# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
আবছা আলোতে আচ্ছাদিত কক্ষে প্রবেশ করল তোভিয়া। হাতে খাবারের ট্রে। দিনের আলোর এখানে প্রবিষ্ট হওয়ায় বাধা আছে। একপাশের বিশাল জানালায় গাঢ় রঙের পর্দা টাঙানো। কক্ষের ভেতর বাইরের উজ্জ্বল আলো যৎসামান্য প্রবেশ করছে পর্দার আড়াল ভেদ করে। নীলাভ মৃদু আলোর কৃত্রিম বাতি জ্বলছে। কক্ষে অবস্থানরত নারীটির বাইরে রোদ উজ্জ্বল দিন পছন্দ নয়। তিনি আঁধারকে আলিঙ্গন করেছেন বহু বছর পূর্বে। দুনিয়ার মোহমায়া ত্যাগ করেও তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এই আশায়, কখনো তার এই ভ্রান্তিময় জীবনের অবসান ঘটবে। মুক্তি পাবে তার প্রাণআত্মা এই মায়াজাল থেকে।
তোভিয়া বিড়ালপায়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল। হাতের ট্রে বিছানার ওপর রেখে চঞ্চল চোখে এদিক -ওদিক তাকাল। আলো -আঁধারের এই লুকোচুরি খেলায় সবকিছু অস্পষ্ট লাগছে তার। চকিতে ভেসে এলো গোঙানির শব্দ। কক্ষে অবস্থানরত নারীর অস্তিত্ব বোধগম্য হলো তোভিয়ার। আলমিরার দিকে তাকাল তোভিয়া। তার পাশেই কালো রঙের পুটলি। তোভিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না, যাকে সে খুঁজছে সে ওখানেই আছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। কালো রঙের পুটলির মতো বস্তুটির সামনে সন্তর্পণে বসল। আবেগী গলায় চোখে হেসে ডেকে উঠল—
“আম্মি!”
কালো রঙের পুটলিটি সপ্রতিভ হলো। নিজেকে ছড়াতে লাগল। আবছা আলোতে সেই অস্পষ্ট অবয়বের মুখশ্রী জ্বলে উঠে ধরা দিলো তোভিয়ার চক্ষু দর্পণে। তোভিয়ার অন্তঃকরণ হেসে উঠল। সে পূনরায় আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—
“আম্মি, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি, আপনার পদ্মকুমারী। আম্মি, তাকান আমার দিকে।”
তোভিয়া তার নরম হাতের পরশ এঁকে দিলো তার মায়ের মুখচ্ছবিতে। পরম মমতায়, প্রগাঢ় ভালোবাসায়। রাদিয়াত ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তোভিয়ার চাঁদবদনে চেয়ে কুণ্ঠিত হাসলেন। ঈষৎ ফাঁক হলো তার অধর। তোভিয়া জানে, এই হাসির পেছনে কতটা ভয় আর কষ্ট লুকিয়ে আছে। আচানক রাদিয়াত তোভিয়ার হাত টেনে নিয়ে চুমু খেতে থাকেন। জোর করে জড়িয়ে ধরে উন্মাদের মতো অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তোলে তার আনন, কণ্ঠদেশ। তোভিয়া তুষ্ট হয়। পরম তৃপ্তিতে বুক ভরে আসে তার। সহসা হিংস্র হয়ে উঠলেন রাদিয়াত। তার নরম চক্ষু উত্তপ্ত হয়ে উঠল। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তোভিয়াকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে উপর্যুপরি খামচি বসাতে থাকেন। ভড়কে সরে আসে তোভিয়া। ভয়ে তার শ্বাসের গতি বেড়ে গেল। জমাট গলায় বলল—
“আম্মি! আম্মি! আমি তোভিয়া।”
রাদিয়াত দাঁড়িয়ে গেলেন। তার সমস্ত দেহ ঢাকা কালো বসনে। তাতে ময়লা লেগে আছে। চুলের অবস্থা বেহাল। এই কক্ষে তোভিয়া ছাড়া কারো প্রবেশাধিকার নেই। যে কাউকে দেখেই ক্ষীপ্ত হয়ে উঠেন রাদিয়াত। এই আবছা আলোর কুঠিতেই তার সহস্র দিন অতিবাহিত হয়েছে। মায়ের ভালোবাসার সিক্ত আঁচল তেমন পায়নি তোভিয়া আর নুয়ায়াম। তোভিয়ার জন্মের কয়েক বছর পরই আচানক এক সকালে রাদিয়াতকে তার শয়নকক্ষে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। যখন হুঁশ ফিরে আসে তখন তার উন্মাদগ্রস্ত আচরণে আঁতকে উঠে বাড়ির প্রতিটি মানুষ। সেই থেকে নিজ কক্ষেই বন্দি রাদিয়াত। স্বামীর মৃত্যুর পর আরও অধৈর্য হয়ে পড়েন সে। এই বাড়ির কেউ আর তার কক্ষে প্রবেশ করে না।
এইটাকে বাড়ি বললে ভুল হবে। একটা শুভ্রতার আচ্ছাদনে ঢাকা বরফ মহল বলা চলে। সব কিছুই এখানে শান্ত,সমাহিত। চারতলা এই মহলের আনাচে – কানাচে নিস্তব্ধতার প্রহরিরা সব সময় উৎকর্ণ হয়ে থাকে শব্দের জন্য। কিন্তু সব কিছুই নিশ্চল। এই মহলের নারীদের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি তোভিয়াও এই মহলের সীমানার বাইরে যায়নি বহু বছর ধরে। মহলের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে শুধু গাছপালা। আছে একটা দিঘী, পুষ্পকানন, রাতের জ্যোৎস্নায় অবগাগন করার জন্য সজ্জিত পাটাতন। মহলের পেছন দিকটায় ঘন জঙ্গল। এই এলাকার সব মানুষেরা দূর থেকে এই মহলকে দেখে। কিন্তু ভেতরের অবস্থা দেখার সুযোগ খুব কম মানুষের হয়। কারণ, মহলের চারধারে লোহার ফটক ব্যতিত বাকি জায়গায় প্রাচীর গড়া। যার দরুন, এই মহলের অবয়বও সাধারণ মানুষের দৃষ্টির আড়ালে। এই মহলের কারো সাথেই তেমন যোগসূত্র নেই পদ্মনগরের মানুষদের। পদ্মদিঘীর কোল ঘেঁষেই গড়ে ওঠা এই মহলকে সবাই পদ্মমহল নামেই চিনে। যার চূড়াতে রয়েছে ফুটন্ত পদ্মের আকৃতির স্থির প্রতিকৃতি। তবে তা নিতান্তই মানুষের মুখে। কারণ, রাজাদের শাসনামলের কোনো ছাপ নেই পদ্মমহলের বসবাসরত মানুষদের মধ্যে। তারা অতিশয় অমায়িক, ভদ্র আর শান্ত গোছের শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু পদ্মনগরবাসী জানে না, এই শান্তিপ্রিয় মানষগুলোর মাঝেই লুকিয়ে আছে কিছু অশান্ত, হিংস্র আর ভয়ংকর তান্ডবলীলার অধিরাজরা।
রাদিয়াতের আক্রমণাত্মক আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত তোভিয়া কিছু ঠাওর করার পূর্বক্ষণেই তার চুল টেনে ধরেন তিনি। তোভিয়া কঁকিয়ে উঠে। ব্যথামিশ্রিত স্বরে বলল—
“আম্মি! আম্মি!
আম্মি, আমি ব্যথা পাচ্ছি। ছেড়ে দিন আমাকে। ”
তোভিয়ার গলায় ‘আম্মি’ ডাক শুনে কাতর হয়ে উঠল রাদিয়াতের মাতৃমন। তিনি চট করে চুল ছেড়ে দিয়ে আলমিরার কিনার ঘেঁষে বসে পড়লেন পূর্বের ন্যায়। ডুকরে উঠল তোভিয়া। তার সিক্ত নেত্রপল্লব চুইয়ে পড়ল নোনতা জল। রাদিয়াত নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন। সশব্দে শ্বাস ফেলে কোনো হিংস্র জন্তুর অনুরুপ ফোফাতে লাগলেন। মনঃকষ্টে কান্না উপচে আসা চোখ বন্ধ করে ছুটে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে তোভিয়া। নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবুও তা রোজ নতুন করে ক্ষত সৃষ্টি করে তোভিয়া শিশুসুলভ হৃদয়ে। মায়ের ভালোবাসা তার এ জনমে পাওয়া হবে না!
,
,
,
রান্নাঘরে নিজ কার্য সম্পাদেন ব্যস্ত অনিতা। তার সর্বাঙ্গ উত্তপ্ত। বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক ! স্নায়ুঘটিত দ্বন্দ্বে সে বিভোল। কল থেকে ঝপঝপ করে পড়া পানির দিকে অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফর্সা হাতের গোলাপি নখের ডগা দৈবাৎ দীর্ঘ হতে লাগল। অনিতার চোখের কোটরের সাদা অংশ রক্তে ভরে গেল। সেই রঞ্জিত আঁখিযুগলে জেগে উঠল অভিশপ্ত কালো গহ্বর। অনিতা দাঁত কিড়মিড় শুরু করল। অনুরণন শুরু হলো তার অধরে। দেহ কম্পিত হতে লাগল ভয়ংকর মাত্রায়। হিসহিসে শব্দের সাথে তার মস্তিষ্ক নড়তে লাগল। নাসিকা থেকে নির্গত হতো লাগল খরখরে, তীক্ষ্ম, বীভৎস আওয়াজ। আচানক ডাক পড়ল।
“অনিতা!”
অনিতার দেহ কম্পন ছেড়ে দিলো। তার চোখ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো। মুখে স্বাভাবিকতা আসতেই পেছন ফিরল সে। তেহজীব উৎকণ্ঠিত চোখে চেয়ে আছে। সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করল—
“কী হয়েছে তোমার?”
অনিতা মাথা নিচু করল। আনম্র কণ্ঠে বলল—
“ক্ষমা করবেন, ছোটো রাজ।”
তেহজীব বিরক্তি ঝুলিয়ে নিল নাকের ডগায়। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল—
“তোমাকে বলেছি না আমাকে এই নামে সম্মোধন করবে না।”
অনিতা নত মাথায় বলল—
“আমি দুঃখিত। বেগমরাণির আদেশ আছে।”
“বেগমরাণির আদেশ সবকিছু? আমার মতামতের কোনো মূল্য নেই?”
“আমি বাধ্য, ছোটো রাজ।”
“হুম। আমি কথা বলব বেগমরাণির সাথে। নিজের দিকে নজর দাও।”
“জি, ছোটো রাজ। আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
তেহজীব তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু সে ভুলে গেল, পানি নিতে এসেছিল সে।
,
,
,
অবিন্যস্ত কুন্তলে আড়াআড়ি ঢেকে আছে তোভিয়ার ক্রন্দন ভেজা মুখ। তার নিমীলিত নেত্রযুগলের ভারী বর্ষার ঢল নেমেছে গালে। তা চুইয়ে নেমে যাচ্ছে চিবুক বেয়ে। তার সামনেই বজ্রকঠোর জেহেন। কিঞ্চিৎ সামনে এগিয়ে এসে বাম পায়ের হাঁটু মেঝেতে ঠেসে, ডান পায়ের হাঁটু ভাঁজ করে বসল। তোভিয়ার নতমুখ চিবুক ধরে উঠিয়ে ধরল। রোদনে আচ্ছন্ন আননেও চন্দ্রাতপের অবাধ দ্যুতি। তোভিয়ার এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা চুল সরিয়ে দেয় জেহেন। মাথা থেকে কপালের সামনের দিকের চুলগুলো দন্ডায়মান হয়ে ছুঁয়ে আছে মেঝে। জেহেন সেই চুল সরিয়ে পিঠে ঠেলে দেয়। উন্মুক্ত হয় তোভিয়ার গ্রীবাদেশ। রাদিয়াতের ধারালো নখের আঘাতে রক্তের স্রোত মন্থর গতিতে বেরিয়ে আসছে চামড়া ভেদ করে। জেহেনর চোখ প্রজ্জ্বলিত হলো। তার শুকনো গলা অস্থির হয়ে উঠল। ওষ্ঠাধরের গাঢ় স্পর্শে শুষে নিল তোভিয়ার গ্রীবাদেশের নোনতো ঘন তরল। আবেশে চোখ বুজে নেয় তোভিয়া। ক্রন্দনে ভেজা গলায় বলে উঠে—
“আম্মি কী কখনো আমাদের চিনবে না? ”
তোভিয়ার ঘাড় থেকে মাথা সরিয়ে আনে জেহেন। তার পুরু, শুষ্ক অধোরষ্ঠে লেগে আছে রক্তের ঈষৎ ছাপ। সে উঠে দাড়ায়। জেহেনের কক্ষের বৃহৎ দেয়ালের মাঝে একটা কাঠের তৈরি বাক্স লাগানো। দ্বিতল বাক্স আকৃতির বস্তুটির দরজা কাঁচের তৈরি। তার ভেতরে ছোটো ছোটো কৌটা ভর্তি বনজ ঔষধের মিশ্রন। জেহেন বাক্সটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল—
“কেন গিয়েছিলে?”
“আম্মি আজও খায়নি।”
“নতুন কিছু নয়।”
“আম্মি কী কখনো ঠিক হবে না?”
জেহেন একটা কৌটা নিয়ে তোভিয়ার কাছে আসলো। হাঁটু মুড়ে বসে তোভিয়ার ক্ষত জায়গাতে কৌটা হতে ঘন, শুষ্ক তরল নিয়ে প্রলেপ দিয়ে দেয়। শীতল অনুভূতি হলো তোভিয়ার! জেহেন কৌটাটা বক্সে রেখে কাচের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলল—
“আমি ফিজিসিয়ান নই।”
“তাহলে আম্মিকে কেন ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন না?”
“তোমার ভাইকে বলো।”
“ভাইয়াকে দেখলে আম্মি আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
জেহেন দেয়ালের পাশ ছুঁয়ে জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে মুখ করে সোজা হয়ে দাড়ায়। এখান থেকে মহলের পেছনের মহাচ্ছায়া জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। এই জঙ্গলের শেষ কেউ জানে না। জেহেন সেই জঙ্গলের দিকে অনিমেষ চেয়ে থেকে বলল—
“কোনো মা তার ছেলেকে সহ্য করতে পারে না। তা কী করে হতে পারে তোভিয়া? নুয়ায়াম সত্যিই তোমার ভাই? ”
চলবে,,,