দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-১

0
4005

বন্দনা আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ। তুমি চলে গেলে আমি পঙ্গু হয়ে যাব। আমার শরীরের সমস্ত রক্ত কণিকা তাদের কার্যকলাপ ধীরে-ধীরে বন্ধ করে দেবে। বন্দনা শুনছ আমার কথা। প্লিজ আমায় ছেড়ে চলে যেও না। — হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ফারহানের। শোয়া থেকে উঠে বসে সে। আজও বন্দনাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ইদানীং প্রায় সময়ই এমন হচ্ছে যে, সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। বেড টেবিলে ল্যাম্পের পাশে থাকা গ্লাসটা হাতে নেয় ফারহান। এক ঢোকে সবটুকু পানি খেয়ে ফেলে৷
ফোনটা হাতে নেয় ফারহান। রাত এখন প্রায় তিনটা। সকালে অফিসে যেতে হবে। সজাগ থাকলে চলবে না। বন্দনা চলে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে সব কিছুতেই ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে ফারহান। নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটাই কারণ, বন্দনার অনুপস্থিতিটা সে ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু পারে না।
বন্দনার চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারেনি ফারহান। দুই বছর পাঁচ মাস হলো বন্দনা ফারহানকে রেখে চলে গেছে। বন্দনাকে ভীষণ ভালোবাসত ফারহান। তাই তার চলে যাওয়াটা আজও তাকে পোড়ায় প্রতিনিয়ত। এদিকে বন্ধু-বান্ধব এবং অফিসের কিছু কর্মকর্তাসহ বাসার মানুষগুলো তাকে নিয়মিত বলে, ফারহান নতুন করে ভাবতে শুরু করো। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। মাঝে-মাঝে তার প্রশ্ন করে, জীবনকে আরও একবার একটা সুযোগ দিয়ে দ্বিতীয় সূচনা কি করা উচিত?
ফারহানের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক একটাই কথা ভাবে, বন্দনার মতো কি দ্বিতীয় কেউ হতে পারে? বন্দনার মতো কি দ্বিতীয় কেউ তাকে সেই সুখটা দিতে পারবে? দ্বিতীয় সূচনা করা কি সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে? ফারহান উত্তর খুঁজে পায় না। সে কেবল বন্দনাতেই লেপ্টে থাকতে চায়। বন্দনা ব্যতীত অন্য কিছু ভাবনাতেও আনতে চায় না ফারহান। বন্দনার শাড়ি, চুড়ি, গয়না আজও সে তার কাবার্ডে যত্ন করে তুলে রেখেছে। সে বিশ্বাস করে বন্দনা ফিরে আসবে। হ্যাঁ বন্দনা একদিন না একদিন ঠিক ফিরে আসবে। অথচ এই অহেতুক বিশ্বাসের যে কোনো মানে হয় না এটা সে নিজেও বোঝে। তাকে ইদানীং ছয়/সাত বছরের বাচ্চার মতো লাগে যেখানে তার বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়েছে।

সকাল নয়টা। নাস্তার টেবিলে সবার সঙ্গে ফারহানও বসে আছে। রমজান শেখের সম্পত্তির অভাব না থাকলেও তার পরিবারে হাসির ভীষণ অভাব৷ শেখ ভিলা আগে ভীষণ হাসিখুশিতে ভরপুর থাকত। যেন রোজই এখানে কিছুর না কিছুর আয়োজন চলত। বন্দনা চলে যাওয়ার পর থেকে রওশন বেগমও চুপ হয়ে থাকেন। প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কথা তিনি বলেন না। কিন্তু ইদানীং তার মাথায় ভূত চেপেছে। ফারহানের বিয়ে ভূত৷ যেই ভূত হাজার ঝাটা-পেটা করলেও নামবে না।
রমজান শেখের তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে ফারহান সবার বড়ো। মেজ ছেলে ফারাশ এবার ফাইনালে আছে। আর ছোটো মেয়ে সাজি ৩য় সেমিস্টারে। তারা দু’জনেই বাবা আর বড়ো ভাইকে ভীষণ ভয় পায়। এ বাড়িতে রমজান শেখ এবং ফারহান যা বলে তাই-ই হয়। আর এরা দু’জন এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
ফারহানকে নাস্তার টেবিল ছাড়া আর পাওয়া যায় না। এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চান না রওশন বেগম।
‘ফারহান, একটা কথা বলতে চাইছিলাম তোকে।’
‘হ্যাঁ মা, বলো।’
‘ফারহান, এভাবে আর কতদিন? এবার অন্তত আমাদের কথা শোন বাবা।’
‘তোমাদের কোন কথাটা শুনিনি আমি।’
‘ফারহান, এবার অন্তত বিয়েটা নিয়ে ভাব বাবা।’
‘মা, আমার কি মনে হয় জানো। আমাকে খেতে বসতে দেখলেই তোমার এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতেই হয়। এর থেকে ভালো আমি আর খেতেই না বসি।’
ফারহান টেবিল থেকে উঠে সোজা বের হয়ে যায়। রওশন বেগম ব্যর্থ নিঃশ্বাস ফেলেন। রমজান শেখ বলে,
‘ছেলে যখন এইসব পছন্দ করে না। শুধু-শুধু বলতে যাও কেন?’
‘ওর কষ্ট আমি দেখতে পারি না।’
মায়ের কথা শুনে ফারাশ বলে,
‘মা, ভাইয়াকে আরেকটু সময় দাও। ঘটনাটা ভুলতে দাও আগে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘গত আড়াই বছর কি কম সময় ফারাশ? কষ্ট কি আমাদের হয়নি? দুঃখ কি আমরা পাইনি?’
‘আমাদের সবার থেকে ভাইয়ার কষ্ট টাই বেশি মা। আফটার অল জিনিসটা তো তার খোঁয়া গেছে।’
ফারাশও বের হয়ে যায়। রওশন বেগম সাজিকে বলে,
‘তুইও কি জ্ঞান দেওয়ার জন্য বসে আছিস নাকি?’
‘আমি আর কাকে জ্ঞান দিব মা। আমি তো জ্ঞান খাই। এই মনে করো, পরোটা, ডিম, জুস এইসবের সাথে মাখিয়ে জ্ঞানও খাই।’
‘উঠ এখান থেকে। ফাযিল মেয়ে কোথাকার।’
মেয়ের কথা শুনে রমজান শেখ পত্রিকার আড়ালে হাসছেন। মায়ের ধমক খেয়ে সাজিও উঠে চলে যায়। রওশন বেগম ক্ষেপে গিয়ে বলেন,
‘আমারই যত জ্বালা। আল্লাহ আমাকে নেয়ও না এই সংসার থেকে। সব কষ্ট ভোগ করার জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

খাইরুল সাহেবের বাসার মানুষজন একেকজন একেক রকম। একেকজনের একেক রকম। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ফরমায়েশ। সবার সব ফরমায়েশ শুনতে-শুনতে আয়শা বেগম হিমশিম খেয়ে যান। সেই ভোর ছয়টায় উঠে রান্নাঘর ঢুকেন। বের হোন সাড়ে আটটার পর। অবশ্য তাকে সাহায্য করে আরও একজন। আয়শা বেগম মনে করেন তাকে ছাড়া তিনি অচল।
খাইরুল এবং আয়শা দম্পতির তিন ছেলে মেয়ে। বড়ো ছেলে হাসান একটা কোম্পানিতে চাকরি করে। মাস চারেক হবে বিয়ে করেছে। বউ যেন ননির পুতুল। আয়শা বেগম ছেলের বউয়ের ওপর ভীষণ রাগ। সব কাজ তাকে করতে হয়। কোনো কাজই বউকে দিয়ে করানো সম্ভব হয় না। মেজ মেয়ে রত্না ইন্টারে পড়ে। ছোটো মেয়ে মনি এবার ক্লাস নাইনে। আর তাদের সাথে থাকে বাবা-মা মরা খাইরুল সাহেবের এতিম ভাগনি অয়নন্দিতা। এই সেই অয়নন্দিতা যাকে ছাড়া আয়শা বেগম অচল। ভোর বেলা নামাজ পড়ে মামীর সঙ্গে রান্নাঘর টুকিটাকিতে হাত বাড়ায় সে। জগত হারে আয়শা বেগম ভীষণ ভালো মানুষ। ভাগনিকে মায়ের ভালোবাসা দিয়েই কাছে রেখেছন। অয়নন্দিতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। খাইরুল সাহেব এবং আয়শা বেগম তাদের তিন ছেলে মেয়ের মতোই অয়নন্দিতাকেও সমান ভালোবাসা দিয়েছেন। ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবেন। মামার সংসারটাকে একজোট করে রেখেছে অয়নন্দিতা। দুটো ছোটো মামাতো বোনদের পড়াশোনা এবং যত্নের ব্যাপারে সে সচেতন। বড়ো ভাই এবং তার বউয়ের ভালো লাগা খারাপ লাগার ব্যাপারেও সে এক নাম্বার। যদিও হাসান অয়নন্দিতাকে বোনের মতোই দেখে। সমস্যা করে হাসানের বউ মিলি। কোনো এক কারণ অয়নন্দিতাকে সে দেখতে পারে না। তাতে অবশ্য অয়নন্দিতার কিছু আসে যায় না। সে তার মতো থাকে।

বারান্দায় বসে চা খাচ্ছেন খাইরুল সাহেব। আয়শা বেগম বুঝতে পেরেছেন, তার স্বামী কিছু ভাবছেন। কাছে গিয়ে বসেন তিনি। প্রশ্ন করেন,
‘কী চিন্তা করছ?’
‘পাশের গলির আনোয়ার ভাই একটা প্রস্তাব দিলেন গতকাল। ওইটা নিয়েই ভাবছিলাম।’
‘প্রস্তাব! কীসের প্রস্তাব? আর আমাকে তো কিছুই বলোনি তুমি।’
‘নিজেই আগে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চাচ্ছিলাম। তাই আর তোমাকে বলিনি।’
‘এখন বলো কীসের প্রস্তাব?’
‘আনোয়ার ভাই অয়নন্দিতার জন্য একটা প্রস্তাব এনেছেন। ছেলে নাকি ভালো। বিরাট পয়সাওয়ালা। সম্পত্তির অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা একটা আছে।’
‘কী সমস্যা?’
খাইরুল সাহেব তার স্ত্রীর চোখের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকেন। আয়শা বেগম আবারও প্রশ্ন করেন,
‘কী হলো বলো, কী সমস্যা?’

#দ্বিতীয়_সূচনা
#সূচনা_পর্ব
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here