গল্পটা আমাদের আপনিতেই আমরা পর্ব-৬

📚গল্পটা আমাদের
আপনিতেই আমরা
পর্ব-৬
#লেখনীতে-মারজানা দীনা

চরিত্রহীনননন!!!

হু….

একআনা!!!
উনার এই আদুরে ডাকটাকে অগ্রাহ্য করার সাহস ছিলো না আমার।তার দৃষ্টিতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।তার দৃষ্টি ছিলো বড় অসহায় কি জানি কেনো অনুমান করতে পারছিলাম না।আমার জন্য না কি আমার জন্যেই…. একটু ভারী হয়ে গেলো না!! আমার জন্য মানে আমার চোখে জলকণা দেখে নাকি আমার জন্যেই মানে এই আমাকে আপন করে নিয়ে।তবে আমার সমস্ত ভাবনাগুলোকে মিশিয়ে দিয়ে কাছে টেনে বলেছিলেন_

থাক আর বলতে হবে না।যেই স্মৃতি আপনার অক্ষি হতে অশ্রু ঝরায় তা স্মরণ করা অনর্থক।

কিন্তু আমি তার না শুনিনি। বলেছিলাম পুরোটাই।কিন্তু পরে ভীষণ খারাপ লাগলো কারণ তার মাথা যে আমার সামনে নিচু হয়ে গেলো।আমি তাকে বহুবার বহুভাবে বোঝায় যে এতে আপনার কোনো ভূমিকা ছিলো না।তবে সে অবুঝের মতই আচরণ করে।হয়ত সে বোঝতেই পারে নি ঘটনাটা এভাবে ঘুরে গিয়ে তার বিন্দুতেই স্থান নিবে।তবে তার প্রতি আমার কখনোই কোনো অভিযোগ অভিমান ছিলো না।কারণ আমরা সবাই পরিস্থিতির শিকার। বলে না টাইম হিলস এভিরিথিং। তাই মানিয়ে নিয়েছি।তবে একটা কথা থেকেই যায় সপ্তম শ্রেণীতে পড়া ১২ বছর বয়সী কিশোর জীবনের ছোট্ট একটি ঘটনার রেশ যে আজও আমার সাথে জড়িয়ে থাকবে ভিন্ন মোড়কে সেটাই অকল্পনীয়।

দুইআনা..

হু…
জানেন সেদিন বাড়ীর প্রতিটা সদস্যদের সামনে আমাকে চরিত্রহীনার অপবাদ দেয়া হয়েছিলো।প্রতিটা মানুষের পাহাড় সমান কটুক্তি মাথা পেতে নিতে হয়েছিলো।আচ্ছা আমার অগোচরেই কোনো এক ছেলে যদি আমাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করে, কোনোএকদিন হুট করেই গলির মোড়ে ফুল সমেত প্রেম নিবেদন করে সেটাও কি আমার অপরাধ!!কই আমিতো সম্মতিসূচক কোনো আচরণ করিনি।বরং খুব দৃঢ়তার সাথেই এড়িয়ে এসেছি।
তারপরও আমাকেই কেনো ভুক্তভোগী হতে হবে?

কি-কি-হয়েছিলো তিল?

সেদিন_

আমি কিছুতেই এই মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না।ওর মতো অশ্লীল মেয়েকে তো ভুলেও না (পাত্র)

কি বলছো তুমি এসব? আমার মেয়ে মোটেও অশালীন বা অশ্লীল নয়।কি প্রমাণ আছে যে…(বাবা)

প্রমাণ তাই না প্রমাণ হলো আপনার মেয়ে নিজে। আপনার মেয়েকেই প্রশ্ন করুন না স্কুলে থাকতে কোনো ছেলের সাথে ওর সম্পর্ক ছিলো কি না? আমার ভাবতেই অবাক লাগে ক্লাস সেভেনে পড়া বাচ্চা একটা মেয়ে কিনা তার চেয়ে ছোট ক্লাসের ছেলের সাথে হাতধরাধরি করে সময় কাটাতো।বিশ্বাস না হলে স্কুল থেকে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।এই মেয়েটা কতটা বেহায়া!!স্কুলের টিফিন পিরিয়ডের পুরোটা সময় দিয়েও তাদের হতো না যে স্কুল ছুটির পর মাঠে বসে ঘণ্টার পর সময় কাটাতো।প্রথমে তো আমি ভাই বোন বা কাজিন ভেবেছিলাম।কিন্তু একদিন বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে দেখলাম তারা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে প্রণয় মুহূর্ত উপভোগ করছেন।ছি ছি ছি
কতটা অশালীন ভাবতে পারেন আপনি? তখন তো বাচ্চা ছিলো কিন্তু এখন তো প্রাপ্ত বয়সের অধিকারী কে জানে কতজন বয়ফ্রেন্ডের সাথে কতবার ডেট করেছে?? আর আপনি বলছেন এই মেয়েকে বিয়ে করতে? যেই বয়সে মেয়েরা খেলা করে সে বয়সেই এই মেয়ে ছিহ্…
এমন নানা কটুক্তি করে আমিসহ পুরো পরিবারকে অপমান করে বেড়িয়ে গিয়েছিলো তারা।তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলার কোনো শব্দই পাচ্ছিলাম না আমি।আর না শুনতে রাজি ছিলো তারা।বলতামই বা কি আমি নিজেই তো সব ভুলে বসে ছিলাম।জানতাম নাতো সেই ছোট্ট ঘটনা এতবছর পর আবার সামনে এসে দাঁড়াবে।
যেই আমি এতদিন ভালোবাসা নে পেলোও কোনো প্রকার অবহেলার শিকার হয়নি সেই আমি প্রহারের সাথে পরিচিত হলাম।আমার পরিবারও আমার কথা শুনতে রাজি ছিলো না।আর দাদী তো আরো বেশি ক্ষেপে গেলেন।
ঐ দিনের পর ঘরবন্দী হতে হয়েছিলো আমায়।ভার্সিটি যাওয়া নিষিদ্ধ। প্রতিবেশীদের সমালোচনায় আরো বেশি প্রতিকূল হয়ে গেলো পরিস্থিতি। বিয়ের সমন্ধ এলে তাও টিকতো না।ভেঙে যাওয়া তাদের নানান কথা শোনা সব মিলিয়ে আরো বেশি ছড়িয়ে পরলো আমার অশ্লীলতার গল্প।আচ্ছা সত্যিই কি আমি অশ্লীল? জবাব পেতাম না প্রশ্নের।যখন দেখলো কেউই বিয়ে করতে রাজি না তখন সবাই হাল ছেড়ে দিলো।দাদী বলতেন আগেই বলেছিলাম মেয়েকে বিয়ে দিতে শুনলো না এখন ভোগ কর এসব।বাবাও আমার পক্ষে কিছু বলতে পারতেন না।আবার ছুঁড়ে ফেলেও দিতে পারতেন না একমাত্র সন্তান কি না।প্রহারের মাধ্যমেই নিজের রাগ চাপা কষ্ট ঝারতেন।তাও চুপ থাকতাম।তারা হয়ত আমার নিরবতাকেও সম্মতি মনে করত কিন্তু তারা আমাকে বোঝার চেষ্টাও করত না।আমি তো কিছু বুঝে উঠার আগেই সব হয়ে গেলো বলতামই বা কি।চুপই থাকতাম।কিছুটা সময় পর অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়েছিলাম পড়ালেখার জন্য।পা ধরে কেঁদেছি পর্যন্ত একটা সুযোগের জন্য।পেলামও সুযোগ।হয়ত ভেবেছিলো ঘরে বসে রেখে কি হবে বিয়ে তো হচ্ছে না এখন নাহয় একটু পড়ালেখাটাই করুক।
প্রথম প্রথম ঘর থেকে বের হতেই পারতাম না।এক সময় যেসব চাচীরা প্রতিবেশীরা আমার প্রতি পরিবারের উদাসীনতা দেখে মায়া করতেন ভালোমন্দ কথা বলতেন সহানুভূতি দেখাতেন তারাই যেনো আরো বেশি বর্বর হয়ে উঠলেন।অনেক কথা শ্রবণ করতে হয়েছে।প্রতিবাদ করার জোড় ছিলো না।কারণ আমি জানতাম এসবের মধ্য দিয়েই পুরো জীবনটা পারি দিতে হবে।কিছু সময় যাওয়ার পর কিছুটা ঠিক হলেও ঘটলো আরেকটা ঘটনা।আমাদের এলাকায় নতুন আসা এক বড় ভাইয়ের নজরে পড়লাম।খারাপ কিছু না ঘটলেও বাড়িতে আমার জন্য জাহান্নাম সৃষ্টি হয়েছিলো।
ভাইয়াটা একদিন রাস্তাতেই আমার সামনে ফুল নিয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলেন তখনও আমি নিরব।কারণ তাকে আমি চিনতামই না।অথচ তার দোষও আমার।বাবা আর বড় চাচা দেখে ফেললেন।টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।শুধু তারা কেনো মায়ের হাতের মারও কপালে জুটেছিলো।বুঝতেই পারলাম না আমার অপরাধটা কি।
ভীষণ যন্ত্রণা নিয়েই দিন পার করতাম।আগে তাও ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে কেউ না কেউ আসতো সেদিনের পর কেউ দেখতেও আসতো না বেঁচে আছি কি না।
বরাবরের মত চুপই থাকতাম।তবে অনার্সটা শেষ করতে পেরেছিলাম সেটা আমার জন্য সৌভাগ্য। তবে এর জন্য কম সহ্য করতে হয় নি।বিধবা না, ডিভোর্সি না প্রেম বিষয়ক কোনো ঘটনা না, ছোট্টবেলার সেই ছোট্ট একটা স্মৃতির জোড়ে হয়ে গেলাম চরিত্রহীনা।আসলে কি বলেন তো কনজারভেটিভ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে এসবই আকাশ সমান।আর সমাজের কথা নাই বা বললাম।
আমার এতসব কথার মাঝে বুঝতেই পারলাম না মানুষটা কখন যে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আমার উদরে মুখ লুকিয়েছেন।

তিইইইল(কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে)

হু…

স্কুলের সেই ছেলেটা আমি তাই না। আমার অগোচরে আমার জন্যেই আপনাকে এতসব সহ্য করতে হয়েছে যার আচঁটুকুও পেলাম না।আগে জানলে কখনোই আপনার সাথে সেদিন_

সেদিন আপনার আমার শেষদেখা হওয়ার দিনছিলো দুআনা।প্রায় পুরোটা বছর আপনার সাথে কাটিয়েছিলাম।উহু কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা না,সহপাঠী হিসেবে না,বন্ধু হিসেবেও না বেনামী একটা কিছু।সেদিন স্কুল ছুটির পর আপনাকে বলেছিলাম আমাকে অন্যস্কুলে যেতে হবে এতে আপনার খুব খারাপ লেগেছিলো।

হু…মা কে হারিয়ে এতগুলোদিন পর সেদিনই প্রথম কেঁদেছিলাম। জানি না কেনো তবে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছিলো। আপনিই ছিলেন যার সাথে আমি কিছুটা কথা বলতাম যার কারণে স্বাভাবিক হতে পেরেছিলাম।তাই সেদিন আপনি যখন আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন সময়ের সাথে সবঠিক হয়ে যাবে তখন আমিই আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।উচ্চতায় আপনি ছোট ছিলেন তাই হয়ত ছাড়াতে পারেননি। সেটাই কাল হয়ে গিয়েছে তাই না একআনা…
হু…(অস্ফুটস্বরে বলেই ফুঁপিয়ে উঠেছিলাম।ইতোমধ্যে মানুষটার উষ্ণ জলকণারও আভাস পেলাম উদরে। বলার মত কিছু জানা ছিলো না আমার)

#চলবে
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here