চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৫

0
129

চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৫

বন্ধু নজরুলের ওয়াইফ রেবেকা মোবাইলে কী যেন দেখছে মুগ্ধ হয়ে। ওর সঙ্গে জুড়েছে বাকি সব কয়টা বন্ধুর বউয়েরা, সাথে রাজুর কিছু কাজিন সিস্টার্স। কী দেখছে বোঝা মুশকিল মেয়েদের কিচিরমিচির আওয়াজে।
ভোরবেলার কথা মনে পড়লো। উন্মাদের মত ছুটে ছিলাম রাজুকে ডাকতে। ওর ঘরের দরজায় নক দেবো ঐ মুহূর্তে মৃন্ময়ী খপ করে হাত ধরে নিজেদের থাকার ঘরে নিয়ে এল। বোঝালো এভাবে রিএক্ট করলে সবাই জানাজানি হবে এতে করে আমারই নাকি প্রেস্টিজের বারোটা বাজবে। সাথে রাজুরও। এখানকার সবাই জানে মৃন্ময়ী আর আমি ম্যারিড কাপল। সেই খেসারত টানতে হবে মুখ বুজে আমাকেই।
শবনমের জন্য বুকটা ভারি হয়ে এল। তুমি ভীষণ অভিমানী শবনম। কিছুটা অভিমান কমিয়ে যদি অধিকার সচেতন হতে, আমাকে জোর করে নিজের করে রাখতে যেমন আমি রাখি তোমাকে, এদিন এই পরিস্থিতির তৈরি হত না। কেন আসতে দিলে আমায় শবনম? কেন মৃন্ময়ী হতে আমায় সরিয়ে আগলে রাখলে না? আমি যা চাইবো তাই হতে কেন দাও তুমি… ওহ শবনম তুমি বাধ্য বউ না হয়ে একটু কেন জেদি, প্রতিবাদী হলে না? একটু ঝগড়া করতে, মারামারি, চেঁচামেচি। না’হয় রাগে কামড়ে আঁচড়ে দিয়ে স্যুইটের দরজা বন্ধ করে বাঁধা দিতে। কেন দিলে না শবনম? নিজের স্বামীকে কেন বল্গাহীন ছেড়ে দিলে? কেন সবাইকে নিজের মত বিশ্বাসী ভাবো শবনম। আমি বিশ্বাসী হতে পারিনি আমায় ক্ষমা করে দিও শবনম। এই শেষ। আর তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। একটুও কষ্ট পাও এমন কাজই করবো না। এবার রবিন ফিরবে শুধুই তোমার হয়ে।
আমায় ক্ষমা করি দিও শবনম….. আত্মোপলব্ধির আত্মগ্লানিতে কেঁদে ফেললাম।
মৃন্ময়ী চমকে গেল। আমায় কাঁদতে দেখে ও কী বুঝলো জানি না তবে আমাকে কাছে টেনে নিল। উষ্ণ আদরে শুষে নিল অশ্রু। একটা পর্যায়ে ফের মাতাল করা আহ্বানে আমায় বিবশ করে দিল মৃন্ময়ী।
তীব্র আত্ম দহনের মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক শরীরি এ আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারিনি।
না কোনো প্রেমিক হিসেবে নয়। একজন রেপিষ্ট হয়ে টানা দুই ঘন্টা মৃন্ময়ীকে ফ্লোরে ফেলে রেপ করেছি। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল নইলে পশুর মত মৃন্ময়ীকে খুবলে খেতাম না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ব্যথায় অঝোরে কাঁদলেও মৃন্ময়ী আমাকে একটু বাঁধা দেয়নি। বরং অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেও সে সাড়া দিচ্ছিলো, আর এটাই আমাকে প্রচন্ডভাবে রাগিয়ে হিংস্র করে তুলছিল বার বার। মৃন্ময়ী দমে যাওয়ার পাত্রী নয় জানতাম। কিন্তু নিজেকে এতটা অসম্মান করে দেবে ভাবিনি।

সকাল হয়ে গেছে। বাইরে থেকে ভেতরে বিয়ে বাড়ীর শোরগোল ভেসে আসছে। মৃন্ময়ীকে ছেড়ে উঠে আসবো এমন সময় মৃন্ময়ী নিজেই আমাকে ফের কাছে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— অনেক তো হিংস্রতা দেখালি এবার একটু ভালোবাসার প্রলেপ মেখে দে রবি প্লীজ জাস্ট কয়েক মিনিট সব ভুলে তুই আমার হয়ে যা।

মৃন্ময়ীর কান্নায় মায়া হলো খুব। ওকে কাছে টেনে নিলাম সেই প্রথম দিনের রুম ডেটের মত করে। আমার ভালো লাগলো ভাবতে দুজনের ফার্স্ট রুম ডেটের সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করতে। মৃন্ময়ী ফিসফিসিয়ে জানালো তারও মনে পড়ছে সেসময়ের কথা। আমরা নষ্টালজিক হয়ে উন্মাতাল সময় কাটালাম সেই প্রথম দিনের অনুভূতি নিয়ে। মন থেকে কখন শবনম হারিয়ে গেছে টের পাইনি। আসলে ঐমুহূর্তে মনেই আসেনি শবনমের কথা। ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে মৃন্ময়ীকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। বিনিদ্র রাত্রির ক্লান্তি তো ছিলই। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগমুহূর্তে মৃন্ময়ীকে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললাম,

— কায়সার ভাইয়ের আম্মা মারা গিয়েছে। কায়সার ভাই তোকে, আমাকে আমাদের কাউকে রিচ করতে না পেরে শবনমকে টেক্সট করেছে। তুই যাবি? গেলে বল এ্যারেঞ্জমেন্ট করি।

মৃন্ময়ী নিরুত্তর। কিছু না বলে আমার বুকের মধ্যে এসে মুখগুঁজে দিল। এর পর পরই ঘুমিয়ে তলিয়ে গেছি দুজনেই।
আমার সেই ঘুম ভাঙলো অনেক বেলা করে। সাড়ে এগারোটা বাজে। তাকিয়ে দেখি মৃন্ময়ী তখনো আমার সাথে মিশে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। ওর মেয়ে দুটো বেডে নেই। অস্বস্তি নিয়ে উঠলাম। ছিঃ কী হয়ে গেল এটা! বাচ্চারা কী ভাবছে… ড্যাম! কাজটা ঠিক হয়নি মোটেও ঠিক হয়নি।

শাওয়ার নিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বাইরে আসতে চোখে পড়লো বারান্দায় পেতে রাখা গালিচায় বসে মেয়েদের মোবাইল দেখা নিয়ে এই জটলা।
কী দেখছে অমন মনোযোগ দিয়ে জিজ্ঞেস করতে যাবো, কানে ভেসে এল অপূর্ব সুন্দর মোহময়ী দ্বৈত কন্ঠে গেয়ে ওঠা গানের সুর…

“তোমার হৃদয় পানে হাঁটতে গিয়ে পথ
সরে যায় দূরে দূরে
ভালোবাসার আশায় এপাড় ওপাড় আমি
মরি ঘুরে ঘুরে

কেবল যাই সরে সরে দূর বহুদূরে
ভেতর ঘরে কে খায় কুড়ে কুড়ে

শূন্য এ রাত চলে যায়
একেলা প্রহর ঘিরে আমায়
কেন তুমি এলে না ফিরে
বাঁধার নদী পেরিয়ে ধীরে

জীবন নদীর এই দুই তীরে
তোমার কল্লোল আছে ঘিরে
দূরে গেলে কাছে আসি
কাছে এলে যাই দূরে দূরে

কেবল যাই সরে সরে দূর বহুদূরে
ভেতর ঘরে কে খায় কুড়ে কুড়ে……”

গান শেষ হতেই রেবেকা উচ্ছ্বসিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল,
— মার্ভেলাস ভয়েস টোন ওহ শবনম কী দারুণ গাইলে সুইটহার্ট জাস্ট লা-জওয়াব!

সবাই সমস্বরে রেবেকাকে সাপোর্ট করে নিজেরাও ভিডিও লিংক নিয়ে শেয়ার করার জন্য শশব্যস্ত ভাবে হয়ে উঠলো। এদিকে আমি স্তব্ধ, জায়গায় স্থির হয়ে আছি।
রাজুর মা এসে মেয়েদের হট্টগোল দেখে জিজ্ঞেস করলো, কী দেখে চেঁচাচ্ছে ওরা। রেবেকা শবনমকে আমার বউ বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

— আন্টি, আমার এক ছোটবোন সায়মন বীচে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যুগল সঙ্গীত পরিবেশন করেছে এই কিছুক্ষণ আগে। আধঘন্টায় সেই গানের ভিডিও ক্লিপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে আন্টি এই দেখুন….

রাজুর আম্মুকে ভিডিও দেখাতে লাগলো রেবেকা। শবনমকে মিসেস রবিন ইফতেখার পরিচয় না দেয়ার কারণ জানা স্বত্তেও আমি সহ্য করতে পারছি না।
একছুটে রুমে এসে নিজেই ফেইসবুকে লগ ইন করে ওয়াচ ভিডিও স্ক্রল করছি। কয়েক সেকেন্ডেই ভিডিও ক্লিপটা শো করলো।
আমার বিস্মিত দৃষ্টি আটকে গেল অফ হোয়াইট জামদানীর নীল আঁচলে জড়ানো অপার সৌন্দর্যের অধিকারী এক অপরূপার দেহসৌষ্ঠবে। সে আর কেউই না, আমার শবনম। আমার প্রিয়তমা মিসেস রবিন ইফতেখার।
মাত্র আধঘন্টায় হাজার হাজার রেসপন্স, কমেন্টস, শেয়ার.. পোস্টের রিচ দেখে অবাক হলাম। সেকেন্ডে সেকেন্ডে এত এত মানুষের শুভেচ্ছা বার্তায় কমেন্ট বক্স ভরে যাচ্ছে। বেশিরভাগই “ওয়ান্স মোর ওয়ান্স মোর” কমেন্ট। লাইভ কনসার্ট ছিল এটা বুঝতে বাকি রইলো না। একটা কমেন্টে চোখ আটকে গেল। কমেন্টদাতা লিখেছে,

“যুগলবন্দীকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা। আপনাদের সুখী দাম্পত্য জীবন কামনা করি। গানের কথার মতই রোমান্টিক হোক আপনাদের আগামীর পথচলা। শুভকামনা প্রিয় জুটি।”

কলিজা খামচে ধরে ভিডিও ক্লিপটা বার বার ফরোয়ার্ড করে দেখার চেষ্টা করছি যুগলবন্দীর ছেলেটা কে তা দেখার জন্য। নাহ দেখা যাচ্ছে না। যে’ই ভিডিও করে থাকুক সে গিটার হাতে গায়ক ছেলেটির পিঠের দিক থেকে ভিডিও করেছে। যারফলে গায়কের সম্মুখে বসে থাকা শুধু শবনমকে একপাশ থেকে দেখা গেল। শবনমের পরনের শাড়ী নজর কাড়লো। এ শাড়ী আমার কিনে দেয়া নয়। লাগেজে আনা হয়নি। শবনম শাড়ী কিনলো কখন!
বুকের মধ্যে নানান আশঙ্কায় অস্থির তোলপাড় শুরু হলো। বাইরে বের হয়ে এলাম। বন্ধুরা জেঁকে ধরলো ট্রিট দেয়ার জন্য। কানে কানে বলল, তোর মিসেস দারুণ সুকণ্ঠি রে। ভিডিওতে মা শা আল্লাহ অপ্সরী লাগছে ভাবীকে।

আমার ওদের ফিসফাস একদমই সহ্য হলো না। প্রায় জোরেই বললাম,
— শবনম আমার মিসেস একথা চোরের মত ফিসফিসিয়ে বলছিস কেন কী সমস্যা তোদের?

কোত্থেকে মৃন্ময়ী এসে আমার মুখ চেপে ধরলো। রাজু অনুনয় করছে চুপ থাকতে। ওর আব্বু আম্মু শুনে ফেললে বাজে হবে। সবার সব অনুরোধ রাখতে গিয়ে প্রচণ্ড আক্রোশে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি।
এই চক্রব্যূহে দম আটকে আসছে আমার এটা ভাবতে গিয়ে শবনমের সাথে যুগলবন্দীতে ছেলেটা কে ছিল! বার বার কমেন্টের কথাগুলো দেখছি মোবাইলে। ইতিমধ্যে আরও অসংখ্য কমেন্টদাতা যুগলবন্দী দুজনকে সেইম উইশ করছে।
পাঁজর মুচড়ে উঠলো ব্যথায়। নিতে পারছি না ভিউয়ার্সদের কমেন্ট। সহ্য হচ্ছে না শবনমের সম্মুখে বসে থাকা ব্যক্তিটিকে।
হাতের মোবাইল মাটিতে আছাড় মার‍তে নিলে বন্ধু নজরুল ধরে ফেলল। সাথে সাথেই নজরুলের ওয়াইফ পিঞ্চ করলো,

— রবিন ভাইয়া আবার জেলাস ফিল করছেন নাতো যুগলবন্দীর সঙ্গীত পরিবেশনায়? কেবলই তো গানের যুগলবন্দী। তা’ই সহ্য করতে পারছেন না। ভাবুন, মৃন্ময়ী আর আপনার ব্যাপারটি ভাবী যখন জানবে তখন সে কী রিএক্ট করবে? পারবেন শবনম ভাবীকে ধরে রাখতে? আই ডোন্ট থিংক সো… ভাবীর জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে নজরুলকে ডিভোর্স দিয়ে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াতাম। ঘেন্না করি এমন হাই সোসাইটির লাইফস্টাইল। যেখানে দোস্তির নামে নষ্টামো চলে।

রেবেকা যেন পিঞ্চ করলো না, এক বালতি এসিড ঢেলে দিল আমার মাথায়। মৃন্ময়ীর কিছুই এল গেল না। সে ভ্রুক্ষেপহীন। লজ্জায় অপমানে বুকের ভেতর অসহ্য জ্বলুনি নিয়ে আমি এখনও শবনমের ভিডিও ক্লিপ দেখছি। মেয়েটি গাইছে, কিন্তু গাওয়ার সময় একবারও তার সামনে বসা ছেলেটির দিকে চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত। দৃষ্টি অবনত রেখে আকুল হয়ে গান গাওয়া মেয়েটির ঠিক এই রূপের প্রেমে পড়েছিলাম ওর অফিসের প্রথম দিনেই। না আমি কিছুতেই তোমাকে আমায় ফেলে ফিরে যেতে দেবো না শবনম। কিছুতেই না। আমার স্রেফ তোমাকে চাই মাই লাভ… শুধু তুমি চাই। চোখ ভরে এল শবনমকে মিস করতে যেয়ে। কমেন্ট বক্সের কমেন্টগুলো আর জুটিতে সীমাবদ্ধ নেই। স্বামী স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। আর আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মৃন্ময়ী আমার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে রাগে উঠে চলে গেল। রাজু আর নজরুল এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। রাজু অস্ফুটস্বরে বলল,

— বলেছিলাম আমার মন কু ডাক ডাকছে….

নিশ্চিত জানি এটি শাওকাতের কারসাজি। নইলে হোটেল কতৃপক্ষের জানার কথা নয় আমি গাইতে পারি। তাদের রিকোয়েস্টে শাওকাতের সাথে একটি ডুয়েট গেয়ে স্টেজ থেকে নেমে আসতে নিলাম। দর্শক সারি থেকে “ওয়ান্স মোর” ধ্বনি উঠলো। ‘সরি’ বলে স্টেজ থেকে নামার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। হটাৎ একটি মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে আমার শাড়ীর কুঁচি ধরে নামতে সাহায্য করলো। মেয়েটি বয়সে আমার কাছাকাছি হবে। দেখতে ভারি মিষ্টি আর আদুরে। সাহায্য করার জন্য সস্নেহে ওর গোলাপি গাল টিপে দিয়ে বললাম,

— থ্যাংকইউ ডিয়ার! কী নাম আপনার?

— এনিটাইম আপু! আমি সেবা ইসলাম। শাওকাত দা’ভাই আমার বড়ভাই। উনিই চোখ ইশারাতে আপনাকে নামতে সাহায্য করতে বললেন।

— ও তাই!

— আপনি ছবির চেয়েও সুন্দর শবনম আপু। গানের গলা দারুণ! আরেকটি গাইতেন….

সেবার মুখে খই ফুটেছে। চুপচাপ হাসিমুখ নিয়ে শুনছি ওর কথা। একটু পর এসে শাওকাত ওর আব্বু আম্মু আর অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনভাই, দুইবোনের মধ্যে সেবা সবার ছোট। কথায় কথায় আন্টি বললেন সেবা ও শোভা দুই বোনের বিয়ের কথা পাকা হয়ে আছে। একসাথেই দুজনকে তুলে দেবেন। দু’মাস পরেই বিয়ে। আমার কাছথেকে এড্রেস চাইলেন বিয়ের কার্ড পাঠাবেন বললেন। আমি আমার আব্বুর বাসার এড্রেস দিলাম। শাওকাতরা তিনভাই তারপর দুই বোন। ভাই দু’জন পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে জবের ট্রাই করছে। আপাতত দুজনেই টিউশনি করে জানালো। শোভা বিএ পাশ করে আর পড়েনি। সেবা এম এ পড়ছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শাওকাত। কত সহজ সরল মন নিয়ে কথায় কথায় ওরা সবাই যার যার পরিচয় দিল আমাকে। যদিও আমি পারিনি নিজেকে নিয়ে অনায়াসে মুখ খুলতে। টুকটাক আরও কিছু কথা শেষে ওদেরকে অনুষ্ঠানে রেখে একাকী হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সী-গাল বীচে।
আকাশে মেঘ করেছে। দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়ছে সৈকতে। সমুদ্রে এখন জোয়ারের সময়। শুকনো বালুতে কোলাপুরি সু জোড়া খুলে রেখে শাড়ী তুলে নিলাম গোড়ালির ওপর। সাগরজলে পা ভেজাবো। ভেজা বালুতে হাঁটছি।

— তোমাকে এই শাড়ীতে এতটা মানাবে ভাবিনি।

পেছন থেকে শাওকাতের আকস্মিক কথায় থমকে দাঁড়ালাম। সে সামনে এসে মুখোমুখি হয়ে নির্বিকার চেহারা নিয়ে পুনরায় বলল,

— সরি শাড়ীর সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস দিতে ভুলে গিয়েছি। সেজন্যই বুঝি অলংকার বিহীন সাজ! একটু কাজল, লিপস্টিক এঁকে নিলে কী হতো?

লম্বা শ্বাস নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম,

— অফ হোয়াইট জামদানীতে রয়েল ব্লু পাড় ও আঁচল। আপনার নিজের আউটফিটের সাথে আমার শাড়ীর এই মিল কী ইচ্ছাকৃত?

শাওকাত নিরুত্তর রইলো। বিষন্ন চোখে আমার চোখে চেয়ে থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে বলল,

— গান কে গেয়েছে মিসেস রবিন ইফতেখার নাকি শুধুই শবনম শাহজিদ ইসলাম?

নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম,
— মিসেস রবিন ইফতেখার। এবার বলুন প্রক্সি দিচ্ছিলো কে, রবিনের হয়ে শাওকাত নাকি স্বয়ং শাওকাত?

— আমি আপনার হাজব্যান্ডকে চিনি না, জানি না। তার হয়ে গান গাওয়া মেকি হয়ে যায়। ভেবেছিলাম রিপ্লাই দিচ্ছিলেন।

— প্রথম গানের?
— হ্যাঁ।
— ইশশ সঙ্গেও ছিলাম না তখন। রিপ্লাই দেবো কেন!

— সঙ্গে ছিলেন না বলে বুঝি কানে পৌঁছেনি আর্তনাদ? মেনে নিলাম। সমুদ্র উপভোগ করুন। আমি যাই ওদিকটায় দেখে আসি।

কন্ঠে তার রাগ সুস্পষ্ট। আমাকে অতিক্রম করে শাওকাত সায়মন বীচের দিকে এগোলো। এতক্ষণ নিজেকে সামলে কথা বলছিলাম। অশ্রুর বাঁধ ভাঙলো। সাগরজলে পা ভেজানোর শখ মিটে গেল। সমুদ্র বুঝি কী নিদারুণ উপহাস করছে আমায় দেখে।
মোবাইলে কল আসছে। রবিনের কল। কল লাইন কেটে দিলাম। ফেরার জন্য ঘুরে দাড়াতেই শাওকাতের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে ও ধরে ফেললো। দু’হাতে আমার কাঁধ শক্ত করে ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিল।

— যাননি! চলে গিয়েছেন ভেবেছি।

রাগ চেপে ভরাট অথচ শীতল গলায় শাওকাত বলল,

— কেন মন বলে, কেন মন টানে। যেতে গিয়েও ফিরে আসি বার বার। ভয় লাগে, যদি চলে যাই আর পথ হারিয়ে ফেলে কেউ।

— আমায় হারানোর এত ভয় নিয়ে বাঁচবেন কী করে শাওকাত? চিরদিন থাকতে তো আসিনি।

— জানি না।

— বলুন না দুজনের পোশাকের এই মিল কাকতালীয় নয়?

— ম্যাচিং পোশাকে দেখতে চেয়েছিলাম হাটুর বয়সী এই মেয়েটির পাশে মানিয়ে যাই কিনা। বয়স হলো যে।

— আপনাকে প্রথম দেখায় জুনিয়র ভেবেছি।
— কী! পাগল নাকি!

অভিমানী ধরা গলায় বললাম,
— আমি গাইতে পারি রবিন জানে না। যে জানে গান তারজন্য ছিল। অন্য কারো জন্য না।

— জানি। না বললেও জানতাম। স্বীকার না করলে তাতে কী। সত্যের রূপ বদলে যায় না। অনুভূতি মিথ্যে বলে না।

— তবে রেগে গেলেন কেন?

— অধিকার আছে।

— আমি কষ্ট পেয়েছি।

— আমি বেশি।

— তুমি করে বলবেন না? পর লাগছি তাইনা?

কিছুটা চমকে দিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে শাওকাত বিষন্ন গলায় বলল,

— এস…

ওর ঐ হাতের ওপর হাত রাখতেই পরিশ্রমী কঠোর করতল মুঠোবন্দি করে নিল আমার হাতখানি। টেনে নিয়ে আমার সঙ্গে একসাথে সাগরজলে পা ডোবালো শাওকাত। আমার চোখের পানি সমুদ্রের জলের চেয়েও বেশি। চোখ সরিয়ে আড়ালে মুছে নিলাম সে জল।
রবিন আমার ভেতর বাহির সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। নিজের আত্মিক এ পরাজয়ের গ্লানি গতরাত থেকেই বার বার স্মরণে আসছে আর চোখ ভাসিয়ে নিচ্ছে।
কক্সবাজার থেকে নিভৃত এ প্রস্থান বড্ডবেশি ভোগাবে। যেন আমি এক চোর। পালিয়ে যাচ্ছি নিজেরই তিক্ত অভিজ্ঞতার ছায়া থেকে।

মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। দর্শনার্থীরা হুটোপুটি করে দৌড়। শুধু আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে। বৃষ্টি, অশ্রু মিশে একাকার হওয়ায় নিশ্চিন্তে মনে শাওকাতের দিকে চেয়ে দেখি সেও তাকিয়ে। চোখাচোখি হতেই আমায় কাছে টেনে নিয়ে শক্ত হাতের আঁজলায় আমার গাল দুটো তুলে বলল,

— সহস্র বৃষ্টিকণা শবনমের চোখের একফোঁটা অশ্রু লুকাতে সামর্থ্য নয়। এই সমুদ্রের জলও না। তুমি লুকোচুরি করতে শেখোনি। মন না চাইলে চলো ফিরি।

— সাজিনি বলে আমায় অসুন্দর লাগছে? বলুন?
— না। আমার বউ বউ লাগছো। গরীবের বউ।
— সাজলে বড়লোকের বউ লাগি?
— কী জানি। আমার নও মনেহয়।
— ঠিক এইজন্যই সাজিনি।

শাওকাত চমকে উঠলো। মানুষটা সহজে চমকায় না। প্রাপ্তির স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে গেল শাওকাতের সিক্ত চেহারায়।

আমাদের মত কিছু বৃষ্টি পাগল দর্শনার্থী ভিজতে সৈকতে এল। উঠতি বয়সী ছেলেরা ঘুরে ফিরে কাছাকাছি এসে আমাকেই দেখার চেষ্টা করছে বার বার। ব্যাপারটা বুঝতে পারলো শাওকাত আগে।
নিজের শরীর দিয়ে আমার শাড়ী পরা ভেজা শরীরকে আড়াল করে নিয়ে হোটেল রুম পর্যন্ত আমায় পৌঁছে দিল শাওকাত।
ফিরে যাওয়ার আগে মাথায় গাঢ় চুমু এঁকে শাসিয়ে বলল,

— শাড়ী পরে এটাই শেষ বৃষ্টিতে ভেজা। এরপর আর যেন পাবলিক প্লেসে ভিজতে না দেখি।

বেপরোয়া সুরে বললাম,
— যদি ভিজি?

— শবনম একটি বাধ্য মেয়ে। আমি জানি আমায় কখনো ইচ্ছে করে রাগাবে না সে। যাও ঠান্ডা লেগে যাবে চেঞ্জ করে এস লবীতে কফি নিয়ে অপেক্ষা করবো।

ভেজা শরীরে নিজেদের স্যুইটে ঢুকে ডোর লক করে দিল শাওকাত। পিছু ফিরে চায়নি একবারও। রেগে আছে। ভারি হিংসুটে এক রূপ লুকিয়ে থাকে মানুষটির শান্ত সৌম্য ব্যক্তিত্বে। এমন মানুষের ছত্রছায়ায় চোখবুজে পুরো একটা জনম খেয়ে না খেয়ে নির্বিঘ্নে পার করে দেয়া যায় খুশী মনে।
কিন্তু,
“সে আমার নয়, এটাই হয়তো আমাদের শেষ দেখা”

মস্তিষ্ক ডঙ্কা বাজিয়ে জানান দিল। সময় এসেছে চলে যাবার। সব পাখি নাকি নীড়ে ফেরে না। আমার নিজের কোনো নীড় নেই।
মায়ের আঁচল আর বাবার কোল সংসার বিতাড়িত শবনমের এইটুকুই শেষ আশ্রয়, শাওকাত কখনো জানবে না।

(চলবে)

©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা

(গানের লিরিক লিখেছেন মাসুদ পথিক)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here