বাসর নিয়ে মেয়েদের মনে স্বভাবতই অনেক কৌতুহল, আবেগ, অনেক স্বপ্ন থাকে। এই একটি রাত একটি মেয়ের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। আজ বিকেল পর্যন্তও আমার এই রাত নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু কয়েকঘন্টার ব্যবধানে সব শেষ।
.
পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হয়েছিল আমার। পাত্রকে মাত্র একবার দেখেছি। আর একবার ফোনে কথা হয়েছিল। সে দেখা করতে চেয়েছিল আমার সাথে। আমি রাজি হইনি। সে জিজ্ঞেস করেছিল আমার কোনো ভালো লাগা আছে কি-না, আমি এ বিয়েতে রাজি কি-না। হ্যাঁ, আমি রাজি ছিলাম। আমার বাবা-মা যাকে আমার জন্য পছন্দ করেছেন সে নিশ্চয়ই ভালো হবে। নিজের বাবা-মায়ের উপর সেই বিশ্বাসটুকু আছে আমার। আর যদি কোন ত্রুটির কথা বলি তবে সামান্য ত্রুটি সব মানুষেরই থাকে। তার মধ্যেও আছে, আমার মধ্যেও আছে। এগুলো মেনে নিতে হয় জীবনে। সে আমাকে বলেছিল আমার কোন চাওয়া সে অপূর্ণ রাখবে না। তার সাধ্যের মধ্যে পূরণ করবে। হবু বরকে কেউ ভালোবাসে কি-না জানি না। তবে তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম।
কিন্তু ভাগ্য… সে কেন এতটা নিষ্ঠুর হয়? কি এমন অন্যায় করেছিলাম যার শাস্তি এভাবে পেতে হলো?
.
আমার বর্তমান বর….. বর্তমান বলার কারণ যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার সাথে বিয়েটা হয়নি। হয়নি তা নয়, হতে দেওয়া হয়নি। নেহাল নামের এই ছেলেটা আমাকে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনেছে। জোর করে বিয়ে করেছে। যখন আমি কবুল বলছিলাম না তখন আমার বাবা-মায়ের ক্ষতি করার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে বিয়ে করি।
.
রাত ১১টায় ঘরে আসলো নেহাল। ওকে আসতে দেখেই ভেতরের রাগ আর ঘৃণা আরও তীব্র হয়ে গেল। কারণ এই মুহুর্তে ও আমার সাথে যা-ই করুক না কেন ওকে বাঁধা দেওয়ার সাধ্য আমার বা অন্য কারও নেই। যে জোর করে বিয়ে করতে পারে সে জোর করে সব কিছুই করতে পারে।
নেহাল বলতে শুরু করলো,
– আমি জানি তুমি খুব রেগে আছো। কিন্তু এসবের জন্য তুমি-ই দায়ী।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম।
– ওভাবে তাকিও না। তুমি মানো আর না মানো, এসবের জন্য তুমি-ই দায়ী। তুমি জানো আমি তোমাকে কত বেশি ভালোবাসি। আর তুমি কিনা অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলে!
– তাহলে কি আপনার মতো একটা গুন্ডাকে বিয়ে করতাম?
– আমি ভালো হয়ে গিয়েছিলাম নিসা। যেদিন তুমি বলেছিলে একটা গুন্ডাকে তুমি ভালোবাসতে পারবে না সেদিনই আমি ভালো হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আবার আমাকে পুরোনো রূপে ফিরে আসতে বাধ্য করলে তুমি।
– আমি এটাও বলেছিলাম যে আপনি বা অন্য কারো সাথে আমি কোনো সম্পর্কে জড়াবো না। আমার বাবা-মা যেটা বলবেন আমি সেটাই করব।
– আমি তো তোমার বাবা-মাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। তাদের অনেক অনুরোধ করেছি তোমার বিয়ে অন্য কোথাও না দিতে।
– কোন বাবা তার মেয়েকে একটা গুন্ডার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে?
– আমি তো ভালো হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে পাবার জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়েছিলাম।
– যে ছোটোবেলা থেকে মারামারি, গুন্ডামি করে বড় হয়েছে সে হঠাৎ করে ভালো হলেও সবার মনে সন্দেহ থাকে। কেউ তাকে বিশ্বাস করে না।
– কেউ বিশ্বাস না করলে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু তুমি তো জানো আমি তোমার জন্য সব করতে পারি, সব করেছিও।
– আমার বিশ্বাসে কিছু যায় আসে না। আমি কখনো আমার বাবার উপরে কথা বলি নি। হ্যাঁ, বাবা যদি আপনার সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাইতেন আমি বাঁধা দিতাম না। কারণ আমার বাবা আমার ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত ভেবে চিন্তে নেন। যেহেতু বাবা আপনাকে মেনে নেন নি অবশ্যই এখানেও তিনি আমার ভালোটাই ভেবেছিলেন। আর আপনি কিনা…..
– আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবোনা নিসা। তাই আমাকে আজ আবার এই রূপে ফিরে আসতে হলো।
– আমাকে ছাড়া না বাঁচলে মরেই যেতেন। তবুও তো আমার জীবনটা এমন হতো না আজ। কেন করলেন এসব?
অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো নেহাল। ও হয়তো আশা করেনি আমি এটা বলবো।
– এভাবে বলো না নিসা। মৃত্যু এত সহজ নয়। যদি সহজ হতো তাহলে সেদিনই মরে যেতাম যেদিন……
– যেদিন?
– কিছুনা, বাদ দাও। তুমি ঘুমাও, অনেক রাত হয়েছে।
– বাহ। এত নরমালি বলছেন যেন কিছুই হয়নি। আমি চাইলেই ঘুম চলে আসবে।
– জানি আসবে না। তবুও চেষ্টা করো। এখন থেকে তোমাকে এখানেই থাকতে হবে।
– যদি না থাকি? কতদিন আটকে রাখবেন?
– তোমাকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। সব সময় আগলে রাখবো।
– সময় বলে দেবে। আপনি এখন আমার চোখের সামনে থেকে যান।
– হ্যাঁ যাচ্ছি। এখানে তোমার খাবার আছে। খেয়ে ঘুমাও।
এই বলে নেহাল পাশের রুমে চলে গেলো। আমি বসে আছি ফুলে সাজানো খাটে। আমি কি খাওয়ার অবস্থায় আছি? চোখের সামনে ভাসছে সব।
.
আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণীতে। বাবা ট্রান্সফার হয়ে এখানে আসলেন। সেই সাথে আমি আর মা-ও। বাবার একমাত্র মেয়ে আমি। ছোটোবেলা থেকে বাবা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আর আমিও বাবাকে খুব বেশি ভালোবাসি। আমাদের ভালোবাসা দেখে মা খুব হিংসে করেন।
– তোমাদের বাবা-মেয়ের ঢং দেখলে আমি বাঁচি না। মনে হয় এ বাড়িতে আমি শুধু রান্না করতেই আছি। আমাকে কেউ পাত্তাই দেয় না।
– ভুল বললে মা। বাবাও মাঝে মাঝে রান্না করেন।
– হয়েছে হয়েছে। বাবার চামচা। তুই নিজে কি করিস শুনি?
– খবরদার আমার মেয়েকে কিছু বলবে না। ও শুধু খাবে আর পড়বে(বাবা)।
– হ্যাঁ হ্যাঁ, মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে না।
– বিয়ের সময় আমি ওকে সব শিখিয়ে দেবো।
এই হলো আমাদের তিনজনের সংসার। বাবার কারণে এখানে চলে আসা। আমার কলেজ ভর্তি অন্য জায়গায়। এখানে শুধু প্রাইভেট পড়ি। পরীক্ষার সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবো।
.
প্রতিদিন প্রাইভেটে যাওয়ার সময় একটা ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমে কয়েকদিন দেখে ভেবেছি অন্য কোনো কারণ হবে হয়ত। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম সে আমার জন্যই দাঁড়িয়ে থাকে। বান্ধবীকে কথাটা বললাম।
– এই শিমু জানিস, একটা ছেলে প্রতিদিন আমি আসার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে।
– তাই না-কি? তোর দিওয়ানা পেয়ে গেছিস।
– চুপ কর এমন কিছুই না। আমি বাবা-মা কে কষ্ট দিব না কখনও।
– সে বুঝলাম। কিন্তু ছেলেটাকে তো একবার দেখতে হচ্ছে।
– কাল তুই প্রাইভেটে আসার সময় আমার বাসায় যাস। দুজন একসাথে আসব। তখন তোকে দেখাব।
পরেরদিন কথামত শিমু আমাদের বাসায় গেলো। আসার সময় সেদিনও ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি শিমুকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই শিমু ছেলেটিকে দেখে আমাকে আস্তে করে বললো,
– তাড়াতাড়ি চল।
– কেন?
– আহা চল না বলছি।
আমরা দ্রুত হেঁটে চলে গেলাম। মনে হলো শিমু একটু ভয় পেয়েছে। ওখান থেকে চলে আসার পর আমি বললাম,
– তুই এভাবে চলে আসলি কেন?
– ওই ছেলেটাই কি সেই ছেলেটা যার কথা বলেছিলি?
– হ্যাঁ।
– সর্বনাশ!
– কেন, কি হয়েছে?
– ও তো একটা গুন্ডা।
– বলিস কি?
– হ্যাঁ। সব সময় মারামারি গন্ডগোল করে। ওকে সবাই ভয় পায়। একদম ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি না।
– ধুর! কি যে বলিস। ও কোন ভালোমানুষ হলেও আমি কথা বলবো না সেটা তো তোকে বলেছি।
সেদিনের মত বাসায় চলে গেলাম।
চলবে……
গল্পঃ অবশেষে তুমি
পর্ব – ১
কলমেঃ Asma Aktar Urmi