চন্দ্রকুঠি পর্ব-১৪

0
4101

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (১৪)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

” এই ভিডিওটা তুমি কোথায় পেলে”?
রাফির কথায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো মুন।
” কি হলো বলো”?
” আপুকে এই ভিডিওটা পাঠিয়ে, কেউ তাকে ফাঁসিয়েছে”।
” কি? মাধুরিকে ফাঁসিয়েছে মানে”?
তারপর মুন রাফিকে ‘চন্দ্রকুঠির’ ভিতরে মাধুরির সাথে যা যা হয়েছে সব বলেছে। শুধু তালুকদার বাড়ি লোকদের নামগুলো বাদে।
” মাধুরি এখন কোথায়? ও ঠিক আছে তো”?
রাফি বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বললো। রাফির উত্তেজনা দেখে মুন কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে মুন বললো,” কালকে আমি যেখানে বলবো সেখানে চলে এসো। আপুকে সেখানেই পাবে”।
” কাল? আজ নয় কেন? এখনি যাই না”?
” না। এখন যাওয়া যাবে না। আপু এখন বাবার সাথে আছে। এখন গিয়ে বাবা, মেয়ের মাঝে ডোকাটা ঠিক হবে না”।
” আচ্ছা। কাল একটু তাড়াতাড়ি ঠিকানাটা দিও”।
” আচ্ছা”।
রাফির সাথে কথা শেষ করে মুন চলে গেলো।
মুন সেখান থেকে সোজা রিয়াদের সাথে দেখা করলো। রিয়াদ মুনকে দেখেই প্রশ্ন করলো,” এটা কার বাড়ি? হঠাৎ এখানে আসতে বললে কেন”?
” এসব বলার সময় নেই। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি সেটা বলুন”?
” সেটা তো ভাবতে হবে”।
” তাহলে ভাবুন”।
” হুম”।
রিয়াদ কিছু বলতে নিবে তখনি মুন বলে উঠলো,” আপনি তো আপনার কথা বলেননি, সেটা কখন বলবেন”?
” আমার কথা মানে”?
” আপনার চন্দ্রকুঠিতে যাওয়ার দ্বিতীয় কারনটি কি”?
” তুমি এটা এখনো মনে রেখেছো”?
” ভুলে যাওয়াটা আসা করেছিলেন”?

” না। এরকম আসা করাটা বোকামি সেটা আমি আগেই বুঝেছি। তাই এরকম আসা রাখার ভুল করিনি”।
” এত কথা বাদ দিয়ে আসল কথা বলুন”।
” আচ্ছা বলছি। তুমি যে কারনে গিয়েছিলে আমিও সে কারনে গিয়েছিলাম”।
” মানে”?
মুন ভেবে নিলো রিয়াদ কারনটি না বলে আবার অহেতুক কথা বলবে। মুনকে ভুল প্রমাণ করে রিয়াদ বললো,” তুমি যেমন তোমার বোনকে খুঁজতে গিয়েছিলে তেমন আমিও”।
মুন বেশ অবাক হলো। মুনকে বিষ্ময় নিয়ে চেয়ে থাকতে দেখে রিয়াদ বললো,” আমি, আপু, বাবা, মা এই চারজনকে নিয়ে আমাদের পরিবার। আমি যখন চাকরি পেয়ে ট্রেনিং এ যাই। তখন আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক ঝড়। যে ঝড়ের আবাস আমার বাবা-মা আমাকে দেয়নি। তাই আমি তখন কিছুই জানতে পারি না। ট্রেনিং শেষে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন জানতে পারলাম। তিন মাস আগে আমার বোন একটি চিঠি লিখে বাড়ি থেকে চলে যায়। চিঠিতে বলা ছিলো সে যে ছেলেটিকে ভালোবাসে তার বাবা-মা তাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। তাই তারা পালিয়ে যাচ্ছে। আপু নিজ ইচ্ছায় গিয়েছে এটা জেনেও আমি আপুর খোঁজ করার চেষ্টা করি। বাবা-মা বারণ করেছিলো কিন্তু আমি শুনিনি। অনেক খোঁজ করেও আপুকে পাইনি। ভেবেছিলাম সে ভালো আছে তার নতুন সংসারে। সেখানে আমাদের আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু একদিন হঠাৎ”!

এতটুকু বলে রিয়াদ থামলো। মুন কৌতুহল নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকালো। মুনকে কৌতূহল নিয়ে তাকাতে দেখে রিয়াদ আবার বললো,” হঠাৎ একদিন আমার কাছে একটি ফোন আসে। আমার পুরনো নাম্বারে। অচেনা নাম্বার দেখে কিছুটা অবাক হই। ফোনটি রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পাই সেই চিরচেনা আপুর গলা, আপু বলছিলো আমাকে বাঁচা ভাই। আমি ভালো নেই। তারপর ফোনটি কেটে যায়। ঐ নাম্বারে আজো কল করলে বন্ধ বলে। যাই হোক সেই ফোনটি কদমতলী গ্রাম থেকে এসেছে এটুকু জানতে পারি। তারপরি সেখানে যাই। তখন ‘চন্দ্রকুঠির’ কথা মাথায় আসেনি, এছাড়া তখন তো আর জানতাম না সেখানে কি হয়! তখন জানলে হয়তো খুঁজে পেতাম”।

রিয়াদ একটু থেমে আবার বললো,” এটাই আমার কথা”।
মুন কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর বললো,” তারমানে সেদিন ঐ মহিলাগুলোকে আপনি নিজের বোনের ছবি দেখাচ্ছিলেন”?
” হ্যাঁ।

” আমাকে একটু দেখাবেন”?
রিয়াদ এবার ঘুরে মুনের দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওখানে নেই আপু। আমার মনে হয় আমি আর আপুকে খুঁজে পাবো না। তাই বেকার ছবি দেখে কি করবে তুমি”?
” আচ্ছা এমনিই দেখি না। চিনে রাখি যদি কখনো দেখা হয়”।
রিয়াদ কিছু না বলে মুচকি হাসলো। তারপর ফোন থেকে ছবি বের করে মুনের সামনে ধরলো। মুন ফোনের দিকে তাকালো। ফোনে রিয়াদ এবং একটি মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফুটে উঠেছে। রিয়াদ পাশে মেয়েটিকে দেখে মুন চমকে গেলো।
” এ আপনার বোন”?
” হ্যাঁ”।
” নাম কি এর”?
” রিশিতা জাহান”।
“কি”?

” তুমি এত চমকাচ্ছো কেন”?
” এই মেয়েটিকে আমি চিনি। এর নাম রিশিতা নয় রেবেকা”।
” মানে? কোথায় দেখেছো”?
তারপর মুন প্রথম থেকে সবটা বললো। সব শুনে রিয়াদ কিছুটা ভেঙে পড়লো। মুন রিয়াদকে আশ্বাস দিয়ে বললো,” চলুন। তার সাথে দেখা করবেন”।
” হ্যাঁ চলো”।

____________

মুন আর রিয়াদ চলে এলো কারাগারে। কারাগারে এসে রেবেকার সাথে দেখা করতে চাওয়ার পর যা শুনলো তার জন্য দু’জনের কেউ প্রস্তুত ছিলো না।
রহিমা ওদের দু’জনকে কারাগারে দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমরা এখানে কেন এসেছো”?
” রেবেকার সাথে দেখা করতে”।
তখনি সেই বৃদ্ধা মহিলা কনস্টেবল(যে মুনকে দেখে চমকে গেছিলো) এলো এবং বললো,” রেবেকা বেঁচে নেই”।
” কি”?
রিয়াদ সেখানেই বসে পড়লো। মুন রিয়াদকে ধরলো এবং বললো,” আপনি শান্ত হন প্লীজ। এভাবে ভেঙে পড়বেন না”।
” আপনি জানেন না ও আমার জন্য কি ছিলো”?
রিয়াদের চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মুন একটু শান্তভাবে বললো,” কিভাবে মারা গেলো”?
” ওর বাচ্চার মৃত্যুর খবর পেয়ে আত্নহত্যা করেছে”।
এবার মুনও একটু ভেঙে পড়লো। যে বাচ্চাটা মুনকে নিজের জন্মের স্মৃতিচারণ ঘটালো সেই বাচ্চাটিও বেঁচে নেই। ওদের দু’জনের অবস্থা দেখে রহিমা বললো,” আমিও কিছু জানতাম না। আজকে এসেই শুনলাম তিনদিন আগে এসব হয়েছে। ওর মৃতদেহ দাফন হয়ে গেছে। তাই এখন তোমাদের জন্য ওর কবরটি ছাড়া দেবার মতো কিছু নেই”।
রিয়াদকে ভেঙে পড়তে দেখে রহিমা কিছুটা আন্দাজ করে নিলো। তাই এই কথাটি বললো। রহিমার কথা শেষ হতেই অন্য মহিলাটি বললো,” আমার কাছে আরো একটি জিনিস দেওয়ার মতো আছে”।
” সেটা কি”? রিয়াদ বললো
” তবে এটা তোমাকে নয় মুনকে দিতে চাই। রেবেকা এটা মুনের জন্যই রেখে গেছে”।
এবার মুন বললো,” কি”?
মহিলাটি একটি চিঠি মুনের দিকে এগিয়ে দিলো। মুন ওনার হাত থেকে চিঠিটি নিলো। মহিলাটি বললেন,” আমি এখানে আসার আগে সেই কারাগারে কর্মরত ছিলাম যেখানে তোমার মতো…..”।
কথাটি শেষ করতে না দিয়ে মুন বললো,” আপনার চমকানোর মানেটা সেদিন না জানলেও আজকে ঠিকই জানি। তাই বলতে হবে না”।

মুন এবং রিয়াদ কারাগার থেকে বেরিয়ে এলো। দু’জনে গাড়িতে বসে আছে। চিঠিটার দিকে তাকিয়ে মুন রিয়াদকে বললো,” আপনি ঠিক আছেন। তাহলে আমরা চিঠিটা পড়তে পারি”?
রিয়াদ মুনের দিক তাকালো এবং বললো,” আমি ঠিক আছে। তুমি চিঠিটা পড়ো”।
” ঠিক আছে”।
এরপর মুন চিঠিটা পড়তে নিলো। চিঠির ভাঁজ খুলতেই প্রথমে লেখা দেখলো,

প্রিয় চন্দ্র,
তুমি যখন এই চিঠিটা পড়বে তখন হয়তো আমি থাকবো না। তুমি একটু অবাক হচ্ছো চিঠির উপরে চন্দ্র লেখায় তাই তো! আসলে তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তখন কিছু মূহুর্তের জন্য হলেও তোমাকে চন্দ্র ভেবেছিলাম।
আমি আমার গল্পটা সম্পূর্ণভাবে তোমাকে বলছি। তারপর তুমি নিজেই বুঝে যাবে সবকিছু।
আমি রিশিতা। বাবা-মা, ভাই নিয়ে আমার একটা সুন্দর পরিবার ছিলো। হঠাৎ একদিন সব এলোমেলো হয়ে গেলো। মায়া, মোহ বেড়াজালে প্রেম নামক এক মিথ্যে আবেগে ডুব দিয়েছিলাম আমি। ভালোবেসে যার সাথে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলাম সেই মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিলো ‘চন্দ্রকুঠি’ নামক এক অন্ধকার নিষিদ্ধ পল্লীতে। সেখান থেকে আমার যন্ত্রণাময় জীবন শুরু। রিশিতা থেকে হয়ে উঠলাম রেবেকা। টাকার কাছে বিক্রি হওয়া জীবনটার প্রতি খুব ঘৃনা হতো। আর সবচেয়ে বেশি ঘৃনা হতো সেই মানুষটার কথা ভাবলে যার জন্য আমার এই অবস্থা। সেই মানুষটির নাম ফাহাদ।
তো যাই হোক ঘৃনিত জীবন থেকে মুক্তি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তি নেওয়ার আগেই জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি। মা শব্দটি শুনে আনন্দিত হয়েছিলাম। যখন ভাবতাম এ সন্তান পাপের তখন খুব খারাপ লাগতো। তবুও এই সন্তানকে খুন করার কথা ভাবতে পারিনি। যতই হোক প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি ছিলো এটা।
গর্ভবতী অবস্থায় ওরা আমাকে ছাড়লো না। একজনকে রুমে পাঠিয়ে দিলো। সহ্য করতে না পেরে লোকটিকে মেরে দিয়েছিলাম। যে কারনে আজ আমি খুনি। সবি তো শুনলে। যেটা বাকি রইলো তাহলো চন্দ্র কে? তাকে কিভাবে চিনি?

চন্দ্রর ব্যপারে আমি চন্দ্রকুঠির একজনার কাছেই শুনেছি। যদিও সবটা জানি না। তবে শুনেছি এই বাড়িটা তার ছিলো। একদিন পুরনো আসবাপত্র রাখতে বাইরের তালাবদ্ধ ঘরটি খোলা হয়েছিলো। সেদিনই ঐ ঘরটির মাঝ থেকে আমি চন্দ্রর একটি ছবি পাই। তারপরো আমি ওর সম্পর্কে জানি।
সেদিন যখন তুমি আমার সামনে মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে ছিলে। কিছু মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছিলো ছবি থেকে চন্দ্র বেরিয়ে এসেছে আমার সামনে।
তোমার সাথে চন্দ্র আর চন্দ্রকুঠির সম্পর্কে আছে এটা ভেবে তোমাকে সব বলতে চেয়েছিলাম। তবে তুমি যেদিন শুনতে এসেছিলে সেদিন তোমাকে সব বলা সম্ভব হয়ে উঠেনি। কারন আমি কিছু বললে আমার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলা হতো…………।
আজ শেষ সময়ে খুব ইচ্ছে করলো তোমাকে সব বলতে। তাই তোমার জন্য আমার লেখা এই শেষ চিঠি।

ইতি
রিশিতা

চিঠিটা পড়া শেষে মুনের চোখ দিয়ে অশ্রুকোনা গড়িয়ে পড়লো। ভালোবেসে কতটা নির্মমভাবে ঠকে গেলো মেয়েটা। কতটা যন্ত্রণাময় ছিলো সেই দিনগুলি। মুনকে কাঁদতে দেখে রিয়াদ বললো,” এখন কান্না করে কোন লাভ নেই। রিশিতা, মাধুরির মতো অনেকগুলো মেয়ের যন্ত্রণার খুশি হতে হলে ওদেরকে শাস্তি দিতে হবে। তাই কান্না থামাও মুন”।
” আমরা এখন কি করবে”? কান্নারত অবস্থায় বললো মুন
” সেটা আমি ভেবে নিয়েছি, বাকিটা তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে”।
” আচ্ছা”।

মুন এবং রিয়াদ যে বাসা থেকে কারাগারের উদ্দেশ্য বেরিয়ে ছিলো সেখানেই আবার চলে এলো। বাসার সামনে গিয়ে বেশ অবাক হলো মুন এবং রিয়াদ। দরজার তালা ভাঙা। রিয়াদ এবং মুন দরজা খুলে ভিতরে ডুকে আরো অবাক হয়ে গেলো। সব জিনিস ছড়ানো, ছেটানো। ঘরটার এমন অবস্থা দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে বসে পড়লো মুন এবং রিয়াদ।

হঠাৎ চিন্তিত মুখ দূর করে দু’জনেই হেঁসে দিলো।

চলবে,
[ কি হলো শেষে! মিষ্টি নির্দোষ সে কিছু জানে না। গল্প শেষের দিকে। এক কি দুই পর্ব হবে। সবাই নতুন গল্পটিও পড়তে আইসেন ওকে। সবশেষে ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here