চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ২২

0
1050

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২২
____________

জোহান কিছুক্ষণ মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে বললো,
“তোমার মন আসলে চাইছে এই তুষার জমা পথ দিয়ে পাগলের মতো দৌঁড়াতে।”

জোহানের কথা শুনে মিতুলের হাত থেকে ব্যাগ পড়ে গেল।
“কী?”

জোহান মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, এটাই চাইছে তোমার মন। পাগলের মতো ছুটতে চাইছে। আচ্ছা, তুমি এমন কেন বলো তো? নিজের মনের এই সামান্য চাওয়াটুকুও বুঝতে পারো না?”

মিতুলের মন জানার আগ্রহ থেকে রূপ নিলো তীব্র আক্রোশে। রাগ ঝেঁকে বসলো মাথার সর্বত্র। এত বড়ো অপমান করলো জোহান? পাগলও বললো শেষ পর্যন্ত? মিতুলের রাগ হচ্ছে, সেই সাথে কান্নাও পাচ্ছে।
মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে। তারপর একটা টু শব্দও না করে, রাস্তা ধরে সোজা হাঁটা শুরু করলো লম্বা পা ফেলে। ওর শপিং ব্যাগ পড়ে রইল রাস্তায়।

জোহান পিছন থেকে ডাকলো,
“হেই মিতুল!”

মিতুল থামলো না। বরং ওর চলার গতি আরও বেড়ে গেল।
জোহান রাস্তা থেকে ব্যাগ দুটো কুড়িয়ে মিতুলের পিছন পিছন ছুটলো।

“আরে মিতুল, দাঁড়াও।”

“ডাকবে না আমাকে। একদম ডাকবে না।” মিতুলের রাগী কণ্ঠ শোনা গেল।

জোহান হেসে ফেললো।
“হেই, ওয়েট ফর মি!…হেই তুলতুল!”

মিতুল থামলো না, হাঁটতেই থাকলো।
জোহান যেতে লাগলো মিতুলের পিছন পিছন।
____________

জোহান কাল রাতে যা বললো, তা মোটেই আশা করেনি মিতুল। ওর মন অন্য কিছু শুনতে চেয়েছিল। কিন্তু ঠিক কী শুনতে চেয়েছিল, সেটা ওর নিজেরই জানা নেই। তবে জোহান যা বললো তা একেবারেই শুনতে চায়নি ও। পাগল…পাগল বললো ওকে? জোহান আস্ত একটা বদমাইশ!
মিতুল জুতোর ফিতা বাঁধতে বাঁধতে মনে মনে আরও কিছু কথা শোনালো জোহানকে ।
আজকে ভ্যাঙ্কুভারে শেষ দিন ওদের। রাতের ফ্লাইটে এডমন্টন ফিরে যাচ্ছে ওরা। তাই আজকে একটু ভালো করে ঘোরাঘুরি হবে। সকাল সকালই যাচ্ছে এখন বিচ দেখতে। স্প্যানিশ ব্যাংক বিচ ও জেরিকো বিচ দেখবে আজকে। রেশমী আন্টি রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছে। মিতুল গায়ে একটা হুডি জ্যাকেট চাপিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো দ্রুত।

হোটেল থেকে বের হয়েই জোহানকে দেখতে পেল, ট্যাক্সির সাথে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জোহানের গায়েও হুডি জ্যাকেট। কালো রঙের। মাথায় হুডি টেনে রেখেছে। চোখে সানগ্লাস। জোহানকে দেখে মিতুলের রাগ হচ্ছে। জোহানের সামনেও পড়তে ইচ্ছা করে না ওর। মিতুল ট্যাক্সির কাছে এসে গেলে, জোহান পিছনের আসনের দরজা খুলে দিলো মিতুলের জন্য। মিতুল রাগী চোখে তাকালো ওর দিকে।
জোহান একটু হাসলো।
মিতুল ট্যাক্সিতে উঠে বসলো রেশমী আন্টির পাশে। জোহান বসলো সামনের আসনে।
ট্যাক্সি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।

আধ ঘণ্টার ব্যবধানে এসে পৌঁছলো ওরা বিচে। স্প্যানিশ ব্যাংক বিচ ও জেরিকো বিচের অবস্থান পাশাপাশি হওয়ার কারণে, দুটো বিচ মিলে এক চওড়া সী বিচের সৃষ্টি হয়েছে। যা দেখতে মিতুলের কাছে অনেকটা বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতো লাগলো। তবে মূল পার্থক্য হলো, কক্সবাজার সৈকতের অবস্থান একেবারে মূল সাগরের ধারে এবং এর অবস্থান সাগর প্রণালীর ধারে। যেখান থেকে উত্তর ভ্যাঙ্কুভার শহর এবং রিচমন্ড শহরের কিছু অংশ পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
শহরের পশ্চিম তীরে অবস্থিত শহরবাসীদের মূল অবকাশ কেন্দ্র হলো এই সমুদ্র সৈকত। শহরের লোকজন সাধারণত সপ্তাহশেষে এখানে পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে আসে। রেশমী আন্টির কাছ থেকে শোনা গেল গ্রীষ্মকালে না কি এখানে একটু বেশিই ভিড় থাকে। সবাই এখানে নানা বিনোদনমূলক কাজে ব্যস্ত থাকে।
মিতুল চারদিকে তাকিয়ে ভালো ভাবে লক্ষ্য করছে সব কিছু। কেউ কেউ কায়াকিং ও জেটস্কি রাইডিং করছে। কেউ কেউ আবার চওড়া বিচের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কায়াকিং করে সাগর প্রণালীর অপর প্রান্তেও যাওয়া যায়, যখন পানির উচ্চতা কম থাকে। অনেকে এখানে এসেছে মাছ এবং কাঁকড়া ধরার জন্য। জেরিকো বিচের প্রায় একেবারে শেষ প্রান্তে ফিশিং এর জন্য একটি কাঠের তৈরি ডক রয়েছে। যেখানে অনেক মানুষজনকে বড়শি হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে কাঁকড়া ধরতে হলে ছোট কাঁকড়া ধরা যায় না। একটি নির্দিষ্ট সাইজের চেয়ে ছোট কাঁকড়া ধরা একেবারেই নিষিদ্ধ। সেরকম কাঁকড়া জালে ধরা পড়লে তা আবার সাগরে ফেলে দিতে হয়।
মিতুলেরও ইচ্ছা হয়েছিল মাছ আর কাঁকড়া ধরবে। কিন্তু রেশমী আন্টি এবং জোহান কারো মাঝেই সে আগ্রহ দেখা গেল না। যার জন্য মিতুলের একটু মনোক্ষুণ্ণ হলো। ও আর ওর ইচ্ছার ব্যাপারে জানালো না তাদের কাছে। ওর ইচ্ছাটা ও চেপে গেল।
এই বিচের আশেপাশে অনেক সুন্দর সুন্দর পার্ক রয়েছে। সেই পার্কগুলোতে সবাই বনভোজন করে। ছুটির দিন না থাকায় আজ বেশি কেউ আসেনি বনভোজন করতে। কয়েকজনকে সাইক্লিং করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে আবার হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওয়াকিং ও সাইক্লিং এর জন্য আলাদা আলাদা ট্রেইল রয়েছে এখানে। যেখানে জেরিকো বিচ শেষ হয়েছে, সেখান থেকেও একটি ওয়াকিং ট্রেইল শুরু হয়েছে। ট্রেইলটি খুব লম্বা নয়। এখানে হেঁটে বেড়ানো খুবই মনোমুগ্ধকর। সাগরের পার দিয়ে হেঁটে যেতে কার না ভাল লাগে।
মিতুল এখন এই ছোট্ট ট্রেইল ধরে হাঁটছে। রেশমী আন্টি নেই সাথে। উনি পার্কে বসে বিশ্রাম করছেন। জোহান বদমাইশটা আছে পিছনে কোথাও। মিতুলের পিছন ফিরে দেখতে ইচ্ছে হলো না। ওর চোখ এখন সমুদ্র দেখায় ব্যস্ত। এখানে আসার পর শীত যেন অনেক কমে গেছে। ভেবেছিল বিচে আরও বেশি শীত লাগবে। কিন্তু হলো উল্টোটা। শীত কম লাগছে এখন। হয়তো রোদ বাড়ার সাথে সাথে শীতের মাত্রা একটু কমে গেছে। মিতুল গায়ের জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে হাঁটছে। জ্যাকেট পরাকালীন একটু গরম অনুভূত হয়েছিল সেজন্য।

মিতুলের চোখ যখন সাগর দেখার মুগ্ধ মোহনাতে ডুবে ছিল, ঠিক এমন সময়েই জোহান পিছন থেকে এসে নিজের হাতে খুলে রাখা হুডিটা মিতুলের মাথার উপর দিয়ে দিলো।
জোহানের হুডি চোখের উপর পড়ে ঢেকে দিলো মিতুলের মুগ্ধ দৃষ্টিকে। মিতুল দ্রুত হুডি সরিয়ে জোহানের দিকে কটমট করে তাকালো। জোহান ওকে অতিক্রম করে সামনে উঠে গেছে। সামনে হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের ইচ্ছা করলো জ্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় সাগরে। কিন্তু সেই ইচ্ছা দমে গেল জোহানের জ্যাকেট থেকে ভেসে আসা পারফিউমের মিষ্টি ঘ্রাণে। সুগন্ধিটা বেশ ভালো লাগলো মিতুলের। মিতুল জ্যাকেটটা দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে নাকের কাছে এনে কিছুটা মিষ্টি সুগন্ধির ঘ্রাণ নিলো। আর এই সময়েই ওর চোখ চলে গেল সামনে জোহানের দিকে।
দেখলো জোহান ওর দিকে তাকোনো।
মিতুল চকিতে জ্যাকেটটা নামিয়ে ফেললো। জোহান ওর জ্যাকেটের ঘ্রাণ শুঁকে দেখার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে কি না কে জানে! মিতুলের দিকে তাকিয়ে হাসতে দেখা গেল ওকে।
মিতুলের মনে হলো জোহান ওকে বিদ্রূপ করে হাসছে। হঠাৎ কেমন অপমানিত বোধ হলো মিতুলের। সেই সাথে মনটাও মিইয়ে গেল কেমন।
মিতুল এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চাইছে না। মনোযোগ দিলো প্রকৃতি দেখায়। এই ছোট্ট ট্রেইলের শেষে চোখে পড়লো ছোটখাটো একটি সৈকত। এই স্থানটিকে মিতুলের কাছে অনেকটা দ্বীপের মতো মনে হলো।
আরও সামনে হেঁটে যেতে চোখে পড়লো বিভিন্ন ডকইয়ার্ডে নোঙর করা অনেক প্রমোদতরী, এবং অপর ধারে অনেক আঙ্গুরগাছ।
জোহান আঙ্গুর গাছের দিকে গেল। মিতুলও ওর পিছন পিছন চলে এলো আঙ্গুর গাছের সমারোহে। এখান থেকে ফ্রিতে যত ইচ্ছা আঙ্গুর খাওয়া যায়। জোহান কতগুলো আঙ্গুর ছিঁড়ে নিলো গাছ থেকে। মিতুল ঘুরে ঘুরে দেখছে আঙ্গুর গাছগুলো।
জোহান আঙ্গুর খেতে খেতে সামনে এগিয়ে চললো। ওর সাথে সাথে হাঁটছে মিতুল। কালকে রাত থেকে ওর মনে জোহানের প্রতি যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা এই মুহূর্তে আর নেই। দুজনে মিলেমিশে আঙ্গুর ক্ষেতটা ঘুরে দেখছে এখন। জোহান নিজে তো আঙ্গুর খাচ্ছেই, মাঝে মাঝে আবার মিতুলকে হা করতে বলে একটা দুটো আঙ্গুর পুরে দিচ্ছে ওর মুখে।
আঙ্গুর গাছের ঝোপে মিতুলের দেখা হয়ে গেল কিছু বুনো খরগোশদের সাথেও। তারাও এই আঙ্গুরগুলোতে ভাগ বসাতে এসেছে।
মিতুলের একটু বেশি সময় ধরেই এখানে থাকার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু জোহান থাকতে দিলো না। জোহান ওকে নিয়ে চলে এলো ওখান থেকে।

এই বিচের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাও অনেক সুন্দর। মিতুল আর জোহান এখানে খানিকটা ঘোরাঘুরি করলো। এখান থেকে আবার পার্কে ফেরার সময় জোহান হঠাৎ বললো,
“হেই মিতুল, আমার সাথে ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ ঘুরতে যাবে?”

মিতুল জোহানের পাশে পাশে হাঁটছে। মাথায় জোহানের জ্যাকেটটা দিয়ে রেখেছে। রোদের মাত্রা একটু বৃদ্ধি পেয়েছে যেন এখানে। যদিও অত বেশি তাপ নেই সেই রোদের, তবুও ভালো লাগছে বলে জোহানের জ্যাকেটটা দিয়ে রেখেছে মাথায়। মিতুল বললো,
“ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ?”

“হুম।”

“এটা কোথায় অবস্থিত?”

“ক্যাপিলানো পার্কে।”

“যাওয়া যায় ওখানে। কিন্তু রেশমী আন্টি?”

“মম থাকুক এখানে। মম ওই পার্ক অতটা পছন্দ করে না। তুমি যাবে?”

মিতুল একটু ভেবে বললো,
“হুম, যাব।”

রেশমী আন্টিকে না জানিয়েই মিতুল জোহানের সাথে বেরিয়ে পড়লো ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ দেখতে যাওয়ার জন্য।
মিতুলের মনে হলো ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজের কথা ও আগেও শুনেছে। কিন্তু ঠিক মনে পড়ছে না কোথায় শুনেছে এই ব্রিজের নামটা। এখন একেবারেই মনে পড়ছে না। কোথায় শুনেছে নামটা?

জোহান মিতুলের হাত থেকে নিজের জ্যাকেট নিয়ে গায়ে পরেছে। এখান থেকে কিছুদূর হেঁটেই একটা ট্যাক্সি নেবে। আর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ক্যাপিলানো পার্ক।
মিতুল গভীর ভাবে ভাবছিল ব্রিজটি নিয়ে। মনে করার চেষ্টা করছিল কোথায় শুনেছে। যখন মনে পড়ে গেল, তখন চক্ষু দাঁড়িয়ে গেল ওর। পা আপনা থেকেই থেমে গেল। মিতুল পিছন থেকে বলে উঠলো,
“যাব না আমি।”

জোহান দাঁড়িয়ে পড়লো। ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরলো।
“কী? একটু আগেই তো বললে যাবে। যাবে বলে এখন যাবে না কেন? অবশ্যই যেতে হবে তোমার।”

“অসম্ভব। আমার জান থাকতে আমি কিছুতেই পা মাড়াবো না ওদিকে। তুমি এত খারাপ জোহান! এই ছিল তোমার মনে মনে? ক্যাপিলানো সাসপেনশন ব্রিজ ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার মানে এবার বুঝতে পারলাম আমি। তুমি আমায় মার্ডার করতে চাইছো, তাই না?”

জোহানের কুঁচকানো ভ্রু এবার আরও বেশি কুঁচকে গেল।
“কী? কী বললে তুমি? আমি তোমাকে মার্ডার করতে চাইছি?”

“হ্যাঁ, তুমি আমাকে মার্ডার করতে চাইছো! তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু জানি না? সব জানি আমি। তুমি কীভাবে ওই ভয়ংকর ব্রিজে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে পারো? সেখানে নিয়ে যাওয়ার কারণ কী হতে পারে আমাকে মার্ডার করা ছাড়া?”

“কীসব বকছো পাগলের মতো?”

“পাগল, পাগল করবে না একদম। কে পাগল? আমি? আমি যদি পাগল হই, তবে তুমি তো একটা ঠান্ডা মাথার খুনি। হ্যাঁ, তুমি একটা ঠান্ডা মাথার খুনি। তোমার কি ধারণা আমি কিছু জানি না ওই ব্রিজ সম্পর্কে? সব জানি আমি। আমার ভাইয়েরা আমায় সব বলেছে। ওই ব্রিজটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর ঝুলন্ত ব্রিজগুলোর মধ্যে একটি। ওই সেতুটি ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক হওয়ার কারণ হলো, এই সেতুটির পথ অনেক সংকীর্ণ এবং মানুষ হাঁটার সময় এটি কাঁপতে থাকে। ব্রিজে উঠে অনেক নিচের দূরত্বে ক্যাপিলানো রিভারের দিকে তাকালে, কিছুক্ষণের জন্য সবার হৃদয়েই ভয়ে কাঁপন ধরবে, এমনটা শোনা যায়। যাদের হাই ফোবিয়া আছে তাদের না ওঠাই ভালো ওই ব্রিজে, সে কথাও শোনা যায়। প্রাণ হাতে নিয়ে ওই ব্রিজ পাড়ি দিতে হয়, এমনটাও শোনা যায়। আমার ভাইয়েরা তো কানাডা আসার আগেই সাবধান করেছে আমায়, যাতে ওই ব্রিজে না যাই সেজন্য। এখন তুমিই বলো, তুমি যে আমাকে ওই ব্রিজে নিয়ে যেতে চাইছো, তুমি একটা ঠান্ডা মাথার খুনি ছাড়া আর কী হতে পারো?”

জোহান মিতুলের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে ওর সব কথা শুনছিল। মিতুলের কথা শেষ হলেই ফিক করে হেসে ফেললো জোহান। জোহানের এ হাসি যেই সেই হাসি নয়, অশান্ত হাসি ওর।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের রাগ আর ধরে না। মিতুল তেজি স্বরে বললো,
“হাসবে না বলছি। হাসবে না একদম। তুমি আসলে জেনে বুঝেই করেছো এসব। তুমি জানো যে, রাঙামাটির ওই ঝুলন্ত ব্রিজে উঠেই আমার বমি পর্যন্ত হয়ে যায়। আর এই ক্যাপিলানো সাসপেনশন ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে ভয়ে আমার হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, এসব তো তুমি আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছো। মনে মনে এ সব প্ল্যানই করা তোমার। মারতে চাও আমাকে, তাই না? যাতে আমি মরে যাই সেজন্যই ওখানে নিয়ে যেতে চাইছো আমাকে, তাই না?”

জোহান কোনো রকমে নিজের হাসি সামলিয়ে বললো,
“রেংঙামাটি? তুমি রেংঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজে গিয়ে কী করো, সে কথা আমি জানবো কীভাবে? আমি তো তোমার সাথে যাইনি সেখানে। আমি তো আমার কাজিনস, আঙ্কল, ব্রাদার, গ্রান্ডপ্যারেন্টস তাদের সাথে গিয়েছিলাম রেংঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজে।
আর রেংঙামাটি ব্রিজে উঠে তুমি বমি করে দিয়েছিলে? হেই মিতুল, তুমি এত ভীতু? বাহ! বাহ! এখন তো দেখছি বাংলাদেশি মেয়েদের সাহসিকতারও বড্ড অভাব। ওদের তো কোনো যোগ্যতাই নেই। ওহ না না, একটা যোগ্যতা আছে ওদের। ওরা হাত হলে পা বানিয়ে ফেলতে পারে নিমেষে। তার সাথে আবার আরও একটা যোগ্যতা এড হয়েছে, সেটা হলো ওরা প্রচুর ঝগড়াটে।”

জোহান যে সব ওকে মিন করে বলছে সেটা বুঝতে মিতুলের সময় লাগলো না। মিতুল কড়া গলায় বলে উঠলো,
“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ! কাকে ঝগড়াটে বলছো তুমি? ভেবেছো কি কিছু বুঝি না? কোন এঙ্গেল থেকে আমাকে ঝগড়াটে মনে হয়? ঝগড়াটে কি আমি? ঝগড়াটে হলে তুমি। নাম্বার ওয়ান বিশ্ব ঝগড়াটে তুমি।
আর কথায় কথায় বাংলাদেশ টানো কোন সাহসে? একদিন না নিষেধ করে দিয়েছি কথায় কথায় বাংলাদেশ টানবে না একদম। বার বার বাংলাদেশ টেনে ইনিয়ে বিনিয়ে কথাগুলো কাকে বলো, সেটা কি আমি জানি না? বুঝি না কিছু? আমি কি ফিডার খাই? আমাকে কি তোমার শিশু মনে হয়?”

“ও আচ্ছা, তুমি শিশু নও? তা কত বয়স তোমার?”

মিতুল গর্বের সাথে বললো,
“একুশ। একুশ প্লাস আমি।”

জোহান একটু টেনে বললো,
“ওহ… একুশ? একুশ হওয়ার সাথে সাথেই দৌঁড়ে কানাডা চলে এসেছো?”

“কী? কী বললে তুমি? কী বোঝাতে চাইলে এই কথা দ্বারা? মানে তুমি কি অপমান ছাড়া কথা বলতে জানো না? কানাডা পা রাখার পর থেকেই দেখছি তুমি প্রত্যেক কথায় অপমান করো আমাকে। কথায় কথায় বাংলাদেশ টেনেও ইনিয়ে বিনিয়ে খোঁচা দিয়ে দিয়ে কথা বলো আমাকে। কেন? তুমি কি আদব কায়দা শেখোনি? মানুষের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় কেউ শেখায়নি তোমাকে?”
রাগ ঝরে পড়ছে মিতুলের প্রত্যেকটি কথায়।

“শোনো, তোমার সাথে ঝগড়া করার মুড নেই আমার।”

“হ্যাঁ? কী? ঝগড়া করার মুড নেই? মাগো মা! কার মুখে কী শুনছি আমি? একটা বিশ্ব ঝগড়াটে বলছে তার না কি ঝগড়া করার মুড নেই! কোথায় যাব আমি?” মিতুল মুখ চেপে শ্লেষ পূর্ণ হেসে উঠলো।

জোহানকে তেমন প্রতিক্রিয়া করতে দেখা গেল না। ওকে দেখালো খুব শান্ত। শান্ত দৃষ্টি রেখেই এক ধাপ এগিয়ে এলো মিতুলের দিকে। মিতুলের হাসি থেমে গেল। চোখ পড়লো জোহানের ওই বাদামি চোখ পানে।

জোহান মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, আমি ঝগড়াটে। তুমিই বানিয়েছো। এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এখন। এটা বোধহয় এই জীবনে আর আমার পিছু ছাড়বে না। সারাজীবন আমার ঝগড়া করেই যেতে হবে। আর আমার ঝগড়ায় সঙ্গ দেওয়ার জন্য তোমাকে থাকতে হবে সবসময় আমার সাথে। থাকবে তুমি?”

মিতুল অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
“কী?”

জোহান কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইল।
মিতুল নিজেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করলো। বললো,
“দেখো, যাই করো না কেন আমি যাব না তোমার সাথে ওই ব্রিজ দেখতে। তোমার মরার শখ হলে তুমি একাই চলে যাও ওই ব্রিজে।”

বলে মিতুল রেশমী আন্টির কাছে ফেরত যাওয়ার জন্য আবার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। দ্রুত পা ফেলতে লাগলো। ক্ষণিকের জন্যও নিজের গতি থামালো না। যেমন ওর হাঁটার গতি দ্রুত, তেমনি দ্রুত ওর হৃদয়ের গতি। পায়ের গতির থেকেও ওর হৃদয়ের গতি বেশি দ্রুত। ওর হৃদয়ের এমন অস্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে ও জানে না। মাঝে মাঝে জোহান অস্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করেছে, আর সেই সাথে ওর হৃদয়টাও। এই রকম চলতে দেবে না ও। নিজের অস্বাভাবিক হৃদয়কে স্বাভাবিক বানিয়ে ফেলবে আবার। আগে এডমন্টন ফিরে নিক। কার্লকে দেখার পরই সব ঠিক হয়ে যাবে। কার্লকে অনেক দিন না দেখার ফলে বোধহয় এমন হচ্ছে। কালকেই কার্লকে দেখতে যাবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here