ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ৭

0
320

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব-৭
__________🖌️নাজনীন নাহার
১৬.০৩.২০২২

লোকটি তার হাত বাড়িয়ে আমার ঘোমটা দেয়া মুখের কাপড়টি সরাতে চাইলেন। কারণ আমি তার বিয়ে করা স্ত্রী।
রাত এখন এগারোটা বাজে। পুরো বাড়িটা একটা নির্জনতায় ছেয়ে আছে। অনান্য দিনের চাইতে আজ যেন একটু বেশি নির্জন। আব্বা খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আব্বা রেগুলার প্রায় রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ নিয়ম করে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য জেগে উঠেন। আমি রাত জেগে পরীক্ষার পড়া পড়তাম। মাঝে মাঝে আব্বা তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠলে আমি ঘুমাতে যেতাম। আজকেও আব্বা নিজের ঘুমের নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম করেননি। মা বড়ো আপার সাথে নিচু গলায় কথা বলছেন খাবারের ঘরে বসে। হ্যারিকেনের আলোয় পুরো বাড়িটা কেমন ঝিমাচ্ছে।
বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে। যিনি আমার স্বামী।বিয়েটা আজকেই আমার হয়েছে। যদিও বিয়েটা আমার বাবা আমার মতামত না নিয়ে না জানিয়ে কাবিন রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে নিজেই সম্পন্ন করে এসেছেন। আমার সেই বিয়ের স্বামী এখন আমার রুমে।
আসলে বাবা মা আমার সাথে আমার এইসএসসি পরীক্ষার পূর্বে এই বিয়ে নিয়ে কথা বলেছিলেন। আলোচনা করেছিলেন। আমি বাবা-মাকে বিয়ের বিষয়টিতে অমত করলাম। বাবা মানলেন না।তিনি আমাকে এখনই বিয়ে দেবেন।
আমি বাবা-মাকে খুব অনুনয় বিনয় করে কেঁদে কেটে বুঝিয়েছি, বলেছি। প্লিজ আব্বা প্লিজ মা আমি এখন বিয়ে করবো না। আমাকে এখন বিয়ে দিয়েন না প্লিজ। আমি পড়াশোনা করব। আমি তো ডাক্তারি পড়ব। আপনারা তো জানেন।আপনারাই তো আমাকে ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
বাবা আমাকে সাফ জানিয়ে দিলেন তোমার কথায় কী সব হবে! আমরা তোমার অভিভাবক। আমরা বুঝবো তোমার জন্য কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। আর তাছাড়া মেয়েদের এতো কিছু বুঝতে হয় না।আব্বা আমার সাথে বিষয়টি নিয়ে ভীষণ রাগ দেখালেন। আমি কান্না করলাম।কিন্তু কোনোভাবেই আব্বা আমার সাথে আর বিয়ের বিষয়ে কথা বললেন না।

এক পর্যায়ে আমি মা’কে আলাদা করে অনেক রিকুয়েষ্ট করলাম।অনেক বুঝালাম এবং অনেক কাঁদলাম। কয়েকদিন পরে মা আমাকে কথা দিলেন। ঠিক আছে তোমাকে বিয়ে দিব না এখন। তুমি পড়াশোনা করো। এরপর আমি ভালোভাবে পরীক্ষা শেষ করলাম। আর পরীক্ষা শেষ করার প্রায় সাথে সাথেই আমার সাথে এই ঘটনা। মানে আব্বা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন আমাকে না জানিয়ে। আমার আব্বা এমন ছিলেন না।কিন্তু আব্বা হঠাৎ মাত্র কয়েক বছরে অনেক বেশি বদলে গেলেন তার ধ্যান ধারণা ও চিন্তা ভাবনায়। আমি পরবর্তীতে বলবো সে কথাগুলো। কবে থেকে আমার আধুনিক চিন্তা ভাবনার আব্বা কেমন সেকেলে মানসিকতার হয়ে গেলেন।

রাত বেড়ে এগারোটার ঘড়ির কাঁটা বারোটার দিকে ছুটছে। আমার স্বামী নামক মানুষটি এখন আমার রুমে। এটাকে বাসর রাত বলে নাকি প্রি-বাসর রাত বলে আমার জানা নেই। কারণ মা বলেছেন আমার স্বামী আজ আমাদের বাসায় থাকবেন না। আমার সাথে একটু দেখা করে চলে যাবেন। আসলে কোনোদিন আমার মা বাবা ও মুরব্বি কিংবা কোনো আলেম ওলামাগণকে জিজ্ঞেস করা হয়নি এটাকে কী রাত বলে!

যাই হোক নিয়তি আমাকে বিয়ে দিয়ে আমার স্বামীর সামনে বসিয়ে দিল। লোকটি আমার কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার মুখের ঘোমটাটা সরাতে চাইল। আমি একটু নড়েচড়ে সরে বসলাম। তখনও আমার চোখ থেকে নিরবে পানি ঝরছে। এবার তিনি আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।
———- তোমার নাম কী?
আমার খুব ইচ্ছে হলো মাথার ঘোমটাটা ফেলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি। আপনি মিয়া আমার নাম না জেনেই আমাকে বিয়ে করে ফেললেন!
তখনই মনে পড়লো আমিও তো তার নাম জানি না। কিন্তু মায়ের কথাগুলো মনে করে আমি চুপচাপ বসে রইলাম। মা বলেছেন। কোনো বাড়াবাড়ি করো না। তোমার বাবার মান সম্মান। তাই আমি আর কিছু বললাম না।
এবার তিনি আমাকে বললেন।
———– তোমার মুখের ঘোমটাটা একটু সরাও তো।আমি তোমাকে একটু দেখতে এসেছি। রাত বাড়ছে আমাকে চলে যেতে হবে। বাইরের ঘরে ছোট ভাই আর খালাতো ভাই বসে আছে।
আমি তারপরও শক্ত হয়ে বসে রইলাম। তিনি তখন আমার আরও একটু কাছে এসে আমার ডান হাতটা ধরলেন বেশ অধিকার নিয়ে। আমি কিছুই বললাম না আর। কী বলব! মনে হলো আমার শরীরটা অসার হয়ে আসছে। আমার বোধহয় মৃত্যু হচ্ছে। আমি খুব শব্দ করে কেঁদে ফেললাম।
তিনি সাথে সাথে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমার কেমন ভয় লাগল। আমার স্বামীকে নয়। আমার বাবা-মা’কে।কারণ আমার স্বামী নামের লোকটি যদি আমার বাবা-মাকে কিছু বলে দেয় আমার বিরুদ্ধে!
হঠাৎ তার কণ্ঠ ভেসে এলো। তিনি বললেন।
——- আমি বুঝতে পেরেছি তুমি লজ্জা পাচ্ছ। ঠিক আছে তুমি থাকো। আমি যাই। শুধু একটা কথা শুনে রাখো। আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি ইলোরা। খুব বেশি পছন্দের মানুষ তুমি আমার। প্রথম দেখাতেই আমি তোমাকে আপন করে নিয়েছি। আমাকে হয়তো তোমার পছন্দ হবে না।তবে জেনে রেখো আল্লাহর হুকুম ছাড়া বিয়ে হয় না। আমাদের বিয়েটাও আল্লাহর হুকুমেই হয়েছে। তুমি আমাকে ভালোবাসবে কিনা আমি জানি না।তবে আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবেসেই বিয়ে করেছি। তুমি আমার স্ত্রী। তুমি আমার ভালোবাসা। তুমি আমার দায়িত্ব। তুমি কেঁদো না। তুমি কাঁদলে আমার ভালো লাগবে না। তুমি কান্না থামাও ইলোরা। আমি এখন যাই তাহলে।

সাথে সাথে আমার কী যেন হয়ে গেল জানি না। আমি আমার মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার মনে হলো ইনি নিশ্চয়ই আমার খুব আপন কেউ হবে। আমার আজকের দুঃখের দিনে তিনিই তো সবচেয়ে মায়া দিয়ে কথা বললেন আমার সাথে। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া মানুষটা যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। বাঁচতে চায় ভেসে উঠা কুমিরের পিঠে আশ্রয় নিয়েও। আমি তেমনি এই মানুষটাকে আমার শেষ ভরসা মনে করলাম।
নিজের ওড়নার আঁচলে চোখের পানি মুছতে মুছতে তাকে সালাম দিলাম। আর বললাম।
————আপনি আমাকে লেখাপড়া করাবেন? জানেন আমি আরও লেখাপড়া করতে চাই। আমি ডাক্তার হতে চাই।
————তাই বুঝি! বাঃ বেশ তো। আমি তো তাহলে একটা ডাক্তার বউ পাব। তোমার মতো পরী বউটা যদি ডাক্তার হয়।তাহলে তো তোমাকে দেখেই অর্ধেক রুগীর অসুখ ভালো হয়ে যাবে। হাসি হাসি মুখে তিনি কথাগুলো বললেন। হাসি মানুষের সবচেয়ে সুন্দর সৌন্দর্য। মানুষটাকে আমার কেমন আরও আপন মনে হলো।
আমি তার কথায় কোনো লজ্জা পেলাম না। আমার মাথায় কেবল আমার স্বপ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমার পড়াশোনাটা হবে তাহলে। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে। আমি সত্যি সত্যি ডাক্তার হতে পারব। এতো সহজে যে একটা অপরিচিত মানুষ আমার সব আবদার মেনে নেবে তা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি। যেখানে নিজের বাবা-মা পৃথিবীর সবচেয়ে আপন হয়েও আমার সবকিছু শেষ করে দিলেন।সেখানে এই মানুষটা দূরের হয়েও কেমন আমার আপন হয়ে গেল।
এবার আমি বেশ ভালো করে তার দিকে তাকালাম। তিনি দেখতে মোটামুটি ভালো। তবে তাকে স্বামী কম একজন টিচারের মতো লাগল। প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় ল্যাব শেষে ভালো নাম্বার পাওয়ার আশায় যেভাবে কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকতাম অসহায় মুখে টিচারের সামনে। আমি আমার প্রথম দেখা স্বামীর দিকে তাকিয়ে প্রায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।

বুঝলাম আমার চেয়ে বয়সে সে বেশ বড়ো। কত বছরের বড়ো হবে তা ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার বড়ো ভাইয়ার চেয়ে বড়ো তা বুঝতে পারছিলাম। বড়ো ভাইয়া তখন খুলনাতে আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এম এ পাশ করে বেকার হয়ে ঘুরছিলেন চাকরির পেছনে।

আমার এইসএসসি পরীক্ষার আগে বড়ো ভাইয়া বাড়ি এসেছিল। আব্বা তাকে আমার বিয়ের কথা কিচ্ছু বলেনি। ভাইয়া যেদিন চলে যাচ্ছিল। আমি সেদিন ভাইয়ার রুমে গিয়ে খুব করে বলেছিলাম।
———-ভাইয়া আব্বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। আপনি আব্বাকে নিষেধ করেন।
———–আরে নাহ্!
কেন বিয়ে দেবে! কয়েকদিন পরে তোর পরীক্ষা। ভালো করে পড়ালেখা কর।
———–ভাইয়া আমার অনেক ভয় করছে। আব্বা যদি সত্যি বড়ো আপা আর মেজো আপার মতো আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়!
———-দূর পাগলী! আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তুই ভালোভাবে পরীক্ষাটা দে। রেজাল্ট এর পরে আমি তোকে আমার কাছে নিয়ে যাব।
আমারও খুব বিশ্বাস হয়েছিল ভাইয়ার কথাগুলো।
কিন্তু আজকে সব মিথ্যে হয়ে গেল। মিথ্যে হয়ে গেল ভাইয়ার দেয়া কথা ও মায়ের দেয়া কথা। আমি এখন বিবাহিতা হয়ে গেলাম। আজকে আবার আমার এই অপরিচিত স্বামী পুরুষকে বিশ্বাস করতে লাগলাম। তার কাছে ওয়াদা চাইলাম। তিনি আরও একটু আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন। তুমি যা চাও তাই হবে। তুমি আমার স্ত্রী। তোমার সব রকম খুশির খেয়াল তো আমাকেই রাখতে হবে। কই দেখি! এবার একটু হাসো তো!
আমি কেমন তাকে বিশ্বাস করলাম। আমি কেমন তাকে খুব আপন মানুষ মনে করতে লাগলাম। তিনি আমার হাত দু’খানা ধরলেন আরও কিছু হয়তো বলবেন বলে। ঠিক তখনই আমার দরজায় টোকা দিয়ে ডেকে উঠলেন আমার বড়ো আপা।
———-ইলোরা! জামাইকে নিয়ে খেতে আসো।অনেক রাত হয়েছে।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here