ছায়াকরী পর্বঃ১

0
2089

কালো চিতাটি ক্রোধে বিহ্বল হয়ে খুবলে নিল নিশ্চল মানুষটির হৃৎপিন্ড। কম্পিত যন্ত্রটি অনেক সময় পূর্বেই তার গতিবিধি থমকে দিয়েছে। কচকচ করে দন্তপাটির নিষ্পেষনে তা দলিয়ে নিচ্ছে কালো চিতাটি। তার জ্বলন্ত সবুজ চোখ দুটো ক্রমশ উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। হৃৎপিন্ডের শেষাংস গিলে নিয়েই ধারালো পাঞ্জার চিতাছ  বসাল কলিজায়। মৃত লোকটির বুক চিরে আছে। ভেতকার সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ শান্ত। রক্ত স্রোতে মৃত্তিকার বাদামী বর্ণ রক্তিম হয়ে আছে। কলিজা খুবলে নিতেই জমাট রক্তের বান ছুটল। ছিটকে মেখে গেল তা কালো চিতাটির মুখচ্ছবিতে। রক্তের ধারা চুষে নিচ্ছে শুকনো ভূতল। চিতাটির লালামিশ্রিত রক্ত টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে মৃত দেহটির ওপর। মৃত দেহটির উন্মুক্ত, স্থির, নিষ্কম্প চোখ দুটো আকাশে পান চেয়ে আছে। প্রাণহীন চাহনি। মৃত দেহটির ওপর থেকে নেমে আসে চিতাটি। গরগর করে বিদঘুটে, ভয়ংকর শব্দ করে। তারপর শান্ত শব্দ। তার চোয়ালের দুই পাশের ফোলা ভাব কমে যায়। মুহুর্তেই মৃত দেহটির ওপর পূনরায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিড়ে নেয় তার নরম মাংস। চিবুতে থাকে নির্বিঘ্নে। উদরপূর্তির খুশি মনে দোলা দিতেই মৃত খন্ড দেহটির কাছ থেকে দূরে সরে আসে চিতাটি। সেখান থেকেই শীতল সবুজ চোখ দুটো দিয়ে চেয়ে দেখে মৃত লোকটির দেহ টেনে নিয়ে আসার খরখরে মাটির ছাপ। আচনক চিতাটির আঁখিযুগল পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন মাত্রায় জ্বলে উঠে। সবুজাভ অক্ষিকোটরের মাঝে গাঢ় সবুজ মনি। তার মাঝে ক্ষুদ্র কালো বিন্দু। গাঢ় রং আরও উজ্জ্বল হলো। দিনের রোশনাই টুপ করে ঢুকে পড়ল গভীর শ্বাপদসমাকীর্ণ জঙ্গলে। কালো চিতাটি ভীত হলো না। সে স্বাভাবিক করল তার চাহনি। উড়ন্ত পত্রীদের কুজন উঠল। ভয়ংকর প্রাণীদের গর্জন। চিতাটি তার নরম পায়ের ছোটো ছোটো কদমে দেহটির পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতে লাগল। সামনে পড়ল ছোট্ট কাঠবিড়াল। চিতাটিকে দেখেই দৌড়ে গাছে চড়ে গেল। চিতাটি ভেতর থেকে অদ্ভুত, হিংস্র শব্দ করে কিঞ্চিৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল গাছের ডালে বসা কাঠবিড়ালের দিকে। সেই হিংস্র চাহনি দৃষ্টিগোচর হতেই কাঠবিড়ালটি লাফিয়ে লাফিয়ে আরও উঁচু ডালে উঠে যায়। সেখান থেকে আবার তাকায় চিতাটির দিকে।

হরিণ ছুটে যাচ্ছে তূরন্ত বেগে। চিতাটির উপস্থিতি হরিণের টানা চোখে ভয়ের ঝড় তুলে দিয়েছে। চিতাটির চলনে রাজকীয় ভাব। ভয়ের লেশমাত্র নেই তার ভয়ংকর, দৃঢ়, নিশ্চিন্ত আননে। ঘন জঙ্গলে নাম না জানা গাছের বাস। তার পাশ ডিঙিয়ে চলছে চিতাটি। বিভাবসুর তরল অংশু যৎসামান্য প্রবেশের অধিকার পায় এই গহন, গা ছমছমে, দুর্বোধ্য জঙ্গলে!

জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসে চিতাছটি। বিস্তৃত অনিকেত প্রান্তরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পলেই এক অদ্ভুত, গা হিম করা কালো ধোঁয়া বিচ্ছুরিত হতে থাকে চিতাটির কৃষ্ণকায়া থেকে। গাঢ় হতে থাকে সেই ধোঁয়া। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়। হঠাৎ লুপ্ত হয়ে যায় সেই ধোঁয়ার কুন্ডলি। আর দৃশ্যত হয় সবুজের মনির অধিকারী এক অকল্পিত সুদর্শন পুরুষ!
,
,
,
নির্ভয়চিত্তে ড্রাইভ করছে নুয়ায়াম। তার সোজা দৃষ্টি। পিচ ঢালা পথ। পথের দু’ধারে সরু গাছের সারি। গাছের নিচের দিকে ভূতলে ঘাস বিছানো। তাতে ছোটো ছোটো সাদা রঙের ফুল। ফুরফুরে হাওয়া। প্রভাকরের শান্ত, তীর্যক কিরণ। গাড়ির জানালা খোলা। তা দিয়ে হাওয়ার তোড়ের সাথে মৃদু রোদের লুকোচুরি।

সহসা নুয়ায়ামের চোখের পাল্লা কেঁপে উঠল। অদূরে কাউকে দেখে তার হৃৎস্পন্দন থমকে গেল। চোখের দৃষ্টি অস্থির, এলোমেলো। কুঞ্চিত কপাল, ভীত অন্তঃকরণ, রুদ্ধশ্বাস! ব্রেক কষলো নুয়ায়াম। স্টেয়ারিং থেকে হাত উঠিয়ে দুই হাতের বাজু আড়াআড়ি করে চোখ ঢেকে ফেলল। সময় গেল। স্থির হয়ে গেল সব। থেমে গেল গাড়ির চাকার কর্কশ শব্দ, বাতাসের আন্দোলন, শ্বাসের কম্পন। কিছু সময় সব বিবশ হয়ে রইল। কোনো শব্দের আভাস না পেয়ে নুয়ায়াম ধীরে ধীরে সচল হলো। চোখের ওপর থেকে দুই হাত সরিয়ে সামনে তাকাল। শুভ্র বসনে আবৃত রমণী উদাও! হতভম্ব হয়ে যায় নুয়ায়াম। ত্রস্তে বের হয়ে আসে গাড়ির ভেতর থেকে। গাড়ির সামনে দাড়িয়ে উদ্ভাসিত দৃষ্টি প্রক্ষেপ করে সম্মুখপানে।

শুভ্র আলখাল্লা পরিহিত এক নীল নয়নাকে দেখেছিল নুয়ায়াম। গাড়ির ব্রেক কষেছে তাকে বাঁচাতেই। কিন্তু বিধিবাম! রমণী কোথাও নেই। ভয়ে জারকাঁটা দিয়ে উঠে নুয়ায়ামের লোমকূপ। সে ভীত, আড়ষ্ট, বিচলিত। আচনক গাড়ির পেছন দিকটায় শব্দ হয়। চকিতে পেছন ফিরে নুয়ায়াম। দিনের আলোতেও অাছোঁয়া ভয় তাকে আহত করে তুলল। সে ধীরে ধীরে পদযুগল বাড়াতে থাকে। গাড়ির ডিকির কাছে আসতেই দেখতে পেল একটা পাখি পড়ে আছে। তার সফেদ রঙের খানিক অংশ রক্তিম। নুয়ায়াম সচেতন দৃষ্টিতে দেখল, সাদা ধবধবে পাখিটির চোখ দুটো গাঢ় নীল, আরক্ত অধর। সে আলতো করে পাখিটিকে হাতে নিল। নুয়ায়াম ভড়কে গেল। ডিকির ওপর রক্তের আলপনা। পাখিটির দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে উদঘাটন করল, পাখিটির পায়ের দিকের কোনো অংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। হলুদ রঙের পায়ে রক্তের স্মিত ধারা।
,
,
,
দরজার পাল্লা খুলেই ব্যস্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে জেহেন। তার বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক। জিবের ডগায় এখনো রক্তের নোনতা স্বাদ লেগে আছে। দ্রুত হাতে দরজা লাগিয়ে থমকে যায় সে। কারো গায়ের ঘ্রাণ এসে ঝাপটে ধরছে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়। জেহেন ক্রোধিত হয়। চোখের কোটর পূর্ণ প্রশ্বস্ত করে ঘার ফেরাতেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দীর্ঘ অপেক্ষারত অঙ্গনা। জেহেন বিরক্ত হয়। কিন্তু তা প্রকাশ করল না। সে স্থবিরচিত্তে দাঁড়িয়ে রইল। অঙ্গনার বুকের খরায় বর্ষণ হলো। সে অবগাহনে মত্ত সেই শীতল নহরে। জেহেনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বিধুর কণ্ঠে শুধাল—

“কোথায় ছিলেন আপনি?”

প্রত্যুত্তর করল না জেহেন। নিষ্পেষিত চিত্তে অটল হয়ে রইল। অঙ্গনা নিমগ্ন রইল নিজের আদুরে অভিলাষে। কণ্ঠে তুলল আকুলতা। বলল—

“বলছেন না কেন? কোথায় ছিলেন জেহেন?”

জেহেনের শ্বাস ক্ষুব্ধ হলো। অঙ্গনার কটিদেশ চেপে ধরল প্রবল আক্রোশে। নারীদেহটি সেই আদুরে যন্ত্রনা সহ্য করে নিল। জেহেনের বক্ষ পাটাতনে সমাহিত হলো। জেহেন তার অপ্রকট ইচ্ছা দমিয়ে রাখতে পারছে না। নিজের তীক্ষ্ম ঘ্রাণেন্দ্রিয় বুলাতে লাগল কোমল নারীদেহটির গলদেশে, কাধে। বক্র হাসে জেহেন। উহু, নারীদেহের কমনীয়তা নয়, তোভিয়ার নরম মাংসপিন্ড আর নোনতা রক্তের স্বাদ জেহেনকে উন্মাদ করে তুলছে। সে ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল—-

“তোমাকে আমি নিষেধ করেছি তোভিয়া। আসবে না আমার কক্ষে। বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি আমার কথা শুনছ না।”

তোভিয়া নাসিকা ঘষতে থাকে জেহেনের বুকে। আহ্লাদী গলায় বলল—

“অন্য কারো অধিকার নেই আসার।”

দাঁত-মুখ খিঁচে ফেলে জেহেন। বাম হাতে তোভিয়ার বাজু চেপে ধরে সজোরে। ছুড়ে ফেলে তাকে নিজের থেকে আলগা করে। তোভিয়া ভয়ভীত। তার প্রস্ফুটিত চাহনি জেহেনের সবুজ মনিযুক্ত আঁখিযুগলে। যা মুহূর্তেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

লাস্যময়ী, ভুবনমোহিনী, হৃদকাঁপানো তোভিয়া! তার ধনুকের ন্যায় বাঁকানো ভ্রূযুগল, ভ্রূ ছুঁই ছুঁই করা পক্ষ্মচ্ছেদে আচ্ছাদিত ঘন কালো ভরাট মনিযুক্ত লোচন, জবা ফুলের রং ছড়িয়ে আছে তার ওষ্ঠধরে। নিতম্ব ছাড়িয়ে যাওয়া গহীন অরণ্যের ন্যায় কুন্তল। ফুলস্লিভ গোলাকার জামা। যাতে করে তোভিয়ার সারা অঙ্গ ঢেকে আছে। শুধু তার হাতের কব্জি আর পায়ের গোড়ালি দৃশ্যমান। অকল্পনীয় চাঁদ! দিন কী রাত, সব সময় তার দ্যুতি ছড়াতে থাকে। সেই চাঁদ বদন থেকে চোখ সরায় জেহেন। নিস্পৃহ অভীপ্সা!

ছলছল লোচনে চেয়ে আছে তোভিয়া। জেহেন ভাবাবেশহীন। তার অন্যমনষ্ক দৃষ্টি খোলা জানালায়। পাহাড়ের মতো অটল শিড়দাঁড়া। তা দৃঢ় করেই দাঁড়িয়ে আছে সে। তোভিয়া অসহায় গলায় বলে উঠে—

” এমন না করলেই নয়?”

“বাধ্য নই আমি।”

জেহেনের কণ্ঠে নিষ্করুণতা। জলসিক্ত আঁখি দুটো মেলে ধরে রেখেছে তোভিয়া। জেহেন সোজা হেঁটে চলে যায় জানালার কাছে। তার পাশ ঘেঁষেই ব্যলকনিতে যাওয়ার দরজা। সেখানে এসে দাঁড়ায় সে। লোহার সদর দরজা দিয়ে মাত্রই প্রবেশ করেছে নুয়ায়ামের সাদা রঙের গাড়ি। জেহেন গম্ভীর স্বরে বলল—-

“তোমার ভাই এসেছে।”

পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল তোভিয়া। সদর দরজার দিকে দৃষ্টি ফেলে বলল—

“তার সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই?”

জেহেন তার শীতল নেত্রগোলক শিথিল করে চাইল তোভিয়ার দিকে।
,
,
,
,
করিডোর দিয়ে শশব্যস্ত হয়ে ছুটছে তোভিয়া। ধাক্কা লেগে যায় কারো সাথে। রাগান্বিত হলো পুরুষটি। রুষ্ট কণ্ঠে বলল—

“হরিণের মতো দৌড়াচ্ছিলে কেন?”

তোভিয়া বসন্তের সজীবতা টেনে নিল শুষ্ক ওষ্ঠাধরে। হৃদয় বিগলিত হেসে বলল—

“ভাইয়া এসেছে।”

তেহজীব চোখের কোটর ক্ষুদ্র করল। স্পৃহাহীন স্বরে বলল—

” আমি ভেবেছি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এসেছে।”

“আমার ভাইয়া মোটেও তার থেকে কম নয়। এই পদ্মনগরের রাজকুমার সে।”

তেহজীব হু হা করে বাতাস কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলল—

“পদ্মনগরের রাজার আমল চলে গেছে আজ থেকে কয়েক শত বছর আগে। তোমার ভাই কোথা থেকে টপকে পড়ল?”

আড় চোখে তাকাল তোভিয়া। খনখনে গলায় বলল—-

“খামোশ হও যাও মানব। যেতে দাও আমাকে। ভাইয়া এসেছে।”

“জরুর রাজকুমারী। আপনি প্রস্থান করুন। আপনাকে তো আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে।”

তোভিয়া ভাব নিয়ে নাকের ডগায় আঙুলের আগা ঘষে ব্যঙ্গ করে বলল—

“দিবাস্বপ্ন মানব!”

তারপর দপদপিয়ে চলতে শুরু করল। তেহজীব ক্রুর হেসে স্বগতোক্তি করল—

“তোমাকে আসতেই হবে ভবিতব্য রাণিসাহেবা। আমার হৃদকুঠিরে তোমাকে আসতেই হবে।”

চলবে,,,

# ছায়াকরী( ছায়া করে যে)
# পর্বঃ১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here