গল্পঃ অবশেষে তুমি পর্ব – ২

গল্পঃ অবশেষে তুমি
পর্ব – ২
কলমেঃ Asma Aktar Urmi

এরপরও সবসময় যখনই বাইরে যেতাম ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনো আমাকে কিছু বলতো না। এমনকি পিছুও নিতো না। শুধু তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে ভাবতাম ছেলেটা তো খারাপ তাহলে ওর তো আমাকে বিরক্ত করার কথা কিন্তু ও তো সেটা করে না। তবে কি শিমু আমাকে মিথ্যা বলেছে?
একদিন মায়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছি। ফেরার সময় দেখলাম রাস্তায় গন্ডগোল হচ্ছে। আমাদের রিক্সা ওখানে যেতেই একটা ছেলে রিক্সা থামালো।

– এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। অন্য রাস্তা দিয়ে যান।

– এটা তো সরকারি রাস্তা। তাহলে তুমি বলার কে?(মা)

– আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? দেখছেন না একজনকে শায়েস্তা করা হচ্ছে?

– রাস্তায় দাঁড়িয়ে গুন্ডামি করছো আবার বড়ো বড়ো কথাও বলছো? আচ্ছা বেয়াদব ছেলে তো তুমি!

– কি?(পিস্তল বের করল ছেলেটা)

আমি আর মা খুব ভয় পেলাম। যেখানে মারপিট হচ্ছে সেখান থেকে একজন বেরিয়ে এলো।

– কি হইছে রে ছোটু?

– দেখেন না ভাই। ভদ্রভাবে অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে বললাম উল্টা ফালতু কথা বলতেছে।

– গুন্ডাকে গুন্ডা বলবো না তো আর কি বলবো?(মা)

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই সেই ছেলেটা যে রাস্তায় আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। শিমু সত্যি বলেছিল। ছেলেটা সত্যি একটা মাস্তান। ছেলেটাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর মাথা নিচু করে বললো,

– ছোটু রাস্তা ফাঁকা কর ওনাদের যেতে দে।

– কিন্তু ভাই…

– যা বললাম কর।

৫ মিনিটে রাস্তা ফাঁকা করে দিলো। আমাদের রিক্সা চলে এলো। আমি আড়চোখে দেখলাম ছেলেটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
বাসায় এসে ভাবতে লাগলাম কি করবো। বাবাকে কি জানাবো যে আমার জন্য ছেলেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে? আমাকে তো ডিস্টার্ব করে না। তাহলে? বাবা শুধু শুধু চিন্তা করবেন। কোনো সমস্যা হলে তখন বলবো।

আমার এইচএসসি পরীক্ষার ডেট এসে গেল। যে কলেজে ভর্তি ছিলাম সেখানে গিয়ে একমাস থেকে পরীক্ষা দিলাম। খালা বাড়ি পাশেই ছিলো। ওই একমাস খালার কাছে ছিলাম। পরীক্ষা শেষে ফিরে এলাম। ততদিনে ছেলেটার কথা আমি পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি। একদিন আমি বিকেলে ছাদে উঠেছি। কোথা থেকে হঠাৎ ছেলেটা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি দেখে চিৎকার করতে যাবো তখনই আমার মুখ চেপে ধরলো।

– চিৎকার করো না প্লিজ।

– আপনি এখানে কিভাবে এলেন?

– পাইপ বেয়ে।

– মানে? পাইপ বেয়ে এখানে আসলেন কেন আপনি?

– তোমার সাথে কথা বলার আর কোনো উপায় ছিলো না তাই।

– দেখুন আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না।

– বেশি কিছু বলতে হবে না। শুধু এটা বলো এই একমাস তুমি কোথায় ছিলে?

– যেখানেই থাকি আপনাকে কেন বলবো?

– প্লিজ বলো, আমার জানতে হবে।

– পরীক্ষা ছিল তাই খালার বাসায় ছিলাম।

– বাঁচলাম!

– কেন?

– আমি ভেবেছিলাম তোমার বিয়ে….

– কি?

– না, কিছু না।

– আপনি এখন যান। আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাই না। আর কখনো এভাবে চোরের মত পাইপ বেয়ে ছাদে আসবেন না।

– শোনো নিসা….

– আপনি আমার নাম জানেন কিভাবে?

– হাহাহা সামান্য নাম জানাটা নেহালের জন্য পিপঁড়ের সমান কাজ।

– তা যা বলেছেন। যে রাস্তায় রাস্তায় মারপিট করে তার পক্ষে শুধু আমার নাম কেন, আমার চোদ্দ গুষ্টির নাম জানাও পিপঁড়ের মতোই হবে।

– এভাবে বলো না নিসা।

– আমি যাচ্ছি।

– প্লিজ শোনো।

– বলুন।

– আমি তোমাকে ভালোবাসি।

– জানি।

– কিভাবে জানো?

– মেয়েরা দূর থেকে কোন ছেলেকে দেখলেই বলে দিতে পারে সে কোন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।

– তাহলে তোমার উত্তরটাও দাও।

– আপনার কেন মনে হলো যে আপনার মতো একটা ছেলেকে আমি ভালোবাসবো? তাছাড়া আপনি ভালো মানুষ হলেও আমি আপনাকে ভালোবাসতাম না।

– কিন্তু কেন?

– আমি আমার বাবা মাকে কষ্ট দিতে চাই না। আমার বিয়ের সিদ্ধান্তটা তাঁরাই নিবেন।

– আমি তাদের রাজি করাতে পারলে তোমার আপত্তি নেই তো?

– তাদের রাজী করান। তারপর দেখবো।

– ধন্যবাদ নিসা। আসি, আবার দেখা হবে।

এই বলে নেহাল পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেল। আমি জানতাম বাবা কখনোই ওর সাথে আমার বিয়ে দেবেন না। যেহেতু ও বলেছে বাবাকে রাজী করাবে তাহলে আমাকে আর ডিস্টার্ব করবে না। নিশ্চিন্ত ছিলাম আমি।

কয়েকদিন পর শিমুদের বাসায় গিয়েছি। ওখান থেকে বাসায় ফিরতেই শুনলাম বাবা চিৎকার করছে। আমি তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি নিয়ে এলাম। বাবাকে পানি খাইয়ে শান্ত করলাম।

– কি হয়েছে বাবা?

– একটা মাস্তান তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বাসায়।
(বুঝতে পারলাম নেহাল এসেছিল)

– তুমি কি বললে বাবা?

– কি বলবো মানে? ওর সাথে তোর বিয়ে দেবো না-কি?

– কখনোই না বাবা। তুমি তো আমার ভালো চাও। কে কোথা থেকে আসলো তার জন্য তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন!

– হবো না? সোনার টুকরো মেয়ে আমার। ওই ছেলেটার সাহস হয় কি করে?

– হয়েছে বাবা। তুমি একটু শান্ত হও।

বাবাকে শান্ত করে রুমে গেলাম। চিন্তায় পড়ে গেছি। ভাবতে পারিনি ছেলেটা এত তাড়াতাড়ি এসব করবে। বাবা খুব রেগে আছেন। আমার ছেলেটার সাথে কথা বলা দরকার। বিকেলে ছাদে গেলাম। মনে মনে চাইছি ছেলেটা সেদিনের মতো আজও ছাদে আসুক। আশেপাশে রাস্তায় তাকালাম। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না ওকে। পেছনে ফিরতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। নেহাল দাঁড়িয়ে।

– আমাকেই খুঁজছিলে বুঝি?

– আপনাকে খুঁজব কেন আমি!

– চোখ দেখলেই বোঝা যায়।

– আপনি বাসায় এসেছিলেন কেন?

– বা..রে সেদিন তুমি তো বললে তোমার বাবা যদি বিয়েতে রাজী হন তাহলে তুমিও রাজী হবে।

– হ্যাঁ বলেছি। তার মানে তো এটা নয় যে আপনি এখনই আমার বাসায় চলে আসবেন। কত কান্ড হয়ে গেছে আপনি জানেন?

– হ্যাঁ জানি। তোমার বাবা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন।

– দেখুন বাবা এখনি আমার বিয়ে দিতে চান না। আমি পড়াশোনা করছি। তার উপর বাবা আপনাকে পছন্দ করেন না। কেন সেটা নিশ্চই জানেন।

– আমি সব ছেড়ে দিয়েছি নিসা বিশ্বাস করো। তুমি আমার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিতে পারো।

– আমার সেটার প্রয়োজন নেই। দেখুন, বাবা যেহেতু আপনাকে পছন্দ করেন নি তাই আপনার আমাকে ভুলে যাওয়া উচিত।

– কি বলছো তুমি? তোমাকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব না।

– সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু আপনি আর আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।

– নিসা শোনো….

– শুনতে পান নি? আপনি চলে যান। এখানে আর আসবেন না।

তারপর আর কখনো নেহাল আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। যখনি বাইরে বের হতাম ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। কিছু বলতো না শুধু দূর থেকে দেখতো। যখন অনেকদিন বাসার বাইরে বের হতাম না ও বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। যতক্ষণ আমাকে না দেখতো এক চুলও নড়তো না। ব্যাপারটা বাবা মায়ের চোখ এড়ালো না। বাবা বুঝতে পারলেন ছেলেটা আমার পিছু ছাড়বে না। আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করলেন। আমি এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। বাবার সাথে সরাসরি কথা বললাম।

– বাবা তুমি কেন এমন করছো?

– কি করছি মা?

– কেন আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়েছো?

– ওই ছেলেটা যে তোর পিছু ছাড়বে না মা।

– একটা গুন্ডাকে ভয় পেয়ে তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দেবে?

– সেকি মা! সব মেয়েকেই একদিন বিয়ে করে বাবার ঘর ছাড়তে হয়।

– বাবা, আমি এখনো পড়ছি।

– হ্যাঁ মা, আমি জানি। তোকে এমন পাত্রের হাতেই তুলে দেবো যে তোকে পড়াবে তোর স্বপ্ন পূরণ করবে। সারাজীবন তো বাবাকে বিশ্বাস করলি। এবার করবি না?

আমি আর কিছু বললাম না। বাবাকে বোঝানো বৃথা। আমাকে বিয়ে দিয়ে যদি বাবা খুশি হন তবে তা-ই হোক।

বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। ছেলে কানাডা থাকে। বিয়ের পর আমাকেও সেখানে নিয়ে যাবে। বাবার ছেলেপক্ষের সাথে একটাই কথা হলো। আমি যতদূর পড়তে চাইবো কেউ বাঁধা দিবে না। ছেলের পরিবারেরও সবাই রাজি। তারাও চায় তাদের পুত্রবধূ উচ্চশিক্ষিত হোক।

সেদিন কেনাকাটা করে বাসায় ফিরছিলাম। রাস্তায় নেহাল পথ আগলে দাঁড়ালো।

– তোমার সাথে কথা ছিল।

– আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই। পথ ছাড়ুন।

– তুমি আমাকে কথা বলতে মানা করেছো। আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করি না। তুমি যা চেয়েছিলে তাই করেছি। আর তুমি কি-না অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে?

– মানে কি? আমি কি আপনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো না? আমি তো আপনাকে বলেই দিয়েছি আপনি আমাকে ভুলে যান।

– নিসা, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।

– আমার বাবা মা আপনাকে পছন্দ করে না। তাই এসব আমার সাথে বলে লাভ নেই।

– প্লিজ নিসা। চলো আমরা পালিয়ে যাই।

– কি? পাগল হয়েছেন?

– হ্যাঁ নিসা। তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শোনার পর থেকে আমি পাগল হয়ে গেছি। চলো না আমরা পালিয়ে যাই। আমি তোমাকে খুব সুখে রাখবো। কোনকিছুর অভাব হবে না তোমার। (বলেই নেহাল আমার হাত ধরলো?

– আরে কি করছেন, হাত ছাড়ুন।

– তুমি যতক্ষণ রাজি না হবে হাত ছাড়বো না।

অনেকক্ষণ ধরে ও আমার হাত ছাড়ছিল না। অবশেষে জোরে একটা থাপ্পড় দিলাম ওর গালে। ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আমি সেদিকে খেয়াল না করে সোজা বাসায় চলে আসলাম। সেদিন থেকে ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। বাসার সামনে নেহাল এসে রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো। বাবা মা-ও এসব দেখতেন। আমাকে বলতেন বিয়েটা হয়ে গেলেই সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে।

আজ বিয়ে। হবু বর বারবার মেসেজ দিচ্ছে। আমি বউ সেজেছি কি-না, সকাল থেকে খেয়েছি কি-না, এখন কি করছি আরো অনেক কিছু। ছেলেটা একটা পাগল বলা যায়। সবাই বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত আর সে আমাকে নিয়ে। সর্বশেষ এসএমএস দিয়ে বলল আমার একটা ছবি দিতে। আমি বললাম কিছুক্ষণ পর সরাসরি দেখবেন। সে হাসির ইমোজি দিলো।

তার সাথে চ্যাটিং করতে করতেই শুনতে পেলাম বাইরে গন্ডগোল হচ্ছে। প্রথমে যাইনি। বিয়ে বাড়িতে অমন একটু ঝগড়া হয়। কিন্তু যখন ঘটনা গুরুতর মনে হলো আমি বের হলাম।
বাইরে গিয়ে দেখি নেহাল বাবার সামনে হাতজোড় করে কাকুতিমিনতি করছে আমার বিয়ের না দেওয়ার জন্য। আর আমাদের আত্মীয়রা সবাই ওকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে রাগে বাবা ওকে চড় মারলেন।

– তুমি ভাবলে কিভাবে তোমার মতো একটা বাউন্ডুলে মাস্তানের সাথে আমি মেয়ের বিয়ে দেবো?

– আঙ্কেল আমি ওসব ছেড়ে দিয়ে বলেছি তো।

– অমন সবাই বলে। সময় হলে আসল রূপ বেরিয়ে আসে।

– আমি কি করলে আপনি বিশ্বাস করবেন যে আমি নিসাকে কতটা ভালোবাসি? আমি তাই করবো। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ও আমার কাছে সুখে থাকবে।

– দেখো ছেলে, আমার মেয়ের সুখের কথা ভেবেই এত ভালো ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছি। যথেষ্ট ঝামেলা করেছো। এখন বিদায় হও।

আমাকে দেখতে পেয়ে নেহাল দৌড়ে এলো।

– নিসা, তুমি তো কিছু বলো। প্লিজ তুমি বিয়ে করো না।

– আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি বাবা যা বলবেন আমি তাই করবো। হাতজোড় করছি আপনি চলে যান।

– শুনলে তো আমার মেয়ে কি বললো? এবারও যদি তুমি না যাও আমি পুলিশ ডাকবো(বাবা)।

নেহাল খুব রেগে আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেল।

চলবে……
গল্পের রচনাকালঃ ১০/০৬/২০১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here