চলো রোদ্দুরে পর্ব-১২

0
1815

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_12

বই নিয়ে হোস্টলের নিচে দাঁড়িয়ে আছে রাদ। হাতে একদম ই সময় নেই। অফিস টাইম থেকে সময় নিয়ে বুক শপে গিয়েছিলো। ফার্স্ট ইয়ারে বই আর নোট কেনার জন্য। সেটা অবশ্য প্ল্যান এর মধ্যেই ছিলো।তবে জ্যাম এর কারনে লেট হলো। গাঁয়ে হুডি জড়িয়ে নিচে নেমেছে ভোর। হোস্টেলের সবাই হুডি পরে সেই কারনে নিজেকে এলিয়েন মনে হয় না। তবে কিছু টা অপ্রস্তুত বোধ এখনো হচ্ছে। বই গুলো তুলে দিয়ে রাদ বলে
_কাল থেকে কলেজ শুরু। আমি তোমাকে রোজ সকালে পিক করবো আবার টাইমলি ড্রপ করে দিবো।

_আচ্ছা।

_কিছু দিন সময় নাও।দ্যান কোচিং এ এডমিট করিয়ে দিবো। মন দিয়ে পড়ো।

_হুম। ভেতরে যাবেন না?

_না সময় নেই।

_ওহহ।

এক পা এগিয়ে আবারো চলে আসে। ভোর সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। একটু ঝুঁকে রাদ বলে
_ যদি ও হুডির সাথে স্কাফ এর প্রয়োজন নেই , তবে আনকমফর্টেবল ফিল হলে মাফলার নিও।

_আচ্ছা।

_আমি যাচ্ছি আর শোনো নিজের যত্ন নিও।

রাদ চলে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোর। কি একটা জীবন। যেখানে পরিবার বলতে কেউ নেই। আপন বলতে শুধু একজন সে ও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর সাথে বিয়ে নামক এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে মাত্র। এমন জীবন তো চায় নি ওহ। শুধু শুধু ওর জন্য আরেক টা জীবন ও নষ্ট হতে যাচ্ছে। চরম ঘৃনা হয় নিজের প্রতি। পরিস্থিতি ওকে কোথায় নামালো।
.

_শোনো রাদ দুটো পেশা সামলানো একটা আর্ট। যাহ অতি সহজে হয় না। এখন তুমি ফ্রি টাইমে আছো, তাই বিজনেস সামলানো তেমন আহামরি লাগছে না। কারন সম পরিমানে প্রেসার তুমি আগে ও নিয়েছো। বাট যখন তুমি লাইসেন্স পেয়ে যাবে হসপিটালে জয়েন করবে। দ্যান আরেক টা প্রেসার নিতে হবে তোমাকে। কতো টা গভীর চাপ একটু ভেবে দেখো।

_আমি জানি ড্যাড। দুটো প্রফেশন সামলানো প্রচন্ড হার্ড।বাট আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট এন্ড আই বিলিভ নাথিং ইজ ইমপসিবল।

_শুনে ভালো লাগলো। আশা করি তুমি তোমার ড্যাড এর থেকে বেশি প্রেসার নিতে পারবে।

_উমম পারবো ড্যাড। তোমরা পাশে থাকলে অবশ্যই পারবো।

ইফতিহার শুধুই হাসলেন। একটা ফাইল নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে পরলেন। রাদ কে তো চাপ নিতেই হবে। মাত্র তো পড়াশোনার এক টা ধাপ পেরোলো। এখনো তো আরো অনেক মেডিকেল ড্রিগি নিতে হবে।

আজ খুব সংকোচ বোধ করছে রাদ। ইফতিহার এর বিজনেস ফেস সত্যিই প্রশংসা প্রাপ্ত। এমন কঠোর কর্মসূচির জন্যই সমান তালে এগিয়ে আছেন তিনি।

কেবিনের এক পাশে সাধারন জনতার মতো বসে আছে রাদ। এই কয়েক দিন কনফারেন্স মিটিং এ স্বাভাবিক থাকলে ত অফিসে বেশ কঠোর ইফতিহার।

_মে আই কাম ইন স্যার?

_ইয়েস কাম ইন।

সোফা তে রাদ কে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসে মুসতাকিম। সামনে এসে বলে
_গুড মর্নিং স্যার।

_গুড মর্নিং।

_আজ থেকে অফিসে জয়েন করবেন?

_উহহু এখন একটু কাজ গুলো শিখে রাখবো। পরে সময় হলে জয়েন করবো।

_ওহহ।

_ এদিকে আসো মুসতাকিম।

_ ইয়েস স্যার।

ইফতিহারের বরাবর চেয়ারে বসে মুসতাকিম। ছেলেটা অফিসের ছোট খাটো পদে পার্ট টাইম জব করছিলো। তাছাড়া কম্পিউটারে ও বেশ ভালো দক্ষ, আর কাজের প্রতি সৎ।
_তোমাকে বিশেষ প্রয়োজনে ডেকেছিলাম।

_ইয়েস স্যার।

_গত এক বছর যাবত বেশ ভালো কাজ করেছো তুমি। আমি বেশ খুশি তোমার উপর। এবার মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছো তাই তো?

_জি স্যার।

_তুমি আর রাদ সমবয়সীই হবে। আর সমবয়সী দের মাঝে যদি বন্ধুত্ব সুলভ আচারন হয় তবে কাজ ও সুষ্ঠু হয়। আমি বিশ্বাস করি তুমি তোমার দায়িত্বে অটল। তাই তোমাকে রাদ এর পি এ হিসেবে নিয়োগ দিতে চাই। তোমার কি মতামত?

মুসতাকিমের চোখ দুটো গোল হয়ে যায়। বেশ কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে ছেলেটা। এই ছোট চাকরি টা ওকে কতো টা সাহায্যে করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। সৎ কাজ করেছে সব সময়।আর সেই সুবাদে আজ এতো বড় দায়িত্ব পেয়েছে ওহ।
বসা থেকে উঠে যায় ওহ। খুশি মুখে বলে
_থ্যাংকস স্যার।আমি আমার বেস্ট দিয়ে কাজ করবো।

_আই নো দ্যাট। ফরমালিটিস গুলো পূরন করে দাও।

_জি স্যার।

কিছু টা অদ্ভুত ভাবে বসে থাকে রাদ। সব কিছুই ওর মাথার উপর দিয়ে গেল। ছেলের অবাক হওয়া দেখে বিস্মিত হয় নি ইফতিহার। চত্বর বুদ্ধি সম্পূর্ণ তিনি। বিজনেস টা রক্তে মিশে আছে। তবু ও ভয় হয় কে কখন ক্ষতি করে দেয়। রাদ কে ও বিজনেস কি জিনিস তা প্রতি অক্ষরে অক্ষরে শিখতে হবে।

ইফতিহার ড্রাইভ করছেন আজ। আর রাদ তাঁর সহযাত্রী। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ছেলে টা কিছু বলবে বলবে করে ও বলতে পারছে না। ইফতিহার যে এতো টা আলাদা তা কিছু তেই বুঝতে পারে নি তবে এক পলক তাকিয়ে বুঝতে পারে অফিসে থাকা কালীন ইফতিহার আর বর্তমান ইফতিহারের মাঝে অনেক ফারাক। তাই বলে
_একটা কথা বলার ছিলো ড্যাড।

_হুম বলো।

_অফিস টাইমে তোমাকে অদ্ভুত লেগেছে আমার। দেখে মনেই হয় নি তুমি আমার ড্যাড।

হেসে ফেলেন তিনি। রাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারো ড্রাইভে মনোযোগী হন। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি টা সাইট করে বলে
_প্রতি টি মানুষের বিজনেস ফেস ভিন্ন হওয়া উচিত। একটা বিষয় মনে রাখবে কে কখন তোমার পিঠে ছুড়ি চালাবে বুঝতে ও পারবে না। এখানে চলে টাকার খেলা। তবে কেউ কেউ আছে যাঁরা আত্মিক ভাবে কাজ টা কে গ্রহন করে। এমন মানুষের সংখ্যা খুব ই কম বেটা।

_হুম বুঝলাম। তবে সত্যি কথা বলতে কি তখন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার ড্যাড যাঁর চোখে মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে সে এমন ভঙ্গিমা করে থাকতে পারে, অবিশ্বাস্য ছিলো।

_তুমি আমার ছেলে রাদ। ভয় কেন পাবে? এই চব্বিশ বছরের জীবনে এই টুকু তো বুঝতেই পেরেছো তুমি আর তোমার মম আমার কাছে সব থেকে প্রিয়। যখন থেকে তোমার দাদা দাদি কে হারিয়ে ছি তখন থেকে শুধু মাত্র তোমরাই আমার আপন। কারন আমি বুঝেছিলাম রক্তের সম্পর্ক হলেই আপন হওয়া যায় না।
অবশ্য কষ্ট তো তখন পেয়েছিলাম যখন নিজের ভাই ও পর হয়ে গেল।

_প্লিজ ড্যাড ক্লোজ দ্যা ম্যাটার। অনেক দিন হলো কাচ্চির কম্পিটিশন করি না। চলো হয়ে যাক আজ।

_তুমি পারবে না বেটা।

_তোমাকে হারাবোই আমি।

_আচ্ছা দেখা যাক।

দুই প্লেট কাচ্চি শেষ করে দিলেন ইফতিহার আর রাদ এক প্লেটেই বসে আছে। হার মেনে নেয় ছেলে টা। বাবার মতো খাদক হতে পারে নি সে। হাসেন ইফতিহার, কার্ড বের করে নাক কুঁচকে রাদ বলে
_ইসস আমার এতো গুলো টাকা চলে যাবে এখন।

_বলেছিলাম, পারবে না। এখন পে করো 1500 টাকা।

_ধ্যাত আমার প্রিয় টাকা গুলো।

ছেলের ভঙ্গিমা তে হাসেন ইফতিহার। রাদ কে ড্রপ করে দিতে চাইলে রাদ বলে
_আমি একটু পরে যাবো ড্যাড। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চাচ্ছি।

_আচ্ছা যাও। তবে বেশি রাত করো না। আমি কি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো?

_দরকার নেই। ওদের কারো বাইক দিয়ে চলে যাবো।

_ওকে।

ইফতিহার চলে যান। মিনিট দশেক পর রনিত আসে। বন্ধু মহলের বেস্ট ফ্রেন্ড হলো রনিত। ছেলেটা যেমন তেমন স্বভাবের। তবে ইনায়ার সংস্পর্শে এসে একদম ই বদলে গেছে। ভালোবাসার প্রভাবে পাল্টে গেছে ওহ। এখন এই মনে এক জনের ই বাস।
.

কলেজের প্রথম দিন। বুকের ভেতর ধীম ধীম কিছু একটা বেজে চলেছে। মনের ভেতর খচ খচ হচ্ছে। এই আড়ষ্টতা, এক অদ্ভুত সংকোচ, ধীম ধীম আওয়াজ কি পাশে থাকা মানুষ টা বুঝতে পারছে না?

গাড়ি তে থেকে তিক্ত হয়ে গেছে ভোর। এতো সময় যাবত জ্যাম লেগেছে যে ঘাম নেমে গেছে। কে বলবে এখন শীত কাল?
_ এটা কি এসি গাড়ি ডাক্তার সাহেব?

_হুম।

_এসি টা অন করুন না।

এতোক্ষন পর ভোরের দিকে পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকায় রাদ।মেয়েটা ঘেমে একাকার। গ্লাস অফ করে এসি অন করে দেয় রাদ। বলে
_মাফলার খুলে ফেলো।

_হুম।

_এতো ঘামছো যে? শরীর খারাপ লাগছে।

_উহহু ভয় হচ্ছে খুব।

_ভয়? সেকি এতে ভয় পাওয়ার কি আছে?

উত্তর করে না মেয়েটা। রাদ ও নিশ্চুপ হয়ে যায়। জ্যাম ছাড়তেই গাড়ি চালাতে শুরু করে। ক্যাম্পাসে এসে ভোরের বরাবর দাঁড়ায়। ধীর হাতে দুই বাহু তে হাত রেখে বলে
_আমার দিকে তাকাও।

ভোর তাকায়। তবে আবারো চোখ নামিয়ে নেয়। মুখ দিয়ে বিরক্তি কর শব্দ ফুঁটিয়ে বলে
_আরে তাকাও।

এবার মুখ তুলে তাকায় ভোর। রাদের দৃষ্টি ধারালো। গলায় পানি শূন্য অনুভব হয়। আদুরে কন্ঠ টা কানে আসতেই গা শিউরে উঠে। মেয়েটা যে পুরো ক্যাম্পাসে একা। রাদ বলে
_ভয় পেলে চলবে বলো। জীবনে কতো কাজ একা করতে হয়। তোমাকে তো সেভাবেই গড়ে উঠতে হবে। এতো টা বড় হতে হবে যাতে আর ও দশ টা মেয়ে তোমার থেকে শিক্ষা গ্রহন করে। কোনো স্বামী তাঁর স্ত্রী কে যৌতুক এর জন্য টর্চার করতে না পারে। কোনো বাবা মা ভবিষ্যত পরিস্থিতির জন্য চিন্তা গ্রস্ত হয়ে মেয়ে কে অবহেলায় না ঠেলে দেয়।

আরো অনেক কথাই বলে রাদ। তবে ভোর আটকে গেছে। মানুষ টির মুখ থেকে স্বামী শব্দ টি শুনে আটকে গেছে ওহ। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টি যে ওর স্বামী। তবে কাগজে কলমের স্বামী, মনের দিক থেকে কারোই তো অনুভূতি নেই। এই সম্পর্ক এক জনের কাছে দায়িত্ব আর আরেক জনের কাছে মাধ্যম। শুধু মাত্র নিজ লক্ষ্যে পৌছানোর মাধ্যম। রাদ ছাড়া সাহায্য করার মতো কেউ নেই ওর কাছে। সৃষ্টিকর্তার এক মাত্র উছিলা হলো রাদ। যেই মানুষ টি পরিস্থিতি অনুযায়ী ওর স্বামী হয়েছে।
_আপনি চলে যান।

_ক্লাস রুমের ভেতরে পৌছে দেই তোমায়।

_উহুহ। পুরো ক্লাস তো আমি একাই করবো, আপনাকে আর নিতে চাচ্ছি না। আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন এই মুহুর্তে আপনাকে আর বিপাকে ফেলে দিতে চাই না।

_বিপাক কেন বলছো?

_আপনার জীবন থেকে অনেক টা সময় নিয়ে নিলাম আমি। যে সময় টা আপনি অন্য কোথাও ব্যয় করতে পারতেন।

_এমন করে কেন বলছো তুমি? লুক, তুমি কি আপসেট বা আমার প্রতি বিরক্ত। কোনো ভাবে আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি?

কিছু টা দূরে সরে যায় মেয়েটা। রাদের প্রতি বিরক্ত হওয়া ওর কোনো কালেই সাজে না। যে ছেলে টা ওর জন্য এতো করলো সেই মানুষ টার প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা আসে। পেছন থেকে অনুনয়ের সরে রাদ বলল
_ ভোর।

প্রচন্ড আবেগ এই কন্ঠে। রয়েছে মন মাতানো সুর।সাথে তীব্র ব্যাথা ও মিশ্রিত। আতকে উঠে মেয়েটার হৃদপিন্ড। খন্ডিত করতে চায় বুক। দেখতে চায় মানুষ নামের সেই অদ্ভুত ব্যক্তি টি কে।যে কিনা সবার থেকে আলাদা।বিনা সংকোচে রাদের হাত দুটো স্পর্শ করে বলল
_আপনি মন খারাপ কেন করছেন? আমি তো শুধু বলতে চাচ্ছি বাকি পথ টা তো আমায় একাই চলতে হবে। জীবনে বড় হতে হবে না? আপনি তো সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে পারবেন না। তাই আমি এই টুকু ও একা চলতে চাচ্ছি।

_আচ্ছা যাও। বাট কাউ কে ভয় পাবে না। তোমার ডাক্তার সাহেব সব সময় তোমার পাশে আছে।

_হুম।

_ফোন অফ করবে না কখনো। ক্লাস শেষ হলে আমাকে জানিয়েও আমি তোমাকে পিক করবো। বেস্ট আফ লাক।

মৃদু হেসে পথ আগায় ভোর। নির্লিপ্ত তাকিয়ে থাকে রাদ।মেয়েটা কে একা ছাড়তে ও ভয় হয়। তবে জীবনের সব টুকু পথ কারো পাশে চলা যায় না। মাধ্যম হলে ও সর্ব সাথী হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।তবে হ্যাঁ জীবন কে সুষ্ঠু ভাবে গড়ার জন্য মনোবল ই যথেষ্ট। আর ভোরের মনোবল ই হতে চায় রাদ। এক টা অবহেলিত মেয়ে কে গড়ে তোলায় প্রত্যয় নিয়ে এসেছে। এই দায়িত্ব কে আগলে রাখতে পিছু হটবে না কখনোই।

জয়েন করুন
Fatema’s story discussion

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here