চিঠি দিও
১৩ (১)
_________.
বেশ কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যাচ্ছে রওনক। আনিস শেখের আটকে পড়া মাল গুলো ছাড়িয়ে আনার নির্দেশ পেয়েছে সে। আনিসের ব্যবসায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে ওর ইলেকশনের পরপরই। এর মধ্যে ইলেকশনটা হয়ে গেল। বরাবরের মতো বিপুল সংখ্যক ভোটে জয়লাভ করেছে নিজাম চৌধুরী। অথচ ও ভেবেছিল নিজাম এবার আসন হারাবে। ফলাফল যেদিন বেরুলো সেদিন খুব করে আনিসের শেষ কথাটা মনে পড়ছিল। নিজাম চৌধুরী এই শহরের রাজা। যতদিন পার্টি আছে ততদিন নিজাম চৌধুরী আছে। জয়ে আর কিছু ভালো হোক না হোক রওনক নিজামের নজরে এসেছে। জয়ের খুশিতে একটা পার্টি থ্রো করা হয়েছিল আনিস শেখের বাড়িতে। ঐ পার্টিতে নিজাম চৌধুরী অনেক প্রশংসা করেছে রওনকের। এভাবে কাজ করে গেলে দ্রুত একটা পদ পেয়ে যাবে বলে ওয়াদাও করেছে। রওনক যদিও ওর কথাকে বিশ্বাস করেনি। অতনু থাকা অবস্থায় পদ পাওয়া কঠিন বৈকি! তবে নজরে আসতে পেরে ভালো লাগছে। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো সহজ হয়ে যাবে। মুখে বললেও আনিসের ব্যবসায় ঢোকার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল রওনক। কিন্তু সেদিন রাতের পর থেকে আর কোনো দ্বিধা নেই। সুযোগ নিজেই তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে তবে হেলা করবে কেন? নিশ্চয়ই এই ব্যবসা তার লক্ষ্য পূরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পথ হয়ে উঠবে।
আনিস শেখের খুব ভালো করেই জানা আছে রওনককে দিয়ে কোন পর্যায়ে কাজ করানো সম্ভব। রওনক একটা ডেঞ্জারাস ছেলে। অসীম সাহসের অধিকারী। ভয়ডরের লেশমাত্র নেই ওর মধ্যে। এবারের যে কাজটা সেটাও বেশ কঠিন। লাম-ছাম কাউকে দিয়ে হবে না। অতনু এসবে হাত দিতে চায় না আর। ওর চোখ এখন আকাশের দিকে। জমিন দেখতে পছন্দ করে না ও। অনেক ভেবেচিন্তে তাই রওনককে বেছে নিয়েছে আনিস।
বাড়িতে তো আর এসব বলা যায় না। তবুও রওনক বলেছে পার্টির কাজে শহরের বাইরে থাকবে। যদিও তার ধারণা বদিউজ্জামান আঁচ করেছে কিছু। বদি খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ। বয়সে, অভিজ্ঞতায় সে রওনকের থেকে বড়। রওনক যে পথে চলছে, পথটা মোটেও সহজ নয়। প্রতি মুহুর্তে যে পথে মৃত্যুর ভয় সে পথ আবার সহজ কি করে হয়! সর্বক্ষণ একটা আতংকে থাকে বদি। হাত হারাবার পর থেকে তার মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। একটুখানি অসামঞ্জস্যতা দেখলেই ভয় লাগে। রওনককে সে খুব ভালোবাসে;সন্তানের মতো দেখে। কখনো মুখে বলেনি, কিন্তু আশিকের আগে সে রওনককে নিজের সন্তান মনে করে৷ প্রিয় সন্তানটিকে আগুন নিয়ে খেলতে দেখে ভয় হয় ওর। বারণ করে বারংবার। কিন্তু বারণ মানে না রওনক। সবকিছুর সমাধান ওর কাছে বিশৃঙ্খলা। ইটের বদলে পাটকেল। আঘাতের বদলে পাল্টাঘাত৷ এতখানি প্রতিশোধপরায়ণ কবে হয়ে উঠল ছেলেটা, ভেবে পায় না বদি। মাঝেমধ্যে ওর রওনককে ভয় লাগে। রওনকের কঠোর চোখজোড়ার দিকে তাকালে আসন্ন বিপদের আশংকায় কেঁপে ওঠে ওর বুক। ভবিষ্যৎ ভেবে ও শঙ্কিত হয়। খারাপ কিছু একটার সম্মুখীন হতে হবে জানা৷ পাথরের মতো শক্ত করার চেষ্টা করে নিজের ভেতরটাকে। রওনকের গায়ে একটা আঁচড়ও নিশ্চল করে দেবে ওকে। এ ওর জানা৷ রওনকটাই কেবল বুঝতে চায় না।
পরিবারের মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাবে বলে বাইরের সব কাজের ভার ছেলেপেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে রওনক। আজ সে মেতে উঠেছে আশিকের সাথে বাচ্চামো খেলায়। এইতো সকালবেলা দোকান থেকে পাঁচশ মার্বেল নিয়ে এলো। উঠোনে ছোট্ট গর্ত করে এরপর চাচা-ভাস্তে মার্বেল খেলল। খেলা শেষে মিনিট পনেরো সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করল উঠোনে। এখন গেছে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে। ভর দুপুরবেলা কেউ ঘুড়ি ওড়ায়?
ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে দু’জনের পাগলামো দেখে এক পশলা বকাবকি করে এসেছে হাসনা। তবু যদি ওদের গায়ে লাগে!
বহুদিন বাদে বালকসুলভ উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে বাড়িটা।
— কে ছোডোভাই আসছে বাড়িত?
মশলা বাটার ফাঁকে হাসনাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ল বুয়া। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে হাসনা জবাব দিলো,
— হ্যাঁ। তাই তো সকাল থেকে আমার ছেলের দেখা নেই।
— সে কখন বাড়ি আসে, কখন যায় বুঝাই যায় না।
এ পর্যায়ে কিছু বলল না হাসনা। বুয়াও তার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। তবে তা ক্ষণিকের জন্য। কি একটা কথা মনে পড়ায় সে কাজ থামিয়ে পুনরায় মুখ তুলে তাকাল হাসনার পানে। গলা খাদে নামিয়ে বলল,
— বিয়াশাদী দিবেন নাকি ছোডো ভাইয়ের? বয়স তো মেলাই হইলো।
— কেন তোমার হাতে পাত্রী আছে?
— একখান খবর তো নিয়া আসছিই। ঐ যে মাস্টর, তোমার দুইবাড়ি পরে যার বাড়ি।
— হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি।
— তার বেটির জন্য পাত্র খোঁজোছে।
— মাস্টার চাচার কোন মেয়ে?
— কোনটা ফির? কয় বেটি তার?
ভীষণ বিরক্ত হলো বুয়া। হাসনা এবার বেশ অবাক।
মুখে হাত দিয়ে হতভম্ব গলায় সে বলল,
— ঐ মেয়ে তো মাত্র ক্লাস এইটে পড়ে। ওর আবার কিসের বিয়ে?
— উঁহ চেংড়ি মাইনষের আবার পড়া! মাসিকটা হইলেই তার বিয়ার বয়স। হামার সে কোন কালে বিয়া হইছিল। অর মতো থাকাত ২ ছইল নিয়া ভরা সংসার।
— তোমাকে পড়াশোনা করায়নি তবে?
— হামরা হইনো গরীব মানুষ। ঐসব বেলেল্লাপনা হামার নাই বেহে।
মুখ কুঁচকে ফেলল বুয়া। তা দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হাসনা। অথচ পড়াশোনার জন্য সে কত কষ্ট করেছে একসময়। বদিউজ্জামান স্বামী হিসেবে খুব সাপোর্টিভ। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনাটা..
— রুনুকে এখন বিয়ে দেব না বুয়া। পড়াশোনা শেষ করুক। চাকরি-বাকরি করুক। তারপরেই না!
— হ পুরুষ মানুষের তো বয়সও বাড়ে না।
একা একা বিড়বিড় করতে করতে শিল পাটায় হাত লাগাল বুয়া।
____________
কয়েকদিন যাবৎ উপমার মনে হচ্ছে ওকে কেউ ফলো করছে। কিন্তু কে ফলো করছে ধরতে পারছে না। ওর ধারণা সেদিন খেলার মাঠে যে ছেলেটাকে চড় মেরেছিল ঐ ছেলেটা পিছু নিয়েছে। এসব ছেলেপেলেরা যে ঝামেলা না করে দম নেবে না এ তো জানা কথা। কিন্তু জল কতদূর গড়াবে হবে ধারণা করতে পারছে না উপমা। সেদিনের ঘটনাটা এখন অবধি কাউকে বলেনি ও। এখন মনে হচ্ছে বলা উচিৎ। বিপদের আশংকা আছে। সেজো ভাইকে বললে বিপদের ছায়াটা সরে যাবে মাথার ওপর থেকে। সেজো ভাই হলো ওদের পরিবারের সেফটি শেল। বকাঝকা করুক আর যাই করুক দু’হাতে আগলে ধরে আছে সে পরিবারটাকে।
— তুই হুট করে এমন অন্যমনস্ক হয়ে যাস কেন উপ?
খোঁচা মেরে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে কথাটা বললে উপমা ফিরে তাকাল মিতালির দিকে। মৃদু হেসে বলল,
— মন তো আমার এখানেই আছে। তোদের মনটা কোথায়?
— শোন খোঁচাবি না;খোঁচাবি না আমাকে।
— ছিঃ ছিঃ! আমি কি তোকে খোঁচাতে পারি! এতবড় অপবাদ দিতে পারলি আমাকে।
চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলল উপমা। চোখ সরু করে ওর হাতে চিমটি কাটল মিতালি।
— নাটক করো না! নাটক।
— আচ্ছা আর নাটক করছি না। কি বলছিলি বল তো?
হাসতে হাসতে বলল উপমা। ওর কথায় ফোঁস করে শ্বাস ফেলল মিতালি। গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল,
— সাজু আমাকে প্রপোজ করেছে।
— কিহ্! সত্যি?
ওপরে নীচে মাথা নাড়ল মিতালি।
— কংগ্রাচুলেশনস। কবে হলো ম্যাজিকটা?
— রাখ তোর ম্যাজিক। ঘটনা তো অন্য জায়গায়।
— কিসের ঘটনা?
— তুই তো জানিস আমার মা কতখানি স্ট্রিক্ট। সবসময় খবরদারি করে আমার পেছনে। নজরে নজরে রাখে। সাজু বোকাটা কি করেছে জানিস? প্রপোজ করেছে তো করেছে, মেসেজটা পাঠিয়েছে আমার মায়ের ফোনে।
— তারপর?
— তারপর যা হওয়ার তাই। মা দেখে নিয়েছে।
— হায় আল্লাহ!
— হুমম। এখন মা সাজুর সাথে দেখা করতে চায়৷
— এটা তো পজিটিভ সাইন মিতু।
— পজিটিভ নাকি নেগেটিভ আমিও তো বুঝতে পারছি না।
হতাশভাবে মাথা নাড়ল মিতালি। একহাতে ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরে উপমা বলল,
— ভয়ের কিছু নেই। সাজুকে বলেছিস তুই?
— বলেছি। সেও নার্ভাস।
মুখ ঘুরিয়ে ছেলেদের সারিতে সাজুকে দেখে নিলো উপমা। সেও এদিকে তাকিয়ে আছে। উপমা তাকালে অল্প ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল।
উপমা পাল্টা হাসি ফেরত দিয়ে মিতালিকে বলল,
— এত ভয় পাস না তো। যা হওয়ার ভালোই হবে। আমাকে আবার জানাবি খালাম্মা কি বললেন!
— আচ্ছা।
শান্তভাবে মাথা নাড়ল মিতালি।
এরপর নিয়ম করে ক্লাস শেষ হলো তাদের। ছুটির পর উপমা গেল বড় মামার কাছে। ভেবেছিল মামার সাথে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু মামা পরীক্ষার ডিউটি দিচ্ছেন। ফিরতে দেরি হবে। অগত্যা তাকে একা রওয়ানা হতে হলো। মামা অবশ্য রিকশা ডেকে দিতে চাচ্ছিলেন। উপমা নিলো না।
আজ একবারও রওনকের সাথে দেখা হয়নি ওর। খুব অদ্ভুতভাবে রওনককে মিস করছে ও। ভেবেছে যাওয়ার পথে ক্লাবঘরের দিকটায় একবার যাবে। কিন্তু এখন ভরদুপুর। জয় বাংলা হোটেলের দিকটা মানুষে গিজগিজ করছে। এত মানুষ দেখে গলিটায় একা ঢোকার সাহস উপমার হলো না। তবুও শিঙাড়া কেনার বাহানায় দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ও দেখার চেষ্টা করল। নজরে অবশ্য এলো না কিছুই। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল উপমার। কেন রওনক দেখা করল না এই রাগে মনে মনে রওনককেই দু একটা গালি দিয়ে বসল।
— কিহ্ বোনটি কাউকে খোঁজো?
ভারী পুরুষালী স্বর ভেসে এলে চমকে ফিরে তাকাল উপমা। দেখে রওনকের সাথে যে লোকটা সবসময় চলাফেরা করে সে। কি যেন নাম! হ্যাঁ মিজান৷ হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মিজানের হাসিমাখা মুখটা দেখে বড়ই বিরক্ত লাগল উপমার। বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলে সে বলল,
— কাউকে না।
— আমি জানি কাকে। রওনককে তাই না?
হাসি গাঢ় হলো মিজানের।
সত্য কথা মুখের ওপর শুনতে পেয়ে থতমত খেয়ে গেল উপমা। আমতাআমতা করে বলল,
— কি..কি বাজে কথা। ওনাকে খুঁজব কেন আমি অযথা।
— আচ্ছা তাই? কিন্তু তোমার দৃষ্টি তো অন্য কথা বলে।
— আপনি কি দৃষ্টি বিশারদ!
ভ্রু কুঁচকে ফেলল উপমা। তন্মধ্যে ওর শিঙাড়া প্যাকেট হয়ে গেছে। ঝট করে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে বেয়ারার হাতে ধরিয়ে শিঙাড়া নিয়ে রওয়ানা হলো উপমা। মিজান কিছু বলারই সুযোগ পেলো না।
বোকা দৃষ্টিতে উপমার প্রস্থান দেখতে দেখতে মাথা চুলকে একা একাই বিড়বিড় করতে লাগল,
— মেয়েটা কথায় কথায় রাগে কেন! রুনুকেই তো ও খুঁজতেছিল। মেয়ে মানুষের বিষয় বুঝি না ভাই। বুক ফাটে তবু মুখ ফোটে না।
কিন্তু রুনুকে বলতে হবে আগুন এদিকেও লেগে গেছে। এখন আ”গুনে আগুনে কাটাকাটি হওয়ার পালা।
নাহ্, রুনুর পাশে কিন্তু মেয়েটাকে খারাপ লাগবে না৷
চলবে,
Sinin Tasnim Sara