ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১

0
2285

বিশ্ব নারী দিবসের আয়োজন
—————————————–

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ১

উফফ্ লাগছে তো!
ছাড়ো আমাকে।
রাশেদ আমার হাতটা ভেঙ্গে যাবে।
——-ভাঙুক!
তোর মতো নষ্ট মেয়ে মানুষের হাত গুড়িয়ে দিতে পারলেই সমাজ সংসারে শান্তি আসবে। তোর এত্ত বড়ো সাহস তুই যা খুশি তাই করবি। তোর লজ্জা করে না!
বিয়ে করেছিস সংসার করার জন্য। বাচ্চা পালার জন্য। না তা। তা ভালো লাগবে কেন!
সে ফ্যাশন ডিজাইনার হবে!
আমি তোকে বহুবার নিষেধ করেছি বহুবার!
তোর তা কানে যায় না । না!
আজকে তোর হাত আমি ভেঙ্গেই ফেলব। আমার নিষেধ থাকার পরেও তুই লুকিয়ে লুকিয়ে আঁকা আঁকি করে বেড়াচ্ছিস। ফেসবুকে পেইজ খুলে নিছিস! বাঃ কী খেলা শুরু করছিস তুই!
———-রাশেদ আমার হাতটা ছাড়ো প্লিজ। প্লিজ তুমি আমার এতো বড়ো ক্ষতি করো না। প্লিজ রাশেদ। আমি আমার সংসার, বাচ্চা সবকিছু সামলেই তো এই কাজটা করি। আমি তো তোমাদের কারও কোনো কিছুতে কমতি রাখিনি। উফফ রাশেদ! আমি ভীষণ ব্যথা পাচ্ছি। আহ্ ছাড়ো।
————আগে চিন্তা করিস নাই! তোর এই হাত দিয়ে তুই গোপনে গোপনে ছবি এঁকে কাহিনি করেছিস৷ তুই জানস না ছবি আঁকা হারাম!
————–আমি তো মানুষের ছবি আঁকিনি রাশেদ। জামা কাপড়, শাড়ি, ব্যাগ এগুলোর এঁকেছি। প্রতিবন্ধীদের জন্য সহজে পরিধান করার কাপড়ের ডিজাইন করেছি।
————বাঃ পরিধান! তুমি সাহিত্য মারাচ্ছ! নাটক সাজাচ্ছ। নিজের নাম বানাবা! সুনাম করবা! আমার উপর দিয়ে গিয়ে পৃথিবী জয় করবা!
————আহ্ রাশেদ ছাড়ো। আমি এসব কিছু চাইনি।এসব কিছুর জন্য করিনি। অবসরে আমার ভালোলাগা থেকে এগুলো করেছি।আমি ঘরে বসেই তো সবকিছু করি রাশেদ।
————-ঘরে বসে। না! তাহলে আজকের পত্রিকায় তোমার নামে বড়ো বড়ো খবর ছাপা হচ্ছে কেন! কেন তোমাকে এতো বড়ো অনুষ্ঠানে ডাকছে সবাই!
তুমি কী মনে করেছ!
আমি বুঝি না!
তুমি আমাকে জীবনভর ছোট করতে চেয়েছ। সব সময় শুদ্ধ করে কথা বলতে হবে। ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত বানাতে হলে কালচারাল বানাতে হবে। ছেলের হাতে গিটার তুলে দিতে হবে। মেয়েকে গান শেখাতে হবে। নাচ শেখাতে হবে। আমার বাসাটাই একটা জাতীয় শিল্পকলা বানিয়ে রেখেছ।
———-রাশেদ প্লিজ আগে আমার হাতটা ছাড়ো প্লিজ রাশেদ। আমার এমন কোনো ইনটেনশন নেই।
————নেই মানে!
আজকে তোমাকে সারা বাংলাদেশের মানুষ চেনে। ইলোরা রাশেদ!
নারী দিবস ২০২২ এর রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া নারী।সম্ভাবনার প্রতিক।ঘরে বসে বিশ্ব জয় করার নজির রাখলেন ইলোরা রাশেদ। খবরের শিরোনাম হয়ে গেলে তুমি।
বাঃ তুমি এখন সেলিব্রিটি! তোমার ছবি বিভিন্ন পত্রিকার পাতায়। টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায়! ন্যাকামো করো না! তুমি ন্যাকামো করো!
————–তুমি আমার হাতটা ছাড়ো। তারপর কথা বলো প্লিজ।
—————-তোর সাথে আমার কীসের কথা! আজকে তোর সেলিব্রিটিগিরি ছুটাচ্ছি আমি।
বলেই রাশেদ ইলোরার হাত ছেড়ে চুলের মুঠিতে ধরে ইলোরার গালে শক্ত করে একটা চড় বসিয়ে দিলো।

ভেতর ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার নয় বছরের ছোট মেয়েটা ভয়ে ফোপাঁচ্ছিল। ইলোরার বড়ো ছেলেটা পাবলিক মেডিকেলে পড়ে। সে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ছেলের মেধার যথাযথ প্রয়োগে আজ সে পাবলিক মেডিকেলের ছাত্র। ছোট ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাসার পাশের কোচিং সেন্টারে সে এখন ক্লাস করছে। একমাত্র মেয়ে সবার ছোট।ছেলেমেয়েরা এই যুগেও মায়ের তত্ত্বাবধানে থেকে বেশ গুছিয়ে মানুষ হচ্ছে।
ইলোরার হাসবেন্ড রাশেদ ব্যবসায়ী মানুষ। সারাক্ষণই প্রায় তার বাসার বাইরে কাজ আর ব্যস্ততা। নিজের খেয়াল খুশিতে চলা মানুষ সে। ইলোরা তার কাছে তেমন একটা সময় পায় না।কখনও কিছু বলতে গেলেই টাকা ইনকামের খোঁটা দিয়ে ইলোরাকে থামিয়ে দিতো এক সুক্ষ্ম অপমানে। ইলোরাও সেভাবে আর কথা বাড়াতো না। এইসএসসি পাশের সাথে সাথেই বিএ পাশ ব্যবসায়ী ছেলে রাশেদের সাথে তার বিয়ে হয়। মনের মধ্যে লেখাপড়ার তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্বেও আর পড়ালেখা হয়নি তার। বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান পেটে আসায় স্বামী, সংসার ও সন্তানকেই জীবনের সব মনে করে নিয়েছে সে।
সন্তানদের পড়াশোনার প্রাথমিক শিক্ষকতা করতে করতে আবারও ইলোরা পেন্সিল হাতে তুলে নেয়।
গত দু’বছর হলো বড়ো ছেলে ইলোরাকে ফেসবুক আইডি ও পেইজ খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে, ইউটিউব দেখে দেখে আঁকা আকিতে নিজের হাত পরিপক্ব করতে থাকে সে। বিভিন্ন ফ্যাশন ডিজাইনের পেইজে সে নিয়মিত পোস্ট করে। বিভিন্ন ফ্যাশন পেইজের প্রতিযোগীতায় অংগ্রহণ করে। বিভিন্ন অনলাইন পেইজে যুক্ত হয়ে আজ তার সৃষ্টিতে সে ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পেয়েছে পরিচিতি।এভাবেই ইলোরা তার ফ্যাশন ডিজাইন দিয়ে চারিদিকে সাড়া ফেলতে থাকে। এবার তার কিছু নতুন ধারার কাজ তাকে জাতীয় পদক পাইয়ে দিলো।প্রতিবন্ধী শিশু, কিশোর ও নারী পুরুষদের জন্য করা তার পোশাকের ডিজাইন ” সহজিয়া পরিধেয় ” রাষ্ট্রপতি পদক জয় করে।
ইলোরা সারাজীবন খুব অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে।স্বামী, সংসার সন্তান তার জীবনে ফাস্ট প্রায়োরিটি। সংসারের সব সামলে নিয়ে, গুছিয়ে নিয়ে সে তার ভালোলাগার একটা জগত তৈরি করে নিয়েছে।সে নিজেও বুঝতে পারেনি এতো তাড়াতাড়ি সে এভাবে সকলের সামনে চলে আসবে। এতো সাফল্য, এতো পরিচিতি হয়ে যাবে তার।
———-কী ভেবেছিস তুই! হাজি বাড়ির বউ হয়ে তোর বেলাল্লাপনায় পৃথিবী জয় করবি! তোর ছবি দেখে দেখে বিভিন্নজন আমাকে ফোন করছে।ফেসবুকে নক করছে। আম্মা বাড়ি থেকে আমাকে একটু আগে ফোন দিয়ে জানালো।আব্বা রাগারাগি করে বাড়িঘর মাথায় তুলছে। তার ছেলের বউয়ের ছবি খবরের কাগজে, টেলিভিশনে কেন! জবাব চায় তারা!
আমি আমার অফিসে কাজ ফেলে বাসায় এসেছি। আজকে আমি তোকে শেষ করে ফেলব মাগী।
ইলোরা ঝরঝর করে কাঁদছে আর বলছে।
——–বিশ্বাস করো আমি নিজে থেকে কাউকে নিজের কোনো ছবি দেইনি। ছেলেমেয়ে আর তোমার সাথে তোলা কিছু ছবি ফেসবুকের ওয়ালে ছিলো।সেখান থেকে সবাই নিয়েছে।
———-আবার মুখের উপর কথা বলছিস! আজকে তোর বাবা-মা বেঁচে থাকলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করতাম। কী অসভ্য মেয়ে পয়দা করছেন তারা এবার এসে দেখে যান। আমার আর আমার পরিবারের মান সম্মান সব নষ্ট করে দিলো। একটা নির্লজ্জ চরিত্রহীন মাইয়া মানুষ আমার ঘরে দিয়ে তোমার বাপ-মা তো কবরে গিয়ে আরামেশুয়ে আছে! হারামিগুলারে পাইলে…..
এবার ইলোরা নিজের শরীরের সকল শক্তি একাত্ম করে রাশেদকে জোরে একটা ধাক্কা দিলো। হঠাৎ অপ্রস্তুত ভাবে তাল সামলাতে না পেরে রাশেদ ইলোরার চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াল।
একদিকে ভয়ঙ্কর বীভৎস এক প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতায় রাগ ও ইগোর প্রতিহিংসায় অন্ধ রাশেদ ফুঁসছে। ফুঁসছে ইলোরাকে জব্দ করার জন্য।
অন্যদিকে নিজের জন্য বিচ্ছিরি সব অপমান সয়ে নেয়া ইলোরা নিজের মৃত বাবা-মায়ের অপমানের দহনে ফুঁসছে। ফুঁসছে নিজের চাইতেও নিজের বাবা-মায়ের অসম্মানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার যাতনায়।
অপরদিকে ফুঁসছে বুকের মধ্যে অনাকাঙ্খিত ভয়ের আতঙ্কে জবুথবু হয়ে ইলোরার ছোট্ট মেয়েটা।

আগামীকাল বিশ্ব নারী দিবস।সারা পৃথিবীতে নারীদের সম্মানে সাজবে কত কত মঞ্চ।জ্বলবে কত কত আলোকসজ্জার আলো। সেমিনার, সম্মাননা, বক্তৃতা, আলোচনা আর পদকে পদকে ভূষিত হবে কত কত নারী। নতুন নতুন অধিকারের বিল সম্বলিত বুকলেট সরবরাহ করা হবে এখানে সেখানে।
আর গৃহ অভ্যন্তরে, সম্পর্কের অভ্যন্তরে খুব ছোট ছোট কিছু অন্তরের ভালোলাগা যাপন করতে গিয়ে বীভৎস সব নির্যাতনের শিকার হবে নিয়মিত অগুনতি নারী। ঘাসের মতো, আগাছার মতো করে নারীকে তার খুব কাছের মানুষেরা পদদলিত করবে, নিগৃহীত করবে অনায়াসে।
ইলোরার ছোট্ট মেয়েটি মায়ের প্রতি তার বাবার অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে। পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট হয়ে কী বিকলাঙ্গ মানসিক অসুস্থতায় বেড়ে উঠবে এক বনসাই নারী রূপে!
নাকি ইলোরা, তার মেয়ে এবং নাম জানা অজানা হাজার, লক্ষ, কোটি নারীর জীবনে হলুদ, লাল ও সোনালু রঙের ফাগুন আসবে, বসন্ত খেলবে! ঘাসের মতো যেখানে সেখানে পদদলিত হওয়া নারীরা কী পারবে এই অপনাম ও অযাচিত সামাজিক, পারিবারিক ও সম্পর্কের মানসিক চাপ থেকে বেরিয়ে আসতে! পারবে কী নিজের সৃষ্টির আবর্তে নিজের নাম উজ্জ্বল দ্যুতিতে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিস্থাপন করতে ঘাস ফুলের বসন্ত আবীরে!
পারবে কী ঘাসেদের ফাগুন হয়ে আগুন রঙে ফুটতে!

আগামীকালের বিশ্ব নারী দিবসে কী ইলোরা ঠিক পৌঁছে যেতে পারবে তার মেয়ের হাত ধরে জাতীয় মঞ্চের দিকে।পারবে কী স্বামী, শ্বশুরের ঠুনকো অহমের বিপরীতে গিয়ে নিজের সৃষ্টির স্বীকৃতি স্বরুপ পাওয়া সম্মাননা পদক নিতে!

(চলবে)

ঘাসেদের ফাগুন _পর্ব-১
_______🖌️নাজনীন নাহার
০৪.০৩.২০২২

বিঃদ্রঃ পাঠকের আগ্রহ থাকলে লেখা চলমান থাকবে ইনশাআল্লা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here