ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১৮

0
444

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব-১৮
_________🖌️নাজনীন নাহার
০৫.০৪.২০২২

আমার স্বামী আমাকে জব করতে দেবে না। আমি আমার জবে জয়েন করার বিষয়টি নিয়ে আমার স্বামীর সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে আমার স্বামী উত্তেজিত হয়ে গেলেন। আমি তার সাথে কথা শেষ করে রুমের লাইট অফ করে ঘুমুতে যাওয়ার মুহূর্তে সে এক রকম হুঙ্কার দিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে রুমের লাইটটা অন করে দিলো। তারপর তার মুখে যা আসল তাই আমাকে বলতে লাগল। আমি একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে বাচ্চাদেরকে পড়ানোর জন্য শিক্ষকতা করতে চাইলাম। আর এটাকে কেন্দ্র করে নারী জাতির ঠিকুজি উদ্ধার করতে থাকলো রাশেদ। নারী চরিত্রহীন, যারা জব করে তারা চরিত্রহীন, আমি চরিত্রহীন ইত্যাদি কী বীভৎস বিতণ্ডা!

আমি আমার স্বামী রাশেদের কথায় বিস্মিত হলেও নিজের মুখে কুলুপ এঁটে রাখলাম।
কারণ এই মানুষটার সাথে আমি প্রায় নয় দশ বছর সংসার করছি। আমি জানি সে জেতার জন্য কতটা নিচে নামতে পারে। কতটা নিচে নামতে পারে তার তথাকথিত পৌরষবোধ জাহির করার জন্য। আমার মতে এমন ধরনের নিচু ও নোংরা মানুষগুলোকে কখনও কখনও ওয়াকওভার দিয়ে দেয়া উত্তম। কারণ ওদের লেভেলের অতটা নিচুতে যাওয়ার রুচিবোধ সবসময় থাকে না অনেকের। থাকে না আমারও। অতটা নিচুতে নেমে জেতার তো প্রশ্নই আসে না।
দিন-রাত স্বামী সংসার করার পরে। সারাদিন বাচ্চাদের পেছনে নিরন্তর পরিশ্রম করার পারেও যদি সামান্য উনিশ বিশে স্বামীর মুখ থেকে এতো নোংরা কথা শুনতে হয়! তাহলে আর কী! সহজেই অনুমেয় যে এই হিতাহিত জ্ঞান বিবর্জিত পুরুষটা স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করবে না।

রাশেদের ভাষা প্রয়োগ ও আচরণই বলে দিচ্ছে ও ওর পৌরষবোধের বিকৃত শক্তি ও মননে আমার গায়ে হাত তুলতেই পারে। আমি কেন এই নোংরা লোকটার হাতে চড় থাপ্পর খাব! সে এবং আমি খুব ভালো করেই জানি। আমাদের মধ্যে অনেক কিছু হওয়ার পরেও সংসার আমরা করছি। অতীতেও অনেক খারাপ কথা ও আচরণ করার পরেও যেহেতু আমি তার সাথে সংসার করে যাচ্ছি। সে আমার গায়ে হাত তুললেও আমি তার সাথেই সংসার করব। হয়তোবা আমার গায়ে হাত তোলার পরে সে প্রথম দিকে কয়েকটি সরি বলে আমার শরীরে সুখ খুঁজতে আসবে। আর এক পর্যায়ে আমি তার সাথে আবারও সাতপাঁচ ভেবে দাম্পত্যের সব সুখ ভোগ ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করব। লজ্জা যেমন ওদের মতো কিছু পুরুষের নেই। তেমনি আমার মতো কিছু মেয়েরও নেই। ওরা যা তা আচরণ করে আবার আমাদেরকে আদর সোহাগে মাতিয়ে রাখে। আমরাও অধিকাংশ নারী ওদের যা তা আচরণ ও ওদের হাতের চড় থাপ্পর খেয়েও ওদের সংসার করি আর ওদের শরীর নেই! তাই আমিও ভেবে নিলাম।আমি যতদিন পারি ওর বিকৃতির ও উগ্রতার সাথে জবাব না দিয়ে অন্তত ওর হাতের মাইর খাওয়া থেকে বিরত থাকি।

বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। ওদের মুখ দু”টো খুব মনে পড়ল।আমার জীবনে সন্তানের প্রায়োরিটি প্রথমে। সব মিলিয়ে আমি আবারও একরকম হেরে গেলাম। চুপচাপ বসে বসে রাশেদের মুখে নারীদের চরিত্রহীনতার বয়ান শুনলাম। আমি নিজে আবারও আমার স্বামীর কাছে চরিত্রহীনের উপাধি পেলাম।

আমার এগুলোতে অভ্যাস হয়ে গেছে। অধিকাংশ মেয়েদেরই হয়ে যায়। অভ্যাসটা আমি করে নিয়েছি রাশেদকে চিনতে চিনতে। আমি আমার দাম্পত্যের এই জলঘোলা বীভৎস কাব্যের প্রতিটি শব্দের মানে বুঝি। বুঝি প্রতিটি আচরণের শানেনজুল। এই দশ বছরে আমি বুঝতে শিখে গেছি আমার নিজের সাধ্য, সামর্থ আর সীমাবদ্ধতাগুলো। আমি নিজেই আমার নারী জীবন ও মা জীবন থেকে বের হতে পারি না পুরোপুরি! আর কাকে কী বলব!

আমার শ্রাদ্ধ করতে করতে একসময় রাশেদ কিছুটা নিরব হলো। রাশেদ হয়তো মনে মনে এক ধরণের আত্মতৃপ্তি পেল যে ও আমাকে যা যা বাজে কথা বলল। যা যা ভয়ঙ্কর অপবাদ দিলো সব সঠিক। কারণ আমি ওর কথার এখন আর কোনো প্রতিবাদ করিনি।নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। তাই আমার নিরবতাকে নিজের বিজয় ও আত্মতৃপ্তি মনে করে বিজয়ীর বেশে লাইট অফ করে বাছানার একপাশে এসে শুয়ে পড়ল রাশেদ। আমি ইলোরা তার স্ত্রী যে তার প্রতি কতটা ঘৃণা আমার বুকের মধ্যে পুষে নিয়ে উচ্চারণে স্তব্ধ থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। তা আমার পুরুষ প্রিয়জন জানলোই না।

আমাদের সমাজের প্রায় সকল পুরুষই জানে না। তাদের সাথে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িত নারীরা তাদেরকে কতটা করুণা করে, কতটা ঘৃণা করে আর কতটা ভালোবাসার অভিনয় করে এবং সত্যি সত্যি কতটা ভালোবাসে! নিকট পুরুষদের কতৃক নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে ভুগে ভুগে অধিকাংশ নারীরা কতটা ভালোবাসার অভিনয় করে করে তাদের সাথে সংসারে ও শরীরে যাপন করে জীবন! এই তথাকথিত পুরুষগুলো যদি সত্যিকারের মানুষ হতো। তাহলে তারা পৃথিবীর বুকেই স্বর্গীয় সুখ ভোগ করতে পারত তাদের জীবন সঙ্গীনীর সাথে। আমার তো মনে হয় ওদেরকে ডেকে বলি! হে হিপোক্রেট পুরুষ তোমরা নিজেরাও জানো না তোমরা কতটা দুর্ভাগা জাতি! তোমরা কতটা পেয়ে হারাও তোমার প্রিয়জনকে।

পরেরদিন সকাল হলো। বাচ্চাদেরকে তৈরি করলাম আর আমিও তৈরি হলাম ওদেরকে নিয়ে স্কুলে যাবার জন্য। সাথে সাথে রাশেদ একরকম ছোঁ মেরে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেল স্কুলের উদ্দেশ্য। বুঝলাম আমাকে আর আপাতত কিছুদিন বাচ্চাদের স্কুলেও যেতে দেয়া হবে না। বিষয়টিতে প্রথমে একটু ধাক্কা খেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে বেশ রিলাক্স মুডে নিয়ে নিলাম। ভালোই হলো রাস্তায় বসে থেকে দেখুক কত আনন্দ লাগে জীবনে!

আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছি। রাতের সবকিছু ভুলিনি। তবে সেভাবে মনেও আনতে চাচ্ছি না।ওসব পরে দেখা যাবে। এখন এই ফ্রি সময়টাতে একটু শান্তিতে থাকি। বাসার সহকারী খালাকে নিয়ে ঝটপট বাসার সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। শ্রাবণ মাস চলছিল। এর মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি নামল। বাচ্চাদের জন্য মন কেমন করে উঠল। পরক্ষণেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো ওরা তো স্কুলে পৌঁছে গেছে এতোক্ষণে।এখন ক্লাসে আছে। সুতরাং বাচ্চারা নিরাপদেই আছে আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর মনে পড়লো রাশেদের কথা। আর সাথে সাথেই মনে বেশ ছেলেমানুষী আনন্দ খেলে গেল। বেশ হয়েছে! এবার রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিজো। দোকানের সামনে এক গাদা মানুষের ভীড়ে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে থেকে বুঝো চরিত্রহীনের মানে কী। বুঝো মজা!

সাথে সাথেই মনে শঙ্কা হলো!
আহ্! যদি রাশেদের জ্বর হয়! হোক।
জ্বর হলে নাকি পাপ কমে। তা ওর কিছু পাপ কমুক।আমিও তখন জ্বরে আক্রান্ত আমার স্বামীর সেবা করে কিছু পূণ্য কামিয়ে নেব। আচ্ছা ব্যভিচারি স্বামীর সেবা করলেও কী পূণ্য হয়! আল্লাহ তায়ালা কী অত্যাচারী স্বামীদের জন্য দুনিয়ায় তার স্ত্রীদের হাতে কোনো শাস্তির বিধান তুলে দেননি! আমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে। ও আচ্ছা মনে পড়ল আল্লাহ সকলের জন্যই ক্ষমা করতে বলেছেন।ধৈর্য ধরতে বলেছেন। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে পছন্দ করেন ও পুরষ্কৃত করেন। আচ্ছা সেটাই চেষ্টা করি। ধৈর্য ধরি সবকিছুর জন্য।

কী সব এলোমেলো ভাবনায় মন ভরে উঠেছে। গতরাতের অপমান মনে করে করে বুকের মধ্যে দহন মোচড় খেয়ে খেয়ে শ্রাবণের বৃষ্টির সাথে গলা মিলিয়ে কান্নাকাটির করার চেয়ে এলোমেলো ভাবনায় ডুবে থাকি।
হঠাৎ খুব গান গাইতে ইচ্ছে হলো আমার। আজকের এই আমিটার বাইরের বৃষ্টির ছন্দে মনটা কেমন আলুথালু হয়ে আছে। সাতাশ আটাশ বছর বয়সের একজন নারী আমি। তারুণ্যের শুরুতেই বিয়ে নামক সোনার নুপুর পরিয়ে দিয়ে স্বামী নামক সোনার খাঁচায় ভীষণ থিতু হয়ে আছি। সন্তান নামের মধুময় মায়ার শেকল আমার জীবনের পায়ে পরে আছি বেশ আয়েশ করেই।

আহা কী মানিনি আমি জীবনে! কী করিনি বাবা-মা, স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির সম্মানের জন্য! কী করছি না এই আমিটা আজ মা হয়ে আমার সন্তানদের জন্য! সবকিছু পরিবারের সকলের জন্য ঠিকঠাক পালন করে। এই আমিটা পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট বুকে নিয়ে মাঝে মাঝে জানলা খুলে নীল আকাশটা একটু দেখতে চাই। মেঘের সাদাকালো মল্লরে ক’ফোটা ভালোলাগার বৃষ্টি খুঁজি।
একটুখানি উড়ে উড়ে মিছে স্বপ্নের বায়না বুনি। আর সেই আমিই বায়না সমেত স্বপ্ন হারাই, নিজেকে হারাই।সব হারাই আমি নারী।আমি বেঁচে থাকি পরজীবি হয়ে। বেঁচে থাকি আমি এক সর্বংসহা যামিনী হয়ে!
আমাদের সময়ে এবং এখনও কয়টা পরিবার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে!
মেয়ে তুমি কী চাও! তোমার কী ভালো লাগে! তোমার কী মন্দ লাগে! তোমারও কী মন চায় ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশে ঘুড়ি উড়াতে। ওই যে শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টির মধ্যে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলছে তুমিও কী খেলবে মেয়ে!
মেয়ে তুমি মনোযোগে লেখাপড়া করো।তোমাকে দায়িত্ববান হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।ইনকাম করে বাবা-মাকে খাওয়ানো পরানোর দায়িত্ব নিতে হবে। শোনো মেয়ে তোমাকে সুন্দরভাবে তোমার ক্যারিয়ার গড়ে বিয়ে করতে হবে। প্রয়োজনে স্বামী সন্তানের দ্বায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। মেয়ে তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছ। তুমি মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠো। সকলকে সম্মান করো নিজেকেও সম্মানিত করো।

তা নয়!
মেয়েদেরকে আমরা শেখাতে থাকি। মা শ্বশুর বাড়ি যেতে হবে।মা তুমি মেয়ে নরম স্বভাবের হও। নমনীয় থাকো। পুতুল দিয়ে খেলো। মেনে নাও মানিয়ে নাও।মায়ের জাত তুমি। আমার তো মনে হয় মায়ের জাত পৃথিবীর সর্ব উৎকৃষ্ট জাত। সবচেয়ে শক্তিশালী জাত। আমরা এই বোধ এই চৈতন্য বুনে দিতে পারি না আমাদের নারী মস্তিষ্কে। এ আমাদেরই ব্যর্থতা।

আমাদের নারীদের ঘরে ঘরে হায়েনার ভয়।বাইরে হায়েনার ভয়।দিনে হায়েনার ভয়।রাতে হায়েনার ভয়। রাস্তা ঘাট, অফিস থেকে শুরু করে সর্বত্র হায়েনার ভয়। আর এই হায়েনা কে বা কারা বলুন তো! আরে ভাই এই হায়েনা আপনি নন! আপনি তো কত্ত ভালো মানুষ! আচ্ছা তবুও কেন এই হায়েনা জাত কেবলই পুরুষ!

নারীরও তো শরীর আছে। অঙ্গ প্রতঙ্গ আছে। ক্ষুধা তৃষ্ণা ও কামনা আছে। আছে দাঁত, নখ, চোখ, রাগ। তাহলে নারী কেন হায়েনা হয়ে বড়ো হয় না। একটু মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারব তা হলো। জন্ম শৈশব থেকেই ছেলে শিশুকে দৃঢ়তার শিক্ষা দেয়া হয়। মেয়ে শিশুকে ভয়ের বীজ বুনে দেয়া হয়।
চরিত্র যাবে, মান ইজ্জত যাবে মেয়েদের ও মেয়ের কারণে। এইগুলো থেকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদল করতে হবে। আমি ইলোরা একজন মা হয়ে প্যাঁচপ্যাঁচ করে কাঁদব আর বড়ো বড়ো দীর্ঘস্বাস ফেলব। কী শিখবে তাহলে আমার থেকে আমার সন্তান!

বাসায় হাত ভরে বাজার আনে বাবা, মুঠো ভরে টাকা দেয় বাবা। সকল বড়ো সিদ্ধান্তগুলো নেয় বাবা।উঁচু গলায় কথা বলে বাবা।কথায় কথায় ধমক দেয় বাবা।
আর!
আর সারাদিন রান্না ঘরে পরে থাকে মা। আস্তে কথা বলে মা। বাবার কাছে টাকার জন্য হাত পাতে মা। অবস্থানটা ঘর থেকেই মস্তিষ্কে গেঁথে নেয় মেয়ে ও ছেলে শিশুরা। তৈরি হতে থাকে সেই বৃত্তে চিন্তা, চেতনা আর জীবন বোধ।

যেই সকল মেয়েরা, মায়েরা ও স্ত্রীরা চাকুরি করছেন। তাদের জীবনের প্রহসনেও কী তেমন কোনো বড়ো পরিবর্তন হয়েছে দু’চারজন ছাড়া! স্ত্রীর টাকা নিয়ে কাড়াকাড়ি। কোনো না কোনো উছিলায় স্ত্রীর হাত টাকা শূন্য করতেই হবে অধিকাংশ পুরুষের। ছলে বলে কলে কৌশলে পেশাজীবি নারীদেরকে নানান প্রহসনে ফেলে মানসিক ভাবে বা চিন্তার জায়গায় পঙ্গু করে রাখতে হবে। নইলে যে স্ত্রীকে বাগে রাখা যাবে না! কী বীভৎস মানসিকতা!
আর আমি ইলেরা এমনিতেই কতটা নিঃস্ব! বাবা আছে, মা আছে, বাবার বাড়ি আছে কিন্তু অধিকার নেই। স্বামীর সংসার ছাড়লে সম্মানের স্বীকৃতি নেই। তাইতো আমি পারলাম না বাচ্চাদের নিয়ে রাশেদকে কিছু না বলে অমন গ্যাট গ্যাট করে বেরিয়ে যেতে!পারলাম না নিজের মতামতের প্রাধান্য দিয়ে চাকরিতে জয়েন করতে। হয়তো পারতাম।কিন্তু পরিনতি হতো আরও ভয়াবহ!
অনেকেই বলেন।আজকালকার অতিরিক্ত সংসার ভাঙার কারণ মেয়েদের স্বাবলম্বিতা। তার মানে কী অর্থনৈতিক পজিশন নারীর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একটা অন্যতম অনুষঙ্গ। আর এজন্যই আমাকে রাশেদ লেখাপড়া করতে দিলো না। আমাকে আমার স্বামী চাকরি করতে দেবে না। আমাদের সমাজের অধিকাংশ পুরুষরা নারীদের চাকরি করাটা মেনে নিতে পারে না। মেয়েদেরকে বিভিন্ন পন্থায় অর্থনৈতিক ভাবে শূন্য অবস্থানে রেখে দেয়।
তবুও আমি ইলোরার বিশ্বাস আজকে আমি না পারলেও আমি এই বিপ্লবের বীজ বুনেই যাব। আমি সময়ের মেরুদণ্ডে নারীর সম্মানের বোনমেরো প্রতিস্থাপন করেই যাব। করে যাব আমার প্রজ্ঞা, সহন, প্রেম ও দূরদর্শিতায়।আমিই হব পরিবর্তীত, পরিবর্ধিত, পরিশীলিত পরবর্তী প্রজন্মের সফল জননী। আপনিও হবেন। আপনি আমি আমাদের পেটের সন্তানদেরকে শিখিয়ে যাব মানুষ হতে, মানবিক হতে। শিখিয়ে যাব নারী শুধু নারী নয়। নারী একজন শক্তিশালী মা। নারী একজন পরিপূর্ণ মানুষ। এ আমাদের দায়িত্ব। এ আমাদের মানুষ জন্মের অধিকার ও কর্তব্য। আমাদেরকে পারতেই হবে। আমারা সকালেই পারব এ আমার বিশ্বাস।

সকাল প্রায় নয়টা বেজে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে বেশ ঘনো মেঘের আস্তর। অন্ধকারের আজ ভীষণ মন ভালো। তাইতো নিজের মতো করে ছেয়ে আছে পুরোটা শহর।
গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে হলো ভীষণ।
শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশিথ যামিনী রে…
কুঞ্জ পথে সখি কেয়সে যাওব অবলা কামিনী রে…..
শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা…….

আহা কী রবীন্দ্র সংগীত লিখে গেছেন কবি গুরু!
ছোটবেলায় মা’কে খুব শুনতে শুনেছি। গুনগুন করে আমিও খুব গাইতাম। মা নিজের শাড়িতে হাতে কুচি বুনতেন। তারপর চুলের ফিতার উপর সেই কুচি সমেত শাড়ি ছড়িয়ে দিয়ে আমার কোমরের সাইজে দুই থাক করে আমার কোমরে বেঁধে দিতেন। ঘাগড়ার আদলে পরা সেই শাড়িতে আমি ঘুরে ঘুরে নাচতাম। নাচতাম এই গানের সাথে বৃষ্টি হলে। মায়ের কেসেট প্লেয়ারে বাজতো কী ভীষণ মিঠে তরঙ্গের বাজনা আর সংগীত।
আরও নাচতাম প্রাইমারি স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতার অনুষ্ঠানে। মা সাজিয়ে দিতো পুতুলের মতো। কী সুন্দর ঘুঙুর কিনে দিয়েছিল মা। আমি পুরষ্কার নিয়ে ফিরতাম বড়ো বোনেদের সাথে। প্রজাপতি প্রজাপতি এই নজরুল গীতির সাথে একটা পুতুল মেয়ে হয়ে আমি নাচতাম। আহা কী জীবন কী হয়ে গেল! কেন আমি একজন পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে গেলাম! তখন কী জানতাম বড়ো হওয়ার আনন্দের চেয়েও বেদন কত বেশি! জানতাম না।তাইতো কেবল বড়ো হওয়ার বায়নায় পায়ের গোড়ালির উপর ভর দিয়ে মায়ের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতাম কতটা বড়ো হয়েছি আমি। তারপরে একদিন একে একে আমার মা বদলে গেলেন, বাবা বদলে গেলেন।আমার বাড়ি ঘর আর উঠোনের রোদের বদল হলো। আমি ইলোরা একজন পরজীবি নারী হয়ে গোঁড়ামি কুসংস্কারের বেড়াজালে জড়িয়ে গেলাম।

মনটা যতই চেষ্টা করছি খুব উৎফুল্ল রাখতে কিন্তু পারছি না। মিশ্র ভাবনায় ডুবে ডুবে দ্রুত হাতে রান্নার আয়োজন করতে লাগলাম।

খালাকে নিয়ে খিচুড়ি, মুরগির মাংস ভূনা করে রান্না করলাম।ইলিশ মাছ আর বেগুন ভাঁজলাম। রাশেদ এই আইটেমের বাইরেও খিচুড়ির সাথে আলু ভর্তা আর সালাদ খুব পছন্দ করে। ছেলে ও ছেলেদের বাবার পছন্দের সব খাবার রান্না করে খালাকে খেতে দিয়ে। সব খাবার হটপটে বেড়ে টেবিলে গুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে গেলাম। শাওয়ারের জলের শব্দে হু হু করে কান্না এলো আমার। কী একটা জীবন আমার! কেন জীবন এমন!
কেন বাবা-মা এমন একটা জীবনে আমাকে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দিল! আবারও সেই রবীন্দ্র সংগীতটা মাথায় এসে ভীড় করল। যেন আমার কথাই বলে গেছেন রবীন্দ্রনাথ।
শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা……

শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আলমারি থেকে দারুণ সুন্দর নীল রঙের একটা শাড়ি বের করলাম। নীল রঙের জলছাপ দেয়া আমার খুব পছন্দের শাড়িটা পরলাম। খুব ইচ্ছে হলো নিজের জন্য আজ শাড়ি পরি নিজেকে গোছাই। ভীষণ ফুরফুরে লাগছিল আমার।মনে মনে সিদ্ধান্ত তো নিয়েই নিয়েছি নাহ্ নো চাকরি।সংসারে শান্তি। ছেলেদেরকে মানুষ করি। নিজের মনের পৃথিবীটাকে বই আর মানুষ পড়ে পড়ে আরও বৃহৎ করি।
আমি আমার জীবনে একটা বিষয় বারংবার খেয়াল করেছি। যতক্ষণ কিছু চাই চাই চাই করে পাওয়ার পেছনে ছুটি। ততক্ষণ আমার অনেক কিছু থেকেও কেমন নাই নাই লাগে। কষ্ট লাগে। কান্না পায়। কিছুটা জেদ কাজ করে। রাগ লাগে।অপমান লাগে। আর যখন আমি আমার চাই চাই ধরনের দরকারি চাওয়াটাও ছেড়ে দেই। বাদ করে রেখে দেই আলমারির উপরে দূর থেকে কিছু ভালোলাগার জিনিস ছুঁড়ে ফেলে রেখে দেয়ার মতো। তখন একটা দারুণ মোহমুক্তির অনুভূতি হয়। ভীষণ একটা শান্তি শান্তি লাগে। নিজেকে বলি, আরে ভাই সবকিছু কী সবাই পায়! পেয়েও কী আমরা সবকিছু ধরে রাখতে পারি! চাইলেই কী সব পেয়ে যেতে হবে আমাদের! না তা নয়।
মনে পড়ে গেলো বিশ্ব অলিম্পিকে একশো মিটার দৌড়ের কথা। কত কত প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষায় পাস করে করে কতিপয় দেশের দৌড়বিদরা অংশগ্রহণ করে মূল প্রতিযোগিতায়। সকলেই জেতার স্বপ্ন নিয়ে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণ নেয়।পারফেক্ট টাইমিং থাকে তাদের। লক্ষ্য স্থীর থেকে। মাঠে নামে। এবং একসাথে এক সময়ে দৌড় শুরু করে। অথচ সবাইকে পেছনে ফেলে একজন বিজয়ীর মুকুট পরে। তার মানে কী! তার মানে হলো সবার জন্য সব নয়। কোনো এক অদৃশ্য বিধান বা নিয়তি আমাদেরকে এভাবেই বেঁধে ফেলে নানান বাহানায়।

আমিও তাই খুব সহজেই জীবনকে আলিঙ্গন করলাম জীবনের পরাবাস্তব নিয়মে। পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। মানিয়ে নেই নিজেকে। আমার ফ্যাসাদ করতে ভালো লাগে না। আমি জানি আমি কিছু একটা করবই। আমি এভাবে আসলাম, খেলাম আর সন্তান উৎপাদন করলাম এবং গরু ছাগল হাস মুরগির মতো চলে গেলাম তা নয়। তবে আমার চেষ্টা কোনো না কোনোভাবে অব্যাহত থাকবে। রাখতে হবে অব্যহত।একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে। আর একটা স্বপ্ন আমাকে ডেকে তুলবে তার নৌকায়। আমার বিশ্বাস আমাকে তুলবেই। কারণ আমি আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আমার নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে চলি।
তাইতো গতরাতের এতো ভয়াবহ পরিস্থিতি ও সকালে রাশেদের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ায় আমি বিচলিত হলাম না। বরং সময়টাকে উপলব্ধি করছি আপন আনন্দে।উপভোগ করছি আমি ইলোরার নিজস্ব ভালোলাগাময় নিজস্ব জীবন।

তাই আজ আমি আলমারি থেকে পাটভাঙা শাড়ি বের করে পরেছি। চুলে শ্যাম্পু করেছি। ফ্যান ছেড়ে চিরুনি করে চুলগুলো শুকিয়েছি। আমার বয়স সাতাস প্লাস। আমি একজন পরিপূর্ণ যৌবনা নারী। আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। গায়ের রং দুধে-আলতা। দুই সন্তানের জননী হয়েও আমি এখনও আমার ওজন ধরে রেখেছি ৬০ কিলোর মধ্যে। আমি বাইরে হিজাব পরে চলাফেরা করি। কিন্তু ঘর আমার নিজের স্বাধীন বিস্তারের জায়গা। আমি আজ নিজের জন্য পরিপাটি হলাম। মুখে ক্রিম, ঠোঁটে লিপজেল, চোখে অনেকদিন পরে হালকা করে কাজল টেনে নিলাম। পিঠ ছাড়িয়ে সিল্কি চুলগুলো নেমে গেছে প্রায় কোমর অব্দি। আমি নীল শাড়িতে আজ আবারও পৃথিবীর অপ্সরি হলাম আমার জন্য। গতরাতে রাশেদ আমাকে বলেছে এই বয়সে তুমি চাকরি করবা!

তার মানে আমার স্বামী রাশেদ আমাকে ফুরিয়ে যাওয়া গল্পে শামিল করে ফেলেছে। না আমি ফুরাইনি।আমি রাশেদের মিমির চেয়েও সবদিকে পরিপূর্ণ আছি। পৃথিবী না জানুক। নষ্ট মন ও নষ্ট দৃষ্টির স্বামী রাশেদ জানুক আমি এখনও পরিপূর্ণ আছি। আমি আয়নায় আমাকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। আমাকে খুব করে ভালোবাসলাম। আমি নিজের প্রতি আজ আবারও প্রেমে পড়লাম। আমার কাছে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র প্রেম আল্লাহর প্রেম ও নিজের প্রতি সঠিক প্রেম। আমি আজ আপন প্রণয়ের মাধুর্য উপভোগ করলাম। শ্রাবণের বৃষ্টিতে আবারও ধুয়ে নিলাম আমার না পাওয়ার গ্লানিগুলো।

কলিং বেলের শব্দে সংবিৎ ফিরল। খালা দরজা খুলে দিয়েছে। দুই ছেলেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। এ আমার অর্জন।এ আমার মাতৃত্বের বিজয়। আমি শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিলাম। দুই ছেলেকে গোসল করিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিলাম। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রাশেদকে ডেকে বললাম এটা এটা রান্না করেছি এসো খাবে। আমার ভাব ভঙ্গিমা দেখে রাশেদের রীতিমতো আতঙ্কিত চোখ মুখ! সে আমার আচরনে তাল পাচ্ছে না। আমি আসলে তাকে তাল পেতেও দিচ্ছি না। রাশেদ নিশ্চয়ই ভেবেছিল আমি আজকে কান্নাকাটি করব।মন খারাপ করে থাকব। আবারও হয়তো রাশেদের কাছে আমার চাকরির জন্য অনুনয়-বিনয় করব। কিন্তু তা না করে পুরোপুরি উল্টো মেজাজে আছি আমি। বিন্দাস শাড়ি পরে ঘুরছি।

আমার সাথে কথা বলল না রাশেদ। চুপচাপ এসে খাবার টেবিলে আমার সামনের চেয়ারে বসে খেয়ে উঠল। আড়চোখে আমাকে দেখছিল বার বার। এরপর সে রেডি হয়ে বাইরে চলে গেল। আমি খালাকে নিয়ে সব গুছিয়ে রেখে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে বই পড়তে পড়তে ভাতঘুমে ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতে বেশ দেরি করে বাসায় ফিরল রাশেদ। আমার সাথে কথা বলল না। আমিও বললাম না। সকালে বাচ্চাদের গুছিয়ে দিয়ে আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম। রাশেদ বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে চলে গেল। আমি আজকেও কেমন অন্যরকম ফুরফুরে মেজাজে সকালটা পার করলাম। কয়েকটি বছর পরে কিছু সময় নিজের ঘরের মধ্যে নিজেকে কাছে পাবার আনন্দটা উপভোগ করছিলাম। রান্না করে ঘরের কাজ গুছিয়ে। ফ্রেশ হয়ে আমি কিছুক্ষণ বই পড়লাম। বাচ্চারা ফিরে এলে বাচ্চাদের ফ্রেশ করে খাওয়াদাওয়া করিয়ে আমরাও খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম। আজকে আর রাশেদ বাইরে গেল না। আমার কাছে কেমন খটকা লাগল। কারণ রাশেদ বারবার ঘড়ি দেখছে আর এই রুম ওই রুম পায়চারি করছে। কেমন অস্থির একটা ভাব তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। একবার মনে হলো জিজ্ঞেস করি। আবার মনে হলো না বাবা! খামোখা প্যাঁচাল বাড়ানোর দরকার নেই।

বিকেল হয়ে গেছে। আমি আছরের নামাজ পড়ে চা বানিয়ে রাশেদকে দিলাম। বাচ্চারা তখনও ঘুমাচ্ছে। এমন সময় আমাদের বাসার কলিং বেলের শব্দ। আমি একটু চমকে উঠলাম! সাধারণত এমন সময় তো কেউ আমাদের বাসায় আসে না। আমি খালাকে দরজা খুলতে ডাকলাম। আর তখনই রাশেদ প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি আমার আব্বা আর মা বাসায় ঢুকছেন। আমি তাদেরকে দেখে যেন আসমান হাতে পেলাম। যতই নিজের বাবা-মায়ের উপর অভিমান থাকুক। তবুও বাবা-মা তো বাবা মা-ই। তাদের ছায়া দেখলেও পৃথিবীর প্রশান্তি অনুভূত হয়।

আমি এগিয়ে গিয়ে আব্বা মা’কে ছালাম করলাম। কেমন আছেন! হঠাৎ করে কোথা থেকে! সব খবর ঠিক আছে তো! আমার আব্বা মা কেউ কোনো কথা বললেন না। তাদের চোখেমুখে শ্রাবণের ঘনো মেঘ। ভীষণ মনখারাপ আর বিরক্তি তাদের চোখেমুখে। আমার বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠল! বড়ো কোনো খারাপ খবর নয় তো! তাদেরকে বসতে দিলাম।পানি দিলাম।মা আমার সাথে আমাদের আলাদা বেডরুমে গিয়ে বোরখা খুললেন। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম।
—– মা ভাইয়া ভাবিরা ভালো আছে তো! আপারা! নাদিরা!
—- সবাই ভালো আছে। আমরাও ভালো ছিলাম। তুমিই তো আমাদেরকে ভালো থাকতে দিলা না!
আমি চট করে মা’কে ছেড়ে দিয়ে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালাম।
—– কেন মা কী হয়েছে! কী করলাম আমি!
—-তা তুমিই জানো! তোমার আব্বা তো ভীষণ অপমানিত হয়েই ঢাকায় এলো আমাকে নিয়ে। রাশেদ খবর দিয়েছে আমাদেরকে। তুমি নাকি কী সব উল্টো পাল্টা বেলাল্লাপনা করতেছ এই বয়সে! তুমি নাকি চাকরি করবা। আবার বাইরের পুরুষ মানুষের সাথে তোমার নাকি কী সব খারাপ সম্পর্ক! রাশেদের দোকানের একজন কর্মচারীকে চিঠি লিখে দিয়ে পাঠিয়েছে তোমার আব্বার কাছে। জরুরি ঢাকায় এসে এর একটা বিহিত করতে বলেছে। সেজন্যই তো আমরা ঢাকায় এলাম। এমনিতেই তোমার আব্বার শরীরটা ভালো না। আর তুমি দুই দুইটা বাচ্চার মা হয়েও এতো সুখে থেকেও।এতো ভালো স্বামী সংসার পেয়েও আজকে এতো বড়ো জঘন্য কাজ করে বেড়াচ্ছ বাবা! আমাদের আর মান ইজ্জত রইলো না। তুমি কী একবার তোমার আব্বার মান ইজ্জতের কথাও চিন্তা করলা না মা!

আমার মাথায় কিছুই যেন ঢুকছিল না কিছুক্ষণ! এসব কী! এতোটা নিচে কী করে নামতে পারল রাশেদ! এ কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছে আমার প্রিয়তম স্বামী আমার উপর! কেন এতো ভালোবাসলাম এই মানুষটাকে! কেন! আমার তো পুরো পৃথিবীটাই এলোমেলো হয়ে গেল! আমি এখন কী করব! হায় আল্লাহ! তুমি এ আমায় আমার কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ! কীসের পরীক্ষা নিচ্ছ তুমি আমার! আমি আবারও একটা ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম। আমার মায়ের মুখের শেষের কথাগুলো গম গম শব্দে জড়িয়ে জড়িয়ে আমার কানে ঢুকছে। আমি তলিয়ে যেতে যেতে শুনলাম আমার নাম ধরে সেই ছোটবেলার মতো করে আব্বা ডাকছেন। ইলোরা! ইলোরা! আব্বার কণ্ঠে রাগ, জেদ ক্ষোভ! আমি সম্বিত ফিরে পাচ্ছি। এবার আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম আব্বার ডাক। ইলোরা! এদিকে আসো!

রাশেদ আব্বাকে থামানোর চেষ্টা করছে। আব্বাকে আগে খাবার খেয়ে নিতে বলছে। আব্বা খাবেন না। আমি এসে ডাইনিং এ আব্বার কাছাকাছি দাঁড়ালাম। রান্না ঘরের দরজার থেকে মাথা বের করে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে আমার সহকারি খালা। খালা আমাদের সবাইকে দেখছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা।একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। আব্বা এক রকম হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন!
—- তোমার এতো বড়ো আস্পর্ধা……

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here