চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |১
সূর্যোদয় দেখার জন্য সেই পাখিডাকা ভোরে উঠেছিলাম। রবিনকে এত ডাকলাম উঠলো না। উল্টো ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে দিল,
— এই বিরক্ত কোরো নাতো তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যাও আমাকে ঘুমোতে দাও।
এরপর এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী বিয়ের নয়দিনের মাথায় স্বামীর সাথে কক্সবাজারে এসেছি হানিমুনে। দুজনে অফিস থেকে পনেরো দিনের ছুটি পেয়েছি। একই অফিসে জব করি বলে বস আমাদের পোস্ট দুই রকমের হলেও বিয়ে উপলক্ষে সুবিধাদি একইরকম দিল। আমি শবনম।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সবে জবে জয়েন করেছি দেশের একটি নামকরা ইলেকট্রনিকস কোম্পানিতে। হেড অফিসে বসি। আমার অফিস গুলশান এক দুইয়ের মাঝামাঝিতে। এই অফিসের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের হেড আমার স্বামী রবিন ইফতেখার। দেশের বাইরের প্রজেক্টগুলো নিয়ে রবিনের কাজ। আমি জয়েন করেছি সেলস এক্সিকিউটিভ ট্রেইনি অফিসার হিসেবে। ছয়মাস পর প্রমোশন সহ জব পার্মানেন্ট হবে এই শর্তে সীমিত সুবিধার আওতায় জবটা নিয়েছি। সেলারী বলার মত না। ঢাকার শহরে চল্লিশ হাজারের নীচে সেলারীতে একটা সাধারণ পরিবারে মা বাবা আর দুইভাইবোনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়। ভাগ্যিস বাবার মাস শেষে পেনশনের টাকা আর মায়ের সেলাইমেশিনের টুকটাক কাজে যা পায় তা দিয়ে কোনোরকমে চলে যেত। ছোট ভাইটা সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বাবা, মা আমার বিয়ের তোড়জোড় করছিল। মাস্টার্স মানেই তো আইবুড়ো মেয়ে। এ শহরে সহজে পাত্র মেলে না এম এ পাশ মেয়ের। বললাম বিয়ে এখনই নয়। একটু ক্যারিয়ারিস্ট হতে দাও। কে শোনে কার কথা। বাবা মরে যাওয়ার দোহাই দিলেন। মা দিলেন মান সম্মানের ভয়। কিছু না বলে নিজেই জব খোঁজায় মন দিয়েছিলাম। ফ্যামিলি যা করে করুক গে।
অফিস জয়েনিংয়ের পাঁচ দিনের মাথায় ডাক পড়লো মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান রবিন ইফতেখারের চেম্বারে। ঢুকেই লাইফে ফার্স্ট টাইম মনে হয় ক্রাশ বলতে যা বোঝায় তাই খেলাম। তবে ভীষণ চাপা স্বভাবের দরুন মনের হাল চোখে পড়তে দিইনি।
বিশাল গ্লাস ডেস্কটপের উল্টো দিকে বিদেশী ব্রান্ডের এন্টিক রিভলভিং চেয়ারে বসে থাকা ত্রিশোর্ধ মানুষটিকে আমার জাস্ট তাকে জাপানিজ রাজপুত্র মনে হল। গায়ের রঙ গমের মত সোনালী। চোখে রিমলেস সিলভার কালার চশমা দেখে বুঝতে পারছি না পাওয়ার মাইনাস নাকি প্লাস। এই লোকের সুদর্শন অবয়বের বর্ণনা দিতে গেলে নিজেই নিজের চরিত্র নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়বো। বাদ দিলাম। ব্যক্তিত্ব ভাবগাম্ভীর্যেপূর্ণ মানুষটা চেয়ার ছেড়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত ভেবেছিলাম লম্বায় সাতফিটের কম না। আমি সেই অর্থে চুনোপুঁটি। ছিঃ আল্লাহ কী সব ভাবছি ধুরর হতচ্ছাড়ি শবনমের বাচ্চি..
— কী নাম আপনার? দরজায় দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে আসুন।
রবিন স্যারের কথায় ওনাকে নিয়ে আমার ধ্যানভঙ্গ হল। ভেতরে এসে বেশ জড়োসড়ো মনোভাব নিয়ে ওনার সামনে ডেস্কটপের অপজিটে দাঁড়ালাম। জানি না কেন ডেকেছেন। মার্কেটিং হেড কেন মাত্রই জয়েন করা সেলসের একজন সাধারণ ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ অফিসারকে ডাকবে মাথায় এল না। কনফিউজড একটা মাইন্ড নিয়ে বললাম,
— আমি শবনম শাহজিদ ইসলাম স্যার। আপনি আমায় ডেকেছিলেন।
— হুম নাইস নেইম শবনম। বসুন। কী খাবেন বলুন হট অর কোল্ড ড্রিংকস?
— কোনোটাই না স্যার থ্যাংকইউ।
— হুম.. মাত্রই পাঁচদিন হলো জয়েন করেছেন, রাইট?
— জ্বি স্যার।
— কী মনে হয় কেন ডেকেছি আপনাকে? আমার নাম জানেন? বলুন।
— হ্যাঁ জানি রবিন ইফতেখার আপনার নাম।
— কখন জানলেন?
প্রশ্নটি করেই উনি বেশ আয়েশী ভঙ্গিমায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখে আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। আমার হাঁসফাঁস লাগছে। বানিয়ে মিথ্যে বলা একেবারেই আসে না আবার সত্যিটা মরে গেলেও বলবো না। স্যার পলক ফেলছেন না। একটু যদি পলক ফেলতো শ্বাস নেয়ার সুযোগ পেতাম। নাহ.. সত্যি মিথ্যার মাঝামাঝি উত্তর দিলাম,
— আপনার কেবিন ডোরের নেইম প্লেটে নাম ও পজিশন লিখা।
উনি বেশ সময় নিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন। আমার দ্বিধান্বিত মনোভাব বাড়লো। চুপ করে রইলাম। এখনপর্যন্ত এই অফিসের কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে কথা হয়নি ইন্টারভিউয়ের সময় মনে হয়েছিল বোর্ড অভ ডিরেক্টর ছিল দুই একজন। কিন্তু জয়েন করার পর এই পাঁচদিনে তাঁদের কাউকে দেখিনি। অবশ্য দেখবো আশা করিনি আমার কেবিন ভিন্ন। আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র অফিসারদের ছাড়া অন্যদের রিপোর্ট করতে আমি বাধ্য নই। সেভাবেই ট্রেইনড হচ্ছি।
আবারও রবিন স্যারের কথায় ধ্যান ভাঙলো।
— বললেন না কেন ডেকেছি?
— বলতে পারছি না স্যার কেন ডাকলেন!
— কোনো আইডিয়া?
— উঁহু সরি স্যার…
— অফিস টাইম কটা পর্যন্ত আপনার?
— সন্ধ্যা সাতটা।
— ট্রান্সপোর্ট? মানে কীভাবে বাসায় ফেরেন?
— অফিস স্টাফদের জন্য ট্রান্সপোর্টের সুবিধা দেয়া হয়েছে।
— ও গুড গুড.. ওকে শবনম দেখা হচ্ছে সাতটায়। এবার আপনি আসুন।
কোনোকিছুই বুঝতে না পারা আমিটা যন্ত্রচালিত মেশিনের মত কীভাবে যে রবিন স্যারের কেবিন থেকে নিজের কেবিনে সেদিন পৌঁছে ছিলাম সত্যিই বলতে পারবো না।
না সেদিন ওনার সাথে আমার দেখা হয়নি। বাসা থেকে ইমার্জেন্সি কলে অফিস ছুটি হওয়ার একঘন্টা আগেই বের হতে হয়েছিল। পড়িমরি করে বাসায় এসে দেখি পাত্রপক্ষ আমার অপেক্ষায় বসে আছে। ভীষণ রাগ হয়েছিল আব্বু আম্মুর ওপর।
প্রচন্ড অভিমান নিয়ে যেভাবে ছিলাম ফ্রেশ না হয়ে ওভাবেই পাত্রপক্ষের সামনে বসে পড়লাম। সাধারণ একটা বেগুনি রঙের সুতির থ্রি-পিস পরেছিলাম। তাড়াহুড়োয় সিএনজিতে বাসায় ফেরার দরুন মাথার চুলগুলো সজারুর কাটার মতই ধুলোমলিন রুক্ষ। সাজসজ্জা বিহীন চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। মেজাজ খারাপ ভাবটুকু খুব সাধারণ চেহারার আমিটার সৌন্দর্যের স টুকু মুছে দেবে এটাই স্বাভাবিক। আজ নির্ঘাত বিয়ের ঘটক সহ পাত্রপক্ষ পালাবে এমনই ভাবছিলাম।
নিশ্চিন্ত মনে নতমুখে বসে থাকা অবস্থায় ঐদিন ঐমুহূর্তে আমার বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল। কার নামের শেষে কবুল বলেছিলাম তাও জানি না কারণ তার আগেই আমি শকে।
কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম। আম্মুর কেঁদে ওঠায় বুঝেছিলাম বিয়ে সম্পন্ন। অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের আইবুড়ো মেয়েগুলোর বিয়েটাও যেন হয় সবার অলক্ষ্যে। পাছে বিয়ে ভেঙে যায় সেই ভয়ে।
পাত্রের মা তাঁদের নিয়ে আসা ভারি ভারি শাড়ী গহনা দিয়ে নিজেরাই আমাকে সাজিয়ে নিলেন। কেননা, ততক্ষণে ওনারাও বুঝে গেছেন বিয়েটা আমার অমতে হয়েছে।
আমার বাবা মায়ের মত পাত্রের ফ্যামিলি আমার মর্জিকে মোটেও পাত্তা দেয়নি। আম্মু হলুদ দিয়ে শাওয়ার করাতে চেয়েছিল। আমার পাথর দৃষ্টি দেখেই কিনা জানি না ওনার চাওয়ার গুড়ে বালি। অফিস থেকে যেমন ফিরেছিলাম ঠিক তেমন ক্লান্তশ্রান্ত অবস্থায় বাবার বাড়ী ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এলাম। মনেমনে কসম করা শেষ, “এই জন্মে আব্বু আম্মুর বাড়ীতে আসবো না মুখ দেখাবো না।”
রাগে দুঃখে থম মেরে থাকায় দেখা হলো না কোন এলাকায়, কোন বাড়ীতে পা রেখেছি। দেড় হাত ঘোমটার নীচে আমার নজর শুধুই কখনো নিজ কোলে কখনো মাটিতে।
রাত একটায় তাজা অর্কিড ফুলে সেজে ওঠা একটি ইয়াবড় আলিশান বেডরুমে আমাকে দিয়ে গেলেন আমার শ্বাশুড়ি ও একমাত্র ছোট ননদ। এদের কারোরি চেহারা ঠিক করে দেখা হয়নি তখনও। পরদিন সকালে চিনবো বলে মনে হয় না। তবু ওরা সবাই এত আন্তরিক আর অমায়িক ব্যবহার করছে আমার সাথে যা আমাকে সত্যিই লজ্জিত করে দিল। আইবুড়ো মেয়ের জামাই দেখতে কেমন হতে পারে তা আমার আগেই অনুমেয় ছিল। তাই কোনো স্বপ্ন সাজাইনি কখনো। এখনো না।
শ্বাশুড়ি ননদ আমাকে আদর করে গুড নাইট কিসি দিয়ে রুম ছাড়লেন। যাবার আগে আমার জন্য খাবার ট্রলি ভর্তি বিভিন্ন আইটেমের খাবার রেখে গেলেন।
জেদের বশে আমি যে খাচ্ছি না ওনারা আগেই জেনেছেন। তবুও কোনো জোরাজুরি বা নেগেটিভ কথা বলেননি কেউই।
দরজায় নক করে কেউ ঢুকলো।
উফফ.. বর মশাই এল বুঝি। স্বপ্নহীন আজ রাতটা কেমন কাটবে আমার.. একধরণের ভয় মিশ্রিত অভিমানে চোখে জল চলে এল।
ধীর পায়ে হেঁটে এসে আমার সামনে দাঁড়ানো মানুষটির মখমলের কার্পেটে আধা ডুবে যাওয়া পায়ের পাতাদুটো বলে দিচ্ছে মানুষটির গায়ের রঙ গমের মত সোনালী। উনি আমার মাথার ঘোমটায় হাত রাখতেই দুই চোখ অজানা ভয়ে বুজে এল। বেডরুমে এক কর্ণারে পেতে রাখা ভিক্টোরিয়ান সিঙ্গেল সোফায় বসেছিলাম। ফুলশয্যা সুশোভিত বিছানায় বসতে একটুও ইচ্ছে হয়নি। অচেনা মানুষটি আমার সরু কাঁধের দুদিকে দু’হাত রেখে বসা থেকে তুলে দাঁড় করাতে চাইলেন হয়তো। ইলেক্ট্রিক শক খাওয়ার মত ভয়ানক চমকে উঠে ছিটকে পড়ার মত অবস্থা হোলো আমার। আশ্চর্য মানুষটার গায়ে এত শক্তি! বিদ্যু বেগে এক ঝটকায় আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে আমার পতন ঠেকালেন উনি।
দীর্ঘদেহী মানুষটির চওড়া বুকে আতঙ্কে আছড়ে পড়ে দুহাতের মুঠোয় শেরওয়ানীর কলার চেপে ধরলাম। অস্ফুটস্বরে মুখ ফসকে বের হয়ে এল,
— প্লীজ আমায় ছেড়ে দিন। আপনাকে ঘৃণা করি।
এক আঙুলে আমার চিবুক উঁচু করে ধরলেন তিনি। দেখবো না তাকে তাই চোখ বুজে নিয়েছি। ওনার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার সারামুখে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে যেন। সুশীতল এয়ারকন্ডিশনড রুমে রীতিমতো ঘামছি। হায় এ কী বললাম আমি! এই লোক ধাক্কা মেরে ফেলে দিলে আমার অস্তিত্ব সহ মিটে যাবে। হঠাৎ গুরুগম্ভীর গলায় অবাক বিস্ময়ের অনুভূতি নিয়ে একটি পুরুষ কন্ঠ ঠিক আমার মুখের খুব কাছথেকে কথা বলে উঠলেন,
— সত্যি!! সত্যি তুমি আমাকে ঘৃণা করো শবনম?
একদিনের একমুহূর্ত সময়ে চেনা এই কন্ঠ এত সহজেই কী ভুলে যাওয়া যায়! ঝট করে চোখ মেললাম। প্রায় পাঁচফিটের দূরত্বে গ্লাস ডেস্কটপের অপরপ্রান্তে বসে থাকতে দেখা মানুষটির এমুহূর্তে শক্ত বাহুর বেষ্টনীতে আটকে আছি ব্যাপারটি আমার ছোট্ট মস্তিষ্ক একদমই নিতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে রবিন ইফতেখার স্যারের বুকে ঢলে পড়লাম।
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা
(একা’র কাল্পনিক গল্পগুচ্ছ)