চেরি ব্লসমের সাথে এক সন্ধ্যা পর্ব: ৫৭

0
1150

#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৭
____________

ঘুমের রেশ কেটে যেতেই মিতুল বুঝতে পারলো, ওর ধারণা ভুল। নাকে ভেসে আসছে চেনা মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ। আতঙ্কিত দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো তাই। কেটে গেল আতঙ্ক। ভুল ভেবেছিল! এটা জায়িন নয়, জোহান! দুশ্চিন্তা, আর হঠাৎ ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার কারণে জোহানকে জায়িন ভেবে ভুল করেছিল। রুমে ড্রিম লাইট জ্বালানো, ঘুটঘুটে অন্ধকার পরিত্রাণ করে ঝাপসা অন্ধকার ছড়ানো। ঝাপসা অন্ধকারেও ওর চিনতে অসুবিধা হলো না, ওখানে ঠিক জোহানই দাঁড়িয়ে আছে। মিতুলের মুখ থেকে মায়া জড়ানো কণ্ঠে বেরিয়ে এলো,
“জোহান!”

মিতুল দ্রুত বেড থেকে নেমে সাইড টেবিলের ল্যাম্পশেড জ্বালালো। ল্যাম্পশেডের হলুদাভাব আলোয় জোহানের মুখটি দেখতে পাওয়া গেল এবার।

“কোথায় ছিলে তুমি? কত টেনশনে ছিলাম জানো? ফোন দিলাম, ম্যাসেজ পাঠালাম অথচ কোনো রেসপন্স করলে না। কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

জোহান কোনো উত্তর দিলো না।

“বাড়িতে ঢুকলে কীভাবে? বাড়ির গেট তো এখন বন্ধ থাকার কথা।”

জোহান এবার বললো,
“রিল্যাক্স! চোরের মতো উপর থেকে গেট টপকে বাড়িতে প্রবেশ করিনি। তোমার বিগ ব্রো’র কাছে কল দিয়ে গেট খোলার ব্যবস্থা করিয়েছি। তারপর এসেছি। তোমার রুমে যে এলাম, এটাও তোমার ব্রো’র পারমিশন নিয়ে।”

“সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু এতক্ষণ বাইরে কোথায় ছিলে? কল রিসিভ করছিলে না কেন?”
মিতুলের গলায় উৎকণ্ঠা।

“তোমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছি, তারপর দাদা বাড়ি গিয়েছিলাম।”

“দাদা বাড়ি?”

“হুম। কিছুক্ষণ সেখানে কাটিয়ে আবার চলে এলাম। তবে সেখান থেকে একটা জিনিস নিয়ে এসেছি তোমার জন্য। দাদা বাড়িতে মূলত এটা আনতেই গিয়েছিলাম।”

“কী জিনিস?”

জোহান মুঠোবন্ধি হাতটা মিতুলের সামনে খুলে বললো,
“এটা।”

জোহানের হাতের দিকে তাকিয়ে মিতুলের ভ্রু কুঁচকে গেল,
“এগুলো কী?”

“জানতাম তোমার চিনতে একটু অসুবিধা হবে। এগুলো হলো, চেরি ব্লসম!”

চেরি ব্লসম শুনে মিতুলের দৃষ্টি জোহানের হাত থেকে মুখে চলে গেল। তবে বেশি সময়ের জন্য সেখানে দৃষ্টি স্থির রাখলো না। আবারও চোখ ফিরে এলো জোহানের হাতের উপর। জোহানের হাতে চেরির পাপড়ি দেখে মিতুল আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল।
জোহানের হাত থেকে পাপড়িগুলো নিজের হাতে নিয়ে এলো। পাপড়িগুলো শুকিয়ে একেবারে চুপসে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো ঠিক কী। জোহান কানাডা থেকে ওর জন্য চেরি ব্লসম নিয়ে এসেছে? আনন্দ এবং ভালোবাসা দুই মিলে চোখে পানি এসে গেল মিতুলের।

মিতুলের চোখে পানি দেখে জোহানের হলো অন্য আশঙ্কা। সে ব্যস্ত ভাবে মিতুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“এই না না মিতুল, আমি তোমাকে অপমান করার চেষ্টা করছি না। আসলে আমি এগুলো তরতাজা তোমার হাতে তুলে দিতে চাইছিলাম, কিন্তু কানাডা থেকে আসতে আসতে এগুলো শুকিয়ে গেছে! আমি কী করবো?
এটা আমার তোমাকে দিতে চাওয়া সেকেন্ড সারপ্রাইজ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ফিরে যখন দেখলাম পাপড়িগুলো শুকিয়ে গেছে, তখন সারপ্রাইজটা ক্যানসেল করে ছিলাম।
আমি এই শুকনো চেরি পাপড়ি দিতে চাইনি তোমাকে। তবুও হুট করে আজকে মনে হলো এগুলো তোমাকে দিই, তাই…”
জোহান সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না। কথার মাঝেই মিতুল জড়িয়ে ধরলো ওকে। আকস্মিক এমন ঘটনায় জোহানের কণ্ঠ নিজ থেকেই থেমে গেল। থমকে গেল জোহান।

মিতুল যেই ক্ষণের অপেক্ষায় ছিল, সেই ক্ষণ এখনও আসেনি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কিছুতেই ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। মিতুল জোহানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বললো,
“সময়টা এত কঠিন যাচ্ছে কেন জোহান? কী ভুল আমাদের?”

_________________

রেশমী খবর পেলেন জোহান কাল গভীর রাতে ফিরে এসেছে। খবরটা পেয়েছে মিলানের কাছ থেকে। এত রাত অবধি কোথায় ছিল জোহান?
রেশমী জোহানের রুমে ছুটে আসেন। দরজা আনলক ছিল। ঢুকে পড়লেন তিনি। জোহান ঘুমে বিভোর। তিনি ডাকলেন,
“জোহান!”

জোহান জাগলো না।
রেশমী একটু জোরেই ডেকে উঠলো এবার,
“জোহান!”

জোহানের বন্ধ চোখের পাপড়ি কম্পিত হয়ে খুলে গেল। চোখে ঝাপসা করে মমের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। জোহান উঠে বসলো। দুই হাতে আলতো করে চোখ ডলে ঘুম নিবারণের চেষ্টা করলো।

“রাতে কোথায় ছিলে? ফোন দিলাম ফোন ধরলে না কেন তুমি? তোমার দাদা বাড়ি ফোন দিয়ে জানলাম তুমি সেখানে যাওনি। তোমার মামার কাছে কল দিলাম, সেও জানালো তুমি তাদের ওখানে যাওনি! তাহলে কোথায় ছিলে?”
অশান্ত ভাবে জানতে চাইলো রেশমী।

জোহান ধীর কণ্ঠে বললো,
“দাদা বাড়িতে ছিলাম। তুমি যখন ফোন করেছিলে, তার কিছুক্ষণ পর গিয়েছিলাম ওখানে।”

“তো, তুমি ফোন করে জানাবে না সেটা? এমনিতেই বাংলা জানো না, বাংলাদেশ এসে একা একা চলতে পারো না, কোন সাহসে তুমি ওরকম ভাবে বেরিয়ে গেলে বাইরে? ফারদার এমন কাজ কখনো করবে না। বাংলাদেশ থাকাকালীন কোথাও গেলে অবশ্যই আমাকে জানিয়ে যাবে। বুঝেছো?”

জোহান মায়ের কথায় সম্মতি দিয়ে বললো,
“ইয়াহ।”

রেশমী জোহানের সাথে এখন অন্য কোনো ব্যাপারে কথা বলতে চাইছেন না। এমনিতেই গভীর রাতে ফিরে এসেছে জোহান। এখন ওই ব্যাপারে কথা বলাটা ঠিক হবে না। রেশমী বললেন,
“ঠিক আছে ফ্রেশ হও। আমি যাচ্ছি।”

রেশমী রুমে ফিরে একবার স্বামীর কাছে কল দিলেন। সাদাতকে এখনও জানানো হয়নি বিষয়টি। কালকে রাতে যে কল দিয়ে জানাবে সেই মেজাজে ছিল না সে। এখন বাংলাদেশে সকাল সাতটা। কানাডাতে এর বিপরীত। কানাডাতে এখন বিকেল।
সাদাত কল রিসিভ করতেই রেশমী অন্য কোনো কথা না বলে, সোজা বললেন,
“তোমার ছেলে খুব বাড় বেড়ে গেছে সাদাত। ইতোমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে ও। এখানে এসে কী কী করেছে তা তোমার ধারণার বাইরে। আমি তো এটা কল্পনাও করতে পারিনি। এমন কিছু হতে পারে আশা করতে পারিনি আমি।”

সাদাত বুঝতে পারলেন রেশমী জোহানকে নিয়ে বলছে। তিনি একটু চিন্তিত বোধ করলেন।
“কী করেছে জোহান?”

রেশমী সব খুলে বললেন সাদাতকে।
সব শুনে সাদাত বললেন,
“জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়েটা ওদের না জানিয়ে ঠিক করা হয়েছে। যেহেতু ওরা জানতো না, সুতরাং এই না জানার কারণে মধ্য থেকে জোহান এবং মিতুলের মাঝে রিলেশন তৈরি হওয়ার ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা ভুল কোনো বিষয় নয়।”

স্বামীর কথা শুনে রেশমীর মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি এই কথা আশা করেননি স্বামীর থেকে। তবুও তিনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললেন,
“এটা ভুল কোনো বিষয় নয়? ঠিক আছে, ধরলাম জোহান, মিতুলের মাঝের রিলেশন তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা যে সবকিছু অস্বাভাবিক করে তুলছে, সেটার কী করবে? কীভাবে সামাল দেবে এটা?”

“যেখানে তোমার ছোট ছেলের সাথে রিলেশন ছিল, সেই মেয়েকে তো তুমি নিজের বড়ো ছেলের সাথে বিয়ে দিতে পারো না। এটা বেমানান! যেখানে জোহান, মিতুল দুজনই অমত পোষণ করেছে এই বিয়েতে, সেখানে তুমি যদি এখনও এই বিয়ে নিয়ে ভাবো, তাহলে সেটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে আমি বুঝতে পারছি না। আর ধরলাম জোহান, মিতুলের কথাকে প্রধান্য না দিয়ে আমরা বিয়েটা জায়িনের সাথেই দিয়ে দিলাম। এরপর কী হবে ভেবে দেখেছো? জায়িন এবং জোহানের মাঝে সম্পর্কটা কেমন হয়ে যাবে?
মিতুলের আর জায়িনের মাঝের সম্পর্কটাও বা কেমন হবে? দুজনের স্বাভাবিক সংসার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে?
এক জায়গা, একই বাড়ি, এক সাথে থাকা, সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। আমি তো মনে করি এতকিছুর পর জায়িন এবং মিতুলের বিয়ে নিয়ে ভাবাটা ভুল ছাড়া আর কিছুই নয়।”

রেশমী নিজের রাগ প্রকাশ করেই ফেললেন,
“ও এটা ভুল? আর বড়ো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া, সেটা খুব সঠিক, তাই না?”

“হ্যাঁ, এটা সঠিক। জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ের ব্যাপারটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। জোহান আর মিতুলের ব্যাপারটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। এরকম অনেক আছে। বিয়ের কথা হয়েও, বিয়ে হয় না। অনেক সময় তো এমনও হয় যে এনগেজমেন্টের পরও বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যায়। আর এখানে তো জায়িন এবং মিতুলের এনগেজও হয়নি। তাহলে এই বিয়েটা ভাঙতে কী সমস্যা? জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে হওয়াটা কি তুমি সঠিক ভাবছো?”

“হ্যাঁ, ভাবছি। যদি জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়ে না হয়, তাহলে মান সম্মান কিছু থাকবে না। যেখানে বড়ো ছেলের সাথে বিয়ের কথা হয়েছে, সেখানে ছোট ছেলের বিয়ে দেওয়াটা আমার পক্ষে অসম্ভব!”

“অবুঝের মতো কথা বলছো কেন রেশমী?জোহান, মিতুল একে অপরকে ভালোবাসে, এখানে ওদের বিয়ে দেওয়াটাই তো শ্রেয়। এখানে অসম্ভবের কী আছে? আর মান সম্মানের কথাই বা উঠছে কেন এখানে? এটা তো আমরা আমরাই। মিতুলকে তো তুমি পুত্রবধূ করে আনছোই। হয়তো কথা ছিল বড়ো ছেলের বউ করে আনবে, কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্য দেখে ছোট ছেলের বউ করে আনতে হবে। এটাই তো? এতে মান সম্মান না থাকার তো কিছু দেখছি না আমি।”

রেশমীর মেজাজ এবার চরম খারাপ হলো,
“আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি এমন কিছু বলবে। বরাবরই তুমি এমন। তবুও আশা করেছিলাম এবারের কথাগুলো তোমার ভিন্ন হবে। কিন্তু হলো না। তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। তোমার চোখে হয়তো মান সম্মান না থাকার মতো কিছু ধরা পড়ছে না, কিন্তু আমার চোখে পড়ছে। যেখানে বড়ো ছেলের বিয়ের সম্বন্ধ করেছি, সেখানে ছোট ছেলের বিয়ে দেওয়াটাই মান সম্মান না থাকার কারণ। এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। আমি মিতুলকে পছন্দ করে রেখেছি জায়িনের জন্য। জোহানের সাথে বিয়ে দেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া তোমার ওই উগ্র ছেলের সাথে কে মেয়ে বিয়ে দেবে? শাসন তো করো না ছেলেকে। মাহিরার সাথে কাল কথা হয়েছে আমার। মাহিরা জানিয়ে দিয়েছে, যদি জায়িনের সাথে আমরা মিতুলের বিয়ে দিতে চাই, তাহলে ওর আপত্তি নেই। কিন্তু জায়িনের সাথে যদি বিয়ে না হয়, তাহলে জোহানের কথাও ভাববে না তারা। অন্য জায়গায় মেয়ে বিয়ে দেবে। মাহিরা একেবারে সরাসরি কথাগুলো বলেছে আমাকে। এমন একটা ঘটনার পর যদি জায়িনের সাথে মিতুলের বিয়েটা না হয় তাহলে কী হবে বুঝছো? আমাদের সাথে মাহিরাদের সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যাবে। যেটা আমি একেবারেই চাই না। মাহিরা আমার খুব আপন একজন মানুষ। সেই ছোট থেকে এখন পর্যন্ত ওর সাথে আমার সম্পর্কটা জোরালোই আছে। অনেক ক্লোজ আমরা। এমন একটা বিষয়ের জন্য আমি ওর সাথে সম্পর্ক ঠুনকো করতে পারব না। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক আরও জোরালো করতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন বিয়ে না হলে সম্পর্ক জোরালোর বদলে একেবারেই ঠুনকো হয়ে যাবে।”

ফোনের অপ্রান্তে সাদাতও খুব রেগে আছেন। তিনি রুড ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন,
“তাহলে কী করতে চাও তুমি?”

“আমি মিতুলকে জায়িনের বউ করেই ঘরে তুলতে চাই।”

“এটা পাগলামি রেশমী!” সাদাতের গলা কঠিন।

“কোনো পাগলামি নয়। এটাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। ওদের বিয়ে হয়ে গেলে, মিতুল এবং জোহানের মাঝে প্রেম, ভালোবাসা বলে কিছু থাকবে না। ওসব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এমনও অনেক ঘটনা আছে। বিয়ের আগে প্রেম থাকে একজনের সাথে, এবং বিয়ে হয় অন্য কারো সাথে। এটা স্বাভাবিক। তেমন কোনো ব্যপার নয় এটা।”

“কিন্তু মিতুলের যার সাথে প্রেম সে তোমারই ছোট ছেলে রেশমী। বিয়ের পর মিতুল সেখানে গিয়েই থাকবে, যেখানে জোহান থাকে।”

“ওটা কোনো ব্যাপার নয়। দরকার হলে আমি জোহানেরও দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেবো। বউ রেখে নিশ্চয়ই মিতুলের জন্য ভালোবাসা পুষে রাখবে না।”

“তুমি এত কিছু ভাবতে পারছো অথচ, জোহানের সাথে মিতুলের বিয়ে, এই সহজ বিষয়টা ভাবতে পারছো না? তুমি আগে নাহিদ ভাইদের কাছে বলে দেখো জোহান আর মিতুলের বিয়ের কথা। তারপর…”
সাদাতের বলার মাঝেই রেশমী কল কেটে দিলেন। স্বামীর এই অহেতুক কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার।

জোহান মমের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেবেছিল মম হয়তো একটু নরম হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখে বুঝতে পেরেছে আসলে কোনটা ঠিক। কিন্তু না, ওর ধারণা ভুল! মম আগের চিন্তাতেই আছে। ব্রাদার এবং মিতুলের বিয়ে নিয়ে! যদিও জোহান মমের সব কথা বুঝতে পারেনি। মমের কথা বাংলা, ইংলিশ মিলিয়ে ছিল। ইংলিশ টুকুই বুঝেছে শুধু। আর তাতেই বুঝতে পেরে গেছে। জোহান চোখ বন্ধ করে কষ্ট হজম করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো। তারপর ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো।

“কী সিদ্ধান্ত নিলে?” মমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো জোহান।

__________________

দীর্ঘ একটা রাত ধরে ভেবে চিন্তে মা-আব্বু সুন্দর একটা সমাধান বের করবে সেটাই ভেবেছিল মিতুল। আর সেই সুন্দর সমাধানটা হবে, ওর এবং জোহানের বিয়ে। এটাই ভেবেছিল ও। কিন্তু ওর ভাবনায় গুড়ে বালি। সকাল হতেও সেই আগের গানই চলছে। জায়িনের সাথেই বিয়ে হবে ওর। নয়তো জায়িন, জোহান কারো সাথেই নয়। তবে জায়িনের সাথে বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এই বিয়েটা না হলে না কি দুই ফ্যামিলির মাঝে সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে যাবে। যেটা এক ফ্যামিলিও চায় না। মিতুল বুঝতে পারলো ওর মা-আব্বুকে বুঝিয়ে পারবে না ও। অন্য কোনো পথ ধরতে হবে ওর। আর এই অন্য পথটা হবে জায়িন। জায়িনকে ও এখন পর্যন্ত কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখেনি। জায়িনের সাথে ওর বিয়ে নিয়ে এত কিছু চলছে, অথচ জায়িনকে একটা বাক্যও বলতে দেখেনি। যেন একটা রোবট। কোনো কিছুই গায় লাগে না তার। অহংকারী একটা! এই অহংকারীটাকে বিয়ে করা তো ইম্পসিবল। মিতুল মনে মনে ঠিক করলো জায়িনকে বোঝাবে ও। জায়িন যদি বিয়েতে না করে দেয় তাহলে তো এই বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। জায়িন অহংকারী হলেও বুঝদার। বুঝবে নিশ্চয়ই। চোখের সামনে এতকিছু দেখেছে, বোঝাই তো উচিত।

মিতুল আর সময় নষ্ট না করে জায়িনের নিকটে এলো। রুমের দরজা অর্ধ ভেজানো। মিতুল নক করে বললো,
“আসবো?”

জায়িন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, মিতুলের কণ্ঠ শুনে একবার চোখ তুলে তাকালো। কেমন ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
“এসো।”

মিতুল রুমে ঢুকলো। জায়িন নিজের ল্যাপটপ রাখলো না। একটা মানুষ এসেছে তার কাছে, তার তো উচিত ল্যাপটপ রেখে এই মানুষটির উপর মনোনিবেশ করা। কিন্তু না, সে ল্যাপটপ নিয়েই বসে আছে। রাগী মাথায় আরও একটু রাগ ভর করলো। তবে প্রকাশ করলো না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”

জায়িন ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
“হুম, বলো।”

“আমি যা বলবো তার জন্য এরকম পরিবেশ মানানসই নয়। তুমি আমার সাথে বাইরে কোথাও যেতে পারবে?”

জায়িন আগের মতো ল্যাপটপে চোখ রেখেই উত্তর দিলো,
“দুঃখিত! আমার কিছু কাজ আছে। তোমার সাথে যেতে পারছি না।”

জায়িনের কথা শুনে মিতুলের রাগ চড়াও হলো। ওর ইচ্ছা করলো একটা ঘুষি মারে জায়িনকে। এই ইচ্ছা যে ওর ইহজনমে পূর্ণ হবে না সেটা খুব করেই জানে। তারপরও এমন ইচ্ছা হলো ওর। মানুষের ইচ্ছা কি আর বাধ মানে?
মিতুল রাগ দমিয়ে রেখে যথা সম্ভব মৃদু, নরম কণ্ঠে বললো,
“বেশি সময় নেবো না আমি। এখান থেকে যেতে আসতে আট মিনিটের মতো। আর যা বলবো তা মিলিয়ে মাত্র বিশ মিনিটের মতো লাগবে। এই বিশ মিনিট সময়টা দিতে কি খুব বেশি অসুবিধা হবে তোমার?”

জায়িন নিজের ল্যাপটপ বন্ধ করে, মিতুলের দিকে তাকালো। বললো,
“কোথায় নিয়ে যাবে?”

“কাছেই একটা কফিশপে যেতাম।”

“আমার মনে হয়, কফিশপ নয়। কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে যাওয়া উচিত আমাদের। কালকে রাতে কিছু খাওনি, আজকে সকালেও ব্রেকফাস্ট করতে দেখা গেল না তোমাকে, কিছু খাওয়া উচিত তোমার।”

মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল জায়িনের কথা শুনে। ভিতরে রাগ থাকলেও মুখে জোরপূর্বক একটু হাসি ফোঁটাতে হলো ভদ্রতা স্বরূপ। বললো,
“ঠিক আছে, কোনো রেস্টুরেন্টেই যাব আমরা। এখন রেডি হলেই ভালো হয়। দ্রুত বেরিয়ে পড়তাম তাহলে। দশটা বাজে, আর দেরি করা ঠিক হবে না।”

জায়িন সায় দিলো,
“ওকে। এখনই রেডি হচ্ছি।”

মিতুল মুখে আরেকটু বাধ্য হাসি ফুঁটিয়ে চলে গেল।

জায়িনের কথা মতো একটা রেস্টুরেন্টে এলো ওরা। ও খাবে না কিছু, তারপরও অনেক কিছু অর্ডার করলো। অতিথি নিয়ে এসেছে কিছু অর্ডার না করে তো পারা যায় না। আর রেস্টুরেন্টে এসে কিছু অর্ডার না করে বসে থাকা কি মুখের কথা?
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে গেলে জায়িন বললো,
“হ্যাঁ, এবার বলো। কী বলতে চাও?”

মিতুলের জায়িনকে কথাটা বলতে কেমন যেন লাগছে, তারপরও বললো,
“দেখো তুমি শিক্ষিত একটা ছেলে! তোমার ফ্যামিলির বাকিরাও শিক্ষিত। আমাদের ফ্যামিলির মানুষ জনও শিক্ষিত, তবে তারা শিক্ষিত হয়েও ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে না। আমার বিশ্বাস তারা না বুঝলেও, তুমি বুঝবে ব্যাপারটা।”
মিতুল এইটুকু বলে একটু থামলো। জায়িনের ভাব ভঙ্গি দেখে নিলো একবার। একবারে স্বাভাবিক জায়িন। মিতুল আবার বলতে শুরু করলো,
“আমাদের ফ্যামিলির মানুষজন চাইছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক। যেটা আমি মোটেই চাইছি না। আমি চাই না তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক। কারণ, আমি তোমার ভাইকে ভালোবাসি। আমি ওকে খুব বেশিই ভালোবাসি!”

জায়িন নীরবে শুনে যেতে লাগলো মিতুলের কথা। এর মাঝে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেছে।

মিতুল বলে চলেছে,
“জোহান এবং আমি রিলেশনে আছি এটা জোহান সবার সামনেই বলে দিয়েছে। তুমিও শুনেছো এটা। সবাই শোনার পরও এটাকে গুরুত্ব সহিত দেখছে না, দেখলেও মানছে না। তারা তোমার সাথেই আমার বিয়ের কথাবার্তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। আমি চাই তুমি এই ব্যাপারটা তাদের একটু বুঝিয়ে বলো। শুধু রেশমী আন্টিকে বুঝিয়ে বললেই হয়। তাকে বুঝিয়ে বললেই, সে আবার আমার মা-আব্বুকেও বুঝিয়ে বলতো।
তুমি রেশমী আন্টির খুব আদরের। তুমি বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই সে শুনবে। তুমি শুধু রেশমী আন্টিকে এটাই বুঝিয়ে বলবে যে, আমি জোহানকে ভালোবাসি। আর তাই তোমাকে বিয়ে করা অসম্ভব আমার পক্ষে। আমিও জোহানকে ভালোবাসি, জোহানও আমাকে ভালোবাসে। সুতরাং তোমার সাথে নয়, আমার বিয়েটা ঠিক জোহানের সাথে হওয়া উচিত…”

মিতুল আরও কিছু বলতে চাইছিল। এর মাঝে জায়িন বলে উঠলো,
“তার মানে এই বিয়েটা ভাঙতে হবে আমার?”

“ঠিক ভাঙা নয়, তুমি শুধু রেশমী আন্টিকে বুঝিয়ে বলবে এটা। তাহলেই…”

মিতুলের কথা শেষ হওয়ার আগেই জায়িন দাঁড়িয়ে গেল,
“স্যরি মিতুল, আমি এটা পারবো না। মমের অবাধ্য হতে কিছুতেই পারব না আমি। তুমি যদি এই বিয়েটা ভাঙতে চাও, তবে নিজেই বুঝে নাও সেটা। আমার পক্ষে মমের অবাধ্য হওয়া সম্ভব নয়।”

বলে জায়িন যাওয়ার জন্য এক পা বাড়ালো, মিতুল বলে উঠলো,
“আমার পক্ষেও সম্ভব নয় তোমাকে বিয়ে করা। একেবারেই সম্ভব নয় এটা।
আমি কারো কারো কাছে খানিক বোকা হতে পারি, আবার কারো কারো কাছে পুরোটাই বোকা! কিন্তু শুনে রাখো, আমি বেইমান নই। সবার কাছ থেকে বোকা উপাধি পেলেও, বেইমান হিসেবে একটা মানুষের কাছেও পরিচিত হবো না। আমি বেইমান, স্বার্থপর নই। ভালোবাসতে জানি আমি। খুব করে ভালোবাসতে জানি। আমি জোহানকে ভালোবেসেছি, আর ওর সাথেই বিয়ে হবে আমার। যদি তুমি এই বিয়ে আটকাতে কোনো সাহায্য না করো, তবে এটা আমি আর জোহানই বুঝে নেবো। তোমাকে তোমার মমের অবাধ্য হতে হবে না। এটার জন্য আমরাই যথেষ্ট। শুধু পার্থক্য হলো এটাই, তুমি যদি বুঝিয়ে বলতে তাহলে ঝামেলাটা একটু তাড়াতাড়ি মিটে যেত, আর আমরা বোঝাতে গেলে হয়তো সময়টা একটু বেশি লাগবে। তবে যত সময়ই লাগুক আমরা আমাদের মা বাবাকে বুঝিয়ে নেবো।”

জায়িন পিছন ফিরে না তাকিয়েই বললো,
“সেটা তোমাদের নিজ ইচ্ছা, নিজ খুশি!”
বলেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর পথে যেতে লাগলো।

মিতুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল পিছন থেকে। জায়িন এতটা খারাপ, সেটা আগে জানা ছিল না ওর। আজ নতুন ভাবে চিনলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here