চন্দ্রকুঠি পর্ব-৩

0
2416

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব(৩)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুনের পরিক্ষা আজ শেষ। মুন আজকের দিনের অপেক্ষাই ছিলো এতদিন। আজ পরিক্ষা শেষ হতেই মুন বেরিয়ে পড়লো কারাগারের উদ্দেশ্যে। আজকে কারাগারে গিয়েই প্রথমে রাফির সাথে দেখালো হলো, ” আরো মুন তুমি এখানে?”
” আমি আসলে…”
” তোমার আপু পাঠিয়েছে? কিন্তু আমাদের মধ্যে তো তেমন কিছুই হয়নি তবে তোমাকে পাঠালো কেন?”
” না ভাইয়া। আমাকে আপু পাঠাইনি। আসলে আমি নিজে থেকেই এসেছি।”
” নিজে এসেছো কিন্তু কেন?”
” আসলে আমি একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
” কার সাথে?”
” ভাইয়া আগে দেখা করি তারপর বলি?”
” আচ্ছা। কিন্তু কার সাথে দেখা করবে?”
” রেবেকা।”
” ওনার সাথে তোমার কি কাজ? তুমি কি ওনাকে আগে থেকে চেনো?” চমকে উঠে
” না ভাইয়া। আসলে এমনি বাচ্চাটাকে নিয়ে কথা বলতাম।”
” বাচ্চাটাকে তো অনাথ আশ্রমে দেওয়া হয়েছে, তাকে নিয়ে কি কথা বলবে?”
” আসলে….”
রাফি কিছু একটা ভাবলো। তারপর মুনকে দেখা করতে যেতে বললো। মুন এত সহজে অনুমতি পেয়ে হাঁসি মুখে চলে গেলো। অন্যদিকে রাফি মনেমনে বললো, ” হিসাব তো মিলছে না। মুন কেন একজন অচেনা মানুষের সাথে দেখা করতে এলো।”

অন্যদিকে মুনকে সামনে দেখে রেবেকা কিছুটা মুচকি হাঁসি দিলো। তারপর খুব শান্তভাবে বললো, ” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আসবে না। এই ব্যপারটা তোমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।”
মুনও মুচকি হেঁসে বললো, ” মুনের মাথা থেকে সহজে কোনকিছু যায় না।”
” তাই। তা কিসের জন্য এলে?”
” আপনি কি এমন অপরাধের করেছেন যার শাস্তি পাচ্ছেন?”
” শুধু এটুকুই।”
” হ্যাঁ।”
” আমি তো তোমার কেউ না, তাহলে কিসের টানে এখানে এলে।”
” কারাগারের টানে…” মুখ ফসকে কথাটি বের হয়ে গেলো
” কি?”
” না কিছু না।”
” আচ্ছা।”
” প্লীজ বলুন না কেন এখানে এলেন আপনি? কি করেছিলেন আপনি?”
” সে অনেক বড় কাহিনি। সেটা জেনে তোমার কোন লাভ নেই।”
” আপনি বলতে চাইছেন তাই তো?”
” ধরে নেও তাই।”
” তাহলে আমাকে যে আসতে বললেন?”
” এমনি।”
” আচ্ছা অপরাধ কি সেটা নাহয় না বললেন, বাচ্চাটির বাবা কোথায় তা কি বলা যাবে?”

রেবেকা কিছুটা ব্যঙ্গ হাসলো। তারপর বললো, ” আমি নিজেই জানি না।”
” মানে?” চমকে
” ও আমার এমন এক অন্ধকার জীবনের ফসল, যে জীবনের অতল গভীরে হারিয়ে গেছি আমি। তাই তো শাস্তি পাচ্ছি।”
” আমি কিছু বুঝতে পারছি না, একটু বলবেন?”
” তুমি অনেক ছোট মুন। এসব জানার জন্য তৈরি নও তুমি।”
” আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। যত খারাপ পরিস্থিতিই থাক না কেন আমি ঠিক সামলে নিতে পারবো।”
” তাই।”
” হ্যাঁ।”
” তবে শোন শুধু আমার নয় আমার মতো অনেক মেয়ের জীবনের গল্প আছে সেখানে লুকিয়ে।”
” কোথায়?”
” তা তো বলবো না। তবে জেনে রাখো তোমার মুখখানি একজনের সাথে খুব মিলে। যার জীবনের অন্ধকারও সেখানে লুকানো।”
” মানে? কি বলছেন আপনি? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
” দেখো মুন সেদিন আমি হুট করে তোমাকে আসতে বলেছিলাম। বলতে পারো কিছুটা নিজের অজান্তে। তো এখন বলছি এখান থেকে চলে যাও।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু নয়। আমাদের মতো কিছু অপরাধীর কথা ভেবে জীবনের আলোময় সময়টাকে নষ্ট করো না।”
” প্লীজ আমার কথা শুনুন….”
” যাও তুমি মুন।”
” প্লীজ আমার….”
” যাও।” ধমক দিয়ে

মুন নিরুপায় হয়ে চলে গেলো। মুন একটা জিনিস ভেবে পেলো না, সেদিন বলবে বলেও আজ না বলে পাঠিয়ে দিলো তাকে। ব্যাপারটা খুব গন্ডগোলের। এসবের মাঝে মুনের মাথায় আরো একটা কথা ঘুরছে, ” আচ্ছা আমি ঠিক কি খুজছি? আমি তো জানিই না কিসের টানে এখানে বারবার আসছি! এই টানটা যে রেবেকার জন্য নয় সেটা আমি নিশ্চিত। হয়তো বাচ্চাটার জন্য। কিন্তু তাও নয়। কারণ বাচ্চাটির মায়ায় পড়লে অবশ্যই এতদিনে বাচ্চাটিকে দেখার জন্য হলেও একবার আশ্রমে খোঁজ নিতাম। তাহলে আমার টানটা ঠিক কিসের প্রতি?”
নিজের মনকে প্রশ্ন করে উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলো মুন। তখনি হঠাৎ মনে হলো সেদিন ঠিক কি হয়েছিলো। সেদিন রেবেকা বাচ্চাটিকে জন্ম দেওয়া, বাচ্চাটির জন্মের পর কেঁদে ওঠা। ঠিক ঐ মূহুর্তের টানে মুন অজানা গন্তব্য ছুটে চলেছে। যেখানে জানেই না আদো এর কোন গন্তব্য আছে কিনা।
_____

পড়ালেখা, প্রেম, বাবার, বোন সবকিছু নিয়ে ভালোই চলছিলো মাধুরির। ভালো সময় মানুষের জীবনে দীর্ঘক্ষন থাকে না। তাই হয়তো বদলে গেলো মাধুরির জীবন। রাফির ফোন থেকে আশা একটা ভিডিও বদলে দিলো মাধুরির গন্তব্য। ভিডিওটি অন করে মাধুরি একদম অনুভূতি-শূন্য হয়ে পড়লো। ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটি অন্ধকার ঘরে রাফির হাত-পা বেঁধে রেখেছে কেউ। রাফি শুধু অস্পষ্ট সুরে পানি পানি বলে চিৎকার করছে৷ ভিডিওটি দেখে মাধুরি মেঝেতে বসে পড়লো। এমন সময় ফোনে রাফির নাম্বার থেকে একটি মেসেজ এলো, ” বলেছিলাম তো চলে এসো তোমার বাড়ি৷ এলে না কেন? এখন তার মাসুল দেও। রাফিকে জীবিত চাইলে চলে এসো তোমার বাড়ি।”
মেসেজটি দেখে মাধুরির অন্তর আত্না কেঁপে উঠলো। সেদিনের মেসেজটিকে মজা ভেবে কতবড় ভুল করেছে সে, তা আজ বুঝলো। সে তো ভেবেছিলো কেউ হয়তো তার সাথে মজা করছে কিন্তু এখন ভিডিও মেসেজ দেখে তো মনে হচ্ছে না এটা মজা। মাধুরি কোনকিছু না ভেবে রাফির নাম্বারে কল করলো। প্রথমবার রিং হতেই ফোন ধরলো, ” হ্যালো কে বলছেন? রাফি কোথায়? আপনি কে? কি চান আপনি?”

” আস্তে আস্তে মামুনি। এত প্রশ্ন একসাথে করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবো বলো?”
ফোনের ওপাশ থেকে পুরুষালি এক কন্ঠ ভেসে আসলো। মাধুরি কিছুটা ভয় পেলো। ভয় মার্জিত কন্ঠেই বললো, ” কেন করছেন এমন?”
” তোমাকে তোমার বাড়ি অব্দি নিয়ে আসার জন্য।”
” আমার বাড়ি? কিন্তু আমি তো আমার বাড়িতেই আছি।”
” বলেছিলাম না ওটা তোমার আসল বাড়ি নয়। আসল বাড়িতে চলে এসো।”
” আসল বাড়ি? সেটা কোথায়?”
” সেটা তো তোমাকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।”
” কিন্তু আমি তো কিছু জানি না।”

লোকটি কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটি কাটার দুই মিনিট পর আরো একটি মেসেজ এলো, ” হাতের ফোনটি ভেঙে ফলো এবং চলে আসো ‘চন্দ্রকুঠি’।”
মেসেজটি পড়ে মাধুরি থ হয়ে গেলো। মনেমনে দু’বার উচ্চারণ করলো ‘চন্দ্রকুঠি’।

মাধুরি রাফিকে খুব ভালোবাসে তাই লোকটির কথা অমান্য করার সাহস হলো না। তাই ঠিক করে নিলো তাকে যেতেই হবে। রাফির জন্য যেতে হবে। কিন্তু বাবা, বোন এদের সামলে যাবে কিভাবে? কিন্তু তাকে তো যেতে হবে। বাবাকে বললে বাবা তাকে ছাড়বে না, তাই না বলেই যেতে হবে। মাধুরি ঠিক করে নিলো রাতে বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। জানা নেই সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে কিন্তু তাকে যেতেই হবে। তবে কিছু একটা ভেবে মাধুরি ফোনটি না ভেঙে বন্ধ করে দিলো এবং ফোনটি ঐ ঘরেই লুকিয়ে রাখলো। বেঁচে না ফিরতে পারলেও কোন একদিন হয়তো বাবা বা বোন জানতে পারবে কেন সে রাতের আঁধারে হারিয়ে গেলো।

অন্যদিকে,
মুন অনেক কষ্টে নিজের কৌতূহলী মনকে শান্ত করলো। মনকে বুঝালো মরিচীকার পিছনে ছুটে লাভ নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে।

একজন নিজেকে গুটিয়ে নিলো রহস্য থেকে অন্যজন রহস্যের দিকে পা বাড়াতে লাগলো। কে জানে ভাগ্য তাদের কোথায় নিয়ে যাবে।

রাত ২.৩০,
চোখ মেলে পাশে ঘুমানো মুনের দিকে তাকালো মাধুরি। খুব সাবধানে বোনের কপালে চুমু কাটলো সে। দুই মিনিট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে একমনে বলে উঠলো, ” খুব ভালোবাসি বোন। তুই আর বাবা ছাড়া আমার অস্তিত্ব মূল্যহীন। তাই বলে রাফির অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না। রাফির জন্য আমার তোদেরকে একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমি চেষ্টা করবো সব বাঁধা পেরিয়ে তোদের কাছে ফিরে আসার।”

খুব সাবধানে রুম থেকে বের হলো মাধুরি। পা টিপে টিপে বাবার রুমে ডুকলো। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে দিলো। মনেমনে তাকে সালাম জানিয়ে বললো, ” বাবা তুমি আমার সব। ছোটবেলা থেকে কখনো মায়ের মুখটা অব্দি দেখেনি। আমরা জানি না আমাদের মা দেখতে কেমন। যেদিন মায়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তোমার চোখে অশ্রু দেখেছিলাম সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, মায়ের হারিয়ে যাওয়ার যে কারনই হোক না কেন তোমাকে কখনো সে সম্পর্কে প্রশ্ন করবো না। কিন্তু আজ আমি নিরুপায় বাবা। আজ তোমাকে আমার জন্য একটু কাঁদতে হবে। কিন্তু তুমি ভেবো না বাবা, আমি ঠিক ফিরে আসবো।”
মুখে ফিরে আসবো বললেও হৃদয়ের গভীরে প্রশ্নটা থেকেই যায়, মাধুরি কি আর ফিরে আসতে পারবে?

ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো মাধুরি। মেইন রাস্তায় পা রাখতেই কোথা থেকে কালো চাদর মুড়ানো একজন ছুটে এসে মাধুরির হাতে একটি ফোন গুঁজে দিয়ে চলে গেলো। মাধুরি লোকটিকে পিছন থেকে ডাকলো কিন্তু লোকটি এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলে গেলো। তখনি মাধুরির হাতের ফোনটি রিং হলো। ফোনে রাফির নাম্বার দেখে যা বোঝার তা বুঝে গেলো মাধুরি। ফোনটি ধরে, ‘হ্যালো’ বলতেই লোকটি এরপর কোথায় যেতে হবে সেটা বলে দিলো। মাধুরি এগিয়ে যাচ্ছিলো এক অজানা রাস্তায়, যার নাম ‘চন্দ্রকুঠি’।

চলবে,
~~

[ ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। লেখার মান বেশি ভালো না তবুও কষ্ট করে যারা পড়ছেন তাদের জন্য আন্তরিক ভালোবাসা রইলো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here