চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ২১

0
1024

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২১
____________

রেডিসন হোটেলের রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষ
ইতোমধ্যে ব্রেকফাস্ট করার জন্য জড়ো হয়েছে। চলছে অর্ডার, চলছে খাওয়া।
মিতুলও একটা টেবিলে এসে বসেছে। তবে কিছু অর্ডার করেনি। রেশমী আন্টি আসলে তারপর অর্ডার করা হবে। রেশমী আন্টি এখনও এসে পৌঁছয়নি রেস্টুরেন্টে।
মিতুল একবার সামনে চোখ তুলে তাকালো। ওর চেয়ার বরাবর সামনের চেয়ারে জোহান বসা।
জোহান কিছু বলছে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে রেস্টুরেন্ট দেখছে।
মিতুলের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। এই ব্যাপারে জোহানকে জিজ্ঞেস করবে কি না ভাবছে। মিতুল শেষমেশ জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
“শুনেছি এই ভ্যাঙ্কুভারে না কি একটা পাঞ্জাবি মার্কেট আছে?”

মিতুলের কণ্ঠ কানে আসতে জোহান মিতুলের দিকে তাকায়। খুব কষ্টে উচ্চারণ করে,
“পা-পা-পাজবি?”

মিতুল দুই পাশে মাথা নেড়ে বললো,
“পাজবি নয়। পাঞ্জাবি। পাঞ্জা-বি। তুমি জানো না পাঞ্জাবি বাজার সম্পর্কে?”

“ওহ পানজবি! পানজবি বাজার কোথায় সেটা আমি জানবো কী করে? আর পানজবি দিয়ে তুমি কী করবে? তোমার কি পোশাকের অভাব পড়েছে? পানজবি কিনে পানজবি পরবে তুমি?”

মিতুল কিছু বলার আগে জোহান নিজেই আবার বললো,
“একটা কাজ করা যায়। আমার কাছে অনেক পানজবি আছে। প্রত্যেক ইদে আমার ড্যাড আমাকে গিফট করে। তুমি চাইলে আমি সেখান থেকে তোমাকে একটা, দুটো পানজবি গিফট করতে পারি। চাই তোমার?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের মেজাজ খারাপ হওয়ার অবস্থা।
“আমি ওই পাঞ্জাবীর কথা বলছি না। আমি বলছি পাঞ্জাবির কথা। ইন্ডিয়ার একটা রাজ্য এটা। যার নাম পাঞ্জাব। তুমি কি এটা জানো না? মানে, কোনো দেশ সম্পর্কে কি ধারণা নেই তোমার? এই কানাডাই চেনো না কি শুধু?”

“ইন্ডিয়া সম্পর্কে জেনে আমি কী করবো? শুনেছি কতগুলো রাজ্য আছে। এখন সেই রাজ্যেগুলোর নাম ঠিকানা কি মুখস্থ করে ফেলতে হবে আমার? কী করবো আমি ইন্ডিয়া সম্পর্কে জেনে? আমি কি সেখানে গিয়ে নিজের বসত গড়বো? আর কী বললে, বাইরের কোনো দেশ সম্পর্কে আমার ধারণা নেই? তুমি জানো, আমি কতগুলো বাইরের দেশ ভ্রমণ করেছি? আইডিয়া আছে তোমার কোনো? স্পেন, সৌদি আরব, আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইত্যাদি অনেক দেশে ঘুরেছি আমি। আর তুমি যে আমাকে বলছো, তোমার নিজের কয়টা দেশ সম্পর্কে ধারণা আছে? আমার তো মনে হয় এই কানাডা ছাড়া আর কোনো দেশ ভ্রমণ করোনি।”

মিতুল খুব দাপটের সাথে বললো,
“না জেনে না শুনে কথা বলবে না একদম। অবশ্যই আমি আরও বাইরের দেশ ঘুরেছি। ইন্ডিয়া, মালদ্বীপ, নেপাল, ঘুরেছি আমি। তোমার মতো নই আমি।”

“আমার মতো নও মানে? কী বোঝাতে চাইছো? আমাকে তোমার কী মনে হয়?”

“একটা পাতিহাঁস বৈ কিছুই মনে হয় না।” দ্রুত গতিতে বাংলা বললো মিতুল।

“পে-পেটি-হ্য-হ্যাস? পে-পেটিহ্যাস মানে কী?”

মিতুল ভাবতে পারেনি জোহান তোতলাতে তোতলাতে ‘পেটিহ্যাস’ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে। ও ভেবেছিল, ‘পে-পে’ করতে থাকবে জোহান। কিন্তু না, ভালোই উন্নতি করেছে দেখছে।
মিতুলকে চুপ করে থাকতে দেখে জোহান অধৈর্য হয়ে বললো,
“কী ব্যাপার, বলছো না কেন কিছু?”

“কী বলবো?”

“পেটিহ্যাসের ইংলিশ মিনিং বলো আমাকে।”

“কোনো মিনিং নেই।”

“তুমি বলবে না আমাকে, তাই না? ঠিক আছে বলতে হবে না তোমার। আমি নিজেই বাংলা শিখে পেটিহ্যাসের মিনিং জেনে নেবো। যদি খারাপ কোনো মিনিং বের হয়, তবে তোমার কপালেও খারাপ আছে।”
জোহান চেয়ার ছেড়ে উঠে রেস্টুরেন্টে থেকে বের হয়ে গেল।

মিতুল বাংলাতে বিড়বিড় করে বললো,
“আগে শেখ, তারপর দেখা যাবে।”
___________

ভ্যাঙ্কুভার আর্ট গ্যালারি এবং জন হেনরী পার্ক ঘুরে এইমাত্র হোটেলে ফিরেছে মিতুল’রা। আসার সময় আবার শপিংও করেছে।
রেশমী আন্টি একটা জ্যাকেট এবং একটা লং কোট গিফট করেছে ওকে। মিতুল শপিং ব্যাগগুলো বিছানার উপর রাখলো।
রেশমী আন্টি জ্যাকেট খুলে রাখছে। আজকে বাইরে অনেক শীত। উষ্ণ পোশাক পরে না বেরোলেই বিপত্তি। মিতুলের গায়ে একটা লং কোট। গলায় মাফলার প্যাঁচানো। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বিছানায় রাখতে গেলেই দেখলো, জোহানের ম্যাসেজ এসেছে। মিতুল ম্যাসেজ সিন করলো।
‘এখনই বাইরে এসো। পাঞ্জাবি মার্কেট দেখতে যেতে চাইলে ঝটপট এসে পড়ো। আমি রাস্তায় ওয়েট করছি।’

জোহানের ম্যাসেজ দেখে মিতুল যারপরনাই অবাক। পাঞ্জাবি বাজার? জোহান তো বললো পাঞ্জাবি বাজার চেনে না ও। তাহলে? ব্যাপারটা একবার গিয়ে দেখতে হয় তো!
মিতুল একবার উইন্ডোর দিকে তাকালো, আর একবার রেশমী আন্টির দিকে। এখন শেষ বিকেল। বাইরে রোদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। রেশমী আন্টি চুল থেকে হেয়ার পিন খুলছে। রেশমী আন্টিকে না বলে তো আর যেতে পারবে না। কিন্তু কী বলবে রেশমী আন্টিকে? জোহানের সাথে কোথাও যাওয়ার কথা একদম বলতে পারে না রেশমী আন্টির সাথে। কেমন যেন সংশয় হয়। মিতুল খানিক ইতস্তত করে ডাকলো আন্টিকে,
“আন্টি…”

“হ্যাঁ, বলো।” মিতুলের দিকে তাকাতে তাকাতে বললো।

“বলছি, আমি কি জোহানের সাথে পাঞ্জাবি মার্কেটে যেতে পারি? মানে, ও এই মাত্র ম্যাসেজ করে আমাকে জানিয়েছে পাঞ্জাবি মার্কেট নিয়ে যাবে। এখন আমি কি যেতে পারি ওর সাথে?” মিতুলের বুক ধুকপুক করছে। জানে না কেন রেশমী আন্টির কাছে জোহানের কথা বলতে গেলে ওর এরকম ফিল হয়।

রেশমী আন্টি ওর দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কী যেন ভাবলো। ভাবতে অনেক সময় নিলেন যেন। তারপর বললেন,
“গেলে যাও। তবে ওর সাথে না গেলেই ভালো হতো। আমি কালকে নিয়ে যেতাম তোমাকে।”

মিতুলের কেন যেন মনে হচ্ছিল রেশমী আন্টি পারমিশন দেবেন না। কিন্তু রেশমী আন্টি যেতেও তো নিষেধ করেননি। পারমিশন দিয়েছে আবার দেয়নি, এমন অবস্থা।
মিতুল বললো,
“যেহেতু ও বলেছে আমাকে নিয়ে যাবে, সেহেতু আমি এখন ওর সাথে যাই।” কথাটা বলতে বলতে মিতুল নিজের ব্যাগ উঠিয়ে নিলো বিছানা থেকে। রেশমী আন্টির কিছু বলার অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

রেশমী তাকিয়ে রইলেন দরজার দিকে। জোহানের সাথে মিতুলের এত চলাচল মোটেও ভালো লাগছে না তার!

মিতুল হোটেল থেকে বের হতেই জোহানকে দেখতে পেল। জোহানের গায়ে কালো জ্যাকেট। মিতুল কাছে এসে বললো,
“চলো।”

জোহান মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর একেবারে মিতুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। কোনো কিছু না বলেই মিতুলের গলায় প্যাঁচানো মাফলারটা খুলতে লাগলো। মিতুল বিস্ময় কণ্ঠে বললো,
“কী করছো তুমি?”

জোহান মিতুলের গলার মাফলারটা খুলে নিজের হাতে নিয়ে এলো। বললো,
“দেখছো না বাইরে কী প্রচণ্ড শীত? এই শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় যদি আমার এত সুন্দর গলাটার কোনো ক্ষতি হয়, তাহলে বুঝতে পারছো কত বড়ো সর্বনাশ হয়ে যাবে? তোমার কোনো আইডিয়া আছে?”

জোহান মিতুলের মাফলারটা নিজের গলায় প্যাঁচাতে লাগলো।
মিতুল অনেক রেগে গেল। রাগান্বিত কণ্ঠেই বললো,
“তোমার এত সুন্দর গলা নিয়ে যদি তোমার এতই দুশ্চিন্তা, তাহলে মাফলার ছাড়া বের হয়েছ কেন? আমার গলা থেকে মাফলার খুলে কেন নিলে? আমি পারমিশন দিয়েছি তোমাকে? কেন নিজে সর্বনাশ থেকে বাঁচতে তুমি অন্য আরেক জনের মাফলার চুরি করবে?”

“শুধু তো মাফলারই চুরি করেছি। মুখ বন্ধ রাখো, নয়তো গায়ের জ্যাকেটও নিয়ে নেবো।”

মিতুল অপমান বোধ করলো। মুখের উপর এমন ভাবে ওয়ার্নিং দিলো? জোহানের সাথে যাওয়ার জন্য এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে। মিতুল নিজের ভুল শুধরানোর জন্য আবার হোটেলে ঢোকা দিলে, জোহান পিছন থেকে হাত টেনে ধরলো।
মিতুল রক্তচক্ষুতে তাকালো জোহানের দিকে।
জোহান খুবই শান্ত কণ্ঠে বললো,
“এত রাগ তোমার তুলতুল! এত রাগতে পারো তুমি? যখন তুমি রেগে তাকাও না, মনে হয় তোমার ওই চাহনিতেই খুন করে ফেলবে আমায়। মৃত্যু নামবে আমার জীবনে! আর কখনও ওভাবে অন্য কারো দিকে তাকাবে না। নয়তো মার্ডার কেসে ফাঁসবে তুমি। আমি চাই না তুমি অন্য কাউকে খুন করার অপরাধে শাস্তি পাও। তোমার শাস্তি কেবল আমি লিখবো।”

জোহানের এসব ভারী ভারী কথার কোনো মানেই ধরতে পারলো না মিতুলের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক। ও শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। ওর রক্ত চক্ষু শান্ত থেকে আরও অধিক শান্ততায় হারিয়ে গেছে। জানে না জোহানের এমন ভারী ভারী কথার মানে কী। কিন্তু কেন যেন ওর হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। ঠিক সেদিনের মতো। মনে হচ্ছে ওর হৃদয় ওর নিয়ন্ত্রণে নেই এই মুহূর্তে।
____________

ট্যাক্সি নিয়ে পাঞ্জাবি বাজারে এসেছে ওরা। পাঞ্জাবি বাজারে আছে অনেক কিছু। এটি অনেক বৃহৎ বাজার। এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, গয়না, জুতো, চুড়ি, ব্যাগ, শিশুদের জামাকাপড়, আরও অনেক কিছু। পাওয়া যায় বিয়ের আনুষঙ্গিক পোশাক-আশাকও। খাদ্য ও মুদি দ্রব্যাদিও আছে এখানে। সাউথ এশিয়ান খাবার রান্না করতে যা যা প্রয়োজন, তা সবই আছে এই বাজারে।
এই বাজারটি জোহানের পরিচিত নয়। আগে কখনো আসেনি। তাই মিতুলকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে একটু বেগ পেতে হলো।
ইতোমধ্যে এই পাঞ্জাবি বাজার ঘুরে জোহান মিতুলকে শপিংও করে দিয়েছে। একটা সাইড ব্যাগ এবং একটি লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গাটির দাম অনেক। মিতুল কিছুতেই জোহানকে এর দাম পরিশোধ করতে দিতে চায়নি। কিন্তু জোহান ওর কথা শুনলো না। মিতুলের এই ব্যাপারটি একদম ভালো লাগেনি। কানাডা ঘুরতে এসে নিজের টাকা ব্যয় করে সবকিছু কিনবে, তা নয়, সবাই ওকে গিফটের উপর রাখছে।

মিতুল’রা এখন গহনার দোকানে। এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের নেকলেস, চুড়ি আছে। মিতুলের মনে পড়লো, কার্লকে তো শাড়ি পরে দেখাবে ও। শাড়ির সাথে চুড়ি না পরলে কেমন হবে? শাড়ির সাথে চুড়ি পরলে ভালো লাগবে। মিতুল চুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বিভিন্ন প্রকার চুড়ি আছে এখানে। মিতুল নেভি ব্লু কালারের এক গোছা রেশমী চুড়ি হাতে পরলো। দেখতে চাইছে হাতে কেমন লাগে।

জোহান নেকলেসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মিতুলকে হাতে চুড়ি পরতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে এলো। মিতুলের চুড়ি পরা হাতটা টেনে নিলো। চুড়ি দেখে ওর কপাল কুঁচকে গেল।
“এগুলো কী?”

মিতুল অবাক হয়ে বললো,
“চুড়ি চেনো না তুমি?”

“চুইইরি?” জোহান মনে করার চেষ্টা করলো। মনেও পড়লো। জোহান বললো,
“ওহ, ইয়াহ। আমি চিনি এটা। বাংলাদেশে দেখেছিলাম।”

“শুধু বাংলাদেশে দেখেছো? রেশমী আন্টির হাতে কখনো দেখোনি?”

“মম? দেখেছিলাম হয়তো। মনে নেই আমার।” বলতে বলতে লাল রঙের চুড়ি হাতে তুলে নিলো জোহান। মিতুলের বাম হাতে চুড়ি পরা। ডান হাত শূণ্য। জোহান মিতুলের শূণ্য হাতটা লাল চুড়িতে পরিপূর্ণ করলো। মিতুলের ডান হাতটা ধরে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে বললো,
“এই দুটো কালারই নাও।”

জোহান মিতুলকে লাল চুড়ি নিতে বললো কারণ, ও যে লেহেঙ্গা কিনে দিয়েছে তার রংও লাল। লেহেঙ্গার সাথে পরার জন্যই এটা নিতে বললো ওকে।
মিতুল দুই রঙের চুড়িই নিলো। তবে চুড়ির দামও পরিশোধ করলো জোহান। মিতুলের কেন যেন জোহানের মূল্য পরিশোধের ব্যাপারটা খারাপ লাগলো না আর।

পাঞ্জাবি বাজার থেকে ফেরার সময় হঠাৎ স্নো ফল শুরু হলো। ওরা ট্যাক্সিতে ছিল। জোহান ট্যাক্সি থামাতে বললো। মিতুলকে নিয়ে নেমে পড়লো ট্যাক্সি থেকে।
ট্যাক্সি ওদের রেখে চলে গেল।
মিতুল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে শপিং ব্যাগ ধরে, অন্যহাত বাড়িয়ে দিলো স্নো ফল ছোঁয়ার লোভে। রাশি রাশি বরফ কুচি উড়ে পড়ছে। পরনের শীত বস্ত্রকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মাথার চুলেও নিজেদের জায়গা করছে চুপি চুপি।
জোহান মিতুলের থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ানো ছিল। এবার মিতুলের কাছে এগিয়ে এলো সেলফি তুলতে। এক ফ্রেমে দুজনের সেলফি তুলবে ও। মিতুলকে হাসতে বললো। মিতুল হাসতেই দুজনের এক সাথে একটা সেলফি তুলে ফেললো। এটাই জোহানের সাথে মিতুলের প্রথম ছবি।
জোহানের সেলফি তোলা হলে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। এবার মিতুলের থেকে নেওয়া মাফলারটা গলা থেকে খুলতে লাগলো। মাফলারটা খুলে মিতুলের আরও কাছাকাছি এগিয়ে এলো। মিতুল বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।
জোহান মিতুলের খুব কাছে এসে মাফলারটা পরাতে লাগলো মিতুলের গলায়।
জোহান খুব কাছে থাকায় জোহানের উষ্ণ নিঃশ্বাস এসে মিতুলের মুখে পড়ছে। মিতুলের কেন জানি মনে হচ্ছে ও শ্বাস নিতে পারছে না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে। জোহানের একেকটা নিঃশ্বাস ওর নিঃশ্বাস আটকে দিচ্ছে।

মাফলারটা পরিয়ে দিয়ে জোহান সরে এলো মিতুলের কাছ থেকে। ধীরে পা ফেলে হাঁটতে লাগলো সামনের দিকে।
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলছে। খুবই শান্ত আলোর স্নিগ্ধ পরশ বুলাচ্ছে তুষারপাতের সাথে। তুষারপাত এই কালো রঙের রাতটাকে নিজের রঙে রাঙিয়ে ক্রমশ সাদা কালো করে তুলছে প্রকৃতি। রাস্তা থেকে গাড়ি আসা যাওয়া করছে। রাস্তার দুই পাশের শপ, রেঁস্তোরাগুলোয় আলো জ্বলছে। জোহান হেঁটে মিতুলের থেকে কিছুটা দূরত্বে এসে দাঁড়ালো।
মিতুল পিছনে দাঁড়িয়ে জোহানের কণ্ঠ শুনতে পেল,
“তুমি এত বোকা কেন মিতুল? এত বোকা কেন? এতটাই বোকা যে, তুমি নিজেকেই নিজে বোঝো না। এত বোকা হয় কেউ?”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের হৃদয় অস্বাভাবিক গতিতে কাঁপতে লাগলো। হৃদয়ের এমন কাঁপন সত্যিই ভয়াবহ। এটা ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে না। যার ইঙ্গিত করে তা অপ্রত্যাশিত। মিতুল পিছন থেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“কী বোঝাতে চাইছো তুমি?”

জোহান মিতুলের দিকে ফিরে তাকালো। বললো,
“তুমি নিজেকে বোঝো না। তোমার মন কী চায়, কী না চায়, এসব কিছুই বোঝো না তুমি। তুমি শুধু ঠুনকো জিনিসের পিছনে দৌঁড়াও। তুমি বোঝো না নিজেকে, বোঝো না তোমার মনকে। তোমার মন কী চায় তা জানো না তুমি। আমি জানি। তোমার মন কী চায় আমি ভালো করেই জানি সেটা।”

জোহানের এমন কথা শুনে হৃদয়ের সাথে সাথে সমস্ত শরীরও যেন এবার কাঁপছে মিতুলের। ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। হাত থেকে ব্যাগ পড়ে যেতে চাইছে। মিতুল সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলো ব্যাগ দুটো। ওর শ্বাস ভারী। মস্তিষ্কে চাপ। আশেপাশে কী ঘটছে, না ঘটছে সেদিকে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর ফোকাস শুধু জোহান। মিতুল আগের মতোই কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইলো,
“কী চায় আমার মন?”
মিতুলের মনে উদ্দীপনার ঝড় বইছে। কী চায় ওর মন? কী বলবে জোহান?

“তোমার মন…” বলতে গিয়েও আবার থেমে গেল জোহান।

মিতুল তীব্র আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে আছে জোহানের দিকে। ও জানে না ওর মন কী চায়। সত্যিই জানে না। কিন্তু ও জানতে চায়।
ও জানতে চায়, ওর মনের কী চাওয়া। ও জানতে চায়, ওর মন আসলে ঠিক কী চায়?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here