ছায়াকরী পর্বঃ১৬

0
441

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ১৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

পর্দার সারি একটুখানি সরিয়ে রাখা হয়েছে। সেই সরিয়ে রাখা জায়গাটুকুতে দাঁড়িয়ে আছে তেহজীব, নুয়ায়াম আর তোভিয়া। তাদের দাদা বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখের পাতা স্থির তার। তিনি চেয়ে আছেন অটল দৃষ্টিতে। পালঙ্কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দুইজন নারী। তারা নিশ্চুপ। তোভিয়া ঠাওর করল, প্রতিবারের মতো এবারেও তার দাদা চোখের পলক ফেলছে না। তিনি অনিমেষ চেয়ে আছেন। তোভিয়ার মাঝে মাঝে এই মানুষটাকে মৃত মনে হয়! কারণ, কোনো প্রতিক্রিয়া সে দেখে না। বেগমরাণির আদেশ নেই দাদার কাছে যাওয়ার। তারা দূর থেকেই তাকে দেখে। বেগমরাণি বসে আছেন তার পদ্মাসনে। তার পাশের ছোটো গদিতে বসে আছেন মেহেক। অদ্ভুত সুন্দরী এই রমণীর রূপের ঝলক সময়ের সাথে বাড়ছেই।

কিছুক্ষণ পর পর্দা টেনে দেওয়া হলো। সরে আসলো তারা তিনজন। নুয়ায়াম আর তেহজীব কক্ষ ত্যাগ করল। তোভিয়াকে অপেক্ষা করতে বলল বেগমরাণি। তিনি প্রশ্ন করলেন—

“জেহেন কোথায়?”

তোভিয়া আনম্র গলায় বলল—

“তিনি আসবেন।”

এক ভ্রূ উঁচু করে বিপ/জ্জ/নক চোখে তাকাল বেগমরাণি। তোভিয়া চমকে উঠে মাথানত করল। বেগমরাণি ককর্শ স্বরে বললেন—

“জেহেন কী চাইছে বলোতো পদ্মনন্দিনী? সে কী আমার বিরোধিতা করতেই চাইছে?”

তোভিয়া অনুরক্তির সুরে বলল—

“ক্ষমা করবেন বেগমরাণি। তার এমন কোনো অভিপ্রায় নেই। তিনি ব্যস্ত তাই….।”

“এত ব্যস্ততা?”

কণ্ঠ জোরালো হলো বেগররাণির। তোভিয়া মিইয়ে গেল। বাক হারিয়ে গেল তার কণ্ঠের। তার ওষ্ঠাধর আর চোখের পল্লব কাঁপতে লাগল। চকিতে ভেসে এলো—

“তুমি যাও তোভিয়া।”

তোভিয়া চমকিত হয়ে আঁখিপল্লব প্রশ্বস্ত করল। তীব্র অবিশ্বাস নিয়ে পেছন ফিরে জেহেনকে আবিষ্কার করল। জেহেন উষ্ণ স্বরে বলল—

“তুমি যাও তোভিয়া।”

বেগমরাণি আড়চোখে সবকিছু অবলোকন করলেন। মেহেকের চোখে আর অধরে শ্লেষ। তোভিয়া প্রস্থান করতেই জেহেনের চাহনি ভার হয়। বেগমরাণি ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন—

“আমার আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা কী করে হলো তোমার? তোমার আস্ফালন আমাকে ভাবাচ্ছে জেহেন।”

জেহেন অচক্রী গলায় বলল—

“আমি কৃতার্থ!”

নিজের আসন থেকে উঠে দাড়ালেন বেগমরাণি। ক্ষীপ্ত হলেন তিনি। মেহেক ভ্যাবাচাকা খেয়ে উঠে দাড়ালেন। ব্যতিব্যস্ত চোখে চাহনি ঘোরাতে লাগলেন। বেগমরাণি রুষ্ট স্বরে বললেন—

“তুমি আমার বিরোধিতা করছ। বিদ্রোহ করতে চাইছ?”

জেহেন মৃদু হাসল। কোমল স্বরে বলল—

“দাদাজানকে ডক্টর দেখান। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আমি শুধু এতটুকুই বলতে চাই।”

বেগমরাণি ফুঁসে উঠে বললেন—

“কী বলতে চাও তুমি? আমি তার খেয়াল রাখছি না?”

বেগমরাণির চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। নিঃশ্বাস পড়ছে শব্দ করে। জেহেন মোলায়েম কণ্ঠে বলল—

“গত কয়েকবছর ধরে তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। কী করেছেন আপনি? আপনার পরিচর্যা তাকে কতটুকু সারিয়ে তুলতে পেরেছে? ”

“তুমি….!”

“ভুলে যান। পদ্মনগরের রাজা-রাণিদের আধিপত্য নিঃশেষ হয়েছে বহু পূর্বেই। আমি কোনো বিদ্রোহ করছি না। শুধু আমার মতামত রেখেছি আপনার সামনে। একজন মানুষ, যিনি সারাজীবনে এমন অনেক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন, যা এই পদ্মনগরের অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে; আজ তার অবস্থা এত শোচনীয় ! তার কী চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই? আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আমি দাদাজানকে শহরে নিয়ে যাব। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। আজ পর্যন্ত জানতেও দিলেন না আসলে দাদাজানের হয়েছে টা কী! কেন আজ এতগুলো বছর তিনি শয্যাশায়ী? কেন এতগুলো বছর আপনি আমাদের তার সাথে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছেন না?”

বেগমরাণি চিৎকার করে বললেন—

“তুমি আমাকে দোষারোপ করছ?”

“আমি শুধু সত্য বলেছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।”

জেহেন হনহনিয়ে উত্তপ্ত মেজাজে বিদায় নিল। টগবগ করছে বেগমরাণির শিরা-উপশিরা। মেহেক কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মিহি স্বরে বলল—

“এখন কী করবেন বেগমরাণি? আমি আগেই বলেছিলাম। এই জেহেন সুবিধার নয়। কথার ধার দেখেছেন? ও যদি এখন আমাদের ওপর চড়াও হয়, তখন?”

বেগমরাণি কৌতূহলী চোখে চেয়ে বললেন—

“কী বলতে চাও?”

মেহেক ঝরঝরে গলায় বলল—

“কী দরকার ছিল জেহেনকে এসবের মধ্যে টানার? ওর মধ্যে এখনো মনুষ্যত্ব বিদ্যমান। পশুত্ব তার লাগাম ছাড়াতে পারেনি। দেখছেন না, দাদাজানের জন্য কী মহব্বত!
ও আমাদের কোনো কাজেই আসবে না। উলটো তোভিয়াকে বিয়ে করে, এই পদ্মমহলে আসন পেতে বসবে।”

বেগমরাণি চওড়া কণ্ঠ বললেন—

“চুপ করো তুমি। তোমাকে ভাবতে হবে না এসব নিয়ে। যদি জেহেন আমাদের সাথে একতাবদ্ধ না হয়, তাহলে ও সব হারাবে, তোভিয়াকেও। তোভিয়ার সাথে বিয়ে হলেই, মৃত্যুদূত ওর আশেপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করবে।”

“বিবাহ কী সত্যিই হবে? আপনার ছেলে তো ফিরে এলো না?”

“শিষ!”

মেহেক চুপ হয়ে গেল। চোখের কোটর পূর্ণ প্রকাশ করে গাঢ় স্বরে বললেন বেগমরাণি—

“দেয়ালেরও কান আছে। আস্তে কথা বলো।”

“ক্ষমা করবেন।”

চুপসে গেল মেহেক। বেগমরাণি ছোটো ছোটো পায়ে পর্দার এপাশে এসে স্বামীর পালঙ্কের কাছে দাড়ালেন। শায়িত জোবায়ের হাসনাতের চোখের দিকে তাকালেন। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জোবায়ের হাসনাতের বুকের সমান্তরালে ওপরে হাত রাখলেন। তৎক্ষণাৎ জোবায়ের হাসনাতের সমস্ত দেহ থেকে শুভ্র রঙের আলো ছড়াতে লাগল। সেই আলো বলয় হয়ে লুপ্ত হয়ে গেল বেগমরাণির হাতের তালুতে। ঠিক তখন তার অন্য হাতের ওপর সেই মূষকটিকে দেখা গেল।
,
,
,
বিকেলের ফুরফরে সমীরণে ছাদের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। তার নির্লোভ, নিবিড় চাহনি মহাচ্ছায়া জঙ্গলের পানে। এখান থেকে বহুক্রোশ দূরের ওই মহাচ্ছায়া জঙ্গল জেহেনের কাছে সব সময় নিকটে মনে হয়। তার দৃষ্টির প্রখরতার কারণে। আর মনে পড়ে সেই দিন, যেদিন এই মহাচ্ছায়া জঙ্গল থেকে বেরিয়েই সে তার বাবার সাথে এই পদ্মনগরে পা রেখছিল। আচানক নিজের পিষ্ঠদেশে উষ্ণতা টের পেল জেহেন। সে পাশ ফিরল। তার দিকে আকণ্ঠ মায়া, প্রকট ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে তোভিয়া। তোভিয়ার চোখে-মুখে আত্মহারা খুশির জোয়ার উঠেছে। সে অবারিত মেঘের ন্যায় লাজুক হেসে বলল–

“আপনি বিবাহের জন্য সম্মতি দিয়েছেন?”

চোখে হাসল জেহেন। খোলা আকাশের নিচেও তার দমবন্ধ হয়ে এলো এই প্রশ্নে। সে নিস্পৃহ স্বরে বলল—

“হ্যাঁ।”

তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল তোভিয়া। শ্বাসের সাথে খুশিরা উছলে উঠছে। জেহেন নরম স্বরে বলল–

“তৈরি হয়ে নাও।”

জেহেনের বক্ষ:স্থল থেকে মাথা তোলে তোভিয়া। চোখ ভরা রঙধনু হাসি। মাথা ওপর-নিচ করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলো। দৈবাৎ অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটাল তোভিয়া। জেহেনকে বিস্ময়ের সাগরে ঠেলে দিয়ে তার গালে গাঢ় চুমু এঁকে দৌড়ে পালাল। তোভিয়ার বাচ্চামোতে হেসে ফেলল জেহেন। তার নজর গিয়ে পড়ল পদ্মদিঘীর বুকে। যে ঘুমন্ত এক রহস্যপুরী!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here