ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৯

0
559

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৯
_________🖌️নাজনীন নাহার
০৭.০৪.২০২২

—-তোমার এতো বড়ো আস্পর্ধা তুমি জামাই বাবাজির মতো এমন একজন ভালো মানুষের এতো সুন্দর সংসার রেখে চাকরি করতে চাও! আমি কী তোমাকে এই জন্য বিয়ে দিয়েছি ইলোরা!
—–আব্বা আপনার শরীর খারাপ। আপনি এমন উত্তেজিত হবেন না। চাকরি আমি করব না আব্বা। আপনি শান্ত হন।
—–রাশেদ বাবাজি! এখন তুমি বলো তুমি চিঠিতে আমার মেয়েকে নিয়ে যা যা অভিযোগ লিখেছ। এর বাইরেও কী তোমার আর কোনো অভিযোগ আছে আমার মেয়ের বিরুদ্ধে?
—-আব্বা আপনি আগে খাওয়াদাওয়া করে নিন।রেস্ট নিন। তারপর আমরা কথা বলি।
আমি খুব বিনয়ের সাথে আব্বাকে সহজ করার চেষ্টা করলাম।
—– আমি এখানে খাবার খেতে বা রেস্ট নিতে আসিনি ইলোরা। তোমার বিয়ের দশ বছর পরে আমাকে তোমার বিরুদ্ধে তোমার স্বামীর করা অভিযোগের সুরাহা করতে আসতে হয়েছে।
——আপনি শান্ত হন। শান্ত হয়ে কথা বলুন ইলোরার আব্বা।
আচ্ছা বাবা রাশেদ তুমি এবার বলো তো আসলে বিষয়গুলো কী?
মায়ের বিনয়, আমার সহনশীলতা, বাবার সমর্থন সব মিলিয়ে রাশেদের সিনা খুব টান টান। তার কণ্ঠে বেশ দাপট নিয়ে সে বলতে লাগল।
—–কী আর হতে বাকি আছে! আমি আপনাদের মেয়েকে কী দেইনি বলেন! আমার কী আপনার সাথে কথা ছিল আমি ওকে পড়ালেখা করাব! আমার কী আপনাকে কথা দেয়া ছিল যে ও চাকরি করবে! এগুলো নিয়ে ও আমাকে নানান রকম মানসিক চাপে রাখে সে সব তো আপনারা জানেন না!

এবার আমি আমার কণ্ঠ নরম রেখেই বলতে শুরু করলাম।
—–রাশেদ! তুমি কী বুঝতে পারছ! তুমি আমার বাবা-মায়ের কাছে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে যাচ্ছ!
—–কীসের মিথ্যা! বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার নাম করে তুমি কোথায় কোথায় যাও মনে করো আমি কিছু জানি না! তুমি আমার সাথে সংসার করো। আর তলে তলে নষ্টামী করে বেড়াচ্ছ। ড্রেসের পর ড্রেস কিনছ। যাও তো বাচ্চাদের স্কুলে তা তোমার এতো ফ্যাশন, এতো ম্যাচিং এগুলো কার জন্য করো! ভাবছ এগুলো আমি বুঝি না! তুমি কোথায় কোথায় যাও! কার কার সাথে তোমার নোংরামি!
—–ছিঃ রাশেদ ছিঃ তোমার মতো নষ্ট মনের হিপোক্রেটের কাছে আমার এটাই পাওয়ার ছিল। যদিও তোমার মতো মানুষের সাথে আমার কথা বলার রুচি নেই। তবুও বলো তো আমার বিষয়ে তুমি যা যা বললা। এগুলোর কোনো প্রমাণ কী তোমার কাছে আছে? আর একটা কথাও তুমি প্রমাণ ছাড়া বলবা না রাশেদ।
——আমার কী ঠেকা পড়ছে তোমাকে প্রমাণ দেয়ার!
—- অবশ্যই ঠেকা পড়ছে। কারণ তুমি আমার নামে মিথ্যে ও জঘন্য অভিযোগ করে আমার বাবা-মাকে এভাবে ডেকে এনেছ। আর এর মাধ্যমে তুমি তাদেরকে অপমান করেছ। তুমি আমাকেও অপমান করেছ। এখনও তুমি আমাদেরকে অপমান করেই যাচ্ছ। আমার বাবা-মায়ের সামনে আর একটা কথাও মিথ্যে উচ্চারণ করবা না তুমি। আমাকে অপমানিত করে করে তোমার হয়নি। এখন আমার বাবা-মাকে ডেকে এনেছ অপমান করতে!
—- দেখলেন! দেখলেন আপনারা! তার আচরণ দেখলেন! তার কথা বলার ধরন দেখলেন! নিজেকে কী একজন বিদ্বান মনে করে সবসময়!
—- তোমার সাথে যে আমার কথা বলার রুচি চলে গেছে সেই কবে থেকে। এটা তুমি বুঝো না রাশেদ! স্বামী হয়েছ বলে।বিয়ে করেছ বলে তুমি আমাকে পেয়ে বসেছ! যখন যা খুশি বলে যাবা!

শোনো রাশেদ বিয়ে করা মানে দাদন দেয়া নয়! আমিও তোমাকে বিয়ে করেছি। কৈ আমি তো তোমাকে অযথা অত্যাচার করি না! তাহলে তুমি কেন করো!
আরও শোনো!
আমার বাবাকে তুমি কী কথা দিয়েছ তা আমার জানার দরকার নেই। বিয়ে হয়েছে তোমার আর আমার মধ্যে। বিয়ের পরে তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে ডাক্তারি পড়ানোর। কথা তো রাখোনি।তার উপর আবার মিথ্যে প্রহসন করেছ আমার সাথে বহুবার।
—-অসভ্য মেয়ে! নষ্টা মেয়ে মানুষ! আমার জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে।
——ইলোরা তুমি থামো! তোমার আব্বা তো কথা বলছে।
মা কিছুটা ধমকের সুরে আমাকে থামতে বললেন। মেয়ের জামাইকে তো আর বলতে পারলেন না আমার মা।

আমি মায়ের কাছে গিয়ে মা’কে ছুঁয়ে আস্বস্ত করে বলতে লাগলাম।
—- মা প্লিজ আপনারা বিচলিত হবেন না। আপনারা আমার জন্য এসেছেন খুব ভালো করেছেন। আপনারা আজকে ওর ডাকে এখানে এসে প্রমাণ করেছেন। আমি একা নই। আমার পাশে আমার বাবা-মা আছেন। তোমাকে ধন্যবাদ রাশেদ। তুমি আমার বাবা-মাকে ডেকে এনেছ। যেটা আমি পারিনি। আমি কতবার এই সংসারে নিপীড়নের শিকার হয়েছি কিন্তু আপনাদেরকে ডাকতে পারিনি। বলতে পারিনি। কারণ মা আমাকে ধৈর্য সহ্য শিখিয়েছেন।

শোনেন আব্বা আপনারা আমাকে বিয়ে দিয়ে নিজদের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি স্বামী সংসারের দায়িত্ব আমার সাধ্যমতো শতভাগ পালন করেছি। এখানে আমি আর আমার স্বামী সমান। এই জীবনটা এখন আমার। আমি আপনাদের মেয়ে।আপনাদের অসম্মান হয় এমন কাজ আমি আমার অবুঝ বয়সেই কখনও করিনি। তাহলে এখন এই প্রায় ত্রিশ বছর বয়সের পরিপক্বতায় আমি কেন অবুঝ হব আব্বা! আমি দু’টো সন্তানের মা। মায়ের অনেক দায়িত্ব থাকে। আমি আমার মায়ের জীবন থেকে যে দায়িত্ব শিখেছি।তার থেকে একটুও বিচ্যুত হইনি আব্বা। তারপরও আপনি এবং মা আমাকে যা বলবেন।আমি তাই করার চেষ্টা করব। আমি কোনোভাবেই আমার বাবা-মাকে অসম্মানিত হতে দেব না।
—- নাটকবাজ কোথাকার! নাটক শুরু করছে!
আবারও রাশেদের কটাক্ষ উচ্চারণ!
— নাটকবাজ তুমি। একটু মনে করে দেখো রাশেদ নাটকের অবতারণা কে করেছে বহুবার!
আর শোনো আমি তোমাকে দিনের পর দিন মেনে ও মানিয়ে নিয়েছিলাম কেন জানো! আমার বাবা-মায়ের সম্মানের জন্য। আর আমার সন্তানদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য। এখন তুমি আমার সেই সম্মানের যায়গাতেই আঘাত করেছ।
—– তোমার লেকচার শোনার টাইম নাই আমার। আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি এর একটা বিহিত করেন।

আব্বাকে উদ্দেশ্য করে রাশেদ শেষ কথাটা বলল। আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম রাশেদ আজকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একবারও আমার আব্বা মাকে বাবা মা বলে সম্বোধন করেনি।
এরমধ্যে আব্বা বলে উঠলেন।
—–রাশেদ তোমাদের মধ্যকার সমস্যার সমাধান কী! কী চাও তুমি! আমি আজকেই চলে যাব রাতের গাড়িতে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।
—–আমি এভাবে আর আপনাদের মেয়ের সাথে সংসার করতে পারব না। তাকে বেলাল্লাপনা ছাড়াতে হবে। তাকে আমার কথামতো চলতে হবে।
—- ইলোরা!
রাশেদ কী বলছে! তুমি জবাব দাও এবার!
—–আব্বা আমি কোনো বেলাল্লাপনা করিনি। বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাই। ফুটপাতে বসে থেকে রোদে ধুলায় সময় কাটাই। পাশেই একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল।ওখানকার বাচ্চাদের পড়াতে চাইছিলাম। তারপর থেকে ও আমাকে যত জঘন্য কথা বলেছে।তা আমি আপনাদের সামনে উচ্চারণও করতে পারব না। আমি তাও সহ্য করে নিয়েছিলাম আপনাদের সম্মানের জন্য। এখন আপনিই বলুন আমার কী করণীয়!
আব্বা আমি এই লোকটার সাথে আর এক মুহূর্তও থাকব না। এই লোকটা ভয়ঙ্কর ইতর আব্বা। আমি সারাদিন সংসার করি। রান্না করা, বাজার করা, বাচ্চা দু’টোকে দেখাশোনা করা, পড়ালেখা করানো। নামাজ ও তিলাওয়াত করা। নিজের ভালোলাগার জন্য একটু বই কিনি আর বই পড়ি তার জন্যও বিরক্তি দেখায় ও বাজে বাজে কথা শুনায়। আমার বেশকিছু বই ও ফেলেও দিয়েছে আব্বা। আমার অনেক বই এক এক জনকে ডেকে ডেকে দিয়েও দিয়েছে।
—–ওই তো ন্যাকামি শুরু করছে! আপনি জানেন ও কার বই পড়ে! নাস্তিক আরজ আলী আতুব্বরের বই। তসলিমা নাসরিনের মতো মহিলার বই। বিদেশি নাস্তিক লেখক কাফকার বই! ম্যাকিয়াভেলির বই। এগুলো পড়ে পড়ে ও আরও নষ্ট হচ্ছে। আর এখন ন্যাকামি করে!
—–ন্যাকামি করার মানুষ ইলোরা না রাশেদ! দেখলেন আব্বা এক একজন বিখ্যাত ও সম্মানিত লেখক সম্পর্কে ওর ভাষাগুলো কত নোংরা! সে নিজের স্ত্রীকে কীভাবে সম্মান করবে বলেন!
আব্বা আপনি আমাকে বিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনার সম্মানের জন্য সব মেনে নিয়েছি। এই লোকটাকে আমি বিশ্বাস করে ভালোবাসেছি। এই লোকটার সাথে আমি ভালো থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওর মানসিক অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ আব্বা।
এবার আপনার কাছে আমি আমার সম্মান ফেরত চাই। আমি আপনার সাথে চলে যাব। আজ আপনি আমাকে সম্মান দিয়ে নিয়ে যাবেন। বাবার সম্মান রাখা সন্তানের যেমন দায়িত্ব। সন্তানের সম্মান রাখাও বাবার দায়িত্ব। আব্বা আপনি কী আমাকে আপনার সাথে নিবেন!
—- এসব কী পাগলামি করছ ইলোরা! তোমার আব্বার শরীর খারাপ। তার বয়স হয়েছে। সংসারে ভালো মন্দ হয়। তাই বলে সংসার ছাড়তে হবে কেন!
শুনলাম আমার মায়ের শঙ্কিত কথোপকথন।
— দেখেন আপনারা আপনার মেয়ের দেমাগ দেখেন!
এমন সময় আব্বা নিজের কণ্ঠ বেশ ভারি করে বলে উঠলেন।
—–না বাবা রাশেদ! এটা দেমাগ নয়। আমি আমার মেয়েকে সসম্মানে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। স্বামী স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক। পরস্পরের আব্রু। আমার মেয়ে তোমার সেই আব্রু নষ্ট করছে। তুমি ভালো ঘরের সন্তান। তুমি বাবা ভালো মানুষ।
তাই আমি আমার নষ্ট মেয়েকে আমার সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। চলো ইলোরা।

আমার মনে হলো আমি পুরোটা পৃথিবীর মালিক হয়ে গেলাম এক মুহূর্তে। আমার বাবা! এটা কী আমার বাবা! এতোটা সাপোর্ট দিলো আমার বাবা। মা’কে খুব চিন্তিত দেখলাম। দেখলাম রাশেদের মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আর আমার চোখেমুখে খুশি যেন উপচে পড়ছে। এই মুহূর্তে আমি আমার সকল গ্লানি, সকল অপূর্ণতা ভুলে গেলাম। শুধু দেখতে পেলাম আমার সামনে মুক্তির এক অবারিত আনন্দ ধারা।
—– জি আব্বা চলেন। আমি ইফতি আর ইনতিকে নিয়ে আসছি।
—–দাঁড়াও! তুমি আমার বাচ্চাদেরকে নিতে পারবে না। আমার বাচ্চারা আমার কাছেই থাকবে।
রাশেদের সিদ্ধান্তে আমি চমকে উঠলাম!
—– আব্বা!
আমি আব্বার সাপোর্ট চাইলাম। কিন্তু আমার বাবা আমাকে সন্তান নেয়ার বিষয়ে সাপোর্ট না দিয়ে উল্টো আমাকে বললেন।
—– ঝামেলা করো না ইলোরা। চলো। কই গো! তুমি বসে আছো কেন! বোরখা পরে আসো।
মা’কে উদ্দেশ্য করে শেষ কথাটা বলল আব্বা।

আমি সাথে সাথে বেডরুমে গিয়ে আমার বোরখাটা নিয়ে বেরিয়ে আসলাম। মা উঠে বোরখা পরতে গেলেন। আব্বা উঠে জুতা পায়ে দিলেন।আমি বোরখাটা পরে দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলাম।
আমার বুকের মধ্যে ছেলেদের জন্য উথাল পাথাল কান্নার জল উত্তাল বঙ্গপসারের ঢেউয়ের মতো আছাড় খাচ্ছে। গলার কাছে একটা ভয়ঙ্কর দহনের চিৎকার দলা পাকাচ্ছে। একদিকে মনে হচ্ছে আমার জন্য একটা পুরো পৃথিবী ও পৃথিবীর নীলাকাশ অপেক্ষা করছে। স্বপ্ন ফড়িং আমাকে নিয়ে উড়ে যাবে আকাশে। শঙ্খচিলের ডানায় ভর করে এখন থেকে উড়ে বেড়াবে আমার প্রজাপতি মন। আমার আর কোনো দুঃখ, গ্লানি, অপমান থাকবে না। থাকবে না সোনার খাঁচায় মায়ার শিকল।
মায়ার শিকল!
আমার মায়া! আমার সন্তান।আমার দু’টো চাঁদের টুকরা। আমি যে মা!
তখনই আমার মা বোরখা পরে এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। হু হু করে কান্না আসছে আমার। ভাবলাম।
এই আমার সংসার!
এই সংসার আমি এতো যত্ন করে গোছাই!
অথচ এখন সব ফেলে চলে যাচ্ছি!
তার মানে এইসবের কিছুই আমার না। আমি কেবল একজন আউটসাইডার! আমি কেবল একজন কেয়ারটেকার!
থাকলে আছি না থাকলে নাই।
দরজাটা খুলতে লকটাতে মাত্র মোচড় দিয়েছি। তখনই আমার ছানাপোনা বাচ্চা দু’টো দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। মাম্মা তুমি কোথায় যাও! তুমি বোরখা পরেছ কেন! মাম্মা আমিও যাব আমিও যাব। বাইরে যাব। শুরু করে দিয়েছে হুলস্থুল কান্না।

আমাদের সকলের বেশামাল অবস্থা! আমিও কেঁদে ফেললাম। এক হৃদয় বিদারক অবস্থা।হঠাৎ আব্বার কণ্ঠ!
—- রাশেদ এদিকে এসো। আমাদের দেরি হচ্ছে। তোমার বাচ্চাদের সামলাও। আর যদি বলো আমার মেয়ের সাথে করে আমি আমার নাতনিদেরকেও নিয়ে যেতে চাই।
আমার জীবনে এক অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। হঠাৎ রাশেদের চেহারা ছুরত আচরণ বদলে গেল। দৌড়ে এসে আমার আব্বার হাত দু’খানা নিজের দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বলতে লাগল।
—- আব্বা ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন। আসলে ইলোরা বাচ্চাদেরকে রেখে চাকরি করতে চাইল। এতে আমার মাথাটা পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে গেল। বলেন আব্বা আমরা কী খারাপ আছি! এই যে বাসা, ঘর সংসার এই সব তো ইলোরারই। ও আর আমি সংসার নিয়ে থাকলে কী এমন সমস্যা বলেন আব্বা। আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনিও ওকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন! আপনার নাতনিদের কথাও চিন্তা করলেন না আব্বা!
আমার আব্বা কেমন এক অন্য মানুষ আজ। তিনি বলতে লাগলেন।
—দেখো রাশেদ! দাম্পত্য হলো বিশ্বাস আর সম্মানের বিষয়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলো আল্লাহর নেয়ামত। একজন আরেকজনের আব্রু।কিন্তু আমরা অনেক বড়ো বড়ো শিক্ষায় শিক্ষিত ও সভ্য হয়েও এই দাম্পত্য জীবনের লেহাজ ভুলে ফেলি। স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করি। স্ত্রীর গায়ে হাত তুলি। পরস্পর জেদাজেদি করে নিস্পাপ সন্তানদের জীবনগুলো নষ্ট করে দেই। কখনও কী আমরা বাবা-মায়েরা ভাবি আমাদের এই ধরনের বীভৎস আচরণ দেখে দেখে আমাদের সন্তানদের মনের মধ্যে কেমন লাগে! কী ঝড় উঠে ওদের মনে! ওরা কতটা অনিরাপত্তায় ভুগে এই অবস্থায়!

রাশেদ! আমার ত্রিশ বছরের মেয়েটার জন্য আমরা বাবা মা ছুটে আসলাম অসুস্থ শরীর নিয়েও। কারণ আমার মেয়েটা ভালো নেই। আর দাম্পত্য কলহের কারণে, কে বড়ো কে ছোট এই কারণে, রাগ আর জেদের কারণে বাবা-মায়েরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে ফেলে চলে যাচ্ছে। কত কী হচ্ছে! তোমরা কী জানো! এই সকল দাম্পত্য কলহের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা! বাচ্চারা।
আমি খুব কাঁদছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আমার সন্তানদেরকে আজীবনের জন্য ছেড়ে যাচ্ছি।
বাচ্চারা কাঁদছে। আমার মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আব্বা রাশেদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। আব্বা আমাকে বললেন।
—–চলো ইলোরা। আসলে তোমার কোনো দোষ নেই দোষ আমার। আমি ভুল করে তোমার লেখাপড়া বন্ধ করে তোমাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলাম। আমি রাশেদকে তোমার যোগ্য জীবন সঙ্গী ভেবেছিলাম। আমি বুঝতে পারিনি মা। আমাকে তুমি মাফ করে দিও।
রাশেদ বাবাজি! আমিও তোমার হাতে আমার সোনার টুকরা মেয়েটাকে তুলে দিয়ে ভুল করেছিলাম। আজকে আমার ভালো মেয়েটা তোমার সংসারে এসে নষ্ট হয়ে গেল। তুমি তোমার সন্তানদেরকে মানুষের মতো মানুষ করো বাবা। আমার মতো ভুল করো না।
দরজার সিটকিনিতে থাকা আব্বার হাত সরিয়ে দিয়ে
রাশেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আব্বার একটা হাত ধরে অনুনয়-বিনয় করে আমাকে রেখে যেতে বলল। বাচ্চারা তখনও কাঁদছিল।

আমি যেন এখন এক বিজয়ীনী সম্রাজ্ঞী! আমি এবার আমার ঘাড় একটু উঁচু করে বললাম।
—-আব্বা চলেন চলেন আমি ওর মতো এমন অত্যাচারির সাথে থাকব না।
— আমি তোমাকে আর অত্যাচার করব না ইলোরা। দেখো বাচ্চারা কেমন কাঁদছে।
আব্বা আমাকে আর একটা সুযোগ দিন। আর এমন হবে না।
—-আমি তোমার সংসারে থাকলে কিন্তু আমাকে চাকরি করতে দিতে হবে রাশেদ।
একথা বলতেই মা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন।
—-ইলোরা! সবকিছুর বাড়াবাড়ি ভালো না মা।
—-আম্মা এই আমি আপনাদেরকে কথা দিলাম। আমি আর ইলোরার সাথে খারাপ ব্যাবহার করব না।
আর রাগারাগি করব না। তবে ইলোরার চাকরি করার দরকার নাই। আব্বা আপনি কিছু বলেন।
—- দেখো বাবা সংসার তোমাদের। তোমরা দুইজন একসাথে থাকলে সম্মানের সাথে থাকো। অসম্মানের রাজপ্রাসাদে সব থাকে কিন্তু শান্তি থাকে না।

আর ইলোরা তোমাকেও বলি। তোমাকে আমি আজ তোমার সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারি। একজন মা’কে রেখে যেতে পারি তার সন্তানদের কাছে। এরপরেও যদি কখনও আর রাশেদ তোমাকে অসম্মান করে। তুমি সোজা তোমার বাবার বাড়িতে চলে আসবা। আমি তোমার বাবা তোমাকে হুকুম দিয়ে গেলাম।
রাশেদ শোনো!
আজকে থেকে ইলোরা আর বাচ্চাদেরকে নিয়ে স্কুলে যাবে না। এই দায়িত্ব বাচ্চাদের বাবার। তুমি বাচ্চাদের স্কুলে নেয়া আনা করে পড়ালেখা করাতে পারলে করাবা। না পারলে তোমার বাচ্চারা লেখাপড়া না করে থাকবে।
আমার মেয়েকে সম্মান ও মর্যাদায় রাখতে পারলে ও থাকবে। অন্যথায় ও থাকবে না। তুমি ভাবো ভেবে দেখো। আরও একটা কথা। বলো তো রাশেদ আমার ইলোরা কী পর পুরুষের সাথে কোনোরকমে কোনো সম্পর্কে আছে? তুমি যে সকল অভিযোগ আমাকে লিখেছ ও বলেছ।এগুলো কী সত্যি?
—–না আব্বা এগুলো আমি রাগের মাথায় করেছি।
—-রাগের মাথায় আর কখনও আমাদেরকে মিথ্যে অভিযোগ লিখে ডাকবে না। সরাসরি আমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিবা।সবসময় মনে রাখবা বাবা। ইলোরা আমার মেয়ে। ভালো মন্দ যা হোক। ও আমার মেয়ে। আমি যেমন ওকে ফেলতে পারব না তেমনি ওর অমর্যাদাও মেনে নেব না। যদি তুমি আমার মেয়েকে আর কখনোই অসম্মান করো।তার জন্য তোমার বিহিত শুনে রাখি বাবা।
—– আব্বা আর হবে না। আমরা আমরাই আমাদের সব বুঝে নেব। আপনারা দোয়া করবেন!
আমি চট করে বলে বসলাম।
—আব্বা ওকে আমি বিশ্বাস করি না। ও হচ্ছে কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষ। আমি ওর সাথে থাকব না আব্বা এটাই ফাইনাল।
—দেখলেন আব্বা! ওর কেমন জেদ।সব সময় খোঁচা দিয়ে কথা বলে।
—কেন বিয়ে করার সময় মনে ছিল না রাশেদ! তখন কেন বেছে বেছে আমার মতো এমন তীক্ষ্ম আর ধারালো মেয়ে বিয়ে করেছিলে! ভোতা দেখে বিয়ে করতে পারলে না। তাহলে তো ঘষা ঘষি করলেও খোঁচা লাগত না তোমার!
—- ইলোরা তুমি থামো তো এবার!
মা আবারও আমাকে থামতে বললেন। আমি তবুও বললাম।
—- মা গো! আমি থেমেই থাকি। আর আমি থেমে থাকি আপনাদের মান সম্মানের ভয়ে। তবে আজকে থেকে ও যদি আমার সাথে আর কোনো ঝামেলা করে। তাহলে আমি ওর ঘর, সংসার, শাড়ি, গহনা সব ওর জন্য মোবারক দিয়ে চলে যাব। আরও একটা কথা আমি যদি একবার ওর ঘর ছাড়ি তাহলে দ্বিতীয়বার আমি আর ওর সংসারে ফিরব না। এটা যেন ও মাথায় রাখে।

রাশেদ কেমন অসহায় চেহারা করে আব্বার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মা আমাকে আর বাচ্চাদের টেনে এনে ডাইনিং এ বসালেন। রাশেদ মা’কে বসতে অনুরোধ করে বসাতে পারল।এবার আব্বাকে এক রকম অনুনয় বিনয় করে এনে চেয়ারে বসালেন। আব্বা জুতা পায়ে নিয়েই ডাইনিং এর চেয়ারে বসলেন। এটা লক্ষ্য করে আমার বেশ ভালো লাগছিল। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি একটি বচন। “নরমের গরম শক্তের ভক্ত “।
আজকে তার প্রতিফলন দেখলাম। আমি রাশেদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু এতোদিনের সংসার। বাচ্চাদের কান্না আর আমার মাতৃত্ব সবকিছু মিলিয়ে কেমন একটা দোনোমোনোতে পরে গেলাম।
আব্বা মা কেউই আর বাড়াবাড়ি করলেন না। আব্বা কণ্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক ও দৃঢ় রেখে বললেন।
—-ইলোরা আমি রাশেদকে বলে দিয়েছি। তুমি আর বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাবে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া, মানুষ করা, স্কুলে আনা নেয়া এগুলোর দায়িত্ব রাশেদের। তুমি এখন থেকে বাসায় থাকবা। এটা আমার নির্দেশ। তুমি বাইরেও যাবে না। কোনো ঝামেলাও হবে না।
—–আব্বা আমি বারান্দায় গেলেও ওর সমস্যা। আমার ঘরের জানালার পর্দা সামান্য ফাঁকা হলেও ওর সমস্যা। আবার ওর মনে হলে আমার সবকিছুই খুব ভালো ওর কাছে। এভাবে কী একটা সুস্থ সম্পর্ক হয় আব্বা!
—- তুমি এবার চুপ করো তো ইলোরা। তোমার বাবা যা বলছেন খারাপ তো কিছু বলছেন না।

আমি দেখলাম আমার বাবা-মায়ের অবস্থান। দেখলাম আমার বাবা পুরুষই আমার জন্য মূল শক্তি। দেখলাম মায়ের নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বাবা পুরুষের সিদ্ধান্তের সাথে হ্যাঁ মিলিয়ে যাচ্ছেন মা নারী। আমিও কেমন বাবা পুরুষের ভরসাতেই শক্তি পাচ্ছি শান্তি পাচ্ছি। আমার মা নারী কেমন পুতুলের মতো বাবার হ্যাঁ তে হ্যাঁ বাবার না তে না করে যাচ্ছেন।

রাশেদ আব্বার সাথে কমিটমেন্ট করল আর এমনটি হবে না। আব্বা মাকে খুশি করার জন্য বলল, আমি নাকি খুব ভালো মেয়ে। শুধু একটু জেদ বেশি আমার। আমাদের ঝামেলাগুলো আমরাই মিটিয়ে নেব আপনারা দোয়া করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি বলে আমাকে রাশেদ তার সংসারে রেখে দিল। রেখে দিলো মানে আমি থেকে গেলাম।

আমার আব্বার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমার বাবা-মা রাশেদের বাসায় একটু পানিও মুখে তুললেন না। মা আমাকে আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে সংসারে ধৈর্য ধারণ করার শ’খানেক পরামর্শ দিয়ে চলে গেলেন বাবার সাথে। আমি আর তেমন কিছুই বললাম না কাউকে। আব্বা মা চলে যাওয়ার সময় আমার খুব কান্না পেলো।আমি ঠিক বুঝলাম না আমার বাবা-মা আমাকে জিতিয়ে দিয়ে গেলেন‌! নাকি হারিয়ে দিয়ে গেলেন!

তবুও আমার কাছে মনে হলো। বাবা-মায়েরা তাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিয়ে নিলে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন মেয়েটাকে পেয়ে বসে। আর যদি বাবা মা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পরেও মেয়েদের সুখ দুঃখে সব রকম সাপোর্ট হয়ে পাশে থাকে। তাহলে আমাদের সমাজ থেকে মেয়েদের উপর অত্যাচার কমে যাবে। মেয়েরা আরও বেশি সাহসী হবে। মনোবল বাড়বে। মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে নিজের সংসারে।

আমার বাবা-মায়ের দৃঢ় সমর্থনের পর থেকে রাশেদের মধ্যে বেশ ভালো রকমের পরিবর্তন এলো। দু’দিন ছেলেদেরকে নিয়ে নিজেই স্কুলে গেল।এরপর হাঁটু ব্যথার নাম করে তিনদিন বিছানায় পড়ে রইল। আমাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে পাঠাল। আমিও বাচ্চাদের ভবিষ্যত চিন্তায় ওদেরকে নিয়ে স্কুলে যেতে লাগলাম। একদিন রাশেদ তার নিজের ও আমার জন্য মোবাইল ফোন কিনে আনলো। আমাকে সে একটু পর পর কল দেয়। আমি কোথায় আছি! আমি কী করছি ইত্যাদি। বাচ্চাদের স্কুলের সামনে আমার সাথে বসে থাকা ভাবিরা, আপারা আমার আর রাশেদের প্রেম নিয়ে দুষ্টোমি করে। আমাদের নাকি অনেক প্রেম। আমি মৃদু হেসে বইয়ের অক্ষরে ডুবে যাই। আমি আর কাউকে বলতে পারি না। এগুলো আমার প্রতি রাশেদের প্রেম নয়। এগুলো রাশেদের হীনমন্যতা।

এর বছর দেড়েক যেতে না যেতেই আমি আবারও কন্সিভ করলাম। এবার আমার মেয়ে সন্তান হলো।

আমি ইলোরা আমার তিনটি সন্তান নিয়ে, সংসার নিয়ে সহকারী কাজের লোকেদের ঝামেলা নিয়ে হিমসিম খেতে খেতে আরও বছর পাঁচেক পার করে দিলাম। রাশেদের সাথে এখনও আমার অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য হয়। যথারীতি আমি তেমন তর্কে যাই না। মাঝে মাঝে কিছু কড়া ছবক দিয়ে দেই। রাশেদও চেষ্টা করে অযথা আমার সাথে ঝামেলা না পাকাতে। মেয়েকেও আইডিয়াল স্কুলেই ভর্তি করালাম। বড়ো ছেলে ক্লাস ফাইভে ও ক্লাস এইটে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেল। ছেলেদের পড়ার চাপ।স্কুল, কোচিং, মেয়েটা ছোট। সব মিলিয়ে আমার নিজের জন্য আর তেমন অবসর পাই না। একজন টিপিক্যাল বাঙালি মা হয়ে ডুবে গেলাম সংসার ও সন্তানে।

রাশেদ আরও একটা ফ্ল্যাট কিনলো। একটা এক্স করোলা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনল। ড্রাইভার রাখল। আমার জন্য কিছুটা আরাম হলো। বড়ো ছেলে ইফতির এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল। পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়ছে ইফতি। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই আমার বড়ো ছেলের মধ্যে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন বুনে দিয়েছি। ইফতিও খুব ভালোবেসেই মায়ের মতো পড়াশোনার নেশায় বুদ হয়ে থাকে। তবুও ক্লাস এইটে আমি ওর বাবার সাথে একরকম যুদ্ধ করে ইফতিকে গিটার কিনে দিয়েছিলাম।

লেখাপড়ার পাশাপাশি মিউজিকের প্রতি ইফতির ভীষণ নেশা তৈরি হয়ে গেল। কম্পিউটারে সে সিডিতে গান শোনে। রক, পপ, জাজ, হিপ হপ, হেভি মেটাল শুনে আর মাঝে মাঝে গিটার প্রাকটিস করে। সপ্তাহে দুই দিন এক ঘন্টা করে গিটারের ক্লাসে নিয়ে যাই ওকে। রাশেদের কথা হলো ছেলেকে আমি নষ্ট করছি। আমি আমার মতো বানাচ্ছি। বলুক আমি জানি আমার ছেলে নষ্ট হবে না। এটা বয়সের সাময়িক খেয়াল। এসব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ছেলের মূল নেশা তার মায়ের মতো লেখাপড়ার নেশা। আমি মা সেই জন্ম থেকে আমার প্রতিটি সন্তানের শরীর ও মনের বেড়ে ওঠা ও প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে ছিলাম ও আছি। আমি ওদের চিন্তার ব্যাপ্তি জানি। জানি ওদেরকে কীভাবে জীবন মুখি ও ক্যারিয়ার মুখী করতে হবে। তাইতো গিটার বাজানো শিখেও আমার ইফতি লেখাপড়ায় খুব ভালো করছে। ওর মধ্যে আমি বয়ঃসন্ধির অযথা কোনো রাগ জমতে দেইনি। যৌক্তিক চাওয়াগুলোকে আমি ব্লক করে দেইনি। ওর সাথে থেকেছি প্রায় সারাক্ষণ। সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো খেয়ালে রেখেছি। সেভাবে ওদেরকে আমি টেককেয়ার করেছি। আমি আমার সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছি। বন্ধুর মতো সঙ্গ দিয়েছি।

ইফতির এসএসসির রেজাল্ট দিল। এসএসসিতে বোর্ড সেরাদের তালিকায় ইফতির নাম এলো। আমি পৃথিবীর একজন সফল ও গর্বিত মা হলাম।

আমার স্বামী রাশেদ প্রচুর মিষ্টি কিনে সবাইকে বিলিয়ে দিতে দিতে নিজের বংশের প্রদীপ ও নিজের বংশের গৌরব প্রচার করল আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের কাছে ছেলেকে নিয়ে।
ফোন দিয়ে দিয়ে সবাইকে শোনাচ্ছে। আমি শুনি আর হাসি।
কারণ আমি জানি একজন সন্তান যেমন জন্মগত ভাবে তার বাবার ডি এনএ পায় তেমনি সে মায়ের ডিএনএও পায়। কারওটা একটু বেশি কারওটা একটু কম পায়। অথচ যুগ যুগ ধরে পুরুষ শাসিত সমাজ তাদের ক্ষমতা ও মানসিকতার বিস্তারে যাপন করে আসতেছে সন্তানের গায়ে রক্ত তার।সন্তানের বংশ পরিচয় বাবার। আমি দেখি আর করুণা হয় তাবৎ পুরুষ সমাজের উপর। কোটি কোটি কোটি বছরের এ মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়ায় পুরুষ সমাজ নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে আসছে সন্তানের পরিচয়পত্রে। আর কিছু সত্যের নিদারুণ দহন প্রথিত করে রেখেছে আমাদের নারী জন্মের অভিতাপে!

যতই দিন যাচ্ছে আমি যেন আরও কিছুটা চুপচাপ হয়ে যাচ্ছি। বয়স চল্লিশের কাছে না পৌঁছাতেই কেমন যেন বুড়িয়ে যাচ্ছিলাম। বড়ো ছেলে ইফতি এইসএসসিতে নটরডেমে ভর্তি হলো। মেজো ছেলে ইনতি ক্লাস এইটে বৃত্তি দেবে ও ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। ইনতিও ইফতির মতো লেখাপড়ায় বেশ ভালো। লেখাপড়ার বিষয়ে নিজেরাই ওরা ভীষণ দায়িত্বশীল। শুধু মায়ের সঙ্গটা খুব করে চায় আমার সন্তানরা বরাবর।
ছোট মেয়ে মুনিরাকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর থেকেই লক্ষ্য করলাম সে খুব আঁকা আঁকি পছন্দ করে। ওর সাথে সাথে থেকে ওকে গাইড করতে করতে আমারও শুরু হলো আঁকাআঁকির এক নিজস্ব পাঠশালা।

শুরু হলো আমি ইলোরার এক নতুন দর্শন। এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে নিলাম আমি আমার জন্য । শুরু হলো আমি ইলোরার একেবারেই অন্যরকম এক নতুন পথচলা…….

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here