ছায়াকরী পর্বঃ২

0
656

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

চেয়ারের নরম গদিতে পাখিটিকে রেখে তার দিকে গভীর পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত নুয়ায়াম। তার অস্থির চাহনিতে কিছু একটা ছিল। নীল আঁখির পাখিটি অদ্ভুতভাবে নুয়ায়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। নুয়ায়াম টিশু বক্স থেকে টিশু নিয়ে প্রথমে রক্তের দাগ মুছে দিলো। পাখিটি যেন পরম আস্থার স্থল খুঁজে পেয়েছে!

চকিতে উঠে দাড়াল নুয়ায়াম। পেছন ফিরতেই বোনের আদুরে আলিঙ্গন। হেসে উঠল নুয়ায়ামের চোখ দুটি। তার লালাভ অক্ষিগোলকে কমলা রঙের মনি। তার মাঝে কুচকুচে কালো ক্ষুদ্র বিন্দু। নুয়ায়াম চমকে পেছনে ফিরতেই তার চোখের রং স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঘোলা বিড়াল চোখ। তোভিয়ার আদরসিক্ত কণ্ঠের বাণ ছুটল—

“এত দেরি হলো কেন?”

নুয়ায়াম হাসল। এক পশলা স্নেহময়ী হাসি। মৃদু স্বরে বলল—

“পথে একটা অ্যাকসিডেন্ট হলো তাই।”

তোভিয়া বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল—

“দেখি, দেখি কোথায় লেগেছে? তুমি ঠিক আছ তো?”

নুয়ায়াম মৃদু হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—

“কিছু হয়নি আমার। তবে অন্য কারো হয়েছে।”

নুয়ায়াম সরে দাড়ায়। চেয়ারের ওপরে থাকা শুভ্র রঙের পাখিটিকে দেখে আন্দোলিত হয় তোভিয়ার মন। সে নরম হেসে হাঁটু গেড়ে বসে। আলতো হাত রাখে পাখিটির ছোট্ট মাথার ওপর। তার হাতের তালু ভরে যায়। মন্ত্রমুগ্ধ হেসে বলল—

“ওকে কোথায় পেলে ভাইয়া?”

“গাড়ির ডিকির ওপর পড়েছিল। সম্ভবত, পায়ে ব্যথা লেগেছে।”

তোভিয়া সন্ধানী চোখে খুঁজতে লাগল। কোথায় ব্যথা পেয়েছে পাখিটি! করুন সুরে বলে উঠল—

” ইশ! কতখানি কেটে গেছে!”

নুয়ায়াম দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি সচল হলো জেহেনের উপস্থিতিতে। জেহেন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। খানিকটা দূরত্ব রেখেই তার গতি রোধ করল সে। নুয়ায়াম গাঢ় চোখে তাকাল। সে চাহনির তীক্ষ্মতা থেকে নিজেকে লুকিয়ে নিল জেহেন। তার দৃষ্টি তোভিয়ার দিকে। মনুষ্য বাচ্চাদের মতো বুকের কাছে আগলে নিয়েছে পাখিটিকে তোভিয়া। দুই হাতের তালুর আচ্ছাদনে রেখে মুক্ত গলায় ডাকল—-

“অনিতা! অনিতা!”

অনিতা নামের মেয়েটি খালি পায়ে দৌড়ে এলো। তার পায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে চেচিয়ে উঠে তোভিয়া—

“তোমার পা খালি কেন?”

অনিতা ভয়ে শিউরে উঠে। সে জড়ানো গলায় বলল—

“রান্নাঘরে ছিলাম।”

“এখানে আসার আগে জুতো কেন পরোনি? ভুলের অবকাশ নেই। যাও, এখান থেকে।”

“জি, ছোটো মালকিন।”

জেহেন তীর্যক হেসে বক্রোক্তি করল—

“জুতার ব্যবহার নিয়ে তুমি খুব শঙ্কিত তোভিয়া? তোমার ভাইয়ের পায়ের দিকে তাকিয়েছ?”

তোভিয়া চট করে নুয়ায়ামের পায়ের দিকে তাকায়। বিভ্রম নিয়ে বলল—

“ভাইয়া।”

নুয়ায়াম নত মুখে বলল—

“দুঃখিত আমি।”

তোভিয়া জেহেনের দিকে চাইল। সে এক অদৃশ্য তাচ্ছিল্য দেখতে পেল জেহেনের ওই শীতল চোখে।
,
,
,
বিশাল খাবার টেবিলের এই প্রান্তে বসেছে নুয়ায়াম। তার কাধে শোভা পাচ্ছে সেই পাখিটি। পাখিটির অদ্ভুত আচরণে বিভ্রান্ত সে। পাখিটির পায়ের দিকটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে তোভিয়া। আপাতত নুয়ায়াম খাওয়ায় ব্যস্ত।

টেবিলের মাঝের উত্তর দিকটায় বসেছে তেহজীব। তার পরনে কালো শার্ট। দুই প্রান্তে ইতি-বিতি করে তাকাচ্ছে সে। কারণ, টেবিলের আরেক প্রান্তে বসেছে জেহেন। দশ চেয়ার বিশিষ্ট টেবিলের দুই প্রান্তে দুই মানবের অবস্থান। মাঝের মধ্যস্থতাকারী তেহজীব। অজ্ঞাত কারণেই নুয়ায়াম আর জেহেনে মাঝে চলে স্নায়ু যুদ্ধ। যা তাদের ভেতরকার সুপ্ত মানবদের এক ঘোষণাবিহীন, অস্ত্রবিহীন, চক্ষুযুদ্ধ।

জেহেন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার খাবার এখনো আসেনি। জেহেনের তিন বেলার খাবার তোভিয়া নিজের হাতে বানায়। রান্নায় সহযোগিতা করার জন্য অনিতা আছে। অন্য সকলের জন্য খাবার তৈরিতে অনিতার সাহায্য নিলেও, জেহেনের জন্য সে নিজেই খাবার তৈরি করে। তেহজীব মিষ্টি করে হেসে বলল—

“ভাই! ভাবতো, যদি তোভিয়ার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে তোমার জন্য এই স্পেশাল রেসিপির খাবারটা তৈরি করবে কে?
না, মানে বলছিলাম, তোমার এই আধা সিদ্ধ মাংস খাওয়ার স্পেশাল রেসিপি তো আর তোভিয়া ছাড়া অন্য কেউ তৈরি পারবে না। তখন না আবার তোমাকে না খেয়ে থাকতে হয়!”

অধর কোণে হেসে উঠল নুয়ায়াম। খলখল করে হেসে উঠে তেহজীব। জেহেন শান্ত, নিষ্কম্প, অবিচল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তেহজীবের দিকে। তেহজীবের মুক্ত হাসির মাদল মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল।
তোভিয়ার উপস্থিতি পরিবেশ স্বাভাবিক করল। শুভ্র রঙের এই চাঁদবদন কন্যাকে কী করে ফেরায় জেহেন? তেহজীব বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সাদা গোল জামা পরেছে তোভিয়া। তার গহন অরন্যের অনুরুপ চুল বিছিয়ে আছে পিষ্ঠদেশ জুড়ে। টলটলে চেহারায় রক্তিম অধর। ওই ঠোঁট, ওই চোখ আর ওই চন্দ্রানন। অপার্থিব, অশরীরী ! ঘোর লেগে গেল তেহজীবের চোখে। ভেজা চুলের তোভিয়ার স্নিগ্ধ , মোলায়েম, কুয়াশা ভেদ করা সজীব রূপে মোহিত তেহজীব।

তোভিয়া ছোট্ট করে হেসে তার হাতের ট্রে টেবিলে নামিয়ে রাখল। সেখানে থেকে খাবার তুলে নিল আরেকটি প্লেটে। তা জেহেনের সামনে রাখল। ঝাঁঝালো সুগন্ধ বের হচ্ছে তা থেকে। কিন্তু দেখতে!

আধা সেদ্ধ গোলাপি রঙের মাংসের ওপর চিলিফ্ল্যাক্স ছড়ানো। তার ওপর কালো গোল মরিচের গুড়া। তোভিয়ার নিজের হাতে তৈরি করা এক ধরনের সস রাখা পাশেই। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, জেহেনের খাবারের অদ্ভুত নিয়মের ওপর কারো কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। তোভিয়া জেহেনের পাশের চেয়ারে বসল। তার অধরে প্রসন্ন হাসি। জেহেন সোজা হলো। কাঁটা চামচের সাহায্যে মাংসের টুকরো মুখে দিতেই চমকে গেল সে। স্বাদ পরিবর্তন হয়েছে। সে দৃষ্টি শক্ত করে চাইল তোভিয়ার দিকে। তোভিয়া অধর বিস্তৃত করল। চেয়ার থেকে আলগা হয়ে জেহেনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—-

“বলুন তো, আজ কী দিয়েছি?”

জেহেন কথা বলল না। অনিতা তোভিয়ার কাছে এসে দাড়াল। তোভিয়া বলল—

“কিছু বলবে?”

“জি ছোটো মালকিন।”

“বলো।”

“বেগমরাণি আর ছোটো বেগমের খাবার কী তাদের কক্ষে পাঠিয়ে দেবো?”

“হুম।”

“আর বড়ো বেগম?”

তোভিয়া কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। নত হলো অনিতার মুখমন্ডল। সে কাঁচুমাচু গলায় বলল—

“ক্ষমা করবেন।”

“তুমি যাও এখান থেকে। আম্মির খাবার আমি তার কক্ষে নিয়ে যাব।”

“জি।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here