই৷ ”
মহিলার ভাব ভঙ্গিমা শ্রেয়াসের পছন্দ হলো না৷ মহিলা একটু বেশি কথা বলে মনে হলো শ্রেয়াসের৷
শ্রেয়াস চন্দ্রিকার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“নিয়ে চলুন আমায় তার কক্ষে৷ ”
চন্দ্রিকার মা যেন আরো খুশি হয়ে গেলো খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে বলে,
“চলুন জনাব দিয়ে যাচ্ছি৷ ”
শ্রেয়াস তাকে অনুসরণ করে পা বাড়ালো৷ বাড়িতে ঢোকার পূর্বে বাড়িটির নাম “সৌহার্দ্য নিবাস” দেখে মন ছুঁয়ে ছিলো তার ভেবেছিলো যাদের বাস গৃহের নাম এতো সুন্দর তাদের পরিবারের সবার আচরণ বোধহয় সৌহার্দ্য পূর্নই হবে কিন্তু এ দেখছে পুরো উল্টো৷ এখানে আন্তরিকতার বড়ই অভাব৷
আচ্ছা এ কারণেই বুঝি অবাদ্ধ মেয়েটি এক রুখে? কিন্তু আজ সে নিজের কাজে নিজেই বিস্মিত মেয়েটির কি হয়েছে না হয়েছে তা দেখতে তো প্রহরী বা দাসী কেও পাঠালে পেয়ে যেতো নিজে কেন এলো?
মেয়েটিকি তবে তাকে নিজের থেকে নিজেকে সরিয়ে দিয়ে সক্ষম হলো? না কি ভাবছে এসব? এ তো আন্তরিকতা থেকেও আসে মেয়েটাকে তো তার পছন্দ না৷
আদৌকি সে মেয়ে কে পছন্দ করে না? তবে কেন বার বার এ নারীতেই দৃষ্টি দেয়৷
না কি ভাবছে সে? এ ভাবাও অন্যায়৷ এ মেয়েকে পছন্দ করা যায় নাকি? মেয়েলি রুপটাই রয়েছে ভাব ভঙ্গি সব কেমন এক রুখে৷ মেয়েটা বড্ড বে-পরোয়া৷
মাঝে মাঝে আবার কেমন খাপ ছাড়া কথা বলে মেয়েটা৷ মেয়েটাকে বুঝে না শ্রেয়াস৷
দু-তলার শেষের কক্ষটা চন্দ্রিকা নামক মেয়েটির৷ শ্রেয়াস সিড়ি দিয়ে উঠার সময় হঠাৎ লক্ষ করলেন সিড়ির চৌকিতে এক কোণে তেল তেলে হয়ে আছে৷ সন্দেহ হলো তার মনে কিছু বললেন না৷
চন্দ্রিকার মা শ্রেয়াস কে চন্দ্রিকার কক্ষ দেখিয়ে ছুটলেন কিছু খাবারের আনতে৷
শ্রেয়াস বিনা অনুমতিতেই প্রবেশ করলেন তখন ফারহান প্রতিষেধক দিচ্ছিলেন খাওয়ার জন্য৷
দরজার সামনে শ্রেয়াস কে নজরে আসসতেই থমকালেন চন্দ্রিকা৷ মাথায় ব্যাথা পেয়ে মাথাটা গেলো নাকি? রাজকুমার শ্রেয়াস এখানে আসবেন কেন ভাবলো দৃষ্টি সরালেন অন্য দিকে ফের তাকালেন এর আগেই শ্রেয়াস বললেন,
“স্বপ্ন নয় ভ্রম ও নয় চন্দ্রিকা আপনি আমাকে সত্যি সত্যি দেখছেন৷”
চন্দ্রিকা আরো অবাক হলো ফারহান এবার পিছনে ফিরলেন৷ শ্রেয়াস কে দেখে সে ও অবাক হলেন৷
শ্রেয়াস এবার প্রবেশ করলো কক্ষে তার আগেই ফারহান বললো,
“আরে রাজ কুমার যে৷ সূর্য আজ কোন দিকে উঠলো যে এতো বড় কান্ড ঘটলো৷ আমার নিবাসে রাজকুমারের আগমন৷ ”
শ্রেয়াস ক্ষানিকটা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো৷ অতঃপর চন্দ্রিকার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়লো,
” ব্যাথা পেলেন কি করে চন্দ্রিকা৷ ”
চন্দ্রিকার আগে ফারহানই উত্তর দিলো,
” চন্দ্রের কথা আর বলবেন না জনাব৷ দেখে শুনে হাটে না সিড়ি থেকে পরে গিয়ে শির খানাই ফাটিয়ে দিয়েছে৷”
শ্রেয়াস কিছু বললো না ফারহান ফের বললেন,
“বসুন জনাব৷ কেউ অসুস্থ হয়েছে কি? আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতেন আজ স্বাস্থ কেন্দ্রে যাইনি৷ কিছু কি প্রয়োজন জনাব?”
কি হলো কে জানে শ্রেয়াসের ফট করে সে দিনের মত আশ্চর্যজনক উত্তর দিলো,
“চন্দ্রিকাকে প্রয়োজন৷ ”
থতমত খেলো দু’জনই৷ ফারহান অবাক নয়নে তাকালো শ্রেয়াসের পানে চন্দ্রিকা নামক এক রুখে মেয়েটা যেন লজ্জায় আড়ষ্ট হলো৷
পছন্দ হলো মেয়েটা এহেন মুখশ্রী আজ আর কিছু পাত্তা দিলেন না৷ ফের এক আশ্চর্য কান্ড করে বসলো সে পাশে দেওয়া কেদারায় না বসে চন্দ্রিকার পাশেই বসলেন তখনই ফারহানের মুঠোফোন বেজে উঠে খেয়াল করেনি সে ফোন তুলে বেরিয়ে গেলেন তার জরুরি রুগী এসে পরেছে৷
এক রুখে মেয়েটি মেঝেতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“বাহ আজ চন্দ্রের খোঁজে রাজ কুমার চন্দ্রের গৃহে? এ কারণ কি জনাব?”
শ্রেয়াস উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দায় যেতে যেতে বলেন,
“মেয়ে আপনি বড্ড বাচাল৷ ”

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here