উপন্যাসঃ ঘাসেদের ফাগুন _পর্ব-২
__________🖌️নাজনীন নাহার
০৬.০৩.২০২২
আমি ইলোরা রাশেদ। আমি কীভাবে ইলোরা থেকে ইলোরা রাশেদ হলাম সেই গল্প অন্যদিন বলব। আজ আমার বর্তমান সময়ের কিছু কথা শুনুন আর বলুন আজ আমি কেন সামান্য কারণে নিগৃহীত! কেন আমি ধর্মের নামে বলি হব আজ! কেন হব অমানুষ কিছু মস্তিষ্কের প্রহসনে নতজানু ও অত্যাচারিত! আমি তো কারও কোনো ক্ষতি করিনি।কারও মাথায় বাড়ি দেইনি। সমাজে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করিনি। কারও অধিকার হরণ করিনি। তাহলে কেন শুধু সংসারের আর ধর্মের দোহাই দিয়ে, পরিবারের সম্মানের দোহাই দিয়ে। ইগোর উত্থান পতনের যাতনায় আমি নিপীড়িত হব বারংবার! কেন ঘর, সংসার, সন্তান, স্বামী, আত্মীয় পরিজন সামলে নিয়ে আমি নিজের জন্য, নিজের ভালোলাগার জন্য একটি মনের জানালা খুলে নিলাম বলে আজকে এতো কঠিন হয়ে গেলো আমার ভালোবাসার স্বামীটা! কী সমস্যা! কার ভয়ে! কীসের ভয়ে আমাকে আজ আমার স্বামী বাইরের পরিবেশে মিশতে দিতে, চলতে দিতে এতো আপত্তি করে! কেন যেই হাতে দীর্ঘ তেইশটি বছর আমি স্বামী সংসার সন্তানের যত্ন করেছি।সেই হাতে আজ রং পেন্সিল তুলে নিয়েছি বলে আমার হাতটা প্রিয়তম স্বামী ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায়!
কেউ কেউ হয়তো বলবেন এগুলো সেকেলে কথা। এগুলো বানিয়ে বলছি। এসব সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য করছি। আজকাল আবার এসব হয় নাকি! আজকাল মেয়েদেরকে এতো সব রেস্ট্রিকশনে রাখে নাকি কেউ!মেয়েরা এখন অনেক স্বাধীন অনেক মুক্ত।
জি প্রিয়জন আপনাদের কথাও ঠিক। অনেক মেয়েই বর্তমানে অনেক স্বাধীন, অনেক মুক্ত।
তবে আমি নই। আমাকে অনেক রেস্ট্রিকশনে থাকতে হয়। অনেক অযাচিত বিধিনিষেধ আমি সহ অনেক অনেক মেয়েকে ভোগ করতে হয় এখনও প্রতিনিয়ত।
এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগে শিক্ষারত আমাদেরই মেধাবী কন্যাকে নিছক সন্দেহের রোগে ভোগা প্রিয়তম স্বামীর হাতে নির্মম ভাবে খুন হতে হয়।
নেহায়েত কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে প্রায় মাঝ বয়সী এক স্বনামধন্য নারী অভিনেত্রীকে তারই সন্তানের পিতা এবং তার ভালোবাসার স্বামী শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরকম হাজারো নির্মমতার শিকার অগুনতি নারী আমাদের বহু বহু সুখী দাম্পত্যের অন্তরালে।
আপনারা কী জানেন! অনেক অনেক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করে তার প্রিয় স্বামীটি একটি একটি করে মেয়েটির ওড়ার ডানা কেটে দেয়। ভালোবাসা ও অতি যত্ন আত্তির নামে গৃহবন্দী করে রাখে। সমাজের নোংরামির ভয় দেখিয়ে সমাজ থেকে গুটিয়ে থাকতে বাধ্য করে। নানান ছলে বলে কলে কৌশলে এগুলো করে যাচ্ছে বহু বহু জনার প্রিয়তম স্বামীটি। কেউ কেউ আবার শুরু থেকেই এসব যাচ্ছে নির্লজ্জ কিছু শাসনে ও শোষণে।
আমরা অনেকেই ভুক্তভোগী। আমরা অনেকেই নিগৃহীত। আমাদের অনেক নারীকে স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকেরা দমিয়ে রাখতে চায়। উঠতে বসতে কথা শোনায়। সারাটাদিন ও রাতের একটা বড়ো অংশ আমরা আমাদের স্বামী, সংসার ও সন্তানকে দেয়ার পরও আমাদেরকে শুনতে হয় সারাদিন তুমি কী করো!
রান্না, সন্তান লালনপালন ও ঘরের প্রতিটি কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার পরেও আমাদেরকে শুনতে হয় সারাদিন তো তুমি বাড়িতেই বসে থাকো। তুমি কী বুঝবে।
আমাদেরকে কেন মানুষ মনে করা হয় না! কেন একটি বস্তু বা দ্রব্য মনে করে অধিকাংশ!
আচ্ছা আল্লাহ বেহেশতে পুরুষদেরকে তাদের দুনিয়ার নেক কাজের পুরষ্কার হিসেবে শরাব আর একাধিক হুর ( নারী) দেবে বলে কী ধার্মিকজনরাও নারীকে বস্তু ও দ্রব্য মনে করে!
আমি তো জানি শুধু মুসলিম ধর্মের বেলাতেই এমনটি নয়। অনান্য ধর্মেও নারীদেরকে ভোগ্যপণ্য হিসেবেই দেখা হয়েছে, রাখা হয়েছে সেবাদাসী হিসেবে। কোনো কোনো ধর্মে বর্জন করা হয়েছে মোহ নামে নারীর নেশাকে স্রেফ বস্তু বানিয়েই অনেকটা।
আসলে কোথায় নারীর অবস্থান!
এসব তো একদিনে তৈরি হয়নি!
তাহলে একটি মাত্র নারী দিবসে কেমন করে এতো সব কিছুর বিহিত হয়ে যাবে!
কেউ কেউ আমার প্রিয় মা ও বোনেরা হয়তো আবারও বলবেন এখন যুগ বদলে গেছে।বদলে গেছে তা ঠিক। তবে ক’জনার জন্য!
এখনও কেন চরিত্র বলতে নারীর সম্ভ্রমকে বোঝানো হয়।
পুরুষ চরিত্র বলতে তার সুদ, ঘুষ, দুর্নিতি, খুন খারাবিকে হয়তোবা টেনে আনে কখনও সখনও।
এখনও কেন এই উত্তর আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে একজন ধর্ষককে নয় ধর্ষিতাকে চরিত্রহীন আখ্যা দেয় জাতি!
প্রিয় মা প্রিয় বোন আমার। আপনি হয়তো মুক্ত আছেন।আপনি হয়তো স্বাধীন আছেন। আপনি হয়তো আপনার অনুকূলে আপনার পরিবার, স্বামী ও সন্তানকে পেয়েছেন। তাই হয়তো আমার কথাগুলো আপনার কাছে অযৌক্তিক লাগতেও পারে। লাগুক তারপরও আমি বলব।কারণ আমি ভিকটিম। আমি আপনার মতো পরিবার ও পরিবেশ পাইনি।আমি পাচ্ছি না। আমার স্বামী চায় আমি কেবল তার মতো করে পৃথিবী দেখি। আমাকে সে অনেক বেশি ভালেবাসে। আমি তার পছন্দের রঙের ভালো ভালো পোশাক পরি। আমাকে সে খুব ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছে। চমৎকার সব সুখ সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। আদর মায়া সব দিচ্ছে।তবে তা তার মর্জিতে। আমি তাই মেনে নিয়েছি। আমি আজ তেইশ বছর যাবত তার মতে থেকে থেকে তাকে ও তার পরিবারকে ভালোবেসে সংসার করছি। কারণ পরিবারটা আমারও। সেও আমার। তাহলে আমি কেন আমার নিজের একটা ছোট্ট ভালোলাগার কাজ করতে পারব না!
কেন আমার এতো ভালোবাসার মানুষটা আমার ফ্যাশন ডিজাইনিং এর মতো এই সাধারণ একটা কাজ এবং এর সাফল্য মেনে নিতে পারছে না।
সে আসলে কাকে ভয় পাচ্ছে!
আমার খ্যাতি নাকি সমাজ!
ধর্ম নাকি পরকাল!
বর্তমান নাকি ভবিষ্যত!
আমার স্বাধীনতা নাকি তার মতের বিরোধিতা!
নাকি বাইরের জগতের পুরুষদের কাছে আমি নারীর অনিরাপত্তা!
কেন তাহলে একজন নারী বাইরে পুরুষদের কাছে অনিরাপদ! কেন নানান ভাবে নারীদেরকে ফুসলিয়ে কিছু পুরুষ ফায়দা লুটে!
কেন আজ পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া আমার একটা দু’টো ছবিকে টেনে আনছে আমার স্বামী ও শ্বশুর ধর্মের নামে!সম্মানের নামে!
কেন আমাকে তারা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন অপরাধীর কাঠগড়ায়!
আচ্ছা আমরা নারীরা নিজেরাই কী পেরেছি এই তথাকথিত বদনামের চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে! পেরেছি কী ঠিকঠাক এই ভয় তাড়াতে আমাদের মন থেকে!
পেরেছেন কী আমার শ্বাশুড়ি! যিনি একজন নারী এবং একজন কন্যা সন্তানের জননী। আমরা তো কখনও সময় এক একজন নারীর কাছেও নিরাপদ সম্পর্ক পাচ্ছি না।
কেন আমার স্বামীটি, আপনার ভাইটি, তার ওর বাবাটি ঘরে স্ত্রী রেখেও পরনারীর প্রতি আসক্ত হয়!
এটা প্রেম না প্রহসন!
নাকি নারীত্বের প্রতি অসম্মান!
মন বদলের এই নেশায়ও ঘরে বাইরে নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী। আর আমরা কিছু নারীরাও তথাকথিত অধিকাংশ পুরুষদের মনবদলের নেশার সরঞ্জাম হয়েই ব্যবহৃত হয়েই যাচ্ছি দিনের পর দিন। আমাদের কারও কারও কারণেই এগুলো সহজ হচ্ছে।
তাইতো আমরা যারা শুধু কাজের জন্য নিজেকে বির্হিমুখী করতে চাচ্ছি তারা বিভিন্ন অপবাদের ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছি। চাপের মধ্যে পড়ছি পরিবার থেকে।
আমাকে আপনাকে কেন শুধু নিজের একটু ভালোলাগা। নিজের কিছু সৃজনশীল কাজ করার জন্য স্বামীর সাথে যুদ্ধ করতে হবে! এতো সামান্য কারণে কেন সংসার ছাড়তে হবে! কেন বিয়ের পঁচিশ, ত্রিশ, চল্লিশ কিংবা আরও বেশি বছর একসাথে সংসার করার পরও স্বামীরা আমাকে আপনাকে নতুন করে শর্ত দেবে সংসার করার।বলবে আমার মতে চলতে না পারলে নিজের পথ দেখো।কিংবা তুমি এসব ফালতু কাজ করতে চাইলে তোমাকে সংসার ছাড়াতে হবে। এতো কেন তুচ্ছ মনে করে কেউ কেউ সংসার জীবন! কেন নারীকেই পরাশ্রয়ী গাছের মতো জীবন কাটাতে হয়!
একজন নারীর জীবন যে কখনও কখনও কতটা ঠুনকো হয়ে যায়।হয়ে যায় দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনও অতি ঠুনকো কারণে ও শব্দে নিরুত্তাপ! হয়ে যায় চিরদিনের তরে বিচ্ছিন্ন তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানি।
একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটি সত্যি। ঘটনাটি একটি নারী জীবনের। ঘটনাটি আমি আমার মায়ের কাছে বহুবার শুনেছি। ঘটনাটি শুনে দেখুন বৃটিশ আমলের নারী জীবনের সাথে এই উত্তর আধুনিক যুগের নারী জীবনের অসহায়ত্বের মধ্যে আদৌ কতটুকু পার্থক্য হয়েছে। নারীরা কিছু পুরুষের আধিপত্যের কাছে এখনও কতটা নিগৃহীত ও অসহায়!
ঘটনাটি আমার এক দূর সম্পর্কের দাদির জীবনের। দাদিকে নাকি অতি বৃদ্ধ বয়সে তার হাসবেন্ড মানে দাদা তালাক দিয়েছিলেন। সেই দাদা বেশ স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন তখনকার তার সমাজের। তার কোনো এক শত্রু পক্ষের লোক বন্ধু সেজে দিনের পর দিন সেই দাদাকে ফুসলিয়ে বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করেয়েছিলেন এক তরুণীকে। দাদা যথারীতি বিয়ে করে তার নতুন বউ নিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করার সময়। আমার সেই দাদি তাকে বাঁধা দিয়ে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিছুতেই নতুন বউ নিয়ে দাদাকে ঘরে ঢুকতে দিবেন না। দাদির নাতি পুতিরাও কেউ কেউ তখন বিবাহিত। দাদির এতোদিনের সংসার। এই ঘর, সংসার, স্বামী তার অধিকার। তাই দাদি দৃঢ় তার অধিকার রক্ষায়। দাদির এই কঠিন মূর্তি দেখে দাদা তখন তার পৌরুষত্ব জাহির করতে গিয়ে দাদিকে এক এক করে তিন তালাক দিয়ে দেন সকল মানুষের সামনে।সাথে সাথে আমার সেই দাদি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। দাদা তার এতো দিনের সঙ্গী স্ত্রীকে ওইরকম অবস্থায় ফেলে নতুন স্ত্রীকে………….
(চলবে)