চলো রোদ্দুরে পর্ব-১৮

0
1767

#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_18

নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে ভোর আর রাদ। মৃদু বাতাসে শরীর বার বার কেঁপে উঠছে। দু বাহু তে হাত বুলিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায় ভোর। বিষয় টা চোখে পরলে ও তৎক্ষনাৎ কোনো কথা বলে না ছেলেটা। ওহ আড়চোখে দেখে চলেছে ভোর এর গতি পথ। বেশ অনেকক্ষণ পর মুখ খুলে ভোর। রাদ এর কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল
_দুঃখিত।

মেয়েটার ছলছল চোখ বুকের ভেতর শীতলতা নামায় আবার কোথাও একটা কষ্ট ও অনুভব হয়। কাঁপা হাতে ভোর কে স্পর্শ করে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় এ স্পর্শে বিদ্যুৎ রয়েছে। কিছু টা ঝটকা মেরেই সরে যায়। ফলে বিব্রত হয় রাদ। মাথা টা নিচু করে বলে
_স্যরি। আমি আসলে বুঝতে পারি না।

_ঠিক আছে।

শুকনো ঠোঁট টা জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলে
_কাঁদছিলে কেন তুমি?

_আসলে আমার ভালো লাগছিলো না। সব কেমন কেমন লাগছিলো।

_সত্যি? নাকি কিছু লুকাচ্ছো আমার কাছে?

মাথা টা নিচু করে ফেলে ভোর। গলা টা কাঁপছে। কান্না রা চোখ ফেঁটে বেড়িয়ে আসে। হঠাৎ এমন করায় ভ্রু কুঞ্চিত করে রাদ। প্রগাঢ় দৃষ্টি মেলে তাকায়। লক্ষ্য করে ভোরের আঁখি পল্লব ধীরে ধীরে উঠা নামা করছে। তাই মোলায়েম গলায় শুধায়
_মিথ্যে বলো না মেয়ে। মিথ্যে বলে কখনোই সমাধান হয় না। বরং সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়।

_ঐ ছেলে টা পার্সেল পাঠিয়েছে।

_কোন ছেলেটা?

_যে প্রথম দিন আমার হাত ধরেছিলো।

দু চোখ কিছু টা লাল হয়ে উঠে। কপালে কয়েক টা ভাঁজ পরেছে। নীরস হাসলো ছেলেটা। ভোরের দিকে একটু এগিয়ে আসলো। চোখ ফুলে গেছে একদম। এক গাছি চুল বার বার চোখে এসে লাগছে। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে। শীতলতার মাঝে রাদ এর উষ্ণতা এসে পরে গাঁয়ে। নিশুতি রাতে আঁধারে ডুবে আছে অর্ধচন্দ্র।
ম্রিয়মান আলো প্রস্ফুটিত হয়। দুজনের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভারী হয়ে পরেছে অনেকক্ষণ যাবত। কিছু টা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে রাদ। তাঁতে যেন মেয়েটার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে। চলে যেতে নিলেই হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে রাদ। এই প্রথম কিছু টা চেপে ধরে ভোর কে। ফিস ফিস করে বলে
_ঐ ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করে। তুমি কি ওকে পছন্দ করো? মিথ্যে বলবে না একদম। লজ্জায় বলতে পারছো না এমন কিছু নয় তো?

বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ভোর। এই মুহূর্তে রাদ কে বিরক্ত লাগছে ওর। এমন বাঁজে ধারনা কি করে করতে পারে? অবাক হওয়ার স্বরে বলল
_ডাক্তার সাহেব!

_তাহলে মিথ্যে কেন বলেছিলে ভোর?

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। ওর ছটফট দেখে কঠিন গলায় রাদ বলল
_হুসস। যেভাবে আছো সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকো। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে এক চুল ও ছাড়বো না। কেন মিথ্যে বললে তুমি?

শেষোক্ত কথা তে রাগ স্পষ্ট। কিঞ্চিত কেঁপে উঠে মেয়েটা। রাদ যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরেছে। আরো জোড়ে চেপে ধরায় আহ করে আর্তনাদ করে উঠে ভোর। তাঁতে ও কোনো হের ফের নেই। মেয়েটা ভয় পায় এবার। রাদ এর বুকে হাত রেখে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে
_ব্যথা পাচ্ছি আমি।

_আরো ব্যথা পাবে তুমি। মেরেই দিবো একদম। মিথ্যে কেন বলেছো?

ঝমঝমে কাঁদে ভোর। রাদের হাত আলগা হয় এবার। তবে মেয়েটা সরে না। বরং রাদ এর বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। অদ্ভুত শিহরনে ছেয়ে যায় ছেলেটার শরীর। পাশ থেকে বুনো ফুলের সুভাস নাকে আসে। ঝোঁপ থেকে ঝি ঝি পোকা রা গান গেয়ে চলেছে অবিরত সাথে বাতাসের ঝাঁঝালো শব্দ।
এই প্রথম মেয়েটার কপালে চুমু খায় রাদ। কেন করলো এমন জানা নেই। দুজনেই কেমন অদ্ভুত আচারন করছে। হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে কি?

নাক টেনে ভোর বলতে লাগলো
_ আমি ভেবেছিলাম ছেলে টা এমনি তেই চলে যাবে। অথবা একটু একটু বিরক্ত করবে। ঝামেলা করে লাভ কি? তাই বলি নি। আপনি এতো ব্যস্ততার মাঝে আমাকে নিয়ে ছুটোছুটি করেন তাঁর উপর এসব উটকো ঝামেলা। আমার মনে হয়েছিলো না বলাই ভালো। তবে পার্সেল এ লাল রঙের শাড়ি দেখে আমার কেমন লেগে যায়। ভালো লাগছিলো না কিছু। সব কেমন কেমন লাগছিলো। আম স্যরি, আমি কখনো এমন করবো না ডাক্তার সাহেব,আর কখনো করবো না এমন।

মেয়েটার ছলছলে নয়নের রূপ যেন চাঁদের সৌন্দর্য কে ও হার মানিয়েছে। মেয়েটা কে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে। চোখের পানি তে শার্ট ভিজিয়ে ফেলে ভোর। মৃদু হাসে ছেলেটা। তবে একটু আগের আচারনের জন্য মোটে ও লজ্জিত নয় ওহ। ভোর হলো ওর কাছে আমানত স্বরূপ। সেখানে এক টা মিথ্যে অথবা এড়িয়ে যাওয়ার ফল অনেক ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।
.

পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে থাকতে চেয়েছিলো রাদ। তবে ভোর বারন করেছে। আর প্রমিস করেছে কিছু হলে সোজা কল করবে।কাল মেহেদী সন্ধ্যা ছিলো সেই কারনে প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে সময় কেঁটেছে। আজ আবার হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকেই নানান আয়োজন। তাই রাদ ও সম্মতি প্রদান করেছে। রনিত এর বাসায় আসতেই মৃদু চেঁচামেচি শুনতে পায় ওহ। ডয়িং রুমে আসতেই দেখে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে রূপ। ইশারায় রনিত কে প্রশ্ন করতেই রনিত বলল
_এই হারামি রোজ ভারসিটি যাবে অকারণেই। ক্লাস তো করবেই না। আজ ওর এক মাত্র বড় ভাইয়ের হলুদ সন্ধ্যা কাজ কর্ম না করে এখন ভারসিটি যাবে।

_বসে আছিস কেন রনিত? ওর মাথা টা ফাঁটিয়ে দে না।

_ব্রো।

রূপ এর কথায় মুখ চেপে হাসে রাদ। ছেলেটার মুখ টা দেখার মতো হয়েছে। কান থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ মারে রাদ। সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগায় রূপ। পেছন থেকে চেঁচাতে থাকে রনিত। রাদ বলল
_আরে ছাড় তো ওর কথা। এখন প্রচুর কাজ রয়েছে। একটু পর ইনায়ার বাসায় যাবো।

_ভাই একটা হেল্প করবি প্লিজ।

_কিসের হেল্প হু?

আশে পাশে তাকায় রনিত। কাউ কে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির দম ফেলে। ফিচেল গলায় বলে
_আমি ও যাবো ওকে হলুদ মাখাতে।

_যাবি?

_হুহ।

_ট্রিট?

_শালা প্রতি কথায় ট্রিট দে ট্রিট দে করিস। আচ্ছা দিবো, প্লিজ তুই ম্যানেজ কর। আর হ্যাঁ ইমরোজ স্যার মানে আমার হবু শশুর যেন আমাকে না দেখতে পায়। তাহলে এ জীবন টা সর্বনাশা হয়ে যাবে রে।

হেসে ফেলে রাদ। ইমরোজ কে প্রচন্ড ভয় পায় রনিত। অথচ তাঁর মেয়ে কেই বিয়ে করতে চলেছে।

হালকা সাজে সেজেছে ভোর। মেয়েটা যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলো রাদ এর ভেতর টা ধুমরে মুচরে যাচ্ছিলো। মনে পরে যাচ্ছিলো সেই দিন টির কথা। সব কিছু ঠিক থাকলে ভোর আজ অন্যের ঘরের বউ হতো? কাঁচা ফুলের গহনায় কি দারুন লাগছিলো ওকে। এখনো সেই সময় টা স্পষ্ট।
গাঁ শিউরে উঠলো ছেলেটার। মৃদু শির শির অনুভূতি হয়। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে ভোর। কিছু টা ঝুঁকে সিট ব্লেট লাগিয়ে দেয় রাদ। এমন টা নয় যে ভোর সিট ব্লেট লাগাতে পারে না। তবে মেয়েটা আজ ক্লান্ত। পরীক্ষা শেষ হতে না হতে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হয়েছে। হোস্টলে ফিরেই সাজ গোঁজ করতে হলো। সারা দিনের ধকল যেন ওকে অসুস্থ করে দেয়।
_অসুস্থ বোধ করছো তুমি?

_উহহু।

_তাহলে?

_ক্লান্ত লাগছে খুব।

_স্যরি।

_সমস্যা নেই। আপনি টেনশন করবেন না তো। আমি এখন ঠিক আছি। একটু ধকল গেলো আর কি।

_আরে সেটার জন্য নয়। কাল রাতের জন্য স্যরি। খুব ব্যথা পেয়েছিলে তাই না?

এক রাশ লজ্জা এসে ভর করে মেয়েটা কে। ব্যথা পেলে মানুষের মন খারাপ হয় তবে মেয়েটা কেন লজ্জা পাচ্ছে? ছেলেটার ভাবনার মাঝেই ভোর বলল
_না ঠিক আছে।

রাদ আর কিছু বলল না। ভোর যেন রাদ এর দিকে তাকাতেই পারছে না। অনাকাঙিক্ষত ভাবে হলে ও রাদ ওকে গাঢ় ভাবে স্পর্শ করেছে কাল। বিষয় টা অত্যন্ত লজ্জাদায়ক ই বটে।

রনিত কে ফুলের গাড়ি তে উঠাচ্ছে রাদ। ছেলেটা ভীষন ভয় পাচ্ছে। সেই কারনে পুরো ছদ্মবেশ নিয়েছে। মুখে মাক্স লাগিয়েছে এমন ভাবে যেন কোনো জোকার। হাসির রোল পরে গেছে একদম। সুপ্তি , রায়া অনেক আগেই ইনায়ার বাসায় অবস্থান করেছে। সাথে বাঁদরামো যেন না করতে পারে তাই রূপ কে ও নিয়ে নিয়েছে। এ দিকে ভোর বিব্রত বোধ করছে। তিন টে ছেলের মাঝে ওহ একা দাঁড়িয়ে। ভোর এর কাহিল অবস্থা দেখে রনিত এর উপর রেগে যায় রাদ। চেঁচিয়ে বলে
_ইচ্ছে হলে উঠ না হলে বসে থাক আমি গেলাম।

_আরে ভাই রেগে যাচ্ছিস কেন?

_দ্বীপ ওকে নিয়ে ফুলের গাড়ি তে উঠে পর তো।

_ ওকে তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনি উঠে যাচ্ছি।

_শেষ মেশ বর হয়ে যাবো ফুলের গাড়ি তে?

রনিতের কাছে আসে রাদ। ভ্রু কুটি করে বলে
_তোর শশুর মশাই যে সিকিউরিটি রেখেছে এতে আর কোনো উপায় নেই। অন্য কোনো গাড়ি নট এলাউ। তাছাড়া তুই তো ওনার সামনা সামনি হতে নারাজ। যদি হতে চাস তাহলে বলতে পারিস আমি এখনি নিয়ে যাচ্ছি।

_না নাহহ আমি ঠিক আছি। ফুলের গাড়ি ই বেস্ট।

মেকি হাসি দিয়ে গাড়ি যে চরে বসে। দ্বীপ বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সব ঠিক ঠাক জানায়। ফুলের গাড়ি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায়। শ্বাস ফেলে রাদ। ভোরের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেয়েটা একদম জমে গেছে। রাদ বলল
_কি হলো যাবে না হলুদ দিতে?

_যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া একটু পর তো সবাই ছেলের বাড়ি তেই চলে আসবে। শুধু শুধু জার্নি করে কি লাভ?

মেয়েটার কথা গুরুত্ব দেয় রাদ। সত্যিই তো একটু পর ই সবাই চলে আসবে রনিত কে হলুদ লাগাতে। তাঁর থেকে বরং এখানে থাকাই ভালো। পুরো মন্ডপ খালি প্রায়। ভোর কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে রাদ। কেন যেন রাদ কে কখনোই বাজে মানুষ মনে হয় না ওর। এক মুহুর্তের জন্য ও মনে হয় না একা পেয়ে রাদ ওর ক্ষতি করবে। এমন কেন হয়! তবে কি অনাকাঙিক্ষত সেই বন্ধনের কারনেই এমন শুভ্র অনুভূতি আর বিশ্বাস?

** গ্রাম থেকে টাউনে সিফ্ট হচ্ছি। কতো টা ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে আশা করি বুঝতে পারবেন। সময় হলে গল্প পাবেন ইনশাআল্লাহ।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here