ছায়াকরী পর্বঃ২০

0
434

# ছায়াকরী
# পর্বঃ২০
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভ

প্রত্যুষের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে বাহ্যজগতে। ঘুম ঘুম ধরণী চোখ মেলে সিক্ত হচ্ছে প্রভাকরের নরম, মোলায়েম আভার আলতো স্পর্শে। জেগে উঠেছে মানুষ, পত্র-পল্লবের সাথে পাখিরা। মিহি কূজন তাদের স্বরনালীতে। আকাশের বুক শান্ত। জমাট মেঘের বসত সেখানে।

তেহজীব বিক্ষিপ্তচিত্তে বসে আছে। খাওয়াতে তার মনোযোগ নেই। নুয়ায়াম তার স্বভাবসুলভ কাজে ব্যস্ত। খেয়ে যাচ্ছে অনুদ্বেগ ভঙ্গিতে। জেহেনের চেয়ার শূন্য। এখনো নিচে আসেনি সে। তার অর্ধাঙ্গীনিও অনুপস্থিত। তেহজীবের শিরায় শিরায় তপ্ত রাগের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। নিজের কঠিন ব্যক্তিত্ব কঠোর হস্তে দমন করে শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে সে। তার অভিব্যক্তিতে পাশের মানুষটার বোঝার উপায় নেই কী চলছে তার হৃৎপিণ্ডের অন্দরে!

নারী কণ্ঠের আওয়াজ আসতেই দু’জোড়া চোখ চকিতে তাকাল। জেহেনের সাথে নেমে আসছে তোভিয়া। তার চোখে -মুখে আলাদা লাবণ্য! চোখ দুটো ফুটন্ত পদ্মের মতো হেসে আছে। ওষ্ঠাধরের কোণায় কোণায় প্রসন্নতার ঝড়। পরনে তার ধূসর রঙের শাড়ি। সব সময়ের মতো গম্ভীর, অন্যমনষ্ক জেহেন। বোনকে দেখে প্রশান্তি ছেয়ে গেল নুয়ায়ামের অন্তঃকরণে। মেয়েটা আগে এমন করেই হাসত!

নিজের চেয়ারে বসে জেহেন। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তোভিয়া। তার বিপরীতে উষ্ণ হাসি উপহার দিলো নুয়ায়াম। তেহজীবের গাঢ়, প্রকুপিত, রুষ্ট চাহনি তোভিয়ার হাসি মাখা আননে। রাগে ভেতরটা কাঁপছে তেহজীবের। কিন্তু সবকিছুর মাঝে জেহেনের চোখ আটকে আছে ছায়াকরীর দিকে। নুয়ায়ামের কাঁধে বসেই তার দৃষ্টি জেহেনের জ্বলজ্বলে চোখে। তোভিয়া কাঁধে হাত রাখল জেহেনের। গলায় স্বর নামিয়ে বলল—

“আপনি বসুন, আমি আপনার খাবার বানিয়ে আনছি।”

ছায়াকরীর দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই অস্ফুট আওয়াজ করল জেহেন—

“হুম।”

তোভিয়া আনন্দ মনে রান্নাঘরে যায়। কিছু সময় পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় জেহেন। নরম পায়ে এসে দাড়ায় নুয়ায়ামের কাছে। নুয়ায়াম অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল—

“কিছু বলবে?”

জেহেন ছোট্ট করে হাসল। গলার স্বরে স্বাভাবিকতা এনে বলল—

“ছায়াকরীকে তুমি কোথায় পেয়েছ?”

নুয়ায়াম মুখের খাবারটুকু গিলে নিয়ে বলল—

“তোভিয়া বলেনি তোমাকে?”

“জিজ্ঞেস করা হয়নি ওকে।”

“শহর থেকে ফেরার পথে পেয়েছি। আহত অবস্থায় আমার গাড়ির ওপর পড়ে ছিল।”

“ও।”

জেহেন চোখের কোটর ক্ষুদ্র করল। তার ভ্রূযুগল কুঁচকে এলো। ছায়াকরী উশপিশ করছে। জেহেন কিছু একটা করবে। জেহেন হাত বাড়িয়ে নিজের মুঠোতে নিল ছায়াকরীকে। নুয়ায়াম কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। তেহজীব সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিজ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছেন মেহেক। তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ল পুরো বসার কক্ষে।

ছায়াকরীকে নিজের মুখের সন্নিকটে নিয়ে এলো জেহেন। বিড়বিড় করে কিছু বলল। চোয়াল শক্ত করে হাতের মুষ্টিতে চাপ সৃষ্টি করতেই ছায়াকরী তার দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অকস্মাৎ কঁকিয়ে উঠে জেহেন। হাতের মুষ্টি আলগা করে ব্যথামিশ্রিত আওয়াজে।

“আহ্!”

ছায়াকরী হাতের বলয় থেকে মুক্তি পেয়েই উড়তে থাকে। সে আর নুয়ায়ামের কাছে ঘেঁষল না। নুয়ায়ামের কক্ষের দিকে নিজের গন্তব্য ঠিক করল। বিস্ময়ে বিমূঢ় নুয়ায়াম উঠে দাড়ায় চেয়ার থেকে। ভীত কণ্ঠে বলল—

“কী হয়েছে? তুমি ঠিক আছ?”

জেহেন কপট হেসে বলল—

“কিছু না। শান্ত হও তুমি।”

তোভিয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুট এলো। সে এগিয়ে আসছিল এদিকেই। বিচলিত গলায় বলল—-

“কী হয়েছে আপনার? আপনি ঠিক আছেন? দেখি আপনার হাত?

জেহেন ছোট্ট শ্বাস ফেলে আশ্বস্ত গলায় বলল—

“কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না।”

আচমকা মেহেক বলে উঠল—

“মহলে পাখি এলো কী করে?”

সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মেহেকের থমথমে মুখে। নুয়ায়াম বিনয়ী গলায় বলল—

“ক্ষমা করবেন ছোটো বেগম। আসলে পাখিটিকে আহত অবস্থায় পেয়েছি। তাই তাকে ফেলে আসতে পারিনি।”

“তাই বলে মহলে নিয়ে আসবে?”

তৎক্ষণাৎ কটাক্ষ করে বলে উঠে জেহেন—

“মহলে ইঁদুর, বিড়ালের প্রবেশাধিকার থাকলে একটা পাখির কেন নয়?”

মেহেক ফুঁসে ওঠে। তার চোয়ালের সাথে চাহনি কঠিন হয়। তেহজীব কোনো প্রতিক্রিয়া না করে খাবার টেবিল থেকে উঠে যায়। তার হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। বাম পায়ে চাপ দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে। তা খেয়াল করল জেহেন। মসৃণ ললাটে ভাঁজ খেলিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল—

“তোমার পায়ে কী হয়েছে?”

তেহজীব থমকাল। রোধ হলো তার গতি। পেছন ফিরে বলল—

“পায়ে ব্যথা পেয়েছি।”

“কী করে?”

“দেখে যাও।”

জেহেন এগিয়ে গেল। তেহজীবের গোড়ালিতে গজ কাপড় বাধা। জেহেন প্রশ্ন ছুড়ল—

“কী করে হলো এসব?”

” বাগানে গিয়েছিলাম। গাছের কাটা লেগেছে।”

জেহেন কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তেহজীবের পায়ের দিকে। তার পায়ে গজ কাপড় বাধা। তাতে রক্তের ছাপ লেগে আছে।
,
,
,
নিজেদের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তোভিয়া। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। সে হালকা করে করাঘাত করল দরজায়। ভেতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। তোভিয়া চিন্তিত মনে পূনরায় চাপড় বসাল দরজার পাটাতনে। খট করে দরজা খুলে গেল। এলোমেলো, অস্থির চাহনি জেহেনের। তোভিয়া সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কী করছিলেন আপনি? দরজা খুলতে এত দেরি হলো?”

কথা বলতে বলতে ভেতরে প্রবিষ্ট হয় তোভিয়া। জেহেন শীতল গলায় বলল—

“কিছু না।”

তোভিয়া পুরো কক্ষে চোখ বুলিয়ে বলল—

“তাহলে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন কেন?”

এই প্রশ্নের জবাব দিলো না জেহেন। কাপড় পরিবর্তন করতে করতে বলল—

” আমি বাইরে যাব।”

জেহেনের কথায় ভীত গলায় বলল তোভিয়া—

“কোথায় যাবেন? জঙ্গলে?”

শার্টের বোতাম লাগিয়ে উত্তর করে জেহেন—

“হ্যাঁ।”

ব্যথাতুর শ্বাস ফেলল তোভিয়া। কাতর স্বরে বলল—

“যেতেই হবে?”

“আমি বাধ্য তোভিয়া।”

তোভিয়া মাথানত করে। তার ভয় হয়। কোনোদিন যদি জেহেনের সত্যতা সবার সামনে চলে আসে? বা জঙ্গলে তার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? তখন? কী করে সহ্য করবে সে?
জেহেন নরম হয়। তোভিয়ার নিকটে এসে দাড়ায়। তোভিয়ার চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে। মৃদু হেসে বলল—

“দ্রুত ফিরে আসবো। তুমি একা দিঘীর পাড়ে যাবে না।”

তড়িৎ বেগে প্রশ্ন ছুড়ল তোভিয়া।

“কেন?”

“যাবে না। যতক্ষণ না আমি ফিরে আসছি, ততক্ষণ তুমি মহলের বাইরে পা রাখবে না, এটাই আমার আদেশ।”

বিনা বিরোধে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মিতে দেয় তোভিয়া। জেহেন আলতো হেসে বলল—

“আসি আমি।”

ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তোভিয়া বলল—

“হুম।”
,
,
,
জেহেনকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখেই দ্রুত তার কাছে ছুটে আসে নুয়ায়াম। অধৈর্য হয়ে বলল—

“কোথাও যাচ্ছ তুমি? তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

“জেহেন নির্মল গলায় বলল—

“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে তোমার সাথে কথা বলব। তোভিয়াকে মহলের বাইরে যেতে দেবে না। পদ্মদিঘীর পাড়ে তো একেবারেই নয়। খেয়াল রেখো ওর।”

নুয়ায়াম প্রসন্ন হলো। বোনের জন্য ভগ্নিপতির সচেতনতা দেখে আপ্লুত হলো সে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here