চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |২

0
160

চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |২

— আরে আরে এই মেয়ে কী হোলো!
বার কয়েক ডাকার পরেও চোখ মেলছে না শবনম। সামান্য একটু সারপ্রাইজের ধাক্কা নিতে পারে না এই মেয়েকে নিয়ে কী করি আমি।
শবনমকে বেডে শুইয়ে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে কল দিলাম। সবশুনে ফোনে ব্রিফ করলেন কী করতে হবে।
প্রায় পনেরো মিনিট পর চোখ মেললো শবনম। অপরিচিত মহলে অফিসের সিনিয়রকে দেখে ও সম্ভবত ভুলে গেল আজ সন্ধ্যায় ওর বিয়ে হয়েছে। যে চোখদুটো প্রথম দেখায় আমার হুঁশ উড়িয়েছিল তাই দিয়ে সে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে। এ মেয়ে আরেক বার জ্ঞান হারানোর আগেই কিছু না বলে মোবাইলের ভিডিও ক্লিপ প্লে করে দেখালাম সে আমার বউ হয়।

ইতস্তত কন্ঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেড থেকে নামতে নামতে শবনম বলল,

— সরি স্যার এক্সট্রিমলি সরি.. কী বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল।

— বিশ্রী ব্যাপার! কোনটা?
— এই যে জ্ঞান হারিয়ে গায়ের ওপর পড়ে যাওয়া। আমি সত্যিই সরি স্যার..

আলতো করে ওকে কাছে টেনে নিলাম। এতেই লজ্জায় মিঁইয়ে গেল সে। বললাম,

— বাব্বাহ এত লজ্জা! কিশোরী তো নও। যথেষ্ট এডাল্ট। নও কী? স্যার বলছো কেন?

রবিন স্যারের গুরুগম্ভীর এহেন কথায় অপমান ও লজ্জায় আরও মিঁইয়ে গেলাম। চোখে পানি আসার পূর্বেই চোখ নামিয়ে নিয়ে ওনার কাছ থেকে দূরে সরে আসতে চাইলে উনি বিস্ময়বোধ করলেন। বুঝতে বাকি নেই, উনি ভাবছেন আমি কিশোরীদের মত ন্যাকামো করছি। এবার আমি শক্ত হলাম। বললাম,

— আমার কিছুটা সময় লাগবে স্যার। ব্যাপারটা আপনি জানতেন আপনি কী করছেন। আমি কিছুই জানতাম না। আজই তো দিনে পরিচিত হলাম। তাও সাধারণ এক এমপ্লয়ি হিসেবে। রাতেই বউ হয়ে গেলাম! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সবকিছু।

— তুমি চাইলে এমুহূর্তে তোমার বাবার বাসায় চলে যেতে পারো। সময় নাও। বিশ্বাস হলে জানিও গিয়ে নিয়ে আসবো।

— সময় নিতে হলে আব্বুর বাসায় যেতে হবে কেন? এখানে নয় কেন?

— ওয়েল, তাহলে গেস্টরুমে তোমার থাকার ব্যবস্থা করছি।

রবিন স্যার রুম থেকে দ্রুত পায়ে বের হতে নিলেন। হতভম্ব আমি ঈষৎ চেঁচিয়ে বললাম,

— গেস্ট রুম!

দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,

— তাহলে কোথায় সময় কাটাতে চাও? আমার চোখের সামনে একেবারে নয়। মেয়েলী ন্যাকামো, নখরা একদম পছন্দ নয় বলে এতদিন বিয়ে করিনি। পাত্রী পছন্দ হচ্ছিলো না। এক একটা সব ন্যাকামোতে ভর্তি। আমি সবকিছু স্ট্রেইট বুঝি। এডাল্ট একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি। বাসর রাতের নিশ্চয়ই তার সাথে আমি এখন পুতুল খেলতে বসবো না।

হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছি মানুষটার দিকে। ভাবছি আমি কী পৃথিবীর কেউ নাকি উনি কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী। যার ভেতর নূন্যতম লজ্জা শরমের বালাই নেই। বহুকষ্টে জিজ্ঞেস করলাম,

— কী চাইছেন আপনি?

রুমের লাইট নিভে গেল। জ্বলে উঠলো ক্যাণ্ডেল লাইট। আলো আঁধারীতে স্বপ্নীল হয়ে উঠলো পুরো কামরা। রবিন স্যার ঠিক তাই করলেন যা তিনি চাইলেন। সারাটা রাত আমার কেটে গেল বোধবুদ্ধির ঊর্ধ্বে, নির্ঘুম। সকালের মিঠেল রৌদের ছটায় তন্দ্রা কেটে গেলে নিজেকে নিরাভরণ রূপে রবিন স্যারের বুকের ওপর আবিষ্কার করলাম।
আমার পুরো পৃথিবীটা মাত্র চব্বিশ ঘন্টা হয়নি, কেমন উল্টে গেল। যে মানুষটিকে প্রথম দেখার মুহূর্তটা তীব্র অনুভূতিময় ছিল। ঐ একই মানুষ এমন আজব কিসিমের ভিনগ্রহের প্রাণী হয়ে আমার ভাগ্যেই টপকাতে হোলো কেন কিছুতেই বুঝে এল না।
সপ্তাশ্চর্যকে হার মানালো জীবনের এই নাটুকেপনা।

খুব সাবধানে সরে এসে বেড ছাড়তে চাইলে রবিন রাতের চেয়েও স্বপ্নময় করে দিল আমার দিনের শুরুটা।
ওর স্পর্শ ওর মুখের ভাষার সম্পূর্ণ বিপরীত। মনেহয়, এমন একটি মানুষকেই তো স্বপ্ন না দেখা স্বপ্নময় কিশোরী বেলা থেকে চেয়ে আসছি। কেবল কথা বলা মেলে না। বড় বেশি যান্ত্রিক। কিংবা আমার বোঝার ভুল।
সেদিন বিয়ের প্রথম দিন সকালে আমার গ্রীবায় মুখ ডুবিয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠলো রবিন। রাতেই আমায় তার সুনিপুণ কারসাজিতে স্যার ডাকা বন্ধ করেছিল। বাধ্য করেছিল কোনোরকম নখরা ছাড়াই তাকে তুমি করে বলতে।

পর পর তিনটা দিন স্বপ্নের মত করে স্বপ্নগুলোকে মর্ত্যে নামালো রবিন। নিজেকে ওর মত করে সাজিয়ে নেয়ার চেষ্টায় মত্ত হলাম। যদিও মন সায় দিল না নিজেকে আমূল বদলে নিতে।

চতুর্থ দিন সবকিছু পাল্টে ঠিক কেমন জানি হয়ে গেল। রবিন নিজের মত অফিসে গেল। আমি আমার মত অফিস ট্রান্সপোর্টে। শ্বশুর রাজি হচ্ছিলেন না। উনি ড্রপ করে দিতে চাইলেন। মিষ্টি হেসে বুঝিয়ে বললাম,

“বাবা অফিস আর ফ্যামিলি দুটো আলাদাভাবে রাখতে চাই। এক করে দেবেন না প্লীজ। আমার জব আমার স্ট্যান্ডার্ড অভ লিভিং অনুযায়ী নয় বরং আমি আমার জব অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড অভ লিভিং ফিক্সড করবো। আমাকে সাধারণ থাকতে দিন বাবা।”

এ আবদার ননদ শ্বাশুড়ি সহ সবাই হাসিমুখে মেনে নিল। রবিন এসবের কিছুই জানলো না। সে আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল।

অফিসে পৌঁছে চক্ষু ছানাবড়া। কলিগ, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই পর্যায়ক্রমে এসে এসে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালো মিসেস রবিন ইফতেখার হিসেবে।
একজন মেয়ে কলিগ জানালো রবিন স্যারকে তারা আগেই গ্রিট করেছে। বিষয়টি আমাকে খুব ভাবালো। রবিন নিজে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়নি বা নবদম্পতি হিসেবে আমাদের দুজনকে একসঙ্গে গ্রিট করার কথা। তেমন কিছুই হয়নি। দু’জনকে দু’ভাবে গ্রিট করার ব্যাপারটা আমায় চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছুই বুঝিয়ে দেয়। নিজের কেবিনে এসে সবার আগে ভার্সিটি সহপাঠী সৌম্যকে কল দিলাম। দুই রিংয়েই রিসিভ করলো।

— হাই শবনম! কী রে কেমন আছিস? এতদিন পর!

কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বললাম,

— একটা জব দিবি? ফিল্ডে না ডেস্কটপ। তিনদিন হোলো বিয়ে হয়েছে। বেতন থার্টি ফর্টির ভেতরে হলেই হবে। এরচেয়ে কম হলে আব্বু আম্মুর ভীষণ কষ্ট হয়ে যাবে। ভাইটা পড়ছে জানিস তো।

একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে উঠলাম। সৌম্য নিজেও সারপ্রাইজড হলো।

— দম নে। এত দ্রুত কথা বলার কী আছে! কটা দিন সময় দে দেখি কী করা যায়। তোর সিভি ই-মেইলে ড্রপ করে দিস।

— পুরো মাস সময় নে। সিভি এখুনি মেইল করে দিচ্ছি। এ মাস ফ্রি থাকতে চাইছি।

— ওকে। বিয়ে ঠিকঠাক নাকি গোলমেলে?
— কিছু জানতে চাসনে সৌম্য। কোনো এক সময় বলবো।
— ওকেই।
— রাখছি তাহলে?
— ওয়েট,
— বল।
— রিল্যাক্স কর প্রেশার নিস না। পাশে আছি। জব হতে দেরি হলে সমস্যা নেই। তোর একাউন্টে টাকা পৌঁছে যাবে।
— সৌম্য!
— খেপিস না ধার দিচ্ছি ইন্টারেস সহ ব্যাক করবি। বহুত কষ্টের টাকা আমার।
— ছাগল তুই বদলালি না।
— বউ আসুক বদলে যাবো তোর মত তিনদিনেই…

হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল সৌম্য। আমি নীরবে কাঁদছি।
সৌম্যকে পছন্দ করতাম। ছেলেটা সহপাঠী বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবতে চাইলো না। তাই আর নিজে থেকে আবেগ প্রকাশ করিনি।
স্বাভাবিক বন্ধুত্ব আমাদের। প্রয়োজনের বাইরে কথা হত কম। এখনো তাই।

লাঞ্চ আওয়ারে যার আন্ডারে ট্রেইনিং নিচ্ছিলাম তাকে জব ছাড়ার কারণ দর্শিয়ে রিজাইন লেটার দিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে এলাম। আমার এত কষ্টে পাওয়া জবটা ঠিক নয়দিনের মাথায় ছাড়তে হলো।
সাধারণ ট্রান্সপোর্টে সোজা আব্বুর বাসায় এলাম। আমায় দেখে সবাই চমকালো। সরাসরি আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম,

— একটাই তো মেয়ে ছিলাম। এত তাড়াহুড়ো করলে কেন?

বাবা, মা, ভাই কেউ কথা খুঁজে পেল না। কিছু সময় নিয়ে বাবা আমায় খুলে বললেন সব। আমার মনের অন্ধকার কেটে গেল। রিশাদ আমার ভাই। আমাকে বাইকে সন্ধ্যার আগেই শ্বশুরের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল।
মানুষ যত বড় হয় তত নাকি ঋজু হয়। শ্বশুরবাড়ী এসে প্রমান পেলাম। এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত বিনয়ী। ননদ হৃদি আস্ত একটা বান্ধবী। শ্বাশুড়ি কিছুটা দাম্ভিক প্রকৃতির তবে আচরণে অমায়িক। শ্বশুরকে বুঝতে পারি না। কখনো বাবা বাবা গন্ধ লাগে কখনোবা শিক্ষক। রবিনকে বুঝে উঠতে পারিনি। না, বলা ভাল পারছি না।

রুমে এসে বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলাম। বাসা থেকে নিয়ে আসা সাধারণ মানের ঘিয়ে রঙের একটি ঘরোয়া থ্রিপিস পরে শাওয়ার রুম থেকে বের হয়েই রবিনের সামনে পড়লাম।

— জব ছেড়ে দিলে?
— হ্যাঁ।
— কেন?
— এমনি। কারণ নেই।
— সবাই কী ভাববে এটা ভাবোনি?

— জব আমার। করা না করার ইচ্ছেটাও আমার। যেমন তোমার ইচ্ছে হলো আর অমনি মাত্র পাঁচদিনের জয়েন করা এক জুনিয়র এমপ্লয়িকে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বিয়ে করে ফেললে। আমার বাবা মায়েরও ইচ্ছে হলো এমন যোগ্য পাত্র হাতছাড়া না করতে। কয়েক ঘন্টার নোটিসে বিয়ে দিয়ে মেয়ে বিদেয়। সবাই কেমন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। নয়?

— আমাকে পাত্র হিসেবে পছন্দ হয়নি?

— সুযোগ দিয়ছো পছন্দ করার? অপশন আছে কোনো?

— সম্পূর্ণ অদেখা একটি পরিপক্ক সংসারী মেয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তোমার অফিস জয়েনিংয়ের প্রথম দিন আমার সব চিন্তা ভণ্ডুল করে দিয়েছে যা এর আগে কখনো হয়নি। এমন কেন তুমি? চিন্তা জগতের সব বানচাল করে দাও। দেখতে অতটা আহামরি নও। তবু এমন কেন!

রবিনের চোখ আমার চোখের দিকে নয়, সে আমার ঠোঁটের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বললো সেই সাথে অফিসে সাবমিট করা আসা জয়েনিং লেটাররা আমার চোখে সামনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করলো। কথা ও কাজের মাঝে একটা পলক পড়লো না চোখে তার।
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুল মুছতে মুছতে বেডরুমের বারান্দার দিকে এগোলাম। পেছন থেকে আচমকা হুট করে আমায় পাঁজাকোলে তুলে নিল রবিন। একমুহূর্তে দেরি না করে শাওয়ার রুমে ঢুকেই আমাকে বাথটাবে বসিয়ে দরজা লক করে দিল। হতভম্ব চোখে চেয়ে আছি রবিনের দিকে। বেডরুমে সে যেমন বাইরের জগতে সে মোটেও তেমন নয় চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার ঘোর কেটে গেল। ততক্ষণে বাথটাবে ভরে ওঠা ফেনিল সৌরভে ভরে উঠেছে আমার চারপাশ। শাওয়ার ক্রিমের ফেনায় পিছলে ডুবে যাচ্ছি খেয়াল নেই। রবিন এসে ভাসিয়ে নিল আমায়।

ওয়েডিং সেরেমনির ডেট ফিক্সড করলেন আমার শ্বশুর। একমাত্র ছেলে পাগলামি করে বউ তুলে এনেছে সেটা ডামাডোল না পিটিয়ে বললে কী হয়। শ্বাশুড়ীর সন্দেহ হোলো বিয়েটা হয়তো আমি মন থেকে মেনে নিচ্ছি না। উনিই চাইলেন একটা শর্ট ট্রিপে হানিমুন সেরে এসে ওয়ালিমা হোক। ওনার বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হয়। উনি চাইছেন ওয়ালিমার দিনটা যেন আমার সুন্দর হয় মন থেকে হয়। রবিনকে মেনে নিই আমি। একবার অনিচ্ছাকৃত ভাবে আড়াল থেকে বলতে শুনলাম শাশুড়িকে। রবিনকে বলছে,

— একতরফা নিজের জীবন চলে কিন্তু দাম্পত্য জীবনে দুজন মানুষের ইচ্ছে সমান না হলে সংসার সুখের হয় না। কেন কী কারণে এমন অতি সাধারণ একটা মেয়েকে বিনা নোটিশে হুট করে বিয়ে করেছিস তা তুই’ই জানিস। এখন এই মেয়েটিকে জয় কর। যার জন্য এতকিছু তার চোখ কেন সারাক্ষণ সমুদ্দুর বলতে পারিস?

বিয়ের ঠিক নয়দিনের মাথায় অফিস থেকে ফিরেই রবিন আমায় গোছগাছ করার সুযোগ না দিয়ে উড়াল দিল। শ্বাশুড়ি মা আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। পরে বুঝেছি মা ছেলের সারপ্রাইজ ছিল এটা।

কক্সবাজারে এসেছি আমরা। আজ এখানে প্রথম সকাল। গতরাতের ভালোবাসাবাসির আবেগীয় একমুহূর্তে ঠিক হয়েছিল সূর্যোদয় একসঙ্গে দেখবো। সমুদ্রের পানিতে একসঙ্গে পা ডুবিয়ে হাঁটবো। সায়মন বীচে ব্রেকফাস্ট সেরে ফিরবো। হ্যাঁ এখানেই উঠেছি আমরা। সী-ভিউ স্যুইটে সূর্যাস্ত দেখা গেলেও সূর্যোদয় উল্টো দিকের হিল সাইডে। সেজন্যই বের হওয়া। একাই বের হয়েছি। এমন না যে এই প্রথম এসেছি বঙ্গোপসাগর দেখতে। অসংখ্য বার এসেছি। বাবার খুব সমুদ্র পছন্দ। সময় পেলেই বউ বাচ্চাদের নিয়ে সোজা কক্সবাজারে চলে আসতেন।
একটা অটো রিক্সা নিলাম। বয়োবৃদ্ধ রিক্সা চালক। ওনাকে বললাম, “মামা সূর্য ওঠা দেখবো। সব চাইতে সুন্দর করে দেখা যায় এমন জায়গায় নিয়ে চলেন।” বৃদ্ধ হেসে রওনা হলেন।
কিছু পথ আসতে না আসতেই আকাশ কালো করে মেঘ ছেয়ে গেল। মন কালো করে ঘন বর্ষণ শুরু হলো। শ্রাবণ বৃষ্টির কোন তাল নেই। আসে না আসে না যখন আসে হুটহাট আসে। এমনি করে এসে আনন্দ মাটি করে দিতে ওস্তাদ।

ভিজে চুপচুপে এসে সায়মন বীচে নামলাম। শ্বাশুড়ি মায়ের পছন্দে কিনে দেয়া আড়ংয়ের একটা হাফ কটন জরি সুতোর বুননে আকাশী রঙের কাতান শাড়ী পরে বের হয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে সেঁটে গিয়েছে শাড়ী। দর্শনার্থীরা কেউ নেই বলতে গেলে। থাকলে অস্বস্তিতে পড়তে হতো।

— এক্সিকিউজ মী মিস!

পেছন থেকে একটা ভরাট উদ্দীপ্ত পুরুষালী কন্ঠ হটাৎ এভাবে ডাক দেয়ায় চমকে উঠে পিছু ফিরলাম। অঝোর বৃষ্টি আর উত্তাল সমুদ্রের গর্জন আমাকে মগ্ন করে নিয়েছিল। তাই খেয়াল করিনি নির্জন এই সৈকতে আমি ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারে। বেশ হ্যান্ডসাম ম্যানলি দেখতে ছেলেটি। বয়স আমার কাছেপিঠের হবে কিংবা ছোটও হতে পারে। মাথার চুলগুলো জিপসীদের মত ঘাড় উপচে পড়া। চুলের কোয়ালিটি কেমন বোঝা গেল না কারণ সেও আমারই মত বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সে আবার বলল,

— এত ভোরে বীচে খুব সমুদ্র পাগল মানুষ না হলে আসবে না।

মৃদু হেসে কথার জড়তা কাটিয়ে নিয়ে বললাম,

— ভীষণ সমুদ্র পাগল আমি। বৃষ্টিরও।
— পিঞ্চ.. আমিও।
— হি হি পিঞ্চ পিঞ্চ…

হটাতই বিষন্নতার ঘোর কেটে মন চঞ্চল হয়ে উঠলো আমার। একমুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম হোটেল রুমে রবিন আমার নতুন বর ঘুমিয়ে আছে। যার কাছে আমার ভালোলাগার কোনো মূল্য নেই। সে যা চেয়েছে তা পেয়েছে। শুধু আমার চাওয়াগুলো আমার বাবা মা তাঁদের মনে হওয়া যোগ্য পাত্রের হাতে দাফন করে দিল এই যা।

— আমি শাওকাত ইসলাম।
— আমি শবনম শাহজিদ ইসলাম।
— আরে আমরা মিতা!
— হুম আধা আধি জন্মসূত্রের নামের পদবীতে।

আমার কথায় শব্দ ছড়িয়ে হেসে উঠলেন শাওকাত। মানুষটি দারুণ প্রাণবন্ত হাসেন। দাঁতগুলো মাত্রাতিরিক্ত সাদা.. ধবধবে চুনাপাথরের মত। বললেন,

— হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো দেখছি। তা এই নির্জন সৈকতে এভাবে এই রূপে একা কেউ আসে? ভয় লাগে না?

— আমি এসেছি অনেকবার। তবে এই রূপে প্রথম। সূর্যোদয় দেখতে চেয়েছিলাম। বৃষ্টি সব ভণ্ডুল করে দিল।

— ইশশ..
— আপনি একা কেন?

— আরে না একা নই। বাবা মা ভাইবোন সপরিবারে এসেছি। বছরে অগাস্টের এই সময়টায় আসা হয়। মা সমুদ্র ভালোবাসে। চিটাগাং থাকি আমরা। রুমের বারান্দা থেকে দেখি আকাশি রঙের শাড়ী পরিহিতা এক পাগল মেয়ে শ্রাবণ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে। তাকে বাঁচাতে চলে এলাম।

শাওকাতের হাস্যোজ্জ্বল কথায় প্রথমে বুঝিনি সে কাকে মীন করে শেষের কথাগুলো বললো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে প্রায় চেঁচিয়ে বললাম,

— আরে না সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে যাবো কেন!
— আমার তাই মনে হলো।
— ভুল..
— এসে বুঝেছি ভুল। আপনি ঠান্ডায় কাঁপছেন।
— আপনারা সায়মনে উঠেছেন?
— হ্যাঁ। আপনিও?
— হুম স্বামী সহ হানিমুনে এসেছি।
— কীহহ! আপনি ম্যারিড!

— হ্যাঁ। কেন মনে হয় না বিবাহিত? বয়স দেখে মনে হওয়া উচিত।

কেমন রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইলো শাওকাত। কন্ঠে জড়তা নিয়ে বলল,

— বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আমি ৪১ এ দাঁড়িয়ে। এখনও বিয়ে করিনি।

বিষম খেলাম শাওকাতের কথা শুনে। ৪১! আর আমি ভাবছি সে আমারও ছোট ইয়া মা~বুদ!!
দুজনে একসাথে ফিরলাম। আশ্চর্য হয়ে গেলাম যখন ভেজা চুল মুছতে মুছতে স্যুইটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাওকাতকে দেখতে পেলাম। উনি দেখতে পাননি। ভেজা কাপড় বদলে শর্টস পরে খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ব্যালকণির দিকে পিঠ দিয়ে ছিলেন। আমি যখন লিফটে উঠি উনি রিসিপশনে কী কাজে থেকে গিয়েছিলেন। জানা ছিল না পাশাপাশি রুম আমাদের।
একছুটে রুমে চলে এলাম। কেন? জানি না। রবিন এখনো কুম্ভকর্ণের মত ঘুমুচ্ছে। আমার কান্না পেল।

ঘটনাক্রমে রবিনের সাথে ওর কলেজ জীবনের বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে গেল বেড়াতে আসার দ্বিতীয় দিনেই। মৃন্ময়ী নাম। স্বামী আর দুই ফুটফুটে যমজ পুতুল বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে এসেছে ওনারা। বাচ্চা দুটোর বয়স পাঁচ। ইংলিশ মিডিয়ামে প্লে গ্রুপে পড়ে ওরা। বাচ্চাদের সামার ভ্যাকেশনে বেড়াতে এসেছে। মৃন্ময়ীর হাজব্যান্ড ডাক্তার। মেডিসিন স্পেশালিষ্ট। নিপাট ভদ্রলোক। মিডিয়াম হাইটের মানুষটার মধ্যে সাহেবী একটা ভাব আছে ব্যক্তিত্বে। নাম কায়সার চৌধুরী।
মৃন্ময়ী দেখতে অসম্ভব রূপবতী। ওর দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায় আমার। অথচ ওর হাজব্যান্ডের মুগ্ধ নয়ন ওরদিকে নয় আমাতে নিবদ্ধ থাকে যতক্ষণ সামনে থাকি। চাহনিতে মুগ্ধতা বৈ অন্য কিছু লাগেনি। কথা বলেন কম।

বিকেলে চায়ের আড্ডায় বসলাম আমরা সমুদ্র সৈকতে। মৃন্ময়ীর বাচ্চারা খেলতে খেলতে সমুদ্রের ছুটে আসা ঢেউয়ের দিকে দৌড়ে গেল। কায়সার ভাই উঠলেন বাচ্চাদের সামলাতে। রবিন ওনাকে বসতে বলে নিজে গেল বান্ধবীর বেবিদের সামলাতে।
একটা জিনিষ দেখে অবাক লাগলো, কায়সার ভাই যখন যেতে চাইলো মৃন্ময়ী একবারও ভ্রুক্ষেপ করেনি কিন্তু যেই রবিন গেল চায়ের কাপ হাতে মৃন্ময়ীও ‘মেয়েদের দেখে আসছি’ বলে রবিনের পিছু নিল।
আমি বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে দেখছি মৃন্ময়ীর চায়ের কাপে রবিনকে সিপ নিতে। অথচ ওর এসবে শুচিবায়ু আছে। নিজের পানির গ্লাস, চায়ের মগ অন্যকে ব্যবহার করতে দেয় না নিজেও অন্যেরটা করে না। এমন কী আমরা দু’জনে কখনো একে অন্যের চা কফি একই কাপে শেয়ার করিনি। রবিনের এসবে দারুণ এলার্জি।

— শবনম!

কায়সার ভাইয়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো।

— জ্বি বলুন ভাইয়া..
— নতুন জীবনে হ্যাপি?
— হ্যাপিই তো।
— হ্যাপি শব্দে টান পড়লো মনে হোলো.. (বলেই হাসলেন কায়সার ভাই)

— ডাক্তার মানুষরা বেশি শোনে (আমিও মৃদু হাসছি)।

— তাই কী!

প্রসঙ্গ এড়াতে চাইছি আর উনি ধরে বেঁধে ওখানেই থাকছেন। বললেন,

— আমরা অধিকাংশ মানুষ যা চাই, ভুল করে চাই। চাওয়ায় পূর্ণতা পেয়ে গেলে আফসোস করি.. ‘আঃ কেন চাইলাম এটাতো চাইনি’ বলে। ‘সম্মুখ দূরত্ব নিয়ে যে চিরকাল দাঁড়িয়ে ঐ মানুষটা আমার কেন নয়’ ভাবি!

— আপনার এমন মনেহয় (আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম)?

— হ্যাঁ মনে হয় বৈকি। আপনি বুদ্ধিমতী মেয়ে। সামনের মানুষটির মুগ্ধ দৃষ্টি চোখে পড়েছে নিশ্চয়ই।

— অথচ মৃন্ময়ী আপুর সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দেয়।

— আমার চোখ নষ্ট করে দিয়েছে তার ঐ রূপ। এখন আর নারীর দেহসৌষ্ঠব চোখে পড়ে নাহ.. (কথাগুলো বলার সময় বেদনার্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কায়সার ভাই)

— তাহলে এই যে মুগ্ধতা?

— দৃষ্টি অন্তর্নিহিত দৃষ্টিকে দেখতে পাচ্ছে তাই হয়তো এ মুগ্ধতা। শুনুন শবনম, কিছু সৌন্দর্য ফুলের মত। ফুল প্রকৃতির এমনই এক দান যেটাতে চরম পাপী চরিত্রহীন মানুষও নিষ্পাপ চোখে তাকায়। আপনি ফুলের মত।

কায়সার ভাইয়ের কথায় চোখে জল এসে গেল আমার। অস্ফুটস্বরে বললাম,

— আমি ফুল হতে চাইনি কায়সার ভাই, রবিনের দৃষ্টিতে নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট হতে চাইছি।

— রবিন সন্তুষ্ট বোঝা যায়। আপনি নন।

— জানি না.. হুট করে বিয়ে হোলো। বুঝে উঠতে পারছি না। সবকিছু কখনো স্বপ্ন, কখনো…

— মৃন্ময়ী আমার চায়ের কাপেও সিপ নেয়নি কখনো।

কথাটা বলে নিজের চায়ের কাপের সবটুকু চা সৈকতের বালুতে ফেলে দিলেন কায়সার ভাই। আমিও আমার কাপের চা টুকু ওনার মত করে উল্টে ফেলে দিলাম বালুতে। আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হাসলেন তিনি।
কিছুক্ষণ থম মেরে থাকার পর দুজনেই একসঙ্গে সশব্দে হেসে ফেললাম। আমাদের হাসির শব্দে রবিন ফিরে তাকালো। মৃন্ময়ীকে ছেড়ে আমাদের দিকে দ্রুত এগোলো রবিন। দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল।
কায়সার ভাইকে বললাম,

— দুই কলেজ সহপাঠী নিজেদের জামাই বউকে ফেলে বন্ধুত্ব এনজয় করছে। আমরা গোমড়ামুখো হয়ে কেন পড়ে থাকবো?

কায়সার ভাই চমৎকৃত হলেন। বললেন,

— আমি ডাক্তার মানুষ। রুগীর রোগ বোঝাই আমার কাজ। লেট’স গো শবনম.. চলুন এই সময়টাকে উপভোগ করি। ওদের মত বন্ধু নই। কম কিছুও নই।

আমি চটজলদি উঠে দাঁড়ালাম। উঠলেন কায়সার ভাই। ততক্ষণে রবিন চলে এসেছে। বেশ বসি বসি (Bossy bossy) ভারিক্কি গলায় বললো,

— কী ব্যাপার শবনম চা ফেলে দিলে যে!

— নিজের শুচি বায়ুগ্রস্ত বরকে তার বান্ধবীর চায়ের কাপে ঘন ঘন সিপ নিতে দেখে আমার চা বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল তাই… এনিওয়ে, তুমি আর মৃন্ময়ী আপু তোমাদের এতদিন পর পুণর্মিলনী সময়টা এনজয় করো।

তারপর কায়সার ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললাম,

— আমার হাজব্যান্ড তার বান্ধবীকে নিয়ে ব্যস্ত। লাবণী বীচের ওখানে দারুণ সব ক্যাফেটেরিয়া আছে। আমাকে ওখানে সাতরঙের চা পান করাতে নিয়ে যাবেন কায়সার ভাই?

রবিন কথা ক্যাচ ধরে বললো,
— চলো আমি নিয়ে যাই।
— তোমাকে মৃন্ময়ী আপু ডাকছে রবিন ঐ দেখো…

সত্যি সত্যি মৃন্ময়ী ডাকছিল ‘এই রবি এই রবি’ বলে। আমার বর আর আমায় বলতে পারলো না ‘যে ডাকার ডাকুক গে তুমি আমার সাথে চলো’। কাঙ্ক্ষিত সেই কথাটি কায়সার ভাই বললেন,

— আমি আপনাকে ডাকছি শবনম, চলুন সাতরঙা চা পান করে আসি। একসাথে রিক্সায় পাশাপাশি বসে যেতে আপত্তি নেই তো?’

রবিন মৃন্ময়ীর দিকে এগোতে যাচ্ছিলো, কায়সার ভাইয়ের কথায় থমকে দাঁড়ালো। ও আমার দিকে ফিরে তাকানোর আগেই বললাম,

— না একদম না।

কায়সার ভাই আর আমি সৈকতে বাঁধ দেয়া কংক্রিটের স্লাবের ওপর পা ফেলে চঞ্চল পদক্ষেপে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছি। অনেকটা শিশুসুলভ কাণ্ড বলতে যা বোঝায়। লক্ষ্য রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সা স্ট্যান্ড।
রিক্সায় ওঠার সময় কায়সার ভাই হাত ধরে উঠতে সাহায্য করলেন শাড়ী পরেছিলাম কিনা তাই। একবার সী বীচের দিকে তাকাতে ভুললাম না দুজনের কেউই।

রবিন এখনো সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। মৃন্ময়ী এসে রবিনের হাত জড়িয়ে ধরলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো কায়সার ভাইয়ের সুন্দরী ওয়াইফ। কিন্তু আমার বর তা পারলো না। সে মৃন্ময়ীর হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে। কায়সার ভাই বললেন,

— কী করবো শবনম, আমি নেমে যাই?

একটা বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কায়সার ভাইয়ের হাত ধরে তাঁকে নামতে বাঁধা দিয়ে রিক্সাওয়ালাকে বললাম,

— মামা লাবণী পয়েন্টে চলুন আমরা রিক্সা ভ্রমণে বের হয়েছি। কোনো তাড়া নেই আরামে যান।

রিক্সা চলতে শুরু করলো। বা’হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দু’চোখের কোণ ভিজে ওঠা পানিটুকু মুছে নিতে নিতে কায়সার ভাইকে বললাম,

— আমি কিন্তু সত্যিই জানি না লাবণী পয়েন্টে সাতরঙা চা পাওয়া যায় কিনা।

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন কায়সার ভাই। হাসতে হাসতে বললেন,

— চলুন তাহলে সিলেট যাওয়া যাক। অই মামা সিলেট যাইতে রিক্সায় কত ভাড়া নিবেন?

এবার রিক্সাওয়ালা মামাসহ আমাদের দম ফাটানো হাসিতে যোগ দিলেন। আমরা যেতে যেতে পথিমধ্যে চিনাবাদাম কিনলাম।

(চলবে)

©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here