#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#পার্ট_43 [ সমাপ্তি পার্ট ]
‘ মাঝে মাঝে ভাবি আমি কেন কারো মন ছুঁতে পারি না। একা লাগে খুব। সত্যিই খুব একা লাগে। জানো আমার সব থেকে ও যেন কিছু নেই। ঐ যে স্বর্ন খচিত থালায় মাখা ভাত কেউ তুচ্ছ করে ভাঙা থালার পান্তা খুঁজে। আমি ও বোধহয় তেমনি একজন। কারো জীবনের সুখ হতে পারি নি হয়েছি এক রাশ হতাশা আর দুখ।এগারো বছরের প্রেমানালে জ্বলে আমি তো শেষ হয়ে গেছি বহু আগেই।
এখানে আমার ভালোবাসার মূল্য রয়েছে।তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমার ভালোবাসার মানুষ টি কে আঁধার থেকে রোদ্দুরে নিয়ে এসো। ‘
কিছু সময় হলো কয়েক পাতার চিঠি আর কিছু ডকুমেন্ট পার্সেল এসেছে। কেউ নিজের জীবনের কষ্ট টুকু কয়েক লাইনে স্বল্প ভাষায় ব্যক্ত করেছে। অতীতে ঘটা সমস্ত আলোচনা স্বচ্ছ তরলে মতোই পরিষ্কার হলো ভোরের কাছে। সবার ভাগ্যে সুখ থাকে না। ঠিক তেমনি নীলাশার কপালে সুখ নেই আছে শুধুই তিক্ততা আর প্রেমানল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। তবে নিজের স্বামীর ভাগ দিবে কোন নারী?
রক্তিম হয়ে আছে শুভ্র আকাশ। অসুস্থ কাকের কা কা আওয়াজে পরিবেশ টা বিষাক্ত হয়ে গেছে। জলে টুইটম্বুর হয়ে যাওয়া অক্ষি পল্লব মেলে তাকালো সুপ্তি।সামনেই নিষ্প্রাণ একটি ছেলে দাঁড়িয়ে।হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। সেটা থেকে বুঁদ বুঁদ করে ধোঁয়া উড়ছে।
কিছু সত্য যেন ভেঙে দিয়েছে দুটি হৃদয়। কথায় আছে সত্য সর্বদা তিক্ত হলে ও সেটা সত্য হয়। এই চিরন্তন শব্দ গুলোর বদল ঘটবে না কখনোই।
_কি দোষ ছিলো আমার?
এতো আকুলতা কারো কন্ঠে হয় বুঝি? এই মুহূর্তে সুপ্তির কন্ঠ থেকে যেন বেদনা ঝরে ঝরে পরছে। অশ্রু যেন বৃষ্টি হয়ে নামছে। সত্য কে মিথ্যে করে দেওয়ার তীব্র ইচ্ছের প্রতিনিধিত্ব করছে ভারী নিশ্বাসের শব্দ।
পকেট থেকে আরেক টি সিগার বের করে অতি সহজেই ধোঁয়া উড়াতে লাগলো নাহিদ। তাচ্ছিল্য হাসলো মেয়েটি। আড় চোখে তাকিয়ে সুপ্তির অবিশ্বাস্য চাহনি পরিলক্ষিত হলো। এই ভাঙা চাহনি ওকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলো একটি করুণ বিচ্ছেদ।
ওহ তো চায় নি প্রেমের মায়ায় জড়াতে। তবে কোন কারনে মায়ায় জড়িয়ে গেল? অনেক ভেবে ও এর উত্তর খুঁজে পেল না নাহিদ। সিগারেট টা খুব যত্ন নিয়ে শেষ করলো। ডান হাতের পিঠে চোখ মুছে সুপ্তি আবার শুধালো
_রাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দিয়েছিস তা ফিরিয়ে নে।
_পারবো না।
_নাহিদ!
কিছু টা এগিয়ে এলো নাহিদ। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। গত তিন রাত এক মুহুর্তের জন্য চোখের পাতা বুঁজে নি। শরীর ক্লান্ত, দেহে যেন প্রান নেই। দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো ওকে। বলল
_ওর জন্য মায়া হয় আর আমার জন্য সামান্য করুণা ও হয় না?
_না হয় না। একজন প্রতারকের জন্য কেন করুণা হবে?
_মানছি আমি প্রতারক। তবে সব কিছু মিথ্যে হলে ও আমার ভালোবাসা কিন্তু মিথ্যে নয়।
_সেটা বিলাসিতা মাত্র।
_একটা সুযোগ দিবি আমায়?
_প্রতারক কে আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না। সুযোগ দিয়ে নিজের বিবেকের কাছে নিজে ঘৃণিত হতে চাই না।
_প্লিজ।
এতো আকুলতায় কোনো প্রেমিকা কি ঠিক থাকতে পারে? তাই তো নাহিদ কে জাপটে ধরেই ঝমঝমে কেঁদে উঠে। মন আর মস্তিষ্ক এক সঙ্গে চলছে না। আবেগ আর বিবেক এর বিরুদ্ধে লড়াই করে হাঁপিয়ে উঠেছে মেয়েটা।
কাঁপা হাতে মেয়েটি কে স্পর্শ করলো নাহিদ। ভাঙা গলায় বলল
_এতো ভালোবাসা থেকে ও আমাদের জীবনে বিচ্ছেদ কেন হলো রে সুপ্তি। সব থেকে ও আমরা কেন এক সাথে নেই। আমাদের ভালোবাসায় কেন অপ্রাপ্তি।কেন এতো ব্যথা। এমন তো কথা ছিলো না। এই তো কিছু মাস আগে ও কবুল বলার কথা ছিলো। আজ কেন বিচ্ছেদ নেমে এলো?
_কেন এমন করলি তুই।কেন আমাকে আবেগে জড়ালি। কেন এভাবে আমার ভালোবাসা কে তুচ্ছ করলি। কেন করলি এমন? আমাকে তো জীবন্ত কবর দিয়ে দিলি। কখনো ক্ষমা করবো না, কখনোই না।
_আমি তুচ্ছ করি নি। সত্যিই খুব বেশি ভালোবাসি।
নাহিদ কে ধাক্কা মেরে ছাড়িয়ে নিলো সুপ্তি। পেছন ঘুরে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে দু চোখের কোন বেয়ে অশ্রু বর্ষন নেমে গেল।
নাহিদের শরীর টা কাঁপছে। ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি। সুপ্তি তাকিয়ে রইলো বেশ অনেকক্ষণ। এ ব্যথা সহ্য করা যায় না। প্রকৃতি স্বয়ং বিরক্ত এই প্রেমিক প্রেমিকা যুগলে। যাঁরা এক সঙ্গে ও থাকতে পারছে না আবার বিচ্ছেদ ও করতে পারছে না।এমন অসহায় পরিস্থিতি যেন কখনো আসে নি জীবনে। এক পা দু পা করে পিছু হটতে লাগলো সুপ্তি। নাহিদ অস্ফুটন স্বরে বলল
_ভালোবাসি।
সুপ্তির কানে সে শব্দ পৌছালো না। ছুটতে লাগলো সর্বশক্তি দিয়ে। একটি বার ও পেছন ফিরে তাকালো না। পেছন ফিরে তাকালে হয়তো এ বিচ্ছেদ ঘটতো না। দুটি মন কে এভাবে আলাদা হতে হতো না। চোখ দুটো ঝাপসা হতে লাগলো নাহিদের। হুংকার দিয়ে ঝড় নেমে আসলো। তাঁর ই সাথে মিশে গেল দুটি হৃদয়ের আর্তনাদ।
প্রকৃতির যেন মায়া হলো বেশ। তাই তো সঙ্গ দিতে বৃষ্টি নামালো। প্রকৃতি ও যেন বলতে চায় এ পৃথিবী তে যেন আর কারো বিচ্ছেদ না হয়। আর তা না হলে নিষিদ্ধ হোক ভালোবাসা কিংবা বিলুপ্ত করা হোক অনুভূতি নামক শব্দ টা।
.
জেলে আটক অবস্থায় রাদ কে দেখে হৃদয় টা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। শিকের ভেতর দিয়ে হাত টা বাড়িয়ে দিলো ভোর। খুব যত্ন নিয়ে চুমু খেল রাদ।এই কয়েক দিনে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ভরাট মুখে রুগ্ন চাহনি।হালকা মলিন হাসি টা যেন বার বার কর্পূর এর মতো উবে যায়। মেয়েটার কেবলি মনে হলো রাদ ভীষন ব্যথিত।
_আপনি চিন্তা করবেন না।খুব দ্রুত আপনাকে ছাড়িয়ে নিবো আমি।
_এই শরীর নিয়ে রোজ রোজ দেখা করতে কেন আসো?
_আমার যে সময় কাঁটে না ডাক্তার সাহেব। মনে হয় আমি এই দুনিয়া থেকে বহুদূরে।
_এমন বেখেয়ালি হলে চলবে? এখন তো আমাদের পুঁচকো আসতে চলেছে।প্রচুর খাওয়া দাওয়া করতে হবে আর ফিট থাকতে হবে।
_আপনার লাইসেন্স এর জন্য আমার ভালো লাগছে না।
_আরে চিল। আমি কোন ও অন্যায় করি নি। তাই ভয় পাওয়ার ও কোনো কারন নেই।বরং আমরা একটা পার্টি দিবো খুব তাড়াতাড়ি। আমাদের বাবু আসার পার্টি।
মলিন হাসলো ভোর। বক্স থেকে খাবার বের করে রাদের দিকে লোকমা বাড়িয়ে দিলো। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাবার টি মুখে তুললো রাদ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন রামিসা আর ইফতিহার।
দুজনের ভালোবাসা সকল কষ্ট কে ঠুনকো করে দিচ্ছে। হসপিটাল টা বন্ধ আছে আজ নয় দিন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন সংগ্রাম চলছে।জনগণ মেনে নিতে পারছে না এ অন্যায়।কারন গত কয়েক বছর ধরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সকল কে সাহায্যে করেছে রাদ। তাছাড়া হসপিটাল বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। এর মাঝে ও কিছু লোক রয়েছে যাঁরা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।কথায় আছে না কারো সাফল্য কিছু মানুষের সহ্য হয় না।
একা রুমে থেকে যেন অতিষ্ঠ হয়ে পরেছে ভোর।তাই রামিসার কাছে চলে এসেছে। খুব যত্ন নিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। রাদের বন্ধু রা এসে খোঁজ খবর নেয়। নাহিদের প্রতি তীব্র ঘৃনা পোষন করছে সকলেই।
এর ই মাঝে সুপ্তির কথা মনে হতেই সকলে কেমন মনমড়া হয়ে পরে। তবে সুপ্তি প্লাস্টিকের হাসি রেখে সবাই কে খুশি রাখার চেষ্টায় মত্ত। রাদ কে প্রচন্ড ভালোবাসে মেয়েটা। ছোট থেকেই এক সঙ্গে চলাফেরা। সব কিছু মনে হলেই কেমন আত্মা কেঁপে উঠে। এক টিফিন বক্স করে বিরিয়ানি রান্না করে এনেছে সুপ্তি। ভোর মলিন মুখে বলল
_আপু আপনার কষ্ট হচ্ছে না?
_কষ্ট কেন হবে?
_নাহিদ ভাইয়ার জন্য।
_বেইমানের জন্য কষ্ট পাওয়া কি বোকামি নয়?
উত্তর করলো না ভোর। টেবিলে রাখা টিফিন বক্স খুলতেই দারুন এর সুভাস নাকে এসে লাগলো। ভোর বলল
_আপনি বানিয়েছেন রাইট?
_হ্যাঁ। রাদ বলতো আমি নাকি বেস্ট বিরিয়ানি রান্না করি।
_একদম সত্য বলেছেন ওনি।
চটপট প্লেট নিয়ে দুই চামচ বিরিয়ানি নিয়ে নিলো ভোর। গোগ্রাসে গিলছে দেখে সুপ্তি বলল
_ধীরে।
_খুব মজা, আমার তো ইচ্ছে হচ্ছে রোজ এমন বিরিয়ানি খেতে।
_রোজ খেলে স্বাদ থাকবে না। মানুষ কে অধিক ভালোবাসা দিলে যেমন পর হয়ে যায় ঠিক তেমনি।
শেষ লোকমা গলা দিয়ে নামাতে বেশ বেগ পেতে হলো ভোরের। সুপ্তি চোখের পানি আড়াল করে বলল
_হয়েছে এবার আসো তো, রাদ কিন্তু না খেয়ে আছে।
_ইস আমি তো ভুলেই গেছিলাম।
প্লেট রেখে সুপ্তির সাথে রওনা করলো ভোর। গাড়ি তে বসে কিছু আলোচনা হলো। কাল আদালতে তোলা হবে রাদ কে। ভোর অবশ্য অনেক টাই চিন্তা মুক্ত। বেশ সুন্দর করে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন রামিসা। তাছাড়া নীলাশা নিজ থেকে এতো টা সাহায্য করেছে। বিনিময়ে একটা আর্জি ও রেখেছিলো। ভাবতেই কেমন করে মন। কি অদ্ভুত ভালোবাসা।
সুপ্তির চোখের জল দেখে শুকনো হাসলো রাদ। অদ্ভুত টান রয়েছে ওদের। বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু কে প্রেম ব্যতীত যদি অন্য কোনো নাম দেওয়া যায় তবে সেটাই ওদের সম্পর্ক। বেঞ্চে বসে এলোমেলো চোখে সব টা দেখছে ভোর।
কি সুন্দর নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে সুপ্তি। রাদের বুক টা ধক করে উঠে। সুপ্তির জন্য কিছুই কি করার নেই ওর? হয়তো নেই। যেখানে ভালোবাসা টা নোংরা মানসিকতায় পরিণত হয়েছে সেখানে কিই বা করবে ওহ?
তবু ও ছেলেটা ভাবুক হলো। নাহিদের সাথে সম্পর্ক ঠিক করার কথা টা বলা মাত্র পিছিয়ে গেল সুপ্তি। বলল
_ওর নাম মুখে নিবি না তুই। আমি ওকে ঘৃনা করি।
_সত্যিই ঘৃনা করিস?
তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারে না সুপ্তি। কিই উত্তর ই বা দিবে ওহ? নাহিদ কে ভোলা আদৌ কি সম্ভব! উহু সম্ভব নয়। তবে এক সাথে কাঁটানো ও সম্ভব নয়। হয়তো এ জীবনে ভালোবাসার রোদ্দুরে জ্বলে পুড়ে মরতে হবে ওকে। এটাই যে ভবিতব্য।
পরদিন খুব সকাল বেলা উঠতে হলো সবাই কে। অবশ্য রাদের চোখে ঘুম ছিলো না। সারা রাত জেগে কাঁটিয়েছে।বারো দিন যাবত শরীরে সূর্যের আলো পরে নি। বেশ সেনসিটিভ ত্বক ছেলেটার।
আঁধারে থেকে কেমন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারন করেছে। জিপে করে অদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাষান লোক গুলো বাইরে তাকাতে ও দিচ্ছে না। মাথা টা সোজা রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে রাদ। একটি অন্তিম অধ্যায় এর সূচনা হয়ে গেছে। যে খেলা আড়ালে শুরু হয়েছিলো বহু আগে।
রাদের বেশ আনন্দ হচ্ছে। সব থেকে বেশি আনন্দ হচ্ছে একটি মেয়ে যাকে আঁধার থেকে রোদ্দুরে এনেছিলো সেই মেয়েটাই আজ ওকে রোদ্দুরে নিয়ে যাবে। আনমনেই হেসে উঠলো। একজন কনস্টেবল বিশ্রী ভাষায় গালি প্রদান করলেন রাদ কে। কিছু টা ক্ষুন্ন হলে ও কথা বাড়ালো না রাদ।চার পাশে সাংবাদিক এর আনাগোনা। সেই কারনেই জিপ সোজা গেরেজ এ নেওয়া হলো। সেখান থেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আদালতে প্রবেশ করানো হলো রাদ কে। চার পাশে নিজের প্রিয় মানুষদের দেখে চোখ ভিজে গেল রাদের। ফর্মাল লুকে বসে আছে ভোর। একটি বার ও রাদের দিকে তাকালো না। বিচার কার্যক্রম শুরু হলো। নাহিদ ও এসেছে। তাচ্ছিল্য হাসলো রাদ কে দেখে। সুপ্তির চোখ থেকে সেটা এড়ালো না। দীর্ঘশ্বাস টেনে ভোর বলা শুরু করলো
‘ ইউ রনার প্রথমেই আমি একটি বিষয় বলে নিতে চাই। আমি অন্তঃসত্ত্বা, অধিক কথা বললে অসুস্থ হওয়ার আশংকা থাকবে। তাছাড়া আমি চাই না এবার সময় নষ্ট হোক যা গত দুই শুনানি তে নষ্ট হয়েছে। আমি সরাসরি প্রমান পেশ করতে চাই। ‘
‘ অনুমতি প্রদান করা হলো। ‘
‘ ধন্যবাদ ইউ রনার। আমার মক্কেল ডক্টর ইফতিহার রাদ। গত কয়েক বছরে বিদেশে পড়া শোনা চলাকালীন সময়ে ও নিজের দেশ কে রিপেজেন্ট করেছেন নানান ভাবে। তাছাড়া দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে 36 টি জেলায় বিনামূল্যে সপ্তাহে একদিন গরিব দুঃস্থ মানুষদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন।
এমন একজন মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ টানা হয়েছে মাদক আর চোরাচালান সহ ড্রাগস ব্যবসায়ী হিসেবে। যা নজিরবিহীন অভিযোগ। ‘
‘ ইউ রনার ওনি ওনার স্বামী কে বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছেন মাত্র।’
বিরোধী পক্ষের উকিল দাঁড়িয়ে কথা টা বললেন। বিচারক সর্তক করে বললেন
_ আপনি আপনার সীমা লঙ্ঘন করছেন।
_দুঃখিত ইউ রনার।
ভোর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষ টাকার জন্য কতো কিই না করে। এই যে রাদের বিরুদ্ধে থাকা উকিল। এক সময়ে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। তখন ওনার আর্থিক অবস্থা ছিলো খুব ই খারাপ। ইফতিহার নিজ খরচে ওনার অপারেশন করান। আজ তাঁর ই ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। কতো টা অকৃতঘ্ন হলে মানুষ এমন টা করে।
_ইউ রনার আমি অধিক কথা বলে বিচার কার্যক্রম বিলম্ব করতে চাচ্ছি না। আপনার কাছে আমি কিছু ডকুমেন্ট ন্যস্ত করলাম।
ডুকমেন্ট খুলে দেখতে লাগলেন তিনি। ভোর এক পলক রাদের দিকে তাকিয়ে বলল
_আমার মক্কেল ডক্টর ইফতিহার রাদের পরিবারের সঙ্গে পূর্ব শত্রুতা ছিলো মিনিস্টার কাইসারের।
মিনিস্টারের নাম নেওয়াতে পুরো আদালত চমকিত হয়। নাহিদের কপালে ভাজের সৃষ্টি হয়েছে। ভোর বলল
_ মিনিস্টার কাইসার শত্রুতা বহাল রাখলে ও ডক্টর ইফতিহার রাদের পরিবার শত্রুতা মনে রাখেন নি। মিনিস্টার কাইসার সুযোগ খুঁজছিলেন। আর সুযোগ টা পেয়ে যান। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে কিনে নেন হসপিটালের ম্যানেজার ইমরান মাহমুদ কে।
হতচকিয়ে উঠেন ইমরান। কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম নেমে যাচ্ছে। তাচ্ছিল্য করে ইফতিহার বললেন
_বেইমান।
আদালতে চাঁপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একটি ভিডিও ফুটেজ অন করা হয়। খবর টা লাইফ টেলিকাস্ট হওয়ার কারনে কোনো উপায় নেই ইমরানের কাছে। তাছাড়া রাদের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে কে ফাঁসাতে পারলে ও আদালতের খেলা বদলানোর সাহস কারোই নেই। ইমরান কেঁদে উঠেন। বিচারক কিছু টা দ্বিধায় পরে যান। মিনিস্টারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করতে ওনার হাত কাঁপছে। প্রতি টা মানুষ এর ই প্রানের মায়া রয়েছে। ভোর বিগলিত হাসলো। রাদের দিকে এগিয়ে এসে চোখে চোখে কিছু বললো। রাদের ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমি। আদালতের এমন পরিস্থিতি তে ও ওরা কতো টা সুখি।নাহিদের বুক টা ভেঙে যাচ্ছে। সুপ্তির দিকে তাকাতে পারছে না। ভোর বিচারকের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি তে তাকালো। ছোট্ট মেয়েটির দৃষ্টি দেখে হতচকিয়ে উঠলেন বিচারক। তৎক্ষনাৎ একটি ম্যাসেজ এলো ওনার কাছে। উপর মহল থেকে ম্যাসেজ টি দেওয়া হয়েছে।তিনি যেন স্বস্তি পেলেন। ভিডিও ফুটেজে মিনিস্টার কাইসার এর সকল কুকর্ম স্পষ্ট দেখানো হচ্ছে। নাহিদ উঠে দাঁড়ালো। সামান্য চেঁচানোর চেষ্টা করলে ও সুপ্তির দৃষ্টির জন্য পারলো না। এতো ঘৃনা কেন এই মেয়ের দৃষ্টি তে?
বিচারক রায় লিখছেন।ইতোমধ্য মিনিস্টার কাইসার কে পদত্যাগ করার আদেশ করা হয়েছে।তারপর ওনার বিচার হবে। এই ফুটেজ সহ সকল প্রমানের সাথে একটি বিষয় আড়াল করেছে ভোর। আর সেটা হলো নাহিদ। ছেলেটা অবাক ই হলো। তবে বিন্দু মাত্র অনুতপ্ত হয় নি নিজ কর্মে। কেন অনুতপ্ত হবে? ওর কষ্ট সম্পর্কে কেউ কি খোঁজ নেয়? উহহু নেয় না! মিনিস্টার কাইসার ব্যতীত এর সাথে জড়িত সবাই কে বিভিন্ন ধারা তে শাস্তি দেওয়া হলো। তাঁর ই সাথে ইমরান কে যাবত জীবন শাস্তির ঘোষণা আর রাদ কে বেকসুর খালাস প্রদান করা হলো।
পুরো আদালতে খুশির বন্যা বয়ে গেছে। রাদ কাঠগড়া থেকে নেমে সোজা ইফতিহার আর রামিসা কে জড়িয়ে ধরলো। কিছু ফরমালিটিস পূরনের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো রাদ কে। পুরো দেশ দেখলো একজন স্ত্রী কতো টা সাবলীল ভাবে তাঁর স্বামী কে বাঁচিয়ে নিলো।
যাওয়ার পথে বাঁধা প্রদান করলো নাহিদ। চোখে মুখে কেমন যেন তাচ্ছিল্য ভাব। রাদ বলল
_বন্ধুত্ব টা রইলো না আর। জানিস তোকে কেন শাস্তি দিলাম না কারন তুই আমার ভোর কে বাঁচিয়ে ছিলি।আর আমি তদের মতো অকৃতঘ্ন নই।
_আমাকে তো জীবন্ত লা/শ বানিয়েই দিয়েছিস। আমার সব থেকে বড় শাস্তি আমার ভালোবাসার সাথে বিচ্ছেদ। কতো টা যন্ত্রণা তুই বুঝবি না।
রাদ উত্তর করলো না। এই সম্পর্কে কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। নাহিদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। হাতে একটি কার্ড। সুপ্তি ইনভাইট করেছে ওকে। একবার পেছন ঘুরে তাকালো নাহিদ। সুপ্তির জল ভরা নয়ন দেখে বুক টা ছিঁড়ে যাচ্ছে। খুব যত্ন নিয়ে নাহিদের বুকে হাত রাখলো সুপ্তি। কলিজা যেন বুক চিরে বের হয়ে যেতে চায়। ভাঙা গলায় সুপ্তি বলল
_ শেষ বারের মতো স্পর্শ করলাম। এক ভুল মানুষ কে ভালোবাসার শাস্তি স্বরূপ অন্য একজনের নামে নিজেকে উৎসর্গ করতে যাচ্ছি। আশা করছি নিজ হাতে আমাকে বলি দিতে যাবি। কি যাবি তো?
নাহিদের ইচ্ছে করছে সুপ্তি কে জাপটে ধরে বলতে দিবো না। আমি কাউ কে দিবো না। তুই শুধু আমার আর আমারি থাকবি। তোর বিয়ে আমার সাথেই হবে।তবে কিছু কথা কখনো গ্রাহ্য হয় না।তদ্রূপ ওর মনের কোনে জমে থাকা কথা গুলো ও গ্রাহ্য হলো না। হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল
_এতো বড় শাস্তি না দিলে ও হতো। আমার ফাঁসি কার্যকর করলে বোধহয় অধিক স্বস্তি হতো আমার। খুব বুদ্ধি নিয়ে আমায় শাস্তি দিলি তোরা। না পারবো গিলতে আর না পারবো উপড়ে ফেলতে। আসবো নিশ্চয়ই আসবো। তুই সুখী হবি তো?
ঋণাত্মক উত্তর টা কে সাইডে ফেলে হাসলো সুপ্তি।চোখ বন্ধ করে নাহিদের বুক থেকে ধীরে ধীরে হাত টা সরিয়ে নিলো। নাহিদের চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। ওর জীবনের রোদ্দুরে চিরকালীন আঁধার নেমে এলো। একটি বিচ্ছেদ কতো টা যন্ত্রনা দেয় তা অনুভব হলো ওর। সব পাপের উপযুক্ত শাস্তি মৃত্যদন্ড হয় না কিছু শাস্তি হয় বেঁচে থাকা। আর নাহিদ হলো তাঁর উদাহরন।বেঁচে থাকাই হলো ওর পাপের শাস্তি।
খুব যত্ন নিয়ে পেপারে সাইন করলো ভোর। রাদ কে এক নতুন পৃথিবী উপহার দিবে ভাবতেই বুক টা কেমন করে উঠছে। সমস্ত ফরমালিটিস শেষ হলে রাদ কে বের করা হলো। দুজন দুজনের দিকে বেশ কিছু সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। উত্তেজনায় কথা ফুটছে না। ফট করেই সকলের সম্মুখে মেয়েটা কে কোলে তুলে নিলো রাদ। পেটে চুমু এঁকে বলল
_বেস্ট গিফ্ট বউ জান।
মৃদু হাসলো ভোর। রাদের গালে হাত বুলিয়ে বলল
_জানেন তো ডাক্তার সাহেব প্রতি টা মানুষ জীবনে অনেক বড় হতে পারে। তবে সেটার জন্য উপযুক্ত হাতের প্রয়োজন। আমার জীবনে তেমন টাই ছিলেন আপনি। আঁধার কে তুচ্ছ করে কলঙ্ক মেখে ছিলেন গাঁয়ে। আমাকে প্রতি মুহূর্ত আগলে রেখেছিলেন।এই যে রোদ্দুর সব টাই আপনার জন্য।
_হুসস মেয়ে। এসব বলতে হয় না। স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক হয় জানো না?
_জানি তো।
_আচ্ছা এখন সব বাদ। এখনো চার পাশে ঘুটঘুটে
আঁধার। আমাকে নিয়ে যাবে না রোদ্দুরে?
অধর কোনে হাসি ফুটলো মেয়েটির। আশে পাশে এক বার চোখ বুলিয়ে রাদের কাছাকাছি হলো। ছেলেটার পায়ের উপর ভর করে গলা জড়িয়ে ধরলো। রাদ বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে ওর সাথে।
কোন রোদ্দুরে নিয়ে যাচ্ছে ভোর।ছেলেটার কপালের অগোছালো চুলে হাত গলিয়ে প্রচন্ড রোমান্টিকতার পরিচয় দিলো মেয়েটি। রাদ কে অবাক করে দিয়ে এই প্রথম নিজ থেকে ছেলেটির ঠোঁটে গভীর চুম্বন এঁকে দিলো। লজ্জার ছিটে ফোঁটা যেন নেই আজ। মৃদু হেসে চোখে চোখ রেখে বলল ‘ এই বিষাক্ত আঁধার কাঁটিয়ে চলো রোদ্দুরে। ‘
সমাপ্ত
উদ্দেশ্য : নোংরা সমাজ থেকে ও সাফাল্যে আসা যায়।আর এর জন্য প্রয়োজন হয় একটি উপযুক্ত হাত। সেই অভিপ্রায় থেকেই রাদ, ভোরের সৃষ্টি।
গ্রুপ : Fatema’s story discussion
পরবর্তী গল্প #অভিমানী_সে।আশা করি সকলের ভালোবাসা পাবো। 28 তারিখে শুরু হবে গল্পটি ইনশাআল্লাহ।