ছায়াকরী পর্বঃ১৫

0
501

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১৫
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। তার স্বচ্ছ, খোলা, সচেতন দৃষ্টি। নুয়ায়াম অ্যা/ক/সিডে/ন্টের পর গাড়ি রেখে অন্য গাড়িতে করে মহলে ফিরেছিল। এই গাড়ি জেহেন ফেরত নিয়ে আসে। সে সন্দিগ্ধ! কেউ ব্রেকের তারের সাথে কিছু করেছে। কিন্তু কে?
এটা তো কোনো মানুষেরই কাজ হবে। জেহেন চিন্তিত মস্তিষ্কে তাকাল তেহজীবের দিকে।

তেহজীব উদ্বিগ্ন। জেহেন আর নুয়ায়াম সম বয়সী হওয়ায় তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অনেকটা মিলে যায়। একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার পরও তাদের মধ্যে সুপ্ত টান সবসময় বিচরণ করে। তেহজীবের মধ্যেও তা বিদ্যমান। তিন ভাই একে অন্যের থেকে আলাদা হলেও একের বিপদে অন্যের অংশগ্রহণ সবসময় অবাক করার মতো। বয়সে ছোটো হওয়ায় তেহজীবের সাথে খানিকটা ব্যবহারের তারতম্য রয়েছে বাকি দুইজনের। তবে ভালোবাসা নিরন্তর, নিচ্ছিদ্র, নিবিড়!

তেহজীব গাঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ে–

“নুয়ায়াম ভাইয়ার সাথে কেউ ইচ্ছে করে এমন করেছে?”

জেহেন দৃঢ়চিত্তে বলল—

“কারণ? এই বাড়িতে এমন কে আছে? ”

তেহজীব ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে লাগল। এই বাড়ির পুরুষরা সবাই নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করে। নারীরা যেহেতু বাড়ির বাইরে যায় না, তাই তাদের গাড়ির প্রয়োজন পড়ে না। পদ্মমহলে বাইরের মানুষদের আনাগোনা কম। একমাত্র ভৃত্যবর্গের অবাধ আনাগোনা।
জেহেন ফুলে উঠে। নুয়ায়ামকে কেউ মারতে চায়। এই বিষয়ে সে নিশ্চিত। ছোটোবেলা থেকেই বিভিন্ন সময়ে নুয়ায়ামের ওপর হা/ম/লা হয়। তোভিয়ার মতো নুয়ায়ামকেও দিঘীর জলে ডু/বি/য়ে দেয় কেউ। তিনদিন পর হুশ ফেরে নুয়ায়ামের। এরপর থেকে দিঘীর আশেপাশেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নুয়ায়াম ভীত হয়। তোভিয়ার সাথেও ইদানিং তাই ঘটছে। জেহেনের নিষেধ মেয়েটা মানতেই চায় না। পদ্মকুমারী কি না! হয়তো কলিজা ভর্তি সাহস! নুয়ায়ামের সাথে ঘটা অদ্ভুত ঘটনার ইতি ঘটেনি। একবার ছাদ থেকেও কেউ তাকে ধাক্কা মে/রে ফেলে দেয় তাকে। ভাগ্যের খেল! নুয়ায়াম ছাদের কার্ণিশ ধরে ঝুলে ছিল। তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায় তেহজীব। চিৎকার করে মহলের কোণায় কোণায় ঝড় তুলে ফেলে। সেদিনের মতো বেঁচে যায় নুয়ায়াম। এর আগে পড়েও তার ওপর কম বিপদ আসেনি। তবে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় নুয়ায়াম। একবার তার কক্ষে আ/গু/ন লেগে যায়। পুরো কক্ষ আ/গু/নে ঝ/ল/সে যায়। মহলের সবাই সেদিন ব্যস্ত ছিল তেহজীবের আটমত জন্মদিনে। যখন সবাই ঘটনার পরিব্যাপ্তি আঁচ করল, তখন নুয়ায়ামের ভ/য়ং/কর অবস্থা। তাকে কক্ষের বাইরে পাওয়া যায়। কিন্তু তার ভাষ্যমতে, সে কক্ষের ভেতরেই ছিল।

জেহেনের মানসপটে একটা প্রশ্নই উদয় হয়, কেউ নুয়ায়ামকে কেন মারবে? কারণ, সে পদ্মনগরের অঘোষিত রাজকুমার বলে! না, তা সম্ভব নয়। রাজবংশের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। না কী অন্যকিছু!
তেহজীব নরম স্বরে বলল—

“ভাইয়া, কী করা যায় এখন?”

জেহেন শক্ত কণ্ঠে বলল—

“আপাতত নুয়ায়ামের ওপর নজর রাখো। ওকে একা কোথাও যেতে দেবে না। সাথে থাকবে। আমাকে জানাবে।”

তেহজীব মুখ ফসকে হেসে ফেলল। জেহেনের কাঠ কাঠ দৃষ্টিতে সে হাসি থামিয়ে নিল অচিরেই। কণ্ঠে ভার নিয়ে বলল—

“না বলছিলাম, নুয়ায়াম ভাইয়া তো আর ছোটো নয়। নজর রাখা….।”

“আমি যা বলেছি তাই করবে। যদি তোমার দ্বারা না হয়, তাহলে বলো, আমি অন্য কাউকে বলব।”

“আরে না না। আমি পারব। একদম ছায়া হয়ে থাকব। ব্যস, রোদ -বৃষ্টি নাহলেই হলো।”

আড় চোখে তীক্ষ্ম দৃষ্টি ছুড়ে দিল জেহেন।
,
,
,
আবছা আঁধারময় কক্ষ! সেই আঁধার মানবীকে খুঁজছে নুয়ায়াম। দরজা দিয়ে বিনা শব্দে ভেতরে প্রবেশ করে। সারা কক্ষের কোথাও রাদিয়াতের অস্তিত্ব পায় না নুয়ায়াম। সে বিচলিত, উদগ্রীব। চকিতে ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পায়। নুয়ায়াম বুঝতে পারে রাদিয়াতের অবস্থান। সে ধীর পায়ে এগুতে থাকে। বিছানার কাছে এসে স্থির হয়। বসে সে। হাঁটু ঠেকায় মেঝেতে। নিচু হয়ে মাথা স্পর্শ করে মেঝের পাটাতনে। পালঙ্কের নিচে কুঁজো হয়ে বসে আছে রাদিয়াত। অস্পষ্ট তার অবয়ব। নুয়ায়াম মোলায়েম কণ্ঠে বলল–

“আম্মিজান! কেমন আছেন আপনি?”

রাদিয়াত মাথা ঠেকিয়ে রেখেছিল মেঝেতে। উপুর হয়ে আছে সে। নুয়ায়ামের স্নিগ্ধ কণ্ঠে ধীরগতিতে ঘুরে তাকাল। নুয়ায়াম আবেশিত হাসল। বলল—

“আম্মিজান, বাইরে আসুন।”

নুয়ায়াম হাত বাড়াল। রাদিয়াত ভয়ে আরও সংকুচিত হলো। নুয়ায়ামের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তার মুখের দিকে তাকাল। আদুরে হাসল রাদিয়াত। চোখ হেসে উঠল তার। ভয়ে আড়ষ্ট হাতটা একটু একটু করে নুয়ায়ামের দিকে বাড়াতে লাগল। ছেলের প্রশস্ত হাতের তালু স্পর্শ করল রাদিয়াত। চিত্ত দুলে উঠল নুয়ায়ামের। সে মৃদু হেসে বলল—

“বাইরে আসুন আম্মিজান।”

রাদিয়াত নুয়ায়ামের হাতে ভর দিয়ে মেঝেতে পা ঘষে ঘষে সামনে আগাতে লাগল। বেরিয়ে এলো পালঙ্কের তলা থেকে। মাথা সোজা করে বসল। নুয়ায়াম দেখল তার মাকে। রাদিয়াতে চোখে-মুখে কী অবিচ্ছেদ্য, অকপট, অবিমিশ্র মায়া! শুষ্ক ঠোঁটে মায়াবী হাসি! চোখের তারায় আদরের ঢেউ! নুয়ায়াম আমোদিত কণ্ঠে বলল—-

“কেমন আছেন আম্মিজান? আমাকে চিনতে পারছেন?”

রাদিয়াত ভোলা ভোলা চোখে চেয়ে রইল। হাত উঠিয়ে নুয়ায়ামের মুখ স্পর্শ করল। নুয়ায়ামের চোখ, নাক, মুখে আধো আধো স্পর্শ বুলাতে লাগল। মায়ের অকৃত্রিম স্নেহে অন্যমনষ্ক হতেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাদিয়াত। ধা/রা/লো নখের আঁ/চ/ড়ে ক্ষ/ত সৃষ্টি করল নুয়ায়ামের মুখচ্ছবিতে। নুয়ায়াম মেঝের বুকে পুরোদস্তুর ঢলে পড়ে। তার বুকের ওপর চড়ে বসে ভ/ য়ং/কর রকম শব্দ করতে থাকে রাদিয়াত। নুয়ায়াম দুই হাতে নিজেকে বাঁচাতে শুরু করল।

“আম্মিজান! আম্মিজান! কী করছেন? আমি আপনার ছেলে!”

রাদিয়াত বুঝল না। সে তার কাজ করতেই থাকল। অতর্কিত হা/ম/লা টলাতে বেগ পেতে হলো নুয়ায়ামকে। তার করা শব্দ শুনতে পেল জেহেন। রাদিয়াতের কক্ষের কাছাকাছি ছিল সে। চমকে উঠে নুয়ায়ামের কণ্ঠে। জেহেন অতি দ্রুত ছুটে আসে রাদিয়াতের কক্ষের ভেতর। সামনের দৃশ্যে সে হতচকিত! নুয়ায়ামকে বাঁচিয়ে আনে রাদিয়াতের আগ্রাসন থেকে। ফোঁস ফোঁস শব্দে কক্ষ কাঁপিয়ে ফেলছে রাদিয়াত। তার অদ্ভুত চাহনি, লালাভ চোখের কোটর, তার থেকে নির্গত অশ্রুকণা!
নুয়ায়ামকে বের হতে বলে কক্ষ থেকে জেহেন। নুয়ামায় ব্যগ্রতা নিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। দরজা চাপিয়ে দেয় জেহেন। সে শান্ত পায়ে উন্মাদগ্রস্ত রাদিয়াতের সামনে এসে বসে। আনম্র কণ্ঠে বলল—

“বড়ো বেগম, আমি, আমি জেহেন। তাকান আমার দিকে।”

রাদিয়াত প্রশস্ত, রাগান্বিত, হিং/সা/ত্ম/ক চোখে তাকায়। পরমুহূর্তে শান্ত হয় তার চাহনি। জেহেন জিজ্ঞেস করল—

“আপনি ভালো আছেন?”

রাদিয়াত খপ করে জেহেনের হাত ধরে ফেলল। অনুনয় করে বলল—

” আমার তোভিয়াকে নিয়ে যাও। এখান থেকে দূরে নিয়ে যাও। এই মহল থেকে বহুদূরে। ওরা আমার পদ্মকুমারীকে মেরে ফেলবে। ওকে তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও। তুমি আর ও তো এই পদ্মমহলের…।”

রাদিয়াত কথা শেষ করার পূর্বে বলে উঠে জেহেন—

“বড়ো বেগম, আপনি তো জানেন আমি….।”

জেহেন তার বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না। তার পূর্বেই রাদিয়াত হা/ম/লে পড়ল। জেহেন চমকিত হলো। রাদিয়াত আ/ঘা/ত করার এক ফাঁকে জেহেনের কর্ণরন্ধ্রে টুকটুক করে বলল–

“পদ্মকুমারীকে নিয়ে চলে যাও। ওকে নিয়ে চলে যাও।এই মহল কাউকে ছাড়বে না। ওরা তোমাদের বাঁচতে দেবে না। নুয়ায়াম থেকে দূরে থাকো। ও,ও ওকে নিতে এসেছে। নুয়ায়ামের কিছু হলে ও সবাইকে মে/রে ফেলবে। আমার তোভিয়াকেও।
তুমি ওকে নিয়ে যাও। ”

জেহেন স্থম্ভিত হয়ে গেল। সরে এলো রাদিয়াতের কাছ থেকে। রাদিয়াতের বড়ো বড়ো নখে নুয়ায়াম আর জেহেনের র/ক্ত লেগে আছে। নুয়ায়াম আচ্ছন্ন চোখে চেয়ে আছে। তবে সে বিভ্রান্ত! তার কানে অস্পষ্ট একটা শব্দ ভেসে এসেছে। পাখা ঝাপটানোর শব্দ!
,
,
,
“তোমাকে কে যেতে বলেছে আম্মির কক্ষে?”

বোনের আদুরে শাষনে মাথানত করে রেখেছে নুয়ায়াম। তোভিয়া কপট ধমক দিয়ে বলল—

“আর কখনো যাবে না। দেখো, কী অবস্থা করেছে তোমার!”

নুয়ায়াম মর্মাহত! তার মা তাকে কেন সহ্য করতে পারে না, সে আজও বুঝতে পারে না। তোভিয়া ভাইকে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে। তার মনও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। নুয়ায়াম জানালো জেহেন রাদিয়াতের কক্ষে। ছলকে উঠল তোভিয়া। সে ব্যস্ত হয়ে দরজার কাছে গেল।
জেহেনকে দেখল তোভিয়া। দ্রুত চলছে সে রাদিয়াতের কক্ষের সামনে থেকে। নুয়ায়ামের দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে বের হয়ে গেল কক্ষ থেকে তোভিয়া। পিছু ধরল জেহেনের।

ছাদে এসেছে জেহেন। মহলের পেছনের দিকে গিয়ে নিচের দিকে তাকাল। রাদিয়াতের জানালার কাছে কারো অবস্থান দেখতে চাইছে সে। কিছু একটার আওয়াজ পেয়েছিল। কিন্তু কেউ নেই।

“কাকে খুঁজছেন?”

তোভিয়ার প্রশ্নে সচল হলো জেহেন। ফিরে তাকাল সে। ঠান্ডা গলায় বলল—

“কাউকে না।”

“এখানে কেন এসেছেন?”

“এমনি।”

“আপনাকেও আম্মি আ/ঘা/ত করেছেন?”

“তেমন কিছু নয়।”

বিষণ্ণতা ঝাপটে ধরল তোভিয়াকে। মনমরা কণ্ঠে বলল—

“বেগমরাণি ডেকেছেন। আজ দাদাজানকে দেখতে দেবেন। চলুন।”

জেহেন অস্বীকার করে বলল—

“না, তোমরা যাও। আমি যাব না।”

“জেহেন! এসব কেন বলছেন? কেন যাবেন না? আপনি দাদাজানকে দেখতে চান না?”

জেহেন কিছু একটা ভেবে চুপ থাকে। অনুপল পরে বলল—

“আজকের পর, বড়ো বেগমের কক্ষে কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না। নুয়ায়ামকেও নয়।”

তোভিয়া উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলল—

“কেন?”

” আমি বলেছি তাই। যাও এখন। দেরি হলে বেগমরাণি রাগান্বিত হবেন। তার রোষের স্বীকার হবে তোমরা। দাদাজানকে দেখতে পারবে না।”

“আপনি?”

“যাব না আমি।”

সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে জেহেন। পেছন পেছন তাকে ডাকতে থাকে তোভিয়া।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here