চন্দ্রকুঠি পর্ব-৮

0
2329

#চন্দ্রকুঠি
পর্ব (৮)
#নুশরাত জাহান মিষ্টি

মতিন সাহেবের থেকে চন্দ্রাবতীর কথা শুনে সবাই কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। মুন একধ্যানে ছবির চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। চন্দ্রর ছবির দিকে নিক্ষেপ করা মুনের মায়াময় দৃষ্টি দেখে মতিন সাহেব কিছুটা নিশ্চিত হলেন এটা চন্দ্রর ই সন্তান। চন্দ্রর মুখ নিয়ে জন্ম যার , তার সাথে চন্দ্রর সম্পর্ক না থেকে পারে! মুন এবং রিয়াদও কিছুটা ধারণা করলো এটা মুনের ই মা। কিন্তু আরিফ হাওলাদার আর তালুকদার এর রহস্যটা ঠিক কি! ধরে নেওয়া যাক কোন কারনে আরিফ পদবী বদলে নিয়েছে কিন্তু তার মায়ের নাম। এটাও কি বদলানো হয়েছে! কিন্তু কেন! রিয়াদ নিরবতার ভেঙে মুনকে বললো, ” এবার আমাদের করনীয় কি?”
” তালুকদার বাড়ি যাওয়া।”
” কিন্তু সেখানে গিয়ে কি কোন লাভ হবে?”
” হবে। সেখানে গেলেই চন্দ্রকুঠির ভিতরে প্রবেশ করার সেই সবুজ কার্ডটি পাওয়া সম্ভব বলে আমার ধারনা।”
” কেন এরকম মনে হচ্ছে?”
তারপর মুন আস্তে করে তার মাথায় যা যা ঘুরছে সব বললো। যদিও মুনের রিয়াদকেও সন্দেহ হয়। তবুও রিয়াদ ছাড়া এখন ভরসা করার মতো কেউ নেই। কিছু একটা ভেবে রিয়াদ বললো, ” কিন্তু আপনি ওখানে যাবেন কিভাবে? আপনাকে দেখে যদি সবাই চন্দ্র ভাবে তো?”
রিয়াদের কথায় মুন কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এরকম সময় আশার আলো হয়ে রহিমা ফোন করলো। এখানের আসার অনেক আগেই মুন রহিমার সাথে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করে নিয়েছে। মুন ফোনটি রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই রহিমা বললো, ” একটা খবর জানানোর জন্য ফোন করা?
” কি খবর?”
” রাফির খোঁজ পাওয়া গেছে। রাফি তাদের বাড়িতে। রাফির বাবা মাত্র জানালো।”
” রাফি ভাইয়ার সাথে কথা হয়নি?”
” না। তার সাথে কথা হলে তো মাধুরি ব্যপারে খোঁজ নিতাম।”
” তা রাফি ভাইয়ার বাবা কি কি বললেন?”
” বললো রাফি অসুস্থ। সুস্থ হলে রাফি ফিরে যাবে।”
” ওহ আচ্ছা।”
” আরো একটা কথা?”
” হুম বলুন।”
” রাফির পরিবার কিন্তু তার নিখোঁজ হওয়ার কোন কথাই বলেননি। তাদের মতে রাফি এতদিন ছুটিতে ছিলো যেটা আজিজ স্যার জানতো।”
” ছুটিতে ছিলো?”
” হ্যাঁ তেমনি তো বললো।”
রহিমার সাথে কথা বলা শেষ করে মুন বেশ ভাবনায় পড়লো। রাফিকে বেঁধে রেখে কেউ মাধুরিকে ‘চন্দ্রকুঠি’ ডাকলো। রাফি ফিরে এসেছে, রাফি তালুকদার বাড়ির ছেলে। সবকিছু কেমন ঝট পাকিয়ে যাচ্ছে।
_______

রাফি বাড়ির পাশে এক বাগানে বসে আছে। বাগানের এই নিরিবিলিতে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। আকাশের পানে তাকিয়ে জীবনের হিসাবটা মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে রাফি। হঠাৎ চেনা কন্ঠে ডাক শুনে পিছনে ঘুরে তাকালো রাফি।
” রাফি ভাইয়া।”
ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে মুনকে দেখে কিছুটা চমকালো রাফি। রাফির চমকানো মুখটা আড়াল হলো না মুনের থেকে। রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” মুন তুমি এখানে?”
” হুম। কেন আসতে পারি না বুঝি?”
” তা নয় কিন্তু তুমি এখানে কেন এসেছো?”
” আমার বন্ধুর সাথে ঘুরতে এসেছি। আসলে সুযোগ পেলাম তাই কাজে লাগিয়ে নিলাম।”
” মানে? কি সুযোগ?”
” এইতো মাধু আপু নেই, বাবাও তার বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গেছে। ভাবলাম এই তো সুযোগ জীবনটাকে নিজের মতো উপভোগ করার। বন্ধু বললো কদমতলী গ্রামটি খুব সুন্দর, সেই সাথে ‘চন্দ্রকুঠির’ মঞ্চনাট্যও খুব বিখ্যাত। তো চল ঘুরে আসি।”
” বারবার বন্ধু বলছো কিন্তু বন্ধুটা ঠিক কে?”
” কেন আমাকে চোখে পড়ছে না?”
একটি গাছের পিছন থেকে রিয়াদ বেরিয়ে এলো। রিয়াদকে দেখে রাফির চেনা চেনা লাগছে তাই বললো, ” আপনি কি এখানে আগেও এসেছেন?”
” হ্যাঁ। আট মাস আগেই তো এলাম। তখন তো আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। মনে নাই আপনার?”
” ঠিক খেয়াল নেই। তবে আপনাকে চেনা চেনা লাগছে।”
” যাই হোক এবার চিনে নিন। আমি রিয়াদ রায়হান, মুনের বন্ধু।”
” শুধু বন্ধু্?”
রিয়াদ কিছু বলার আগে মুন বলে উঠলো, ” সেসব কথা পরে হবে, এবার বলো আমাদের তোমার বাড়ি নেবে তো?”
” তার আগে বলো তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?”
” আসলে আমরা রাত্রী যাপনের জন্য বেশ চিন্তিত ছিলাম, এমন সময় একটি বাচ্চার সাথে দেখা। সেই তো আমার ফোনে তোমার আর আপুর ছবি দেখে তোমাকে চিনে ফেললো। তার থেকেই এই অব্দি এসেছি আমরা।”
” কিন্তু সেই বাচ্চাটি কে?”
” জানি না। তবে বললো তুমি তাকে চেনো। নাম বললেই চিনবে। তার নাম রবি।”
” রবি? মানে আমাদের রবি।”
” তোমাদের রবি বলতে?”
” আমার ভাইয়ের ছেলে।”
” ওহ। তা আমাদের যায়গা হবে তোমার বাড়ি?”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
রিয়াদ বললো, ” তা কি পরিচয়ে নিবে?”
মুন ঝটপট বলে উঠলো, ” কি পরিচয়ে আবার? তার হবু শালিকা আমি, সেটা বলেই নিবে।”
মুন এবং রিয়াদকে অবাক করে দিয়ে রাফি হেঁসে উঠলো এবং বললো, ” সেটা আর হওয়ার নয়।”
” কেন হওয়ার নয়?” রিয়াদ বললো
” কারন মাধুরি আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। মুন তুমি হয়তো ভাবছো তোমার বোন আমার সাথে এসেছে কিন্তু এটা সত্যি নয়।”
মুন বেশ চমকে বললো, ” মানে?”
এরপর রাফি যা দেখালো তা দেখে মুন এবং রিয়াদ দু’জনেই বেশ অবাক হলো। রাফির ফোনে মাধুরির একটি ভিডিও। যাতে মাধুরি এবং একটি ছেলে বেশ হাসি-খুশি মুখে রাফিকে তাদের নতুন সংসারের কথা বলছে। ভিডিওটি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে মাধুরি রাফিকে নয় ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসে এবং তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করতে চলেছে। মাধুরি খুব হাসি মুখেই রাফিকে তাদের বিয়ের বর্ননা দিচ্ছে।
ভিডিওটি দেখা শেষে রাফি বললো, ” আমি জানি তোমরা আমাকে খুঁজতেই এখানে এসেছো। তোমাদের মতে আমি আর মাধুরি সংসার করছি হয়তো কিন্তু এটা যে সত্যি নয় তা তো দেখতেই পেলে। আমি এক ব্যর্থ প্রেমিক। যার ভালোবাসাটা এতটাই ঠুনকো ছিলো যে প্রিয় মানুষটি অন্যকারো বুকে ভালোবাসা খুঁজে নিয়েছে।”
কথাটি বলার সাথে সাথে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো রাফির চোখ থেকে। অন্যদিকে মুনের হিসাব আবার তাল-গোল পাকিয়ে গেলো।
রাফি নিজেকে সামলে বললো, ” যাই হোক আমার বাসায় তোমরা বেড়াতে যেতেই পারো। আর চিন্তা করো না বাসায় বলবো তোমরা দু’জনই আমার বন্ধু।”
রিয়াদ বললো, ” গ্রামে ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক কেউ নিবে?”
” আমার পরিবার নেবে। আমাদের পরিবার তেমন নয়। তারা জানেন শহরের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু বান্ধবের অভাব নেই।”
” তাহলে যাওয়াই যায়।”
এবার মুন বললো, ” আমরা কিন্তু বেশ কিছুদিন থাকবো। গ্রামের সৌন্দর্য, মঞ্চনাট্য সব দেখে তারপর যাবো। আর আপুর সম্পর্কেও আপনাকে কিছু বলার আছে ভাইয়া।”
” আচ্ছা তাহলে চলো। আমাদের বাড়ি এখান থেকে কাছেই। মাত্র দু’ মিনিট লাগবে।”
” হুম চলুন।”
_________

আরিফ সাহেব খাবারের সামনে বসে আছেন কিন্তু খাচ্ছেন না। খেতে ইচ্ছে করছে না। গত আঠারো বছরে খুব কম দিন এমন গেছে যেদিন তিনি তার মেয়েদের ছাড়া একা খেয়েছেন। মেয়েরা তো তার হাতে খাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যেই বায়না ধরতো। কত সুন্দর ছিলো সেসব দিন। কতই না রঙীন। দিনগুলো হয়তো আর ফিরে পাওয়া হবে না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মাধুরি আর মুনের সেই হাসিমুখ, যে মুখের দিকে তাকিয়ে আরিফ সাহেব হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারেন।
আরিফ সাহেব মনেমনে হেঁসে উঠলেন মেয়েদের ছেলেবেলার কথা মনে করে। তখনি আরিফ সাহেবের বন্ধু সেখানে উপস্থিত হলেন। আরিফ সাহেবকে হাসতে দেখে তিনিও খুশি হলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন হয়তো পুরনো স্মৃতি মনে করেই আরিফ সাহেব হাঁসছেন। তবুও তিনি খুশি।
“বাস্তবে না হোক কল্পনাতে তো সুখী। মাঝেমাঝে কল্পনায় সুখী হতেও ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে।”
________
রিয়াদ এবং মুন দাঁড়িয়ে আছে তালুকদার বাড়ির প্রবেশ দরজায়। বাড়ির ভিতরে পা রাখার আগে মনেমনে একবার ভেবে নিলো কি কি বলতে হবে এবং কি কি করতে হবে! মুন এবং রিয়াদ ভিতরে ডুকতেই রাফির দাদু, বাবা, কাকা, কাকিমা এবং ভাবীকে দেখতে পেলো। তারা সবাই বসার ঘরেই বসে ছিলেন। তারা মুনকে দেখে কিছুটা যে চমকাচ্ছেন তা তাদের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রাফি সবার কৌতূহল মেটাতে বললো, ” এরা আমার বন্ধু। গ্রাম দেখতে এসেছে। কিছুদিন এখানে কাটাবে।”
তাদের চমকানোটা হয়তো রাফিকে বুঝতে দিতে চাননি তাই রাফির বাবা বললেন, ” রাফি তুমি উপরে যাও, তোমার মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। তিনি তোমার খোঁজ করছিলেন।”
” হ্যাঁ বাবা। কিন্তু ওদের থাকার….”
রাফিকে কথা বলতে না দিয়ে তিনি বললেন, ” সেটা আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি। যেহেতু আমাদের বাড়িতে থাকবে সেহেতু আমাদের ও চিনে রাখা উচিত। তো আমরা পরিচিত হই ততক্ষনে তুমি মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসো।”
রাফি আচ্ছা বলে উপরে চলে গেলো। রাফি সিঁড়িতে উঠতে উঠতে রাফির পরিবার তাদের পরিচয় দিলেন। তাদের সাথে রাফির সম্পর্কে কি সেটা বললেন। এবার রিয়াদ এবং মুনের বলার পালা। রিয়াদ প্রথমে শুরু করলো, ” আমি রিয়াদ এবং ও মনু। আমাদের বাসা….( ওদের বাড়ির আশপাশ থেকে যথেষ্ট দূরের ঠিকানা।)
” তোমরা একে-অপরের কি হও?”
প্রশ্নটি করলেন রাফির দাদু। রিয়াদ কোন রকম সংকোচ ছাড়াই, ” আমরা একই বিল্ডিং এ থাকি। আমাদের মায়েরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু এবং আমরা একে-অপরের খুব ভালো বন্ধু।”
শুধু রাফির ভাবী ছাড়া সবাই চমকালো। রাফির কাকা মুনের উদ্দেশ্যে বললো, ” তোমাকে দেখতে খুব সুন্দর।”
মুন বোধহয় এরকম একটি প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সাথে সাথে বললো,” সবি ডাক্তারের কৃপায়।”
” মানে?”
এবার রিয়াদ বললো, ” আসলে ওর মুখে সার্জারী হয়েছিলো তো তাই বললো।”
” সার্জারী হয়েছিলো মানে?”
” আসলে এটা ওর আসল মুখ না। ওর আসল মুখটিও সুন্দর ছিলো তবে এতটা নয়। সে যাই ওর মুখটি বিশ্রিভাবে পুড়ে গেছিলো তখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ায় ডাক্তার এই মুখ করে দেয় সার্জারী করে।”
” মানে? এভাবে অন্যমুখ বসিয়ে দিলো? আগের মুখের ছবি ছিলো না সেটা দিয়ে তো আগের মতোই করতে পারতো?”
” আসলে ডাক্তার বিক্রি হয়ে গেছিলো। কোন এক আরিফ নামের লোক টাকা দিয়ে এই মুখটি বসাতে বলেছিলো। কিন্তু কেন তিনি এমন করেছেন সেটা আজও জানি না আমরা!”
কথাটি বলে রিয়াদ একটু দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেললো।
রিয়াদের কথা শুনে রাফির দাদু বললো, ” ওদের ঘর দেখিয়ে দেও।”
মুনদের নিয়ে রাফির ভাবী উপরে গেলো। উপরের শেষের দিকের দুটো রুম ওদেরকে থাকতে দেওয়া হলো। মুন জানে ওরা কথাগুলো ততটা হজম না করলেও কিছুটা যে করবে সেটা নিশ্চিত।

চলবে,,
[ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন। আজ আর আমি কিছু বলবো না, আপনারাই বলুন লেখার মান কেমন হয়েছে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here