ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১১

0
222

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১১
_______🖌️ নাজনীন নাহার
২৪.০৩.২০২২

আমার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর। আমি জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে সদ্য বিবাহিত আমার স্বামীকে চিঠি লিখছি।

আমার প্রিয় রাশেদ,
তোমাকে কতদিন দেখি না। আজকে আমার খুব জ্বর এসেছে। মনে হচ্ছে আমি হয়তো মারা যাব। তুমি কী একবার আসতে পারবে! আমি তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে চাই।
আজ দুইদিন হলো আমি আব্বার সাথে আমাদের বাড়ি এসেছি। এখানে এসে আমার নিজের ঘরেই কেমন দম বন্ধ লাগছে তোমাকে ছাড়া। আমি তোমাকে খুব বেশি মনে করছি। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে আমি একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি প্রিয়তম আমার। আমি মনে হয় আমার নিজের চেয়েও তোমাকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। আমার কাছে মনে হয়। এই পৃথিবীতে তুমিই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারো।
আমি চাই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে তুমি চলে আসবা। তোমাকে দেখতে পেলেই হয়তো আমি সুস্থ হয়ে উঠব।
নিজের যত্ন নিও। ভালোবাসা নিও।
ইতি তোমার
সোনা বউ

আমার শরীরটা খুব কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা লিখে খামে ভরে রেখে দিলাম। আগামীকাল আল্পনা যখন কলেজের খবর নিয়ে আসবে। তখন ওর কাছে দিয়ে দিব পোস্ট অফিসে দেয়ার জন্য।

আজকে আবারও আমার খুব ঘর পালাতে ইচ্ছে করছে। মায়ের কাছে শুনেছি তাদের সময়ে নাকি অনেক মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি থেকে পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে যেত। আমার ইচ্ছে হচ্ছে উল্টোটা। আমার ইচ্ছে করছে বাবার বাড়ি থেকে পালিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাই। কিন্তু শরীরে জ্বরের তীব্রতা খুব বেশি। আর তাছাড়া আমার বাবার সম্মান। আমার খুব পানির তৃষ্ণা পেল। রুমের দরজা খুলে বাইরে থেকে পানি নিয়ে এলাম। মা বাবা কেউ টের পেলো না আমি সারা রাত জ্বরের ঘোরে কাটালাম।
সকালের দিকে আমার জ্বর আরও বেড়ে গেলে আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলো মাথার মধ্যে কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনোরকম ভাবে পুকুর জলে গিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে ধিরে ধিরে বেশ কিছুক্ষণ ডুবালাম। মাথাটা কিছুটা হাল্কা লাগল।মনে হলো জ্বর নেমেছে অনেকটা। উঠে এসে গা মাথা ভালো ভাবে মুছে নিয়ে কাপড় বদলে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়লাম। জায়নামাজে বসেই বেঁচে থাকার ব্রত মনে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। এরপর মায়ের কাছে রান্না ঘরে গেলাম। মা রুটি আর আলুভাজির সাথে ডিম অমলেট করে আব্বার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে বললেন।
——–তুমি আর নাদিরা নাস্তা খেয়ে নাও আমি আসছি।
নাদিরা আমার ছোট বোন। রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে খুব সুন্দর গোল গোল করে রুটি বেলছে একহাতে আর আরেক হাতে রুটি সেঁকছে। একদম আমার মায়ের মতো পাকা গৃহিণী হচ্ছে সে। টুকটুকে ফর্সা বোনটা আমার আগুনের তাপে কেমন লাল হয়ে আছে। তার আবার লেখাপড়ার দিকে কোনো রকম আগ্রহ নেই। মা তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে লেখাপড়া শেখাচ্ছে। মা’কে আমার জিজ্ঞেস করতে হবে। আমার ছোটো বোনটাকে কেন এতো জোর করে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। কী হবে তার লেখাপড়া দিয়ে। সে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। টুকটুকে বোনটাকে তো বড়োজোর দু’চার বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দেবেন আব্বা।
নাহ্ মা’কে আর কী জিজ্ঞেস করব! আমি এর উত্তর জানি। নাদিরাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে শুধু বিয়ে দেয়ার জন্য। আর দু’ক্লাস পড়লে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে।
যাক যা খুশি তাই করুক। বাবার বাড়ির উপর থেকে আমার একপ্রকার মন উঠে গেছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আর এখানে আসবো না। আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বাবা-মা তো বলেই দিয়েছেন আমি এখন তাদের কেউ না।আমি এখন স্বামী আর শ্বশুর বাড়ির।
বাবার বাড়িটা ছেড়ে যাবার কঠিন সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর থেকে আমার জ্বরটা নামতে শুরু করেছে। বেশ হালকা লাগছে মাথাটা। ছোটো বোনের কাছ ঘেঁষে বসলাম। কী জানি আবার কবে দেখা হবে ওর সাথে। ও আমার অনেক প্রিয়।আমাকেও সে খুব ভালোবাসে।কিন্তু ভীষণ লেগে থাকে আমার পেছনে। এটা ওটা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করবে। কিন্তু যেই আমি কিছু বলবো তো অমনি সে ভ্যা করে কেঁদে ফেলবে। আর মায়ের কাছে আমার নামে নালিশ। মা তখন আমায় বকবে। আর এতেই তার সেই কী আনন্দ। আমার হাতে গালে তার নখের চিমটির অগুনতি দাগ পাওয়া যাবে। অথচ আমার এই ছোট্ট বোনটি তার জন্য বরাদ্দ করা বিস্কুট, পিঠা, চকলেট বা ফল থেকে আমাকে আলাদা করে ভাগ না দিয়ে খাবে না।
অন্যদিনের চেয়ে আজকে ওর জন্য আমার বুকের মধ্যে মায়াটা বড্ড বেশি করে মোচড় দিয়ে উঠল। মনে মনে খুব করে দোয়া করলাম। নাদিরা যেন খুব সুখে থাকে। ওর যা যা ভালো লাগে ও যেন তা করতে পারে।

আমার চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসল। নিজের কান্নাটা সমলে নিয়ে বললাম।
——নাদুমণি তুমি কীভাবে এতো সুন্দর করে রুটি বানাও বলো তো! কী সুন্দর তোমার হাতের মধ্যে রুটি নিজে নিজেই ঘুরতে থাকে।
হি হি করে হেসে উঠলো নাদিরা।
______আরে না সোনা আপা। রুটি এমনিতে ঘোরে না। এইটার একটা নিয়ম আছে। মা আমাকে শিখাইছে। আপনি শিখবেন!
ওর খুশিটা বহাল রাখতেই বললাম।
——হুম শিখব। শেখাও আমাকে।
নাদিরা খুব মন দিয়ে আমাকে রুটি বানানোর কৌশল শেখাতে লাগল। আমিও খুব মনোযোগে শিখতে লাগলাম।
——এইভাবে গোল করে গোল্লা বানাবেন। এইবার পিঁড়ির উপর রেখে হাতের তালু দিয়ে একটা চাপ দিয়ে চ্যাপটা করবেন একটু। এরপর রুটি বেলার বেলনটা নিয়ে একবার ডানে একবার বামে একটা টান দিয়ে একটু বেলে নিবেন। না না ওইভাবে না ওইভাবে না।হ্যাঁ হ্যাঁ এইভাবে। হুম একদম। এইবার বেলনটা রুটির মাঝখানে হালকা করে চেপে ধরে বেলতে থাকবেন আর একটু একটু করে ডানে টেনে বামে ঠেলে বেলতে বেলতে ঘুরাবেন। দেখেন দেখেন ঘুরছে। এইবার পারবেন তো!
——–বাঃ দারুণ তো! একদম পারব। আর আমার হাতের এমন সুন্দর গোলগোল রুটি খেয়ে তোমার দুলাভাই যখন প্রশংসা করবে তখন বলব। আপনি কী শুনবেন আমার রুটি বানানোর শিক্ষক কে! সে তখন শুনতে না চাইলেও বলব। আমার এই চমৎকার রুটি বানানোর শিক্ষক আমাদের টুকটুক বুড়ি নাদিরা।
আমার বোনটি খুব খুশি হলো। তার এই আনন্দ মাখা মুখটা আমার চোখে লেগে থাকবে আজীবন।

আমি মনে মনে কেমন একটা নির্বাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমি আমার বাবার বাড়ির পরাধীনতার শেকল ফেলে।আমার স্বামী রাশেদের কাছে স্বাধীনতা ভোগ করতে যাচ্ছি। স্বাধীনতা রাশেদকে প্রাণ ভরে ভালোবাসার।স্বাধীনতা আমার ডাক্তারি পড়ার। স্বাধীনতা আমার নিজের মতো করে একটুখানি ভালো থাকার।
——-কী হলো তোমরা এখনও খাওনি!
মায়ের কথার শব্দে ভাবনা ছেড়ে মুখ তুললাম। আমি নিজেকে খুব সহজ করে নিলাম। গতকালকের সবকিছু ভুলে যাওয়ার একটা সুন্দর অভিনয়ের খুশি মুখে মেখে নিয়ে মা’কে বললাম।
——-আমরা একসাথে খাই চলেন।
মা এসে এক চুলায় চায়ের হাঁড়ি চাপাতে চাপাতে বললেন।
——আমার তো দেরি হবে। আগে তোমার আব্বাকে চা দিয়ে তারপর আমি খাব।
—– আচ্ছা আসেন।একসাথেই খাব মা।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার মা আমাকে আড়চোখে দেখছেন। আমার মুড ঠিক আছে কিনা। আমি যে আমার মায়ের সবচেয়ে জেদি মেয়েটা। গতকাল এতোকিছু হয়ে যাবার পরেও আমি সহজ স্বাভাবিক কেন! মা বুঝতে চেষ্টা করছেন এসব কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস নয় তো!
আমার মা অনেক ধীর স্থীর বিদুষী মহিলা। মায়ের দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা খুবই অসাধারণ। আর এই ধীরস্থিরতা ও প্রজ্ঞার কারণেই আমার মা আমার বাবার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নেয়। মা সংসারে কোনো জটিলতা চায় না।কিন্তু সব বোঝে।সবাইকে বোঝে। তাই মা আমাকে বুঝতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক।
তবে আমি ইলোরাও আমার এই মায়েরই মেয়ে। মায়ের কাছ থেকেই আমি অনেক কিছু পেয়েছি। জীবনে তা অনেক কাজে লাগবে এ আমার বিশ্বাস।
——–সোনা আপা দেখেন দেখেন এই রুটিটা কী সুন্দর ফুলে উঠেছে।
নাদিরার আজ ভীষণ আনন্দ। কারণ তাকে আমি অনেক বড়ো সম্মান দিয়েছি।আমার রুটি বানানোর শিক্ষক বলে। আমরা আসলে ইচ্ছে করলেই একটু আধটু খুশি আমাদের প্রিয়জনদেরকে দিতে পারি যখন তখন।কিন্তু দেই না। এটা আমাদের অবুঝপনা বা হীনমন্যতা। এগুলো মনে হয় মানুষ তৈরির সময়।রক্ত মাংসে মিশিয়ে দেয়া হয়!দূর! মাথায় আমার কেন এতোকিছু চলে আসে!

এখন খুব ইচ্ছে হলো ছোটো বোনের সাথে একটু খুনসুটি করি।
——-নাদু এই রুটিটা আমি খাবো কিন্তু। মা ফুলা রুটিটা আমাকে দিতে বলেন।
মা হাসেন। মায়ের মুখের এই হাসিটুকু ভারমুক্তির। নিজের সন্তানের কাছে। আমি বুঝি। তাইতো মাকেও খুশি দিলাম।
নাদিরা বলে উঠল।
——–আপনার জন্যই তো দিলাম। নিন আপনি খান।
কী ব্যাপার! নাদিরা আজ এতো নমনীয়! মা’কে নালিশ করলো না। নিজের জন্য আবদার করলো না।আমার এক আবদারে আমাকে দিয়ে দিলো। বুঝতে পারলাম। আমার জীবনের কিছু বাস্তবতা আমার ছোট্ট বোনটিকেও কেমন ম্যাচুরড বানিয়ে দিচ্ছে।
অধিকাংশ মেয়েরা আসলে মায়ের জীবন দেখেই জীবন শেখে। মায়ের দুঃখ খাওয়া দেখে দেখেই ছোটবেলা থেকে দুঃখ খাওয়া শিখে যায়। বাবারাও খুব চেষ্টা করে নিজের সন্তানদেরকে আনন্দ দিতে। সবাই পেরে উঠে না। পৃথিবীর সকল বাবারাই হয়তো খুব ভালো। তবুও পৃথিবীর প্রতিটি বাবার মধ্যে এক একজন পুরুষ বাস করে। সেই পুরুষ সংসারে আধিপত্য চায়।কতৃত্ব চায় সকল সিদ্ধান্তে। নিজের মতামতের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব চায়। চায় সকলে তাকে এ নম্বর আসনটা দিক। বাবার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হোক। এই চাওয়াটা ও এই পুরুষতান্ত্রিকতাকে সবাই কী বলবে জানি না। আমি বলবো অধিকাংশ সময় এটা এক ধরনের অমানবিকতা, এটা একনায়কতন্ত্র, এটা স্বৈরতান্ত্রিকতা। হয়তো জন্ম থেকেই বাবা পুরুষের মন মানসিকতা ও মস্তিষ্কের মধ্যে একটা পুরুষতান্ত্রিকতা ঢুকিয়ে দেয় পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও অহম। আর আমরাও কেমন বাবা মানেই সব দায়িত্ব। বাবা মানেই সকল নিরাপত্তা। বাবা মানেই সকল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মনে করি। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন, আচরণ ও সম্পর্কগুলো একটু সহজ করে নিলে কত্ত সহজ। অথচ আমরা কেবলই জটিলতায় হাঁটি। অভিমান, অভিযোগগুলো, আমাদের মতের মিল অমিলগুলো আমাদের সম্পর্কের মাঝে কেবলই দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় দুঃখ, গ্লানি, দহন আর কান্নার ইতিবৃত্ত।
থেমে থেমে মনটা কেমন আরও নিরব হয়ে যেতে লাগলো আমার।তবুও খুব খুশি নিয়ে মা আর ছোটবোনের সাথে বসে সকালের নাস্তা করলাম। আজ সবসময়ের চাইতে বেশ বেশি পরিমাণে খেলাম।মা বিষয়টি খেয়াল করলেন।কিন্তু কিছু বললেন না।
আমার মনে হয় পৃথিবীর সব মায়েদের মধ্যে একটা কমন মিল আছে। তা হলো তার সন্তান আরও একটু বেশি খাবার খাক। তার সন্তানরা ভালো থাকুক।

আমি আমার পড়াশোনায় ডুবে থাকলাম সারাদিন। মনে মনে অপেক্ষা বান্ধবী কখন আসবে! বিকেলটা গা এলিয়ে দিতেই আমার ঘরে আমার বান্ধবী আসল। ওর কাছে জানতে পারলাম স্যাররা বলেছেন এই সপ্তাহের মধ্যে রেজাল্ট দেয়া হবে। রেজাল্টের পরপরই ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হবে। রাশেদকে লেখা চিঠিটা বান্ধবীকে দিয়ে বললাম খুব জরুরি। আগামীকালই যেন পোস্ট করে।

আমি আমার সময়গুলোকে খুব কাজে লাগাচ্ছি। কারণ ভর্তি পরীক্ষার খুব বেশি দেরি নেই। আর তাছাড়া মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা অনেক কঠিন হয়। মা আমাকে তেমন কিছুই বলছেন না। আব্বার সাথে আমার আর কথা হয় না। ছোটো বোনটা আমায় খুব যত্ন করে। যে কোনো সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে কেউ এসে আমাকে নিয়ে যাবে হয়তো।

আজ সাতদিন হয়ে গেল। রাশেদ এতোদিনে চিঠি পেয়ে যাওয়ার কথা। সাথে সাথে জবাব দিলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মনটা কেমন হু হু করছে। বিকেল থেকে কুটুম পাখি খুব ডাকছিলো পুকুর পাড়ের গাছের ডালে। মা নাদিরাকে ডেকে বলছিলো বাড়িতে কুটুম আসবে নাদু। কথাটা আমার কানে আসতেই আমার মনে রাশেদের জন্য অপেক্ষাটা তীব্র হলো। রাশেদ আসবে তো!
ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্য বুঝি বুকের মধ্যে কেমনই করে সারাক্ষণ। কেমন করে রাশেদ আমার স্বামী হয়ে গেল। হয়ে গেলো আমার সবচেয়ে ভালোবাসা আর নির্ভরতার মানুষ। মেয়েরা হয়তো জন্ম থেকেই একটু কেমন ভালোবাসার জন্য ব্যাকুল থাকে। আর স্বামী নামক মানুষটাকে খুব করে ভালোবাসবে বলেই একটু একটু করে নারী হয়ে উঠে।
আমিও আমার স্বামী রাশেদকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো আশ্রয় আর ভালোবাসা করে নিলাম আমার সর্বান্তকরণে।
পড়তে পড়তে খুব ক্লান্তি লাগছিল। মনে পড়লো আমার রেজাল্টের কথা।রেজাল্ট হলো কিনা জানা হলো না। রেজাল্ট হলে নিশ্চয়ই পারভীন আর আল্পনা এসে বলে যেতো।
আল্পনাকে কত করে বললাম। আমি যে ক’টা দিন এখানে আছি। একবার করে আসিস আমার কাছে। কৈ এলো না ওরা এই ক”দিনে। ভাবনায় ছেঁদ পড়ল। আমাদের দরজায় কেউ খটখট করছে। রাত এগারোটার উপরে বেজে গেছে এখন। এতো রাতে কে এলো! বড়ো ভাইয়া!
সাথে সাথে রাশেদের মুখটা মনে পড়ল। কিন্তু আমি এতো রাতে গিয়ে তো দরজা খুলবো না। আব্বা মা বোন ঘুম। একটু অপেক্ষা করি। যেভাবে শব্দ হচ্ছে নিশ্চয়ই আব্বার ঘুম ভেঙে যাবে। হলোও তাই। আব্বা উঠে দরজা খুলে গলা বাড়িয়ে মা’কে ডাকছেন।
——-কই গো এদিকে আসো।দেখো কে এসেছে। নাদিরা নাদিরা। তোমার মা’কে বলো জামাই এসেছে।
এসো বাবা এসো। এতো রাত হলো!
——– আসসালামু আলাইকুম আব্বা। ইলোরার রেজাল্ট দিয়েছে আজকে। তাই ওর রেজাল্ট পেয়ে জরুরি সব গুছিয়ে রেখে তারপর গাড়িতে উঠলাম। আব্বা ইলোরা ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে।
———–থাক থাক বাবা সালাম করতে হবে না।
——-আম্মা এখানে মিষ্টি আছে। কাল সকালে সবাইকে মিষ্টি পাঠাবেন। ইলোরার পরীক্ষা পাশের মিষ্টি এগুলো।
আমি আমার রুম থেকে সব শুনছিলাম। আমার রেজাল্টের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট এখন বাবা-মায়ের কাছে আমার স্বামী রাশেদ। তারা রাশেদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমারও ভীষণ আনন্দ।
মানুষের জীবনে একসাথে এতো আনন্দ আসে! আমি জানতাম আমার রেজাল্ট খুব ভালো হবে। তবুও মনে তো একটা ভয় থেকেই যায়। দৌড়ে রাশেদের কাছে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু বাবা মায়ের সামনে আমাদের সময়ে এতোটা করা যেতো না। তাই অপেক্ষা করছি আর খুশিতে কাঁদছি। একদিকে আমার রেজাল্টের খবর। অন্যদিকে রাশেদ আমার কাছে চলে আসছে।সব আনন্দ মিলেমিশে একাকার।
কিছুক্ষণ পরেই রাশেদ আমার রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আমি চাতক পাখির মতো আমার স্বামী রাশেদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লাম এতোদিনের তৃষ্ণা নিবারণে। যেন কত কত কালের মায়ার তৃষ্ণা মিটিয়ে নিলাম প্রিয় স্বামীর বুকে কেঁদে কেটে সুখ খুঁটে।
কিছুক্ষণ পরে মা রাশেদকে খেতে ডাকলেন। খেয়ে আসার পরে আমি সারা রাত রাশেদের সাথে গল্প করলাম।খুব করে ভালোবাসলাম দু’জন দু’জনকে।

রাশেদের কাছে জানতে পারলাম। ওর এক নিকট আত্মীয় পরীক্ষা বোর্ডে চাকরি করেন। তাকে রাশেদ আমার পরীক্ষার রোল নম্বর দিয়ে রেখেছিল। রেজাল্টের ঘোষণার প্রায় সাথে সাথেই রাশেদ ছুটে যায় বোর্ড অফিসে। সেখান থেকে আমার রেজাল্ট জেনে মিষ্টি ও আমার জন্য শাড়ি কিনে নিয়ে রওয়ানা দেয় আমার কাছে।
চিঠি পেয়ে অপেক্ষা করেছিল আমার রেজাল্টের খবর নিয়ে একবারে ফিরবে বলে। আমার মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমাকে ঢাকা যেতে হবে। আর তাছাড়া রাশেদকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না। সব মিলিয়ে রাশেদ বলল আমাকে ও সাথে করে ঢাকায় নিয়ে যাবে। আমার মনে ভীষণ আনন্দ। কলেজে যাওয়া নিয়ে আমাদের বাড়িতে যা কিছু হয়েছে সে সব আর কিছুই বললাম না রাশেদকে। কারণ এগুলো আমার বাবার বাড়ির দুর্বলতা। আসলে বাবার বাড়ির দুর্বল দিক ভুলেও যদি কোনো মেয়ে তার স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির কাউকে বলে।তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখবেন। দু’দিন পরে আপনাকেই আপনার বাবার বাড়ির দুর্বলতা নিয়ে কটাক্ষ করবে তারা। মায়ের কাছে আমি এই শিক্ষাটাও পেয়ে গেছি।

যথারীতি আমি রাশেদের সাথে একদিন পরে আমার শ্বশুর বাড়িতে চলে এলাম। আসার সময় রাশেদ সহ আমি আব্বার কাছে গিয়ে আব্বাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বিদায় নিলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দিলেন। আমার এই প্রথম মনে হচ্ছে আমি নিজে নিজে নিজের পিতৃগৃহ থেকে নির্বাসন নিচ্ছি। মা খুব কান্না করলেন। কেন করলেন জানি না।
পথে আসতে আসতে রাশেদ আমার মন ভালো করতে আমার সাথে আমাদের ভবিষ্যত জীবনের নানান স্বপ্ন নিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। আমিও আস্তে আস্তে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। রাশেদ বলল।এই এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে নিয়ে ঢাকায় যাবে। খুব শীঘ্রই আমার ভর্তি পরীক্ষার ডেট পরবে। আমার যদি ঢাকা মেডিক্যালে সিট না পরে। তাহলে তখন কেমন করে দু’জন দূরে থাকব! রাশেদ আমার রেজাল্টে ভীষণ খুশি। একটু পর পর আমাকে সে ডাক্তার বউ বলে ডাকে। যাবার পথে আমার শ্বশুর বাড়ির জন্য রাশেদ বেশ অনেকগুলো মিষ্টি কিনে নিলো। তার বউ ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছে। তাও আবার সায়েন্স থেকে।

বিকেলের আলোটা প্রায় মিইয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাগরিবের নামাজের আযান হবে। এমন একটা সময় আমরা দু’জন রাশেদদের বাড়িতে ঢুকলাম। রাশেদ আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে ছালাম দিয়ে মিষ্টিগুলো আমার বড়ো জায়ের হাতে দিয়ে জানালো এগুলো আমার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার মিষ্টি।
আমি আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে রুমের দিকে যেতে যেতে কানে এলো।আমার শ্বশুর রাশেদকে বলছেন।
——–কী বেপার রাশেদ! তুমি কবে কখন তোমার শ্বশুর বাড়ি গেলে! একবার আমাদেরকে বলে যাওয়ারও দরকার মনে করলে না!
———আব্বা ইলোরার পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে খবরটা নিয়ে ঢাকা থেকে সোজা ওদের বাড়ি গেলাম। তাই আপনাদেরকে বলে যেতে পারিনি।
——-হ আমরা এখন আর কোন কাজের! পোলা এখন বড়ো হইছে। বিয়ে করছে। এখন তো আমাদের কথা মনে থাকার কথা না।
আমি ঘরে গিয়ে বোরখা খুলে অজু করার জন্য পুকুর ঘাটে যেতে যেতে আমার শ্বাশুড়ির মুখের কথাগুলো কানে এলো। তারপর রাশেদের সাথে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির আর কী কী কথা হয়েছে আমি শুনিনি। কিন্তু এখন রাত দশটা বেজে গেলো কিন্তু রাশেদ এখনও আমার রুমে এলো না। এদিকে আজকে ফেরার পর থেকে শ্বশুর শ্বাশুড়ি আমার সাথে মুখ কালো করে রেখেছেন। আমাকে একবার কেউ খেতেও ডাকলো না। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কেবলই মনে হচ্ছে সংসারের আপন মানুষগুলো কেন এমন হয়! কেন বাবা-মা নিজেদের মতো করেই সন্তানের খুশি নির্ধারণ করে দিতে চায়! কেন এতো নিয়ম! কেন এতো কথায় কথায় সম্মান সম্মান করে আমাদের জীবন আরও বিষাক্ত করি আমরা! ভাবনাগুলো আমাকে খুব অস্থির করছিল। অস্থির করছিল রাশেদের ঘরে না ফেরাটাও।
আমি আমার বড়ো জা এর কাছে রাশেদের খবর জানার জন্য রুম থেকে বের হলাম। ভাবিকে জিজ্ঞেস করতে হবে রাশেদ কোথায়! বড়ো জা এর রুমের কাছে যেতেই শুনতে পেলাম……….
( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here