চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৩
রবিন বান্ধবীকে পেয়ে যেন আমাকে ভুলে গেল। মানে পাশাপাশি তো থাকি কিন্তু এক থাকি না।
তৃতীয় দিনে রবিনের পরিচিতের সংখ্যা বাড়লো। আরও কয়েকজন বন্ধু এসে জয়েন করলো রবিন আর মৃন্ময়ীর সাথে। মৃন্ময়ী বাদে অন্যরা সী প্যালেসে উঠেছে। মৃন্ময়ী জানতো। ওরা দলবেঁধে এসেছে। সবাই কলেজ জীবনের বন্ধু। মৃন্ময়ী একাই মেয়ে বান্ধবী। বাকিরা ছেলে। যার যার ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। ছেলে বন্ধুদের বউদের সাথে মৃন্ময়ীর দারুণ ভাব। কতকালের বান্ধবী যেন তারা। অবাক হয়ে খেয়াল করেছি সবগুলো ছেলে বন্ধু মৃন্ময়ীর সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে থাকে। অবশ্যই বউদের নজর এড়িয়ে। শুধু রবিন ব্যতিক্রম। আমার সামনে মৃন্ময়ীর প্রতি রবিন মুগ্ধতা লুকানোর চেষ্টা করে না। হানিমুন ট্রিপ কখন ফ্রেন্ডস হ্যাং আউট হয়ে গেল রবিন টের পেল না। কেবল সবার মাঝে আসরের মধ্য মণি হয়ে আমি একা হয়ে গেলাম। চতুর্থ দিনে স্পেস দিলাম রবিনকে। বন্ধুদের সাথে বারবিকিউ নাইট পার্টিতে চলে গেল খুশী মনে।
মাথাব্যথার অজুহাতে হোটেল রুমেই রয়ে গেলাম আমি।
রাত এগারোটা বাজে তখন। অদ্ভুত এক বিষন্নতা গ্রাস করে নিল আমায়। রুমে দমবন্ধ হয়ে আসছিল।
একা একাই বীচে চলে এলাম। অস্বস্তি হলো। চারদিকে কাপলরা জোড়ায় জোড়ায় বীচ সোফায় একান্তে সময় কাটাচ্ছে ছাতার নীচে। ভাবলাম, কিছুক্ষণ থেকে ফিরে যাবো। আলো আঁধারির খেলায় রাতের সমুদ্রে পা ডুবিয়ে হাটতে ইচ্ছে হলো। তাগা থেকে কেনা ধুসর রঙের লং স্কার্ট আর রুবি রঙের ছোট্ট ফতুয়া পরেছি। ঘরোয়া পোশাক। বের হবার সময় চেঞ্জ করতে ইচ্ছে হয়নি। গলায় স্কার্ফ জড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওড়না পরতেই হবে এমন সঙ্কীর্ণ মানসিকতা অবশ্য আমার ভেতরে কাজ করে না। ইচ্ছে হলে পরি নইলে নয়।
ঝুঁটি বাঁধা চুলগুলো খুলে দিয়ে দু’পাশে ছড়িয়ে দিলাম।
কোমড় ছাপানো আমার এই রেশমের মত চুলগুলো বাবার খুব পছন্দের। তিনি নিজেই ছুটির দিনে আমার মাথায় অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করে দিতেন। সপ্তাহান্তে এই কাজটি করা বাবার রুটিনে বাঁধা ছিল।
এখন মনেহয় সমুদ্রে জোয়ারের সময়। একটু অদূরে শুকনো বালুর ঢিবির ওপর পায়ের স্যান্ডেল জোড়া খুলে রেখে এসেছি। স্কার্টটা এক হাতে গোড়ালি পর্যন্ত তুলে আলতো পায়ে সমুদ্রের ছোট্ট ছোট্ট উপচে পড়া ঢেউয়ের বুকে যেইনা পা রেখেছি, হিম শীতল পানির ছোঁয়ায় গা কাঁটা দিয়ে উঠলো। একটু পরেই অবশ্য সয়ে এল। এ এক অন্যরকম অনুভূতি।
শুনেছি সমুদ্রের কাছে একাকী আসতে নেই। কখনো আসিনি এবারের ট্রিপের আগে। শুনে হাস্যকর লাগলেও এমুহূর্তে বুঝতে পারছি সমুদ্র অবগাহনে কেন একাকী আসা বারণ। নিজেকে শূন্য অনুভব মানুষকে মৃত্যু কাছে টেনে নেয়। সমুদ্রের নিঃসঙ্গতা আর শোঁ শোঁ ধ্বনি আমায় যেন নিবিড় আলিঙ্গনে নিতে তৈরি।
বলে, ও সাগর কন্যা এই দেখো আমি তোমার মতই একা। এস, আমাতে আছড়ে পড়ো। কোনো ভয় নেই। সমুদ্র নির্ভীক। সদা প্রস্তুত শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দিতে। এস হে সাগর কন্যা… আহা মন! কত কী ভেবে নেয় অকারণ।
বীচের লোনাপানিতে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হাটু অব্দি নেমে গিয়েছি।
থেকে থেকে হটাৎ কান্না পাচ্ছে এখানে আসার পর থেকে। কেন কী জন্য জানি না। আমি বরাবরই খুব স্বাধীনচেতা।
অন্যের স্বাধীনতায় সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করিনি কখনো। এই যে রবিন তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে ফেলে বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় চলে গেল। এতে মন্দ কিছু দেখি না।
শুধু মৃন্ময়ীর রবিনের প্রতি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেয়ারিং চোখে পড়েছিল খুব। বুকের মধ্যে খচখচানি কান্নার সূত্রপাত তখন থেকে বেড়েছে। খুব সহজে ওরা বন্ধুরা একে অন্যকে কথায় কথায় ঘনিষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়।
ওদের হাই সোসাইটিতে এটাকে স্বাভাবিক চোখে দেখা হয়। আমি মধ্যবিত্তের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে এটাকে নেগেটিভ দেখি তা নয়। গোঁড়ামি নেই আমার মধ্যে।
কীভাবে কখন জানি রবিনের প্রতি প্রথম দৃষ্টির সেই মোহজাল ছিঁড়ে গিয়েছে আমার।
শরীরের টানে রবিন কাছে এলে ওর সম্মোহনী স্পর্শের ভালোবাসায় নিজেকে মিস ইউনিভার্স মনে করায়।
আসলেই কী ওর কাছে এত দামী? কেন মনেহয়, এক আমি ছাড়া ও কিচ্ছু বোঝে না।
দুজনের একসাথে শাওয়ার নেয়ার সেদিনের সেই সন্ধিক্ষণে রবিন গভীর আদরের আবেগঘন এক মুহূর্তে বলেছিল, আমার শারীরিক সৌন্দর্য ছাপিয়ে ও আমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিল।
চাকরি প্রথম পাঁচদিন সে নাকি কম করে হলেও পঞ্চাশ বার আমার গ্লাস কেবিনের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করেছিল অকারণে। আমি একবারও চোখ তুলে দেখিনি কে এল গেল। এটা ভাবিয়েছে রবিনকে।
আমার সহকর্মী ছেলেরা একটু বেশিই এটেনশন দিত আমায়। রবিনের ভালো লাগেনি। বোর্ড অভ ডিরেক্টরদের মিটিংয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের এক সিনিয়রের আমার কাজকে নিয়ে প্রশংসা নাকি রবিনের মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল। সিনিয়র কেন বলল,
“শবনম শিশিরের মতই স্নিগ্ধ আর খুব কাজ পাগল মেয়ে। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট, হার্ড ওয়ার্কিং এই মেয়েটি দ্রুতই উন্নতি করবে। ওর প্রতি এক্সট্রা এফোর্ট দিলে অফিস উপকৃত হবে।”
রবিনের অসহ্য লেগেছিল তখন। চেয়ারম্যান স্যার সিনিয়রের কথা গুরুত্ব সহকারে নেয়ায় রবিনের মনে হয়েছিল আমাকে সে খুব শীঘ্রই হারিয়ে ফেলবে। আর তাই এই ‘উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’।
দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে সময় লাগেনি আমার। বউকে নিয়ে পরপুরুষ জনিত নিরাপত্তা সব স্বামীরাই চায়।
যদিও সব পুরুষ সেই নিরাপত্তা তার নিজেস্ব রমনীকে দিতে নারাজ। রবিন নিজেও তাই।
সমুদ্রে নামার পূর্ব শর্ত হলো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। ক্ষণে ক্ষণে পা বদলাতে হবে। নইলে ঢেউয়ের তোড়ে চোরাবালি কখন গ্রাস করে নেবে কেউ বলতে পারে না।
হাটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়া সমুদ্রের পানিতে দাঁড়িয়ে এক মনে ভাবতে থাকা আমি অনেকক্ষণ হলো পা বদলাইনি। গোড়ালি ডুবে গিয়েছে পানির নীচের নরম বালুতে।
সায়মনের বীচ একরত্তি। এখানে সমুদ্রের পানিতে সহজে কেউ নামে না।
বর্ষায় রমরমা ব্যবসা না হলেও সমুদ্র পাগল প্রেমীদের সমুদ্র দেখার লোভ এই সিজনে জাগে বেশি।
উত্তাল তরঙ্গের ঢেউয়ে পাল্লা দিয়ে সাঁতরানোয় ওদেরকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। বীচ পুলিশরা এসময়ে দিনে রাতে ওভারটাইম টহল দেয়।
সাধারণত সমুদ্র দেখতে আসা দর্শনার্থীদের সাগরে হারিয়ে যাবার মত ঘটনা জুলাই অগাস্টে বেশি ঘটে।
একটা তীব্র বেগে ধেয়ে আসা ঢেউ আমাকে ভারসাম্যহীন করে দিল।
উল্টে পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে লোহার সাঁড়াশির মত শক্ত দু’হাত খপ করে ধরে। পরমুহূর্তেই শূন্যে ভাসিয়ে কোলে তুলে নেয় আমার টলে ওঠা শরীরকে।
কয়েক মুহূর্ত বুকের সাথে শক্তভাবে চেপে ধরে রইলো। দুজনেই দুজনের হার্টবিটের স্পন্দন জোরালো অনুভব করছি। আমি ভয়ে, সে কীসে জানি না।
আরেকটু হলে কী হতো কে জানে। এই রাতে ঢেউয়ের তোড়ে চোরাবালিতে ডুবে হারিয়ে যেতাম যদি কেউ কী জানতো কী পরিণতি হয়েছিল আমার?
ছোট থেকে এত এত টানাপোড়েনে বড় হয়েছি মৃত্যুকে এসবের ভেতর আপন লাগতো বেশি। এখন ভয় লাগছে কেন?
সম্ভবত সাগরজলে ভেসে যাওয়ার চেয়ে অচেনা কেউ এভাবে রাতের অন্ধকারে এসে জাপটে ধরবে এটা আমার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারছে না।
‘অচেনা’ শব্দটা মনে হতেই গা মুচড়ে কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
এ সময় সমুদ্রের জোয়ারের শোঁ শোঁ গর্জনের মাঝ থেকে চিৎকার দিই যদি, বীচ পুলিশের কান পর্যন্ত পৌঁছবে না।
— আগেই বুঝেছিলাম এই পাগল মেয়ে সমুদ্রেই ঝাঁপ দেয়ার সুযোগ খুঁজছে। কী ঘটতে যাচ্ছিলো বলুন তো?
ধমকে উঠলো কেমন চেনা চেনা পুরুষালী কন্ঠ। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। চোখ মেলে দেখি শাওকাত!
ওর বুকের মাঝখানটায় তুলে নিয়েছে আমায়। আলো আঁধারীতে ওর রাগী চোখ দৃষ্টি এড়ালো না। আমার জানি কী হলো। শাওকাতের গলা জড়িয়ে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সমুদ্র সমান জমে থাকা অভিমান অশ্রু হয়ে ভাঙছে।
শাওকাত আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিল আমায়। আলতো করে গালে চুমু খেল। আঃ এইটুকু মমতা খুঁজছিলাম আমি। আকন্ঠ তৃষ্ণা জমেছিল প্রাণে না জানি কতকাল ধরে।
এভাবে রবিন কখনো মমতায় ছুঁয়ে দেয়নি। ও শরীরের ভাষা দারুণ বোঝে। হৃদয় হতে হৃদয়ে কথার বিনিময় আসে না রবিনের।
মনের পাপবোধের ঊর্ধ্বে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শাওকাতের কাঁধে চুমু খেলাম।
অস্ফুট আওড়ালাম,
— থ্যাংকইউ ফর সেইভিং মাই লাইফ শাওকাত!
জবাবে সে কিছু না বলে আরও একটি ছোট্ট চুমু খেল গালে। আমায় কোলে নিয়েই হাঁটতে হাঁটতে সায়মন বীচ থেকে অনেকখানি দূরে সরে এসেছে শাওকাত।
সৈকতের শুকনো বালুতে বসলো। কোল থেকে নেমে সরে যেতে চাইলে দ্বিগুণ শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে আমার কান্নাভেজা চোখের অশ্রু চুমুতে শুষে নিচ্ছে। এত মায়া! আহা!
যে মায়ার অনুভূতি রবিনের চুমুতে বিগত দুসপ্তাহ ধরে খুঁজে ফিরছি তার পুরোটাই শাওকাত এই এইটুকু আদরে পূরণ করে দিল।
জানি না কী ঘটে গেল আমার ভেতরে। অনুভূতির তীব্রতায় হটাতই শাওকাতের ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়েই মুখ সরিয়ে লুকোলাম ওর বুকে। আর অমনি সে আমায় পাঁজরের সাথে পিষে ফেললো। প্রসন্ন উষ্ণতায় জড়িয়ে নিয়ে অভিমানে ঈষৎ ফুলে ওঠা আমার দু’ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল শাওকাত।
অনেকটা সময় কেটে গেল এভাবে। এরচেয়ে বেশিকিছু চাইনি আমি। সেও না।
চুমুর আলিঙ্গন শেষে আমার মুখখানি মুখোমুখি নিয়ে ঘনিষ্ঠ আবেগ জড়ানো গলায় মধুরশ্রুতি ঝরালো শাওকাত।
বলল,
— শোনো শবনম, বেশিকিছু নেই আমার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাবার একটি ছোট্ট বাড়ী আর নিজের চেষ্টায় গড়া একটি ছোট্ট গাড়ী মেরামতের গ্যারাজ আছে আমার।
সারাবছর টাকা জমাই বাবা মা ভাইবোনদের নিয়ে সপরিবারে এখানে বেড়াতে আসার জন্য। বিলাসিতা বলতে কেবল এইটুকুনই।
মোটামুটি স্বচ্ছলতায় চলে যায় আমার মায়ের সংসার। ভাইবোনকে মানুষ করার চাপ আছে আমার।
এখনই বেশি কিছু দিতে পারবো না। আপাতত দু’গাছি সোনার চুড়ি আর কানে একজোড়া ঝুমকো দিয়ে তোমাকে আমার করে নিই যদি, চলবে তোমার?
বিস্ময়ে বোবা বনে গিয়েছি আমি। কী বলছে মানুষটা ঘূর্ণনের মত মাথা ঘুরছে মুখে কথা সরছে না।
আমার এ হাল দেখে শাওকাত বাহুর বন্ধন আরেকটু শক্ত করে এঁটে নিয়ে এক হাতে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আনমনা হয়ে বলল,
— সেদিন ভোরে হোটেল রুমের ব্যালকণি থেকে বৃষ্টিস্নাত তোমায় দেখে ছুটে এসেছিলাম। তুমি দেখতে কেমন জানতাম না। শুধু মন বলছিল, ঐ অদূরে সৈকতে নিঃসঙ্গ যে মেয়েটি ওখানে ওমন করে দাঁড়িয়ে, ও আমার।
তুমি ম্যারিড শুনে কেমন চমকে উঠেছিলাম মনে আছে?
মন ভেঙে দিয়েছিলে জানো! বড্ড কষ্ট পেয়েছিলাম। এই কয়দিন তুমি আমায় দেখতে না পাওয়ার এটাই কারণ। নিজেকে রুম বন্দী করে নিয়েছিলাম।
পরিবারের সবাই ঘোরাঘুরি করেছিল। আমি যাইনি। মনে জ্বর এসেছিল আমার। যার দাওয়াই তুমি ছিলে।
মধ্যরাতে প্রতিদিনই এখানে তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনে কেটেছে এ ক’টা রাত। তুমি আসোনি কেন শবনম?
— আমি এখনও ম্যারিড।
— কিচ্ছু এসে যায় না। এমুহূর্তটুকু আমাদের। এবং এই অনুভূতি সত্য। ভুল করে কিছু ঘটেনি। নিষ্পিষ্ট মনে আমরা নিজেরা নিজেদের অজান্তে একে অন্যকে খুঁজছিলাম।
তুমি চাইলে অবশ্য তা অস্বীকার করতে পারো যদি সত্য বলতে না চাও। আমি সত্যই বলবো। প্রথম কোনো নারীর ঠোঁটে চুমু খেয়েছি। সে আমার হয় না কী করে? ২১ বছরের অপেক্ষা এত ঠুনকো!
— ২১ বছর!
— একটি ছেলের বিয়ের চাহিদা শুরুই হয় ২০ থেকে পঁচিশে। আমি ৪১ এ দাঁড়িয়ে।
— এরমধ্যে কেউ আসেনি?
— এসেছিল। বেশি বাবা মা পরিবার পরিজন ভক্ত বলে বিয়েগুলো ভেঙে যায়। পাত্রপাত্রীর প্রাথমিক কথাবার্তায় মেয়েগুলো আমার বক্তব্য শুনে কেমন বিভৎস তাকাতো, যেন আমি মানুষ নই সায়েন্স ফিকশনের কোনো এলিয়েন।
— প্রেম হয়নি?
— না। অক্লান্ত পরিশ্রমী শরীরের বয়স বাড়ছিল যত একটি বউয়ের অপেক্ষা ছিল ভীষণ। মায়ের প্রতি বাবার প্রেম, মায়ার গভীর আবেগীয় টান আমাকে আমার বউয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শিখিয়েছে।
শাওকাতের কথায় বুকে অসহনীয় জ্বলুনি অনুভূত হলো। আমি সদ্য বিবাহিত। মন যতই চাক এত সহজে কী জীবনকে আমূল বদলে নেয়া যায়? মধ্যবিত্ত অতি সাধারণ একটি পরিবারের অনুশাসনে বেড়ে ওঠা আমি কীভাবে পারি আমূল বদলে যেতে.. না না এ অসম্ভব।
একবেলার পরিচয়ে এত বিশ্বাস কীভাবে জন্মে মানুষের?
কত অনায়াসে সে বলে দিল সে তার মত করেই নাকি আমি তাকে খুঁজছি!
আসলেই কী তাই! খুঁজছিল আমার মন তাকে? দুর্বলতায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই কঠিন স্বরে বললাম,
— রুমে ফিরবো আমি।
— চলো নিয়ে যাই।
— আমাদের মাঝে যা কিছু হলো প্লীজ ভুলে যাবেন।
— আচ্ছা।
— সত্যি ভুলে যাবেন তো?
— মিথ্যে বলি না। যে আমার নয় তাকে মনে রাখবো কেন, কোন অধিকারে?
ভীষণ অভিমানী হলো শাওকাত। চোখ সরিয়ে আমায় কোল থেকে বালুর সৈকতে বসিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
রাত দুটোয় রুমে ফিরলাম। রবিন এখনো ফেরেনি। লোনাপানিতে ভেজা বালু মাখামাখি কাপড় বদলে লম্বা শাওয়ার নিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি বাঁধ ভাঙা কান্নায় ভেসে যাচ্ছি।
শাওয়ার শেষ করে এসে ব্যালকণির দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে ধপ করে বসলাম। বিষাদ মনের ভার শরীর বইতে পারছে না। এত ভারি কেন আমি!
ভেজা চুলের পানিতে ভিজে গেল পরনের টপস, শাড়ী আঁচল।
ঝিরিঝিরি শ্রাবণ বৃষ্টি নামলো।
বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছে বারান্দা, ভিজছি আমি। কী এক অচেনা মোহমায়ায় বুঁদ হয়ে দু’চোখ জলে ভেসে গেল।
কন্ঠ ভেঙে বের হয়ে এল এক ব্যথার রোদন সুর..,
‘কেউ যখন আর নেই পাশে
তন্দ্রা মগন কোনো আকাশে
দুঃসময়ের নিঃশ্বাসে গোধুলীর খেলা
দিনশেষে নিয়ে আসে.. মায়া তোর পানে
মায়া তোর গানে..
মায়া তোর কাছে…. যাই চলে
শান্ত নদী ঢেউ ডাকে কাছে
সন্ধ্যা নামে.. স্বপন ফিরে আসে পাছে
রূপকথা জীবনে তবু রয়ে যায়
সাদাকালো যা ছিল সেখানে রঙ বোনে
মায়া তোর পানে.. তোর খেলা যে খেলা
সে যেন মিছে খেলা
তোর খেলা যে খেলা সে যেন মিছে গোধুলীর খেলা
দিন শেষে নিয়ে আসে মায়া তোর পানে..
ভুলে যাবার তেমন আর কিছু নেই
তবু তোর কথা মনে পড়লেই
রঙধনু উঠে আকাশের সীমানায়..
যাচ্ছে চলে সবই তো শুধু চিরস্থায়ী
মায়া তোর পানে…
তোর খেলা যে খেলা
সে যেন মিছে গোধুলীর খেলা
দিন শেষে নিয়ে আসে মায়া তোর পানে.. মায়া…’
ফুঁপিয়ে সশব্দে কেঁদে ওঠা কন্ঠ ভারি হয়ে এল। পাশে কোথাও থেকে ধরা গলায় কেউ ডাক দিল নাম ধরে,
— শবনম! এই মায়া এদিকে এস।
এদিকওদিক খুঁজে ব্যকুল হয়ে তার দিকে হাত বাড়াই। ছুঁতে পারি না কেন! আমি তাকে কিছুতে ছুঁতে পারি নাহ।
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা