ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ৯

0
299

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব -৯
_________🖌️নাজনীন নাহার
২০.০৩.২০২২

সদ্য বিবাহিত আমি। আমার স্বামী আমাকে চিঠি পাঠিয়েছে। তার উত্তরে আমি তাকে আমার প্রথম চিঠিটি লিখছি। যদিও তার সাথে আমার বিয়ে রেজিষ্ট্রির পরে মাত্র একবার বিশ মিনিটের মতো এক ঝলক দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে গোটা কয়েক। তাতেই তাকে আমার কিছুটা আপন লাগতে শুরু করেছে। এক হলো বিয়ে হয়ে যাওয়া স্বামী সে আমার।দুই হলো তিনি আমাকে লেখাপড়া করতে দিবেন এমন আশ্বাস দিয়েছেন।
আমি তাকে চিঠি লিখছি।

প্রিয় রাশেদ,
আমাকে….

এটুকু লিখেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। চিনি না জানি না। এমন একজন স্বামীকে কীভাবে শুরুতেই নাম ধরে ডাকব! আর প্রিয় বলবই বা কেমন করে এতো তাড়াতাড়ি। না না এখনই এতো কিছুর মানে হয় না। ভদ্রলোক আমাকে কী বলবে!
এমনিতেই প্রথম দেখায় নিজের লেখাপড়ার কথা বলতে গিয়ে মাথার কাপড় ফেলে দিয়ে গড়গড় করে কত কথা বলে ফেললাম। তারমধ্যে এখন আবার তার প্রথম চিঠির উত্তরে যদি প্রিয় ট্রিয় বলি। তাহলে আমাকে সে নিশ্চিত বেহায়া ভাববে!
থাক।
বলেই প্রিয় রাশেদ লেখা জলছাপের কাগজটা ছিঁড়ে ফেললাম। এরপরে ভাবতে লাগলাম কী লিখব! কী বলে সম্বোধন করব! আর তখনই মনে পড়ল মা সবসময় বলতেন।
—- ——– শোনো মা। প্রেম করবা বিয়ের পরে নিজের স্বামীর সাথে। জীবনের যত আবদার আছে সব করবা স্বামীর কাছে। মন ভরে আনন্দ করবা স্বামীর সাথে। ঘুরে বেড়াবা নিজের স্বামীর হাত ধরে।
একবার আমার এক বান্ধবী এসএসসি পরীক্ষার পরে তার মামা-মামীর কাছে কক্সবাজারের রামুতে বেড়াতে গেল। ফিরে এসে সমুদ্র নিয়ে তার সেই কী দারুণ সব গল্প। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পরে পায়ের উপর গায়ের উপর। কত কত ছেলে মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্র জলে। এই বুঝি ডুবে গেলো কেউ।কিন্তু না ডুবে যায় না। ঢেউয়ের ভাঁজ ফুরোলেই তার মাথাটা দেখা যায়। সত্যি বলতে সমুদ্রের এই গল্প শুনে খুব ইচ্ছে হলো কাছে গিয়ে সমুদ্র দেখার। মায়ের সাথে সমুদ্রের গল্প জুড়ে দিতেই মা বলে ফেললেন।
——– এখন এতো গল্প শুনে মন খারাপ করো না। বিয়ের পরে তোমার স্বামীর সাথে সমুদ্র দেখতে যাবে বুঝলে! এখন আর এতো নেচো না সমুদ্রের স্বপ্ন নিয়ে।

কী অদ্ভুত সব কথা!
আমার সব স্বপ্ন পূরণ করার জন্য একজন স্বামী বেচারা অপেক্ষা করছেন। স্বামীর সাথে ঘুরতে যাবে। স্বামীর সাথে সমুদ্রে যাবে। স্বামীর সাথে সিনেমায় যাবে। স্বামীর সাথে দেশ বিদেশে যাবে।
আমার মাঝে মাঝে মনে হতো!
আচ্ছা স্বামীরাও কী তাদের সব স্বপ্ন আর ভালোলাগা কেবল তার নিজের স্ত্রীর জন্যই জমা রাখে! বলা হয় না কিছু।জিজ্ঞেস করা হয় না মা’কে।
আজকে আমি না চাইতেই একজন স্বামী পেয়েছি। যদিও আমার স্বামী পাওয়ার কথা ছিলো আরও বেশ কয়েক বছর পরে।
মেঘ না চাইতে বৃষ্টি আসে শুনেছি। স্বামী না চাইতে স্বামী আসে এটা কেউ সেভাবে আমাকে বলেনি আগে।

যাই হোক মায়ের কথা মতো আমার সব আবদার এখন আমার স্বামীর কাছেই করতে হবে। আমিও অবশ্য শুরু করে দিয়েছি না চাইতে পেয়ে যাওয়া আমার স্বামীর কাছে নিজের লেখাপড়ার বায়না।
একটা মেয়েকে মনে হয় সব চেয়েই নিতে হয়। বাবার কাছে চাইতে হয়।বাবা দিলে পাওয়া যাবে না দিলে না। এসব কেবল জামা, জুতা, চকলেট বা আইসক্রিম না। নিজের লেখাপড়া।নিজের ক্যারিয়ার।নিজের কিছু ইচ্ছে আর স্বাধীনতা। চাইতে হয়। চেয়েও যে সকলে পায় তা নয়। তবুও চাইতে হয়।

স্বামীর কাছেও চাইতে হয়। আমাকেও চাইতে হচ্ছে। একটা সিগনেচারে আমার সমস্ত অধিকারের পাণ্ডুলিপি চলে গেছে স্বামীর হাতে। আমি যে মেয়ে তা আমার বাস্তবতা ও আমার বাবা-মা প্রতি পদে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এখন আমার স্বামী পুরুষ বুঝাবেন। তাই নিজের লেখাপড়া করার অনুমতি চেয়ে হাত পেতেছি স্বামীর কাছে। নিজের জন্য কিছু ইচ্ছে পূরণ। নিজের কিছু একান্ত ভালোলাগা ও কিছু স্বাধীনতা। স্বামীর ইচ্ছে হলে দেবে। ইচ্ছে না হলে দেবে না।

কী অদ্ভুত এই মেয়ে জীবন!
কার কেমন জানি না আমি আমারটা এমনই পেয়েছি।
অসহায়ের মতো কেবল হাত পেতে নিতে হয়। বাবার কাছে চাইলাম লেখাপড়া করতে ডাক্তারি পড়তে।বাবা দিলেন না। সোজা বিয়ে দিয়ে স্বামীর অধীন করে দিলেন। আমার বেকার দু’টো ভাইকে এখনো আমার বাবা খরচের টাকা দেয়। তারা ছেলে বলে তারা স্বাধীন। তাদেরকে তো বিয়ে দিলেন না। আমার জীবন এখন স্বামীর মর্জিতে চলবে। সে লেখাপড়া করতে দিলে হবে।না করতে দিলে হবে না। তাইতো এখন বিয়ে করতে না চাওয়া আমিটা স্বামীর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই নিজের লেখাপড়ার আবদার করে ফেলেছিলাম।
আজকে তাকে তার পাঠানো চিঠির জবাবেও কৌশলে লিখে বোঝাতে হচ্ছে আমির লেখাপড়া করার সমর্থন। আমার কেবলই শঙ্কা হচ্ছে। আমাকে তিনি লেখাপড়া করতে দেবেন তো!
নানান রকম ভাবনায় ডুবে আবারও আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামীকে চিঠি লিখতে শুরু করলাম।

আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন নিশ্চয়ই। আপনার চিঠি পেয়েছি। বড়ো আপা আপনার চিঠি আমাকে এনে দিয়ে বললেন।
——এই নাও নতুন জামাইয়ের চিঠি। আগামীকাল আব্বা বাজারে যাবেন। চিঠিটা পড়ে জবাব লিখে দিও। আব্বা পোস্ট অফিসে দিয়ে আসবেন।
তাই আপনাকে চিঠি লিখছি।
আমার লেখাপড়া ভালো চলছে। আজকে থেকে আরও ভালোভাবে শুরু করব ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনি ভালো থাকবেন।

ইতি
ইলোরা

ও হ্যাঁ আপনার দুই ভাইয়ের চিঠিও আমি পোয়েছি। তাদের জন্যও দোয়া রইল।

চিঠিটা লিখে হলুদ খামে ভরে মুখ আটকে টেবিলের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।

যথারীতি আমার সকাল দুপুর বিকেলের গল্পে এখন একটাই স্বপ্ন। তা হলো আমার পড়ালেখা। আমার ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা ও স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নটা এখন একজনকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সে হলো আমার স্বামী রাশেদ।
এক একটা মেয়ে মনে হয় জন্ম থেকেই পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। তার শারীরিক গঠন, পরিবেশ, পরিবার ও জীবনের পরাবাস্তবতা মেয়েদেরকে পরনির্ভরশীল হতে শেখায়।আমিও এর ব্যতিক্রম নই।

দু’দিন তিনদিন পরপরই আমার একটা দু’টো করে চিঠি আসে। আমার স্বামী আমাকে একটার পর একটা চিঠি পাঠাচ্ছে। আমি এখন তাকে আপনি থেকে তুমি করে লিখি চিঠিতে। সে তার এক জীবনের সকল ভালোবাসা আমাকে চিঠির মধ্যে উজার করে দিতে লাগল।আমি একটু একটু করে পুরোপুরি তার প্রেমে পড়ে গেলাম মাত্র একমাসের মধ্যে। এতো তাড়াতাড়ি তার প্রেমে পড়ার বড়ো কারণ হচ্ছে আমার মায়ের কথাগুলো, প্রেম করবি বিয়ের পরে নিজের স্বামীর সাথে।
এছাড়াও তিনি নিয়মিত আমার লেখাপড়ার খবর নিচ্ছেন ও উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। সাথে আছে আমার প্রতি তার ভালোবাসার ভয়াবহ রকম পাগলামি। আমার জীবনে তো প্রথম প্রেম। প্রথম বিশ্বাস আমার স্বামী।

আমি এখন তাকে চিঠি লিখি প্রিয় রাশেদ বলে। তার লেখা চিঠির প্রায় প্রতি ভাঁজে আমার লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া। রাশেদের প্রতি আমার বিশ্বাস অনেক বেড়ে গেল। আমি রাশেদকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেললাম। তিন মাসের যায়গায় দেড় মাসের মাথায় খুব জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে রাশেদ আমাকে তাদের বাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে আসল। আমি রাশেদের বউ হয়ে ওদের গ্রামের বাড়িতে চলে এলাম। আব্বা এতো তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান করতে হিমসিম খাচ্ছিলেন।আব্বার সব টাকার যোগার হয়নি।রাশেদ নিজের পরিবারকে না জানিয়ে আমার আব্বাকে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচের সিংহভাগ টাকা ও গহনা গোপনে আমাদের বাড়িতে দিয়ে এলেন। আমার আব্বার একজন ছেলে হয়ে গেলো রাশেদ। এই মানুষটাকে আমি আমার জীবনের স্রেষ্ট পাওয়া ভাবতে লাগলাম। আমি রাশেদের সাথে আমার বয়সের ব্যাবধান ভুলে গেলাম। নিজের মন ও ভালোবাসা সমর্পন করার সাথে সাথে মানুষটার কাছে আমার সবটুকু নিজেকে ভীষণ ভাবে সঁপে দিলাম।

রাশেদরা পাঁচ ভাই। তিন বোন। রাশেদ তিন নম্বার ভাই। বিয়ের পরে পনেরোটা দিন রাশেদ আমাকে কুটুম পাখির মতো ওর ভালোবাসা, আদর, যত্নে বিভোর করে রাখল। নিজের বাবা-মা ও ভাই বোনদের কথা আমাকে বুঝিয়ে বলল। বললো সবাই তাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। সে নিজও সকলকে ভীষণ ভালোবাসে। রাশেদ চায় আমিও যেন সবাইকে খুব ভালোবাসি। আমি তো ভালোবাসবোই। কারণ আমার মা তো আমাকে বুঝতে শেখার পর থেকে এই স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির জন্যই তৈরি করেছেন।কারণ আমি তো মেয়ে।

পরের বাড়ির সকলের মন যুগিয়ে চলতে হবে। সকলের কথা শুনতে হবে।সকলকে খুশি করতে হবে। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সফলতা হলো একজন ভালো বউ হওয়া শ্বশুর বাড়িতে। আজ পর্যন্ত কতজন মেয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে ভালো বউ হতে পেরেছে জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা শুরু করলাম।

একটা বিষয় খেয়াল করলাম রাশেদ তিন নম্বর ছেলে হলেও ওর গুরুত্ব সংসারে বেশি। দেখলাম বাড়ির সকলের সব আবদার রাশেদ পূরণ করে। সব খরচ ওর হাত থেকেই যায়।
এদিকে আমার মা বলে দিয়েছিলেন।আমি যেন নিজে থেকে ওদের বাড়িতে কাজ করি।তরকারি কাটি। রান্না করি ইত্যাদি। মা আরও বলেছেন। তারা কাজ করতে না দিলেও আমি যেন জোর করে কাজ করি।আমিও মায়ের নির্দেশ অনুসরণ করলাম। কিন্তু আমাকে সবাই কোনো কাজ করতে দিলো না। শ্বাশুড়ি, জা, ননাশ সকলেই আমাকে রাশেদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাদের সকলের আদর ও ভালোবাসায় আমি যেন স্বর্গসুখ ভোগ করতে লাগলাম।
আমার শ্বাশুড়ির মুখে এক কথা।
——-তুমি নতুন বউ। এখনও হাতের মেন্দির রং যায় নাই। এহনই কিসের কাজ। সোজো বউমা তুমি ঘরে যাও।দেখো রাশেদের কিছু লাগবে কিনা!
রাশেদ ও আমি আমরা দু’জন এর বাড়ি ওর বাড়ি দাওয়াত খেয়ে বেড়ালাম খুব। আমার ছোট নানদের বাসার থাকার কথা বলে রাশেদ আমাকে নিয়ে সদরের একটা হোটেলে গিয়ে উঠলো দু’দিনের জন্য। রাশেদ আমাকে নিয়ে সিনেমায় যাচ্ছে, হোটেলে খাচ্ছে। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে না জানিয়ে রাশেদের এই সকল আয়োজনে আমাদের প্রেমটা পৃথিবীর সেরা প্রেম হয়ে উঠল।
রাশেদের প্রেম, ভালোবাসার পাগলামিতে আমি একটা ঘোরের মধ্যে পার করলাম পনেরোটা দিন। এদিকে আমি ভুলেই গেলাম আমার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার কথা। জীবনে প্রথম আমি এতোটা মুক্ত, এতোটা স্বাধীন। আর তার সাথে আমার জীবনের প্রথম প্রেম।প্রথম পুরুষ স্পর্শ। সব মিলিয়ে আমি আমার এতোদিনকার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নটা একরকম ভুলেই গেলাম।

অনুষ্ঠানের পনেরো দিন পরে রাশেদ ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য আমার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো আমাকে নিয়ে। আমাদেরকে ভালো থাকতে দেখে আমাদের বাবা-মা ভীষণ খুশি।রাশেদ আমাকে জানালো খুব শীঘ্রই আমাকে ওর কাছে ঢাকায় নিয়ে যাবে। তাই ঢাকায় যাওয়ার আগের কিছুদিন আমি যেন ওর বাবা-মা মানে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির কাছে থাকি। আমিও খুব খুশি মনে রাজি হলাম। আর তাছাড়া আমার শ্বশুর বাড়ির সকলেই তো আমাকে বসিয়ে রাখে। আমি রাশেদের বাড়িতে নিজের লেখাপড়াটা আরও ভালোভাবে করতে পারব। গত পনেরো দিনের গ্যাপটা ফিলাপ করে নেব।

তবুও রাশেদ চলে যাবে তাই আমার ভীষণ মন খারাপ হতে লাগল। তবে নিজের পড়ালেখাটাও তো করতে হবে। আমি আমার সাথে করে বই খাতা সব নিয়ে রাশেদের সাথে ওদের বাড়িতে ফিরে এলাম। রাশেদ আমাকে ওদের বাড়িতে রেখে ঢাকায় চলে গেল।
এরপর থেকে আমার জন্য আমার শ্বশুর বাড়ির দৃশ্যপট কেমন বদলে গেল। আমি সারাদিন সেভাবে পড়তে বসতেই পারি না। কারণ শ্বশুর শ্বাশুড়ির সেবা করা। জা’দের সাথে সংসারের কাজ করা। সারাটাদিন আমাকে পরিবারের সকলের সাথে ব্যস্ত থাকতে হয়। ঘুমানোর সময় ছাড়া একা রুমে ঢুকলেই শ্বাশুড়ি ডেকে উঠেন।
———-সেজো বউমা!
একটু এদিকে আসো। দেখো তো মা আমার পিঠে এতো ঘামাচি উঠেছে গো মা। আমার পিঠটা খুঁটে দাও। আমার পিঠে একটু পাউডার দিয়ে দাও। একঘন্টা, দু’ঘন্টা পার হয়ে যায় আমার শ্বাশুড়ি মা’য়ের পিঠের ঘামাচির চুলকানো শেষ হয় না। আমিও খুব লক্ষ্মী বউ হয়ে একটার পর একটা ফরমায়েশ পালন করতে থাকি।
ফজরের আজানের সাথে সাথে আমার শ্বশুর ডাকবেন।
——-বড়ো বউমা, মেজো বউমা, সেজো বউমা তোমরা উঠো।নামাজ পড়ো। তাড়াতাড়ি করো সূর্য উঠে যাবে।
ব্যাস সেই যে ফজরে উঠলাম আর ঘুমানো যাবে না। আমার দুই জা’য়ের কোলে ছোট ছোট বাচ্চা। মা বিছানা ছেড়ে উঠে গেলে বাচ্চারা কান্না শুরু করে। তাই তারা নামাজ পড়ে বাচ্চাদের কাছে বিছানায় চলে যায়।ফ্রি থাকি আমি।
এবার শ্বাশুড়ি ডেকে বলবেন।
——সেজো বউমা তোমার শ্বশুরকে আর আমাকে একটু চা করে দাও তো মা।
আমি লাকরির চুলায় চা বানাতে চলে যাই।
তারপর থালাবাসন ধুয়ে ঘরদোর ঝাট দিয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই বড়ো জা ডেকে নিয়ে বলবে।
——-তুমি রুটি বানাতে পারো ইলোরা?
আমি কী বলব! আমাকে মা অনেক দিন রুটি বানাতে শেখাতে গিয়ে পারেনি। আমি এখন তা কী করে বলি! হোক আঁকাবাকা। পারি বলে আটা নিয়ে বসে যাই। কোনোদিন তরিতরকারি কাটি। জা’য়েদের সাথে সবাইকে নাস্তা দেই। আমার এতো সকালে খেতে ভালো লাগেে না। তবুও জোর করে একটা রুটি খেয়ে নেই। আবার ধোয়াপোঁছা। আবার রান্নার আয়োজন। আবার সব গোছানো। গোসল, নামাজ।দুপুরের খাওয়া আর সবাইকে খাওয়ানো। আবার তিন বউ মিলে ধোয়াপোঁছা করা, বাড়িঘর গোছানো।
এতো কাজ আমি জীবনেও করিনি। মা একা কীভাবে আমাদের কতো বড়ো সংসারের সকল কিছু করতেন কোনোদিন বুঝতে দেননি। আমি আজ এক সপ্তাহে তা ভালোভাবে টের পাচ্ছি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি আমায় খুব আদর করে। মাঝে মাঝে মাছের বড়ো টুকরা আমার প্লেটে তুলে দেয়। প্লেটে আরও একচামচ ভাত উঠিয়ে দেয় আমার বড়ো জা। শ্বশুর সাহেব মা ছাড়া কথা বলেন না। তবুও আমার কেমন ক্লান্তি লাগে। আমি কিছু বুঝতে দেই না কাউকেই।বিকেল হতেই আমার খুব ঘুম পায়।কোনো কোনো দিন নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় গা লাগাতেই আমার শ্বাশুড়ির হাঁক ডাক।
——–সেজো বউমা এদিকে আসো তো! আমার সুঁইয়ের গায়ে সুতাটা গেঁথে দাও তো। বয়স হয়েছে বুঝলে! ঠিকমতো চোখে দেখি না। আচ্ছা মা তুমি কী কাঁথা সেলাই করতে পারো?
——পারি মা। দিন আমাকে আমি সেলাই করে দেই।
——–সেলাই করবা! তাইলে ওইপাশ থেকে শুরু করো।
এভাবেই আমি কেমন একটা পুতুল হয়ে গেলাম। আমার লেখাপড়ার সাথে রাত দুপুরে একটু আধটু যোগাযোগ হয়। বই হাতে নিলেই ঘুমে ঢলে পরি।
তারপরও যদি হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে আমি মনে মনে পড়া শুরু করি। আলোটা বেশি জ্বলতে দেখলে তখনই আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি তাদের রুম থেকে হাঁক দিবেন।
——-সেজো বউমা!
এতো রাতে বাতি জ্বালিয়ে কী করো! বাতি কমাও। এতোক্ষণ বাততি জ্বালিয়ে রাখলে হ্যারিকেনের আয়না ফেটে যাবে।
পরেরদিন বিকেল বেলা হ্যারিকেনে তেল ভরা।গ্লাস পরিষ্কার করা।এসব কাজ দাওয়ায় বসে করার সময় আমার শ্বাশুড়ি বলবেন।
———আজকাইল কেরাসিন তেলের দাম খুব বেড়ে গেছে গো সেজো বউ।
আমি কেবল শুনি আর চুপ করে থাকি। মাঝে মাঝে আমার খুব কান্না পায়।
তখনই মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে।
——–শোনো মেয়ে। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মুখে কোনো কথা বলা যাবে না। এক এক বাড়ির এক এক নিয়ম। তারা যা বলবে এক কান দিয়ে শুনবা আর আর এক কান দিয়ে বের করে দিবা। মুখে মুখে জবাব দিবা না। তর্ক তো করবাই না। ভালো বউ হতে হলে বোবা হয়ে থাকবা। জেনে রেখো বোবার কোনো শত্রু নাই।
শোনো মা। পরের বাড়ির ভাত খাওয়া সোজা কথা না। আর শোনো!
রূপের আদর দিন চারি।গুনের আদর সারাকাল।

আমি ঠিক বুঝতে পারি না আমার সাথে আসলে কী হচ্ছে। এতো অল্প সময়ে বিয়ে। সেই স্বামীর সাথে এতো তাড়াতাড়ি প্রেম। আবার শ্বশুর শ্বাশুড়ির এতো ভালোবাসার সাথে এতো কাজ আর রেস্ট্রিকশন!
আমি যেন কেমন একটা পুতুল জীবনে ঢুকে পড়লাম।বিয়ের পরে একমাসের চিঠির প্রেম।আর অনুষ্ঠান শেষে পনেরো দিনের শরীর ও মনের অতিরিক্ত মাত্রার তুমুল প্রেম। এই কয়েকদিনেই কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
যদিও আমার স্বামী রাশেদ আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখছে ভীষণ প্রেম দিয়ে।আমিও রাশেদকে চিঠি লিখছি খুব ছোট করে দু’চারটা কথায়।
বাড়িতে কী হচ্ছে। আমার লেখাপড়া হচ্ছে কিনা! এসব আমি তাকে কিচ্ছু লিখছি না।আমার মনে হলো এসব লেখা ঠিক হবে না। আমার মা তো ছোটবেলা থেকেই বলে আসছে শ্বশুর বাড়ি এমনই হয়। আমি শুধু রাশেদকে লিখলাম।

প্রাণপ্রিয় রাশেদ,
আমি তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্তও থাকতে পারছি না। আমি তোমার কাছে যাব। তোমাকে ছাড়া আমার কেমন পাগল পাগল লাগে রাশেদ। তোমাকে দেখার জন্য আমার কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্লিজ রাশেদ তুমি আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।

আমার এই চিঠির জবাবে আমি আসছি প্রিয় বলে আরও পনেরো দিন কেটে গেল।

এদিকে একদিন আমার আব্বা আমাকে আমাদের বাড়ি নিতে এলে আমাকে যেতে দিবেন না বললেন আমার শ্বশুর। আমি এক পর্যায়ে কান্না শুরু করে দেয়ায় আমাকে আব্বার সাথে যেতে দিতে রাজি হলেন তিনি।

মা আমার হাত, মুখ ও শরীরের অবস্থা দেখে আৎকে উঠলেন। আমাকে কাছে নিয়ে জানতে চাইলেন কেমন আছি আমি!
আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি কেমন মানুষ!
কেমন আদর করে তারা আমাকে।
আমার চোখের নিচে এতো কালি কেন?
আমি কী রাতে ঘুমাই না! মায়ের এতোগুলা কথার জবাব দিতে ইচ্ছে হলো না। আমার খুব কান্না পেল। আমি কান্না চেপে মা’কে এক কথায় “ভালো” বলে। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। আর তাছাড়া কী বলব আমি মা’কে!
আমাকে তো শ্বশুর বাড়িতে তারা পেট ভরে খাবার খেতে দেয়। আমাকে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মা বলে ডাকেন। হ্যাঁ আমার ওখানে অনেক কাজ করতে হয়। এগুলো তো করতেই হবে।আমার নিজের মাও তো কত কত কাজ করেন। তাই নিজের শ্বশুর বাড়ির কাজের কথা মা’কে আমি কী বলব!
আমার বুঝার বয়সের পর থেকে তো দেখেছি আমার মা, চাচিরা সারাদিন ও রাতের প্রায় অর্ধেক সময় সংসারের কাজি করেন। তাই আমাকেও তাই করতে হবে। এসব বলে তো লাভ নেই।
আমার আর লেখাপড়া হচ্ছে না ঠিকঠাক।সেই সব কথা মা’কে কীভাবে বলব!
আমার আর লেখাপড়া দরকার নেই মনে করেই তো আমার বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাই কাউকে কিছু বলার নাই আমার। পথে আসতে আসতে আব্বা বলেছিলেন। বড়ো আপাকে তার শ্বশুর এসে নিয়ে গেছেন শ্বশুর বাড়ি। মনে মনে বড়ো আপার জন্য খুব দোয়া করলাম।
কখনও বড়ো আপার কাছে জানতে চাওয়া হয়নি আমার।তাকে তার স্বামী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি এরা কেমন কষ্ট দেয়! যেই কারণে বড়ো আপা শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলেন।
তবে আমি বুঝতে পারছি এখন।শ্বশুর বাড়ি মানেই পরের বাড়ি। এই কথা মা সবসময় কেন বলতেন!

নিজের বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে কত কী মনে পড়ল। জীবনের অনেক হিসেবই ঠিক মিলছিলো না। রাতে মা’কে জানালাম।
——-মা আমি কাল সকালে একবার কলেজে যাব। আমাদের রেজাল্ট কবে দিবে আর মেডিকেলে ভর্তির বিষয়ে আমাকে একটু জানতে হবে। ডেট পড়েছে কিনা! ঢাকা ছাড়া কী পরীক্ষা দেয়া যায় কিনা!
মা বললেন।
——–জামাই জানে তুমি কলেজে যাবা?
তোমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির মতামত নিয়ে এসেছ?

আমি বললাম।
——–না তো! তারা জানবে কেন!
আমি তো সবসময় কলেজে যেতাম।
এখনও সেভাবেই যাব।আপনাকে তো বললাম।
——–এখন আর আমাকে বললে হবে না। এখন আর তুমি আমাদের দায়িত্ব না। তুমি এখন তোমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির জিম্মাদারি। তাই তাদের অনুমতি ছাড়া তুমি কলেজে যেতে পারবা না।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি এখন কী করব! কীভাবে কলেজে যাব! কীভাবে মেডিকেলে ভর্তির খবর নেব! আমার ভীষণ কান্না পেল। আমি সাথে সাথে আব্বার কাছে গেলাম। আব্বাকে বললাম……..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here