চুপকথা পর্ব-৯ ১০

0
1209

#চুপকথা-(৯+১০)
Zannatul Eva

কুহু.
আমরা এখন কোথায় যাবো? ওদিকে তো সবাই আমাদের খুঁজে না পেয়ে খুব চিন্তায় আছে। জানিনা বাসার সবার কী অবস্থা। মা তো আমাকে ফোনে না পেয়ে বোধহয় নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

তিয়াশকে প্রশ্ন করতেই ও বলল, আমাদের এখন আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। কোনদিক দিয়ে গেলে রাস্তা পাবো বুঝতে পারছি না। আর গহীন পাহাড়ের মধ্যে একবার পথ হারিয়ে ফেললে তখন পথ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল হবে। সাথে নানা রকম বিপদ আপদ তো আছেই।

আমি ভয় পেয়ে বললাম, কী হবে এখন! তন্নীদের একটা খবর দিতে পারলে ওরা অন্তত নিশ্চিন্ত হতো যে আমরা ঠিক আছি এখন৷

তিয়াশ বলল, আমার ফোনটাও ওই লোকটার কাছে। ও যেহেতু বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে কিডন্যাপের ব্যাপারটা তার মানে বাবা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সানির সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছে। ওরাও হয়তো আমাদের খোঁজার জন্য কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে। আর বাবাও বসে থাকবে না। ভয় পেয়ো না। না মানে ভয় পাবেন না। একটা না একটা রাস্তা খুঁজে পাবোই।

আপনি চাইলে আমাকে তুমি করে বলতে পারেন৷ আমি আপনার থেকে বয়সে ছোটোই হবো। আপনি বললে কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগে নিজেকে।

তিয়াশ হেসে বলল, তাহলে তো আমাকেও তুমি করে বলা উচিত তোমার। নিজেকে বয়স্ক লাগাতে কে চায়!

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম। বললম, চেষ্টা করবো।

আমরা পাহাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। এখান থেকে বেরোনোর পথ কখন খুঁজে পাবো জানিনা তবে আমার কেন কানিনা এই সময়টা খুব ভালো লাগছে। মুভিতে এরকম কিডন্যাপিংয়ের সিন দেখেছি। ভালোই লাগতো। নায়ক নায়িকা গহীন জঙ্গলে কিংবা গহীন পাহাড়ে হারিয়ে যেত। তারপর তাদের প্রেম হয়ে যেত। কী সব ভাবছি! আমাদের এসব হওয়ার কোনো চান্স নেই। তিয়াশকে যতটুকু চিনলাম ওকে ভালো ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। ভরসা করার মতো। নয়তো এমন নির্জন পাহাড়ে একা একটা মেয়েকে পেয়েও কুনজরে তাকায় নি বা কোনো এডভান্টেজ নেয়ারও চেষ্টা করেনি। পৃথিবীর সব ছেলে তো এক না। ওকে ভরসা করাই যায়।

তিয়াশের কাঁধে গিটারটা ছিল। কিডন্যাপার এই একটা কাজ ভালো করেছে। গিটার সুদ্ধই কিডন্যাপ করেছে। পথে বোর হলে একটু গান শোনা যাবে। তিয়াশ গান ধরলো______

আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।
সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে
কিছু সময় রেখো ওগো তোমার হাতে।

কিছু স্বপ্নে দেখা, কিছু গল্পে শোনা
ছিল কল্পনা জাল এই প্রাণে বোনা
তার অনুরাগের রাঙা তুলির ছোঁয়া
নাও বুলিয়ে নয়ন পাতে।
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে।

তুমি ভাসাও আমায় এই চলার স্রোতে
চির সাথী হয়ে রইব পথে।
তাই যা দেখি আজ সবই ভালো লাগে
এই নতুন গানের সুরে ছন্দ রাগে।
কেন দিনের আলোর মতো সহজ হয়ে
এলে আমার গহন রাতে।
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে
সেই অঙ্গীকারের রাখী পরিয়ে দিতে
কিছু সময় রেখো তোমার হাতে।
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব
হারিয়ে যাব আমি তোমার সাথে……

আমরা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। কিন্তু কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আরও কিছুদূর এগোনোর পর দেখলাম পাহাড় থেকে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। এই সেই সমুদ্র। তিয়াশ তখন এই অপরূপ সৌন্দর্য্যের কথাই বলছিলো। এতো সুন্দর!

তিয়াশ বলল, দেখেছো কী সুন্দর! বলেছিলাম না এখান থেকে সমুদ্র দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু আমরা বেশিক্ষন এখানে থাকতে পারবো না। আমাদের তাড়াতাড়ি কক্সবাজার পৌঁছাতে হবে। সবাই আমাদের জন্য চিন্তা করছে।

পাহাড় থেকে নামার পর সেখানে সানি তন্নীদের দেখতে পেলাম। প্রচন্ড অবাক হয়ে জোরে চিৎকার করে বললাম, ওই দেখুন তন্নীরা আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। কিন্তু ওরা কিভাবে জানলো আমরা এখানে আছি!

তিয়াশ বলল, হয়তো আমার নাম্বারটা ট্র্যাক করে জানতে পেরেছে। কিন্তু ফোনটা তো গেছে। ওটা তো আর পাওয়া যাবে না।

আমি দৌড়ে তন্নীর কাছে গেলাম। তন্নী আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ভয় পাস না আমাদের সাথে পুলিশ এসেছে। তোদেরকে যারা কিডন্যাপ করেছে তাদেরকে ধরে ফেলেছে পুলিশ। ওরা দুজন পালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু পালাতে পারেনি বদমাশ গুলো।

সানি বলল, ভাগ্যিস তোর বাবা মানে আঙ্কেল রাতেই পুলিশকে ইনফর্ম করে দিয়েছিলো৷ আর এই যে তোর ফোন। ঘুরতে এসে এরকম একটা বিপদে পড়তে হবে স্বপ্নও ভাবতে পারিনি। এখান থেকে সোজা হেটেলে ফিরবো আর তারপর কাল সোজা ঢাকায়।
___________________

আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। মায়ের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তন্নী ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই হ্যান্ডেল করেছে। মাকে কিছু জানতে দেয়নি। এর মধ্যে মা দুই বার ফোন করেছিলো। তন্নী ফোন ধরে মাকে বলেছে, আমি সমুদ্র দেখতে গেছি ফোন হোটেলে রেখে। আরেকবার বলেছে ঘুমোচ্ছি। কিন্তু মায়ের মন এতো সহজে ফাঁকি দেয়া যায়!

মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম এমন সময় মা বলল, হ্যাঁ রে কোনো সমস্যায় পড়িস নি তো আবার? আমার মনটা কেমন যেন খচখচ করছে।

আমি বললাম, না না কোনো সমস্যা হয় নি। কাল ফিরছি আমরা। এখন রাখলাম।

একথা বলেই ফোন কেটে দিলাম। কারন যতক্ষণ কথা বলবো ততক্ষণই নানান প্রশ্ন করবে। মাথাটা এখনও যন্ত্রনা করছে। তন্নী আমার পাশেই বসে ফোন ঘাটছে। ছেলেদের রুম আলাদা। হঠাৎ করে মনে পড়লো, তিয়াশও তো মাথায় আঘাত পেয়েছিলো। কী জানি বেচারার শরীর কেমন এখন। ভাবতে ভাবতেই আমার চোখ লেগে গেল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
___________________

রাতে সবাই সমুদ্র দেখতে বের হলো। খালি পায়ে হাঁটছি সমুদ্রের পাড়ে। পাশেই গানের আসর বসেছে। আমাকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তন্নী ডাক দিলো। আমিও ওদের গানের আসরে গিয়ে যোগ দিলাম। সবাই আনতাকশারি খেলবে। আমি খেলবো না বলতেই তিয়াশ বলল, খেলো না। সবাই যখন এতো করে বলছে।

প্রথম গান তিয়াশকে দিয়ে শুরু হলো____

আবার এলো যে সন্ধ্যা
শুধু দু’জনে
চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে যেখানে নদী এসে থেমে গেছে।

ঝাউবনে হাওয়াগুলো খেলছে
সাঁওতালি মেয়েগুলো চলছে।
লাল লাল শাড়ীগুলো উড়ছে
তার সাথে মন মোর দুলছে।

ঐ দুর আকাশের প্রান্তে
সাত রঙা মেঘ গুলো উড়ছে

আবার এলো যে সন্ধ্যা
শুধু দু’জনে

এই বুঝি বয়ে গেল সন্ধ্যা
ভেবে যায় কি জানি কি মনটা
পাখিগুলো নীড়ে ফিরে চলছে
গানে গানে কি যে কথা বলছে

ভাবি শুধু এখানেই থাকবো
ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে
আবার এলো যে সন্ধ্যা
শুধু দু’জনে…….

আনতাকশারি খেলার এক পর্যায় তন্নী আমাকে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো, তোদের মধ্যে কী চলছে বলতো?
মানে! কাদের মধ্যে?

তোর আর তিয়াশের মধ্যে।

কী চলবে?

সেটাই তো জানতে চাইছি।

কিছুই না। একসাথে থাকলেই প্রেম হয়ে যায় না। তুই যা ভাবছিস সেরকম কিছু না।

হলে মন্দও হবে না। তিয়াশ ছেলে হিসেবে খুব ভালো।

জানি তো ভালো।

তাহলে সমস্যা কোথায়!

কী বলছিস তুই? ও তো আমালে এরকম কিছু বলেনি।

বলেনি বলবে। তুইও তো বলতে পারিস। মানে ছেলেদেরই প্রপোজ করতে হবে এমন তো কোথাও লেখা নেই। আমাকে দেখ। সানিকে তো আমিই প্রপোজ করেছিলাম।

তুই কোথা থেকে কোথায় চলে গেছিস। থাম তো। এরকম কিচ্ছু হবে না।

দেখা যাক।

হ্যাঁ দেখতে থাক তুই।

তন্নী কিছু বলল না। শুধু হাসলো।

আনতাকশারি খেলার পর আমরা ডিনার সেরে নিলাম।

এরপর সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
_______________

১০.
ফেরার সময় আমি আর তন্নী একসাথে বসলাম। সানির সাথে তন্নীর আবারও ঝগড়া হয়েছে। তাই এখন দুটোয় একসাথে বসেনি। আমি কয়েকবার চারপাশে তাকিয়ে তিয়াশকে খুঁজলাম। তিয়াশ পেছনের সিটে বসেছে। একটা মেয়ের সাথে। সানি একাই বসে আছে। আমি খুব অবাক হলাম। সানির পাশের সিটটা খালি থাকতেও ও কেন পেছনে গিয়ে বসলো অন্য একটা মেয়ের সাথে! অদ্ভুত! ও বসলেই বা তাতে আমার কী? আমি শুধু শুধু কেন এসব ভাবছি!

হঠাৎ করেই তিয়াশের চোখে চোখ পড়ে গেল আমার। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে নিলাম। সামনে ফিরে চুপচাপ বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর তিয়াশ আমাদের সিটের সামনে এসে তন্নীকে বলল, আবার রাগ করেছো কেন? বেচারা একা একা বসে আছে। যাও গিয়ে কথা বলো। সিটটা কিন্তু ফাঁকাই আছে, কখন কোন মেয়ে এসে বসে পড়বে তখন কিন্তু জেলাস হতে পারবে না। মেয়েরা জেলাসিতে ভীষণ এক্সপার্ট কিনা।

তিয়াশ বোধহয় কথাটা আমাকে শুনিয়েই বলল। ও কী ভেবেছে, ও ওই মেয়েটার সাথে বসেছে বলে আমি হিংসে করছি! মোটেও না৷ আমার কী ও কার সাথে বসলো না বসলো তাতে!

তিয়াশের কথা শুনে তন্নী তাড়াতাড়ি করে সানির পাশে গিয়ে বসে পড়লো। আমার পাশের সিটটা ফাঁকা, তাই তিয়াশ বলল, আমি কি এখানে বসতে পারি?

জিজ্ঞেস করার কী আছে! সিটটা তো আমি কিনে নিই নি। আপনি চাইলেই বসতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ আবার এখানে বসতে চাইেছন যে? ওখানেই তো বেশ বসেছিলেন।

তিয়াশ বলল, তুমি খুঁজছিলে তাই চলে এলাম।

আমি! আমি কখন খুঁজলাম আপনাকে?

একটু আগে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে যে।

সে তো আমি দেখছিলাম কে কোথায় বসেছে। আপনাকে লক্ষ্য করে তাকাই নি।

হুম বুঝলাম।

কী বুঝেছেন?

তুমি যা বোঝালে।

ও আচ্ছা।

আমি ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করলাম গান শোনার জন্য। তিয়াশ বলল, আমি পাশে থাকতেও গান শুনে সময় কাটাতে হবে! কেন আমি কি ভীষণ বোরিং?

বোরিং কেন হবেন? আপনি তো পেছনে বসেই দিব্যি গল্প করছিলেন। আমার সাথে গল্প করে ভালো নাও লাগতে পারে।

তিয়াশ বলল, এতো রাগ!

রাগ! কিসের রাগ? কার সাথে রাগ?

আচ্ছা একটা কথা বলতো।

কী?

এই যে আমাদের বারবার দেখা হলো এটা কি এমনি এমনি? নাকি এর পেছনে কোনো কারন আছে? তোমার মনে হচ্ছে না সামথিং স্পেশাল?

বিশেষ কী হবে! পৃথিবীটা গোল। তাই যখন তখন যেকোনো সময় যার তার সাথে দেখা হতেই পারে।

আচ্ছা একটা কথা বলতো, এই যে আমরা কিডন্যাপ হলাম, তারপর পাহাড়ে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম, তোমার একবারও ভয় করেনি?

কাকে ভয় পেতাম? যাকে ভরসা করি তাকে ভয় কেন পাবো?

আমাকে ভরসা কেন করলে হঠাৎ?

মনে হয়েছে আপনি ভরসা করার মতো মানুষ তাই।

শুধু ভরসা করা যায়?

ভরসা থেকে অনেক কিছু হতে পারে। সেটা সময়ের উপর নির্ভর করে। সময় অনেক প্রশ্নের উত্তর বলে দেয়।

তিয়াশ আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আমিও চুপচাপ মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
__________________

বাস এসে থামলো। সবাই বাস থেকে নেমেও পড়েছে। আমি চোখ মেলতেই দেখি তিয়াশের কাঁধের উপর আমার মাথা। আমি খুব লজ্জা পেলাম। ইশশ এভাবে ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলাম! সবাই দেখে কী ভেবেছে! আর তিয়াশই বা কী ভাবলো!

আমি চট করে সিট থেকে উঠে পড়লাম। বললাম, সবাই নেমে গেছে! আমাকে তুলবেন তো নাকি? সরি চোখটা লেগে গিয়েছিলো, আপনার কাঁধে এভাবে…….

ইট’স ওকে। ইট’স টোটালি ওকে।

জানালা দিয়ে তন্নী ডেকে বলল, কিরে কুহু তাড়াতাড়ি আয়। আর কত ঘুমোবি!

আমি মাথা নাড়িয়ে হেসে সাড়া দিলাম তন্নীকে। বাস থেকে নেমে যে যার যার মতো বাসায় চলে এলাম।

বাসায় ফিরে শুনলাম, বড় আপার জন্য একটা সম্বোন্ধ এসেছে। কালই নাকি দেখতে আসতো। আমি বাসায় ছিলাম না তাই মা আজকে আসার কথা বলেছে। কিছুক্ষণ পরেই ছেলেপক্ষরা বড় আপাকে দেখতে আসবে। আমি বড় আপাকে রেডি করছিলাম এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তিয়াশের নাম্বারটা ভেসে উঠতেই আমার বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here