দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-৩

0
1739

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩
লেখা – আফরোজা আ

‘ভাগ্য ভালো যে স্টিচ লাগে নি। তবে একটা ইনজেকশন দিতে হবে।’
সিনিয়র নার্সের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ভয় পায় অয়নন্দিতা। মেয়েরা নাকি তেলাপোকায় ভয় পায়। কিন্তু অয়নন্দিতার ভয় ইনজেকশনের সুঁইতে। ছোটোবেলায় এক ইনজেকশন দিতে গেলে আশেপাশের এলাকা গরম করে ফেলত অয়নন্দিতা। সেই অভ্যাসটা বড়ো হওয়ার সাথে-সাথে চলে গেলেও ভয়টা এখনও আছে তার মনে। ইনজেকশনের কথা শুনে অয়নন্দিতার মুখটা শুকিয়ে ছোটো হয়ে যায়। পাশ থেকে ফারহান অয়নন্দিতার মুখটা দেখছে। সে বুঝতে পারছে যে, মেয়েটা ভয় পেয়েছে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং।
নার্সের কথা শুনে অয়নন্দিতা বলে,
‘ইনজেকশন কি দেওয়া খুবই প্রয়োজন?’
‘হ্যাঁ। রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না।’
‘না মানে, মেডিসিন নিলে ঠিক হবে না। ইনজেকশন দিতেই হবে।’
‘হ্যাঁ। দিতে হবে। সেইজন্যই বললাম। আর মেডিসিনও নিতে হবে। জ্বর আসতে পারে কিন্তু। বাই দ্যা ওয়ে পড়লেন কি করে? ভালো ভালো শুধু কেটেছে। বড়ো কোনো সমস্যা হয়নি।’
নার্সের কথা শুনে ফারহান নড়েচড়ে বসে। ভাবছে, মেয়েটা বলে দেবে না তো আবার। বলে দিলে নার্স আবার কি না কি বলে৷ তখনই অয়নন্দিতা বলে,
‘আসলে হাঁটছিলাম তো ঠিকঠাক। মাথাটা ঘুরে গেল। পড়ে গেলাম। খেয়াল ছিল না যে কোথায় পড়েছি বা কিছু।’
‘যাক। বড়ো কিছু যে হয়নি এটাই অনেক।’
ফারহান এতক্ষণ চুপচাপ বসে-বসে অয়নন্দিতার মিথ্যা কথা গিলছিল। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালো নার্স ম্যাডাম।
‘খুব কেয়ারিং হাসবেন্ড আপনি। বউকে নিয়ে ছুটে চলে এলেন।’
‘জি!!’
ফারহান এতটাই অবাক হয় যে, যেন সে কোনো অদ্ভুত কিছু শুনেছে। অয়নন্দিতা নিজেও একটু অবাক হয় নার্সের কথা শুনে। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে মহিলা কাজ কম কথা বেশি বলে। আপাতত তারা দু’জনেই চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। আর বেশি কথা বললে হয়তো এখানেই বাচ্চার বাবা-মা বানিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর৷ ফারহান ভাবছে, যত দ্রুত এখান থেকে বের হওয়া যায়। অয়নন্দিতারও একই ভাবনা, কখন বের হবে এখান থেকে।

দশ দিনের মেডিসিন কিনে ফারহান অয়নন্দিতাকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা হয়। গাড়িতে দু’জনেই চুপচাপ। ফারহান বার কয়েক অয়নন্দিতার হাতটা খেয়াল করে। হাতটা ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন করা উচিত হবে কি না ভেবে-ভেবেও প্রশ্ন করে ফারহান,
‘আপনি তখন মিথ্যা বললেন কেন?’
‘কখন?’
‘যখন নার্স আপনাকে প্রশ্ন করল আপনি ব্যথা কীভাবে পেয়েছেন?’
‘ওহ।’
‘বলুন, মিথ্যা কেন বললেন?’
‘সব জায়গায় সব সত্য বলতে হয় না।’
‘মিথ্যা বলারও কারণ ছিল না। কারণ আমি তো আর আপনাকে ইচ্ছে করে ব্যথা দেইনি। ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।’
অয়নন্দিতার কথা বলতে ভালো লাগছে না। এই মুহুর্তে তার ঘুমোতে ইচ্ছা করছে। যদি এখানে কেউ তাকে একটা বালিশ আর তার প্রিয় কাঁথাটা দিত। তবে সে আরাম করে তিন থেকে চার ঘন্টার একটা দারুণ ঘুম দিত। ইনজেকশনটা দেওয়ার পর থেকেই তার ঘুম পাচ্ছে। মিনিট সাতেক পর ফারহান আবারও জিজ্ঞেস করে,
‘বাসাটা যেন কোথায়?’
ঘুমের ঘোরে অয়নন্দিতার জবাব দেয়,
‘আপনার বাসা কোথায় আমি কেমন করে বলব?’
‘এক্সকিউজ মি ম্যাডাম, আমার বাসা না। আপনার বাসার কথা জিজ্ঞেস করেছি। কোথায় যেন বললেন।’
‘সরি। চৌদ্দ নাম্বার সেক্টর। ৬৪ নাম্বার বাসা।’
‘ওকে।’

গাড়ি ব্রেক করার সাথে-সাথে অয়নন্দিতাও লাফ দিয়ে ওঠে। অয়নন্দিতার এই অবস্থা দেখে ফারহান বলে,
‘ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন নাকি আপনি?’
‘নাহ মানে, আসলে চোখটা লেগে গিয়েছিল আর কি।’
‘চোখ লাগার আর কোনো জায়গা পেল না।’
‘সরি,,, কিছু বললেন?’
‘নাহ নাহ। কিছু বলিনি। নামুন। আপনার বাসা এসে গেছে নিশ্চয়ই।’
‘ওহ হ্যাঁ। তাই তো। বাসা এসে গেছে।’
অয়নন্দিতা গাড়ি থেকে নেমে বাসার গেইটের কাছে গিয়েও ফিরে আসে।
‘কী ব্যাপার, ফিরে এলেন যে।’
‘আসুন না আমাদের বাসায়।’
‘নাহ। আজ আর যাব না। অফিসে কিছু কাজ জমা পড়ে আছে। এখন অফিসেই যেতে হবে। অনেক দেরি হয়ে গেল।’
‘আসলে আমি ভীষণ দুঃখিত।’
‘কেন, দুঃখিত কেন?’
‘এইযে, আমায় নিয়ে হসপিটালে গেলেন। আবার বাসায় পৌঁছে দিলেন। অনেকটা সময় নষ্ট হলো আপনার।’
‘হাতের ব্যথাটা তো আমার জন্যই পেয়েছেন। সো আমি দুঃখিত। আপনাকে দুঃখিত হতে হবে না। আসি তাহলে। ভালো থাকবেন।’
ফারহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে যায়। অয়নন্দিতাও গেইটের ভেতরে প্রবেশ করে।
গাড়িতে বসে-বসে ফারহান ভাবছে, মেয়েটার চিকিৎসা করিয়ে এখন ভালো লাগছে। বন্দনা আমি কোনো দিন কাউকে কষ্ট দেইনা। এটা তো তুমি জানো। তবুও আজ আমার দ্বারা একজনের রক্তক্ষরণ হলো। এটা আমি মানতে পারেনি। তাই নিজেই তার সব চিকিৎসা করালাম। ভালো করেছি না আমি বন্দনা। মেয়েটা কিছুই বলল না জানো তো। একদম চুপচাপ। অনেকটা চাপা স্বভাবের। মিথ্যা বলে আমার দোষটা ঢেকে দিল। বন্দনা জানো, মেয়েটা প্রায় তোমার মতো। তার চোখ জোড়া বহমান নদীর মতো। ঠিক যেমন তোমার চোখ জোড়া শান্ত। জানো বন্দনা, তুমি যেমন ব্যথা পেলে সহ্য করে নিতে এই মেয়েটাও ঠিক তেমন করেই সহ্য করল। আমাকে একটা কটু কথাও বলেনি। চেহারায় মিল নেই তোমাদের কিন্তু আচরণে কতটা মিল দু’জন মানুষের। তুমি থাকলে বলতে, এ তো আমার জেরক্স কপি ফারহান। কিন্তু এটা বলার জন্য তুমি আমার পাশে নেই বন্দনা।

রাত নয়টা।
আয়শা বেগম অয়নন্দিতার কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। সিনিয়র নার্সের কথা ফলে গেছে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর চলে এসেছে অয়নন্দিতার। ব্যথা আর ইনজেকশনের সুঁইয়ের কারণেই এই জ্বর। খাইরুল সাহেব যেন অস্থির হয়ে গেছেন ভাগনির জ্বর দেখে। এতিম মেয়েটার কিছু হলে আর কারো জ্বলুক কি না জ্বলুক। তার জ্বলে। ভীষণ জ্বলে। দুপুর বেলা ব্যান্ডেজ করা হাত নিয়ে বাসায় আসা মাত্রই আয়শা বেগম ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কীভাবে হয়েছে, কখন হয়েছে, কোথায় হয়েছে, ব্যথা বেশি কি না জিজ্ঞেস করে-করে অয়নন্দিতাকে পাগল করে ফেলেছেন। অয়নন্দিতা যখন বলল তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তখনই আয়শা বেগম প্লেটে ভাত এনে নিজ হাতে খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দেন। দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত অয়নন্দিতা ঘুমিয়েছে। অন্যান্যদিন নামাজের জন্য তাকে বলতে হয় না। আজ কয়েকবার ডাকার পরেও সে ঘুম থেকে সজাগ হয়নি। সাড়ে আটটার দিকেই জ্বর শুরু।
আয়শা বেগম খেয়াল করছেন অয়নন্দিতা কাঁদছে। কিন্তু কোনো শব্দ হচ্ছে না। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। অবশ্য তার এই কান্নার কারণ তিনি ধরতে পেরেছেন। তিনি হালকা হেসে অয়নন্দিতার চোখের পানি মুছে দেন। এরপর বলেন,
‘একদিনের মধ্যেই জ্বর ভালো হয়ে যাবে। কান্নার কোনো প্রয়োজনই নেই৷’
মামীর কাছ থেকে পজিটিভ কথা শুনে স্বস্তিতে বুকটা হালকা হয় অয়নন্দিতার।

ফারহান সবেমাত্র ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। এরই মাঝে শরীফের ফোন। ডাটা অন রাখলেই ঝামেলা। এ ফোন করে ও ফোন করে। তবে স্ক্রিনে লেকচারার সাহেব নামটা ভাসতেই ফারহান ফোনটা রিসিভ করে। বলা হয়নি, ফারহান পিঞ্চ করে মেসেঞ্জারে শরীফের নিক নেইম সেভ করেছে লেকচারার সাহেব দিয়ে।
‘হ্যালো।’
‘হ্যাঁ, কী খবর ফারহান সাহেব।’
‘মজা নেস নাকি?’
‘আমার নাম যখন লেকচারার সাহেব দেও, তখন মনে থাকে না।’
‘আমি দিতে পারি, তুই পারিস না।’
‘অভ্যাস ত্যাগ করো বন্ধু। সেই তুমি এখনও বদলাইলা না।’
‘আচ্ছা, ওই মেয়েটার আর কোনো খবর আছে?’
‘কোন মেয়েটার?’
‘ওই যে কি যেন নাম। পড়ে গেল। আমি হসপিটালে নিয়ে গেলাম।’
‘ওহ অয়নি। নাহ খোঁজ খবর পাইনি। আগামীকাল কলেজে গিয়ে দেখি খোঁজ নেব একবার। বাই দ্যা ওয়ে ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ডক্টর কী বলল?’
‘স্টিচ লাগেনি। ক্লিন করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। ইনজেকশন পুষ করল একটা। আর মেডিসিন দিয়েছে দশ দিনের। হোপ সো, দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।’
‘বেচারির ডান হাতটাই গেল।’
‘গিল্টি ফিল হচ্ছিল আমার। যদিও সরি বলেছি আমি।’
‘অয়নি মেয়েটা ভীষণ নম্র এবং ভদ্র। সারা কলেজ খুঁজে ওর নামে একটা রেকর্ড পাওয়া ভীষণ মুশকিল হয়ে যাবে।’
‘তুই কি আমায় মেয়েটার গুনগান শোনানোর জন্য ফোন দিয়েছিস?’
‘আরেহ নাহ। ওটা তো এমনি বললাম। কথার কথা আর কি। আচ্ছা শোন। তোর নাম লিস্টে রেখেছি। পরশু তুইও যাচ্ছিস আমাদের সঙ্গে।’
‘ওকে।’
‘দোস্ত, সকালে ক্লাস আছে। আপাতত রাখছি। আমি সময় করে কাল ফোন দেব। ওকে?’
‘ওকে। টেক কেয়ার।’
‘ইউ অলসো।’
এখন আর কাজ করবে না ফারহান। মাথা ভার হয়ে আছে তার। ঘুমাবে সে এখন। তাই ল্যাপটপ অফ করে দিয়ে ঘরের লাইট নিভিয়ে দেয় সে।

চলবে……………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here