দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-২

0
2079

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

টিচার্স রুমে পিওনের আগমন।
‘স্যার, আসব?’
‘হ্যাঁ আসেন৷’
‘স্যার, আপনার কাছে একজন লোক আসছে। দেখা করতে চান।’
‘কে?’
‘তা তো জানি না স্যার।’
‘আচ্ছা পাঠিয়ে দিন।’
‘আচ্ছা স্যার। আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
শরীফ আহমেদ। পেশায় লেকচারার। তার সাথের বন্ধুরা কেউ ব্যাংকার। কেউ ভালো কোম্পানির ম্যানেজার। কারো নিজস্ব বিজনেস। আবার কেউ বিদেশে স্যাটেল।
কিন্তু তিনি হলেন শিক্ষক। তার কাছে কেন যেন শিক্ষকতা করতেই ভালো লাগত। তাই পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেন।
‘শরীফ সাহেব, অনুমতি পেলে ভেতরে আসতাম।’
শরীফ আহমেদ দরজার দিকে তাকায়। আনন্দে দু’চোখ জ্বল-জ্বল করে ওঠে তার। প্রায় অনেকদিন পর দেখল এই মানুষটাকে সে। তার জীবনে এই মানুষটার অবদান কিছুতেই ভুলতে পারবে না সে। নিজে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়।
‘ফারহান, তুই এখানে! প্লিজ ভেতরে আয়।’
‘হ্যাঁ, আসতে হলো। লেকচারার সাহেব তো খোঁজ খবর রাখে না। তাই আসা লাগে।’
‘আর বলিস না ভাই ভীষণ ব্যস্ত থাকা হয়।’
‘লেকচারার সাহেবদের ভীষণ ব্যস্ততা। তাই না?’
‘খোঁচা মারিস না তো। বল কী খাবি? কফি নাকি চা?’
‘খুব সহজে যেটা পাওয়া যাবে সেটাই খাব।’
‘হা হা। চেঞ্জ আর হইলি না।’
শরীফ খেয়াল করছে ফারহানের মুখটা বিষন্ন হয়ে আছে। এই বিষন্নতার কারণ শরীফের অজানা নয়। তাদের সার্কেলের সবাই মোটামুটি ফারহানেত ক্রাইসিসটার ব্যাপারে জানে। কিন্তু জেনে আর কী করা যায়। যা করার ওই যে উপরে যিনি বসে আছেন তিনিই করেছেন। তার হাতে সবাই কাঠের পুতুল। তিনি যেমন নাচান, তেমনই নাচতে হয় সবার। শরীফ ফারহানকে প্রশ্ন করে,
‘এনিথিং রং ফারহান৷’
‘সব কিছুই তো রং হচ্ছে রে।’
‘কী হয়েছে বল তো। এই যে চা চলে আসছে।’
‘বাসায় তো থাকা যাচ্ছে না।’
‘কেন কী হয়েছে?’
‘বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে। মাথা নষ্ট করে দিছে।’
‘ফারহান, আমারও মনে হয় তোর এইবার অন্তত ভাবা উচিত।’
‘শরীফ, তুইও।’
‘হ্যাঁ। আমিও। দেখ, কোনো মানুষই কিন্তু চিরকাল একা থাকতে পারে না।’
‘আমি আছি। দিব্যি ভালো আছি।’
‘বন্দনার স্মৃতি নিয়ে আছিস। একটা ট্রমার মধ্যে আছিস। তাই এইসব ভাবছিস তুই।’
‘বাদ দে প্লিজ। ভালো আছি আমি। বিয়ে থা আর আমায় দিয়ে সম্ভব না।’
‘তোর জীবন তুই ভালো বুঝবি। আমরা তোর বন্ধু। আমরা তোর ভালো চাই। তাই বার-বার বলি।’
‘তোর বউ কেমন আছে?’
‘হ্যাঁ। ভালো আছে। তবে মন খারাপ করে। ফ্যামিলির কেউ মেনে নেয়নি তো।’
‘খালাম্মা কিছু বলে না তো।’
‘আরে নাহ। মা বাবা সবাই ওকে ভীষণ ভালোবাসে। তবে বুঝিসই তো। নিজের মা বাবা নিজেরই থাকে। তাই হয়তো জ্বলে।’
‘তুই শালা বিয়ে করলি তো করলি তাও আবার একেবারে ছাত্রীকেই বিয়ে করলি।’
‘এটাই ওর মা বাবা বলে। তবে কিছু করার ছিল না। আমি আমার নিজের ভাগ অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে নারাজ। ওর বাপটা আসলেই বজ্জাত। মেয়ে তার ভালোবাসার কথা জানাতেই অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে ফেলছে। ভাব একবার। সে তো একবার অন্তত আমার সাথে কথা বলতে পারত। বলে নাই। পিয়া’র সামনে দুটো রাস্তা দিয়েছিলাম। এক – হয় আমার হাত ধরবে, দুই – নয় আমায় ভুলে গিয়ে ভালোমতো সংসারে মন দিতে হবে। অপশন দুই ওর জন্য ইম্পসিবল ছিল কারণ কলেজে এলেই আমায় দেখতে হবে। ও এমনিতেই শোকে মরে যাবে। তাই অপশন এক’ই রাজি হয়। সেদিনই বিয়ে করলাম। তবে তোর আর রাতুলের অবদান ভুলব না।’
‘আরে অবদান টবদান কিছু না। তোরা ভালো থাক। এটাই কামনা। তা তোর বউ ক্লাসে আসে নাকি?’
‘হ্যাঁ আসে। আসবে না কেন। আমায় দেখার জন্য একবার হলেও সে কলেজে আসে।’
‘বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করলে এমনই হবে।’
‘ও বাচ্চা! তোরে কে বলল?’
‘দেখলেই বোঝা যায়।’
‘বাদ দে। এরপর বল আর কী অবস্থা?’
‘মন ভালো নেই রে। অফিসেও মন বসতেছিল না। তাই এলাম তোর কাছে।’
জীবনে এমন কিছু বন্ধুর প্রয়োজন হয় যাদের সঙ্গে মনের সব দুঃখ শেয়ার করা যায়। যাদের সব বলা যায়। একে অপরের পাশে দাঁড়ানো যায়। এদের সার্কেলটা হচ্ছে তেমন। সবার জন্য সবাই পাশে থাকে। ফারহানের ক্রাইসিসের সময় সবাই মিলে তাকে বেশ সাপোর্ট দিয়েছে।
ফারহানের মনটা খানিকটা হলেও ভালো করার মতো একটা উপায় শরীফের মাথায় আসে।
‘ফারহান, যাবি আমাদের সঙ্গে?’
‘কোথায়?’
‘পরশু কলেজ থেকে দু’দিনের ট্যুরে যাওয়া হচ্ছে৷ ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ৪ টা ইউনিট যাচ্ছে। চল আমার সঙ্গে।’
‘তোরা টিচার আর স্টুডেন্টরা যাবি। আমি যাব কীভাবে? না আমি টিচার না স্টুডেন্ট।’
‘তুই আমার সঙ্গে যাবি।’
‘নাহ রে। ইচ্ছে করছে না।’
‘আরে চল।’
শরীফ জোরপূর্বক ফারহানকে রাজি করায়। ফারহানও কয়েকবার না না করে পরে রাজি হয়। তার কাছেও মনে হচ্ছিল নিজেকে সময় দেওয়া উচিত। সব কথা শেষ করে ফারহান বিদায় নেয় শরীফের কাছ থেকে।
ফারহান শরীফের রুম থেকে বের হয়ে আনমনে হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময়ই পেছন থেক শরীফ ডাক দেয়। শরীফ তার হাতের ইশারায় দেখাচ্ছে যে, ফারহান তার ফোন টেবিলেই ফেলে রেখে এসেছে। ফারহান হাঁটতে-হাঁটতেই পেছনে ফিরে। আর তখনই,,,
‘আহ,,,,’
ফারহান ঘুরে তাকাতেই দেখে একজন পড়ে গেছে। বুঝতে পারে ধাক্কাটা তার সঙ্গেই লেগেছে আর মেয়েটা পড়ে গেছে। পড়ে তো যে কেউই যেতে পারে। এই মেয়েটাও পড়ে গেছে। ব্যাপার না কিন্তু ঘটনা ঘটল আরেক জায়গায়। পাশে পড়ে থাকা ভাঙা গ্লাসের উপর গিয়ে মেয়েটার হাত পড়ে। ভাগ্য ভালো পুরো শরীর নিয়ে পড়েনি। নয়তো কী যে হতো।
শরীফ দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে সে নিশ্চিত পড়েছে কে। ফারহান যেন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বুঝতেই পারেনি তার দ্বারা কারো এমন ক্ষতি হবে। মেয়েটার হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শরীফ এসে মেয়েটার হাত চেপে ধরে।
‘অয়নি, লেগেছে বেশি। এক্সট্রিমলি সরি। আসলে আমারই ভুল। আমিই হঠাৎ পেছন থেকে ওকে ডাকলাম।’
‘ইটস ওকে স্যার।’
‘ব্যথা করতেছে নাকি?’
‘তা তো করছেই। সমস্যা নেই স্যার। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘পিওনকে আমি গতকালকেও বলেছিলাম এখান থেকে গ্লাস ভাঙাগুলো ফেলে দিতে।’
পাশ থেকে অয়নন্দিতার বান্ধবী বলে ওঠে,
‘ইশ! রক্ত পড়তেছে তো স্যার।’
‘হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। কী একটা অবস্থা। চলো তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাই।’
‘লাগবে না স্যার। আমি নিজেই যেতে পারব।’
‘কী বলো নিজেই যেতে পারবা।’
ফারহান এগিয়ে আসে। মুখটা তার অপরাধীর মতো হয়ে আছে। অয়নন্দিতার মুখের দিকে একবার তাকায় সে। এত স্নিগ্ধ আর মায়াময় মুখটা ফারহানের বুকে হালকা ধাক্কা দেয়। অয়নন্দিতার হাতের দিকে নজর করলে দেখতে পায় হাত থেকে রক্ত বেয়ে পড়ছে। তার মনে হচ্ছিল, মেয়েটা মুখে কিছু না বললেও তার যন্ত্রণা হচ্ছে ভীষণ। চোখের কোণে পানি জমে গেছে। ফারহান যেহেতু তার ব্যথার কারণ, তাই ফারহানই তাকে নিয়ে যাবে হসপিটালে৷
‘আপনি প্লিজ আমার সঙ্গে চলুন। আমিই নিয়ে যাব। প্লিজ আসুন।’
‘নাহ। ঠিকাছে। আমি যেতে পারব।’
‘নাহ আপনি যেতে পারবেন না। আর তখন থেকে এমন না না করছেন কেন। আমার জন্য আপনি ব্যথা পেয়েছেন। রক্ত বের হচ্ছে৷ এরপরও বলছেন আপনি নিজে যেতে পারবেন। প্লিজ, আমায় এভাবে অপরাধী করবেন না। চলুন আপনি।’
লোকটার আচরণ অদ্ভুত লাগছে অয়নন্দিতার কাছে। একে তো ধাক্কা দিল। ব্যথা পেল আরেকজন। এখন উল্টো তাকেই ধমকাচ্ছে।
শরীফ ফারহানকে চোখের ইশারা করে। এরপর অয়নন্দিতাকে বলে,
‘অয়নি, ও আমার বন্ধু। তুমি ওর সঙ্গে যাও। পরে সেখান থেকে বাসায় চলে যেও।’
‘কিন্তু স্যার,,,’
‘যাও। সমস্যা নেই। আর ফারহান এই নে তোর ফোন।’
ফারহান আর তেমন কিছু না বলে অয়নন্দিতাকে নিয়ে বের হয়ে যায়। আর এদিকে অয়নন্দিতা, অপরিচিত একজন পুরুষের সঙ্গে কোথাও যেবে ভেবেই ভয়ে সিটিয়ে আছে। বান্ধবীরা দুটো টিস্যু দিয়ে তার হাতটা মুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু রক্তক্ষরণ কমছে না। গাড়িতে বার কয়েক ফারহান আড়চোখে অয়নন্দিতাকে দেখছিল। তার হাতের দিকে দেখছিল৷ মেয়েটা লাল হয়ে গেছে। হয়তো অপরিচিত বলে তার সামনে নিজের যন্ত্রণাটা দেখাতে পারছে না। নিজের ওপর চরম বিরক্ত লাগছে। আরেকটু সাবধান হলে মেয়েটার হাতটা আজ অক্ষত থাকত। কেটেছে তো কেটেছে একেবারে ডান হাতটাই কেটেছে। অনেক বড়ো সমস্যা হয়ে গেল মেয়েটার।

চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here