ছায়াকরী পর্বঃ২১

0
560

# ছায়াকরী
# পর্বঃ২১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ভীতসন্ত্রস্ত নুয়ায়াম। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কাঁপছে। এতদিনের হঠাৎ দেখা উপসর্গগুলোতে ভয়ানক পরিবর্তন এসেছে। নুয়ায়ামের দেহে আকস্মিকভাবে সৃষ্ট হওয়া পশমগুলো আজ আরও দীর্ঘ হয়েছে। ধীরে ধীরে তা পাখির পালকে রূপ নিচ্ছে। চকচকে কালো রঙের পালক। নুয়ায়ামের গলা শুকিয়ে এসেছে। তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল। হলুদাভ কোটরে কমলা রঙের মনি। চোখ দুটো দর্পণে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হয় তার। ভয়ে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে । আজ আরও একটা জিনিস খেয়াল করল নুয়ায়াম। তার গোলাপি আভাযুক্ত নখের সম্মুখভাগ কয়েক ইঞ্চি বেড়ে গিয়েছে। তার অগ্রভাগ ধারালো, সূঁচালো। চকিতে থিতিয়ে যায় নুয়ায়ামের মস্তিষ্ক। আজ তার যন্ত্রণা হচ্ছে না। কিন্তু পরিবর্তন হচ্ছে অনেক কিছু। নুয়ায়াম ভ/য়ং/কর শব্দে শ্বাস ফেলতে লাগল। বুক ওঠা-নামা করতে লাগল তূরন্ত বেগে। শ্বাস যেন বাতাস ফুড়ে দেবে!
তৎক্ষণাৎ ছায়াকরী উড়ে এসে দাঁড়ায় বিছানায়। নুয়ায়াম ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ছুটে আসে তার কাছে। আর্ত গলায় বলল—

“এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? ছায়াকরী! দয়া করে সাহায্য করো!”

নুয়ায়ামের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তোভিয়া। ঠোঁট ভর্তি খুশি। সে আলতো হাতে দরজায় শব্দ তৈরি করল। ভেতর থেকে করাঘাতের আওয়াজ কর্ণরন্ধ্রে গিয়ে পৌঁছাতেই দম বন্ধ হয়ে এলো নুয়ায়ামের। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল—

“এখন কী হবে? কে এসেছে? কেউ যদি আমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলে?”

ছায়াকরী চেয়ে রইল। ধীরে ধীরে তার নীলাক্ষী উজ্জ্বল হতে থাকে, সেই সাথে স্বাভাবিক হতে থাকে ভয়ে বিচলিত নুয়ায়ামের দেহ। শব্দ করেই যাচ্ছে তোভিয়া। বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে উঠল তার মুখ। জোরালো কণ্ঠে বলল—

“ভাইয়া! দরজাটা খোলো।”

নুয়ায়াম তার দেহের স্বাভাবিকতা ফিরে পেতেই উচ্ছ্বসিত হয়। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দিলখোলা হাসে। তোভিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল—

” এত সময় কোথায় ছিলে? তুমি আর জেহেন যে দরজা বন্ধ করে কী করো, আমার বোধগম্য হয় না।”

থতমত খেয়ে যায় নুয়ায়াম। সত্য লুকানোর অভিপ্রায়ে বলল—-

“আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।”

“তাই বলো।”

“কিছু বলবে তুমি?”

ভয়ে আড়ষ্ট নুয়ায়াম বোনকে ভালো করে পরখ করেনি। করলে বুঝতে পারত, তোভিয়া তার হাতে করে কিছু নিয়ে এসেছে।
ছায়াকরীকে বিছানায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদুহাস্য অধরে তাকায় তোভিয়া। বিছানার ওপর হাতে থাকা ট্রে রেখে মেঝেতে হাঁটু মুড় বসে। ছায়াকরীর ঠোঁট আলগোছে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে কপট শাসিয়ে বলল–

“দুষ্ট ছায়াকরী! আমার বরকে ব্যথা দিলে কেন? আরেকবার যদি এই দুঃসাহস করেছে, তোমাকে কালকুঠুরিতে দিয়ে আসবো। বুঝলে!”

ঝুমঝুমিয়ে হাসে তোভিয়া। বোনের খুশিতে তৃপ্ত হয় নুয়ায়াম। কিন্তু নিজের আচরণে সে বিস্মিত! এই যে রোজ তার সাথে অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে, সে এক পাখির কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু কেন, তা নুয়ায়াম জানে না। সে এটাও জানে না, তার এই পরিবর্তন তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে। কিন্তু নিছক পাখি হওয়া সত্ত্বেও ছায়াকরীর ওপর তার আছোঁয়া বিশ্বাস আছে। তার যোগসূত্র খুঁজছে নুয়ায়াম। কারণ, সে খেয়াল করেছে, যখনই ছায়াকরীর চোখ উজ্জ্বল হয়, নুয়ায়ামের দেহ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

নুয়ায়াম বিছানায় বসল। মেঝে থেকে উঠে তার পাশে বসল তোভিয়া। ঢাকনা দেওয়া বাটি উন্মুক্ত করতেই সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নুয়ায়ামের চোখ হেসে উঠল। বোনের হাতের রান্না তার খুব পছন্দ। তোভিয়া ক্ষীরের বাটি নুয়ায়ামের মুখের সামনে ধরে বলল—

“হা করো। তোমার প্রিয় ক্ষীর বানিয়েছি।”

নুয়ায়াম বিনা বাক্য ব্যয়ে হা করল। ছোট্ট চামচে করে তার মুখে ক্ষীর পুরে দিলো তোভিয়া। ভাইয়ের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। ক্ষীরের স্বাধের ছটা ভাইয়ের মুখে দেখতে চায় সে। নুয়ায়ামের প্রসন্নতায় হেসে উঠল তোভিয়ার অন্তরিন্দ্রিয়। নুয়ায়াম প্রশ্ন করল—

“জেহেনের জন্য রেখেছ?”

আচানক এই তিন শব্দের বাক্যেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল তোভিয়া। বুক ভারী হয়ে এলো তার। থেমে গেল তার উড়ে চলা মনপাখি। জেহেন স্বাভাবিক খাবার খুব কম খায়। তোভিয়া কখনো এসব নিয়ে প্রশ্ন করেনি। কিন্তু যখন থেকে সে জেহেনের পশু সত্তা সম্পর্কে জেনেছে, এতকালের সব প্রশ্নের উত্তর যেন ঝকঝকে আকাশ হয়ে তার চোখের আঁধার সরিয়ে দিলো। সেদ্ধ মাংস, সবজি, ফল-মূলেই বেশি আগ্রহ জেহেনের। তোভিয়া কণ্ঠে স্বাভাবিকতা রেখে বলল—

“জেহেন তো এসব খেতে পছন্দ করে না।”

নুয়ায়াম ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল—

“দুঃখিত! আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”

ম্লান হাসল তোভিয়া। নিস্পৃহ গলায় বলল–

“ভাইয়া, আম্মিকে শহরে নিয়ে গেলে হয় না? একবার যদি ডক্টর দেখানো যেত!”

নুয়ায়াম কিয়ৎপল চুপ থেকে বলে উঠে—

“হ্যাঁ। আমি কথা বলব বেগমরাণির সাথে। তার আগে জেহেনের সাথে আমাকে কথা বলতে হবে। ও ফিরলে আমার সাথে দেখা করতে বলবে।”

“আচ্ছা।”

বোনের ফ্যাকাশে মুখ দেখে নুয়ায়াম ভাবল, হয়তো তাদের মায়ের কথা ভেবে তোভিয়ার মন ব্যথিত হচ্ছে! তাই সে চাটুকদার কণ্ঠে বলল—

“এখন আমাকে খাইয়ে দাও। হাআআ।”

নুয়ায়াম হা করতেই হেসে ফেলে তোভিয়া। ছায়াকরী চেয়ে আছে। সে ভীত। কোনোদিন না এই ভাই-বোনের সম্পর্কে চির ধরে!
,
,
,
তোভিয়াকে দেখেই উঠে দাঁড়ায় তেহজীব। তার পায়ের গোড়ালিতে চোখ আটকে তোভিয়ার। সে স্নিগ্ধ স্বরে বলল—

” একটু দেখে হাঁটবে না! কী অবস্থা করেছ!”

বসার কক্ষের কাউচে বসে ছিল তেহজীব। তার মন, মস্তিষ্ক সবকিছুই এলোথেলো, অধৈর্য। সে তাকিয়ে রইল তোভিয়ার মুখের দিকে। ধূসর শাড়ির আবরণ ভেদ করে যেন নারী তোভিয়ার আচ্ছাদিত দেহাবরণ দেখার ইচ্ছেতে অন্ত:পুর জ্বলে যাচ্ছে তেহজীবের। তার দৃষ্টির প্রগাঢ়তা বাড়ল। তোভিয়ার উদ্ভাসিত চোখে, পাতলা ওষ্ঠধরের স্নিগ্ধতায় আর মোমের মতো পেলব আননে হারিয়ে গেল সে। তোভিয়া ভ্রূ নাচিয়ে বলল—

“এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”

তোভিয়ার দীর্ঘ পক্ষ্মচ্ছেদ নড়ে উঠল। ঝড়ে পড়ল তেহজীবের চোখের পল্লব। সে কোনো উত্তর না দিয়ে পা বাড়াল। তোভিয়া বাধা দিয়ে বলল—

“কোথায় যাচ্ছ? বসো এখানে। আমি তোমার জন্য ঔষধ নিয়ে আসছি।”

দম্ভোক্তি করল তেহজীব—

“প্রয়োজন নেই।”

“আছে। একদম নড়বে না। এখানেই বসো।”

অগত্যা ডিভানে বসল তেহজীব। তোভিয়া দ্রুতপায়ে নিজের কক্ষে গেল। জেহেনের তৈরি করা বনজ ঔষধের একটা কৌটা নিয়ে ফিরে এলো। তেহজীবের গোড়ালি থেকে গজ খুলে তার ক্ষত জায়গায় হালকা বাদামি রঙের আঠোলো, ভারী পদার্থের প্রলেপ লাগিয়ে দেয়। প্রফুল্লচিত্তে বলল—

“চিন্তা করো না। দ্রুত সেরে যাবে।”

“হেকিম হয়ে যাচ্ছ তুমি?”

“উহু। জেহেন আমাকে এসব সম্পর্কে বলেছে। আর কৌটার গায়েও লিখে রেখেছে, যাতে আমার ভুল না হয়।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তেহজীব। উসখুস গলায় বলল—

“তুমি খুশি?”

তোভিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। দৃঢ় গলায় বলল—

“অবশ্যই।”

ডিভান থেকে উঠে দাঁড়ায় তেহজীব। স্বর ভার করে বলল—

“আমাকে বুঝলে না তুমি।”

তোভিয়া কোনো জবাব দিলো। সে দেহভঙ্গি বদলে সিঁড়ির দিকে যেতেই পেছন থেকে বলে উঠে তেহজীব—

“ভুল করেছ তুমি।”

তোভিয়া পেছন ফিরল। মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—

“তুমি সীমা লঙ্ঘন করছ।”

“ফিরে এসো।”

“তেহজীব!
দ্বিতীয়বার এই কথা বলার স্পর্ধা দেখাবে না।”

তেহজীব ভাবাবেশ ছাড়া হেসে ফেলল। ঝকঝকে গলায় বলল—

“ভালোবাসি আমি তোমাকে।”

“আমি আমার সবকিছু মেনে নিয়েছি জেহেনকে। তা তোমার অজানা নয়। বিবাহ হয়েছে আমাদের। ভাবী হই আমি তোমার। তার মান রাখবে তুমি। আর কখনো এই ধরনের চিন্তা নিজের মন এবং মস্তিষ্কের কোথাও জায়গা দেবে না। মনে রেখো।”

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে থাকে তোভিয়া। রাগের স্ফুলিঙ্গের বাঁধ ভাঙল তেহজীবের। সবকিছুর এক স্বচ্ছ দৃশ্য অবলোকন করল জেহেন মহলে প্রবেশ করেই, যা তাদের দুইজনের অজানা রয়ে গেল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here