# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩০
লেখনীতঃ তাজরিয়ান খান তানভি
ভাইকে দেখে নিজেকে সামলাতে পারল না তোভিয়া। নুয়ায়ামের বুকের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল—
“কোথায় ছিলে তুমি? কতবার বলেছি দ্রুত ফিরে আসতে!”
নুয়ায়াম অধর প্রসারিত করল। তার চোখ দুটো আচানক জ্বলে উঠল। বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—
‘”দুঃখিত! একটু দেরি করে ফেলেছি।”
নুয়ায়ামের বুক থেকে মাথা তুলে তোভিয়া। ভরাট চোখে তাকিয়ে ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বলল—
“একটু বলছ! কখন বেরিয়েছ খেয়াল আছে তোমার?”
সহাস্য অধরে বলে উঠে নুয়ায়াম—
“ভুল হয়েছে, ক্ষমা করুন পদ্মকুমারী!”
নুয়ায়াম দুই হাত জোড় করে কপট ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি তুলে। তোভিয়া ভাইয়ের দুই হাত ধরে নাক ফুলিয়ে বলল—
“আর কখনো এমন করবে না। ক্ষমা করব না আমি।”
নুয়ায়াম একগাল হেসে বলল—
“জো হুকুম, পদ্মকুমারী। আর বিলম্ব হবে না। এই অধমকে প্রথমবারের মতো ক্ষমা করে দিন!”
ভাইয়ের দুষ্টুমির ছল বুঝতে পারে তোভিতা। ঝুমঝুমিয়ে হেসে উঠে সে। জেহেনের গম্ভীর কণ্ঠ থামিয়ে দিলো সেই হাসি।
“কোথায় গিয়েছিলে নুয়ায়াম?”
নুয়ায়াম সতেজ গলায় আগ্রহ নিয়ে বলল—
“ডঃ আরইয়াজের কাছে। তিনি একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। আম্মিজানের কথা বলেছিলাম তাকে। তিনি আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।”
জেহেন ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। গাঢ় স্বরে বলল—
“কোথায় থাকেন তিনি?”
“অশীতপুর।”
“তুমি অশীতপুর গিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ।”
নুয়ায়াম এগিয়ে গেল জেহেনের কাছে। হাস্যোজ্জ্বল গলায় বলল—
“তিনি বলেছেন, মহলে আসবেন। আম্মিজানকে স্বচক্ষে দেখবেন।
আরে জানো না, কী হয়েছে! সেখানে….।”
জেহেনের চোখ দুটো কেমন অদ্ভুতভাবে সপ্রতিভ হলো। নুয়ায়ামের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ল তক্ষুণি। সে নীরব হয়ে গেল। জেহেন প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে বলল–
“চুপ করে গেলে যে?”
নুয়ায়াম থতমত গলায় বলল—
“না…মানে…তেমন কিছু নয়। আমি কক্ষে যাচ্ছি। ফ্রেশ হতে হবে।”
দুই জোড়া চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেকে নিয়ে চলল নুয়ায়াম। ভ্রূকুটি করে তাকাল জেহেন। সে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, নুয়ায়াম কিছু লুকিয়েছে। তোভিয়া কোনো ধরনের চিন্তা মাথায় আনলো না। জেহেন তার দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধ হেসে বলল—
“আমি ভাইয়ার জন্য শরবত নিয়ে যাচ্ছি। আপনার চাই?”
জেহেন হালকা করে মাথা নাড়িয়ে ঋণাত্মক সম্মতি দিলো। কাষ্ঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল—
“তেহজীব কোথায়? ওকে দেখেছ?”
তোভিয়া সরাসরি বলল—
“না তো। সকাল থেকেই তেহজীবকে আমি দেখিনি। দুপুরেও খায়নি। ইশ! ভীষণ ভুল হয়েছে আমার। খোঁজ নিয়েও দেখিনি। আম্মির সাথে ব্যস্ত ছিলাম বলে, মাথাতেই আসেনি তেহজীবের কথা!”
জেহেন কড়া শ্বাস ফেলে বলল—
“তুমি নুয়ায়ামের কক্ষে যাও। আমি যাচ্ছি তেহজীবের সাথে দেখা করতে।”
“আচ্ছা।”
,
,
,
দরজায় করাঘাত পড়তেই আওয়াজ করে মেহেক।
“ভেতরে এসো।”
জেহেন আনম্র ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করল। তেহজীবকে তার নিজ কক্ষে খুঁজে না পাওয়াতে মেহেকের কক্ষে এসেছে সে। মেহেকের পুরো কক্ষ জুড়ে নেশাক্ত গন্ধের বিচরণ। অসহনীয় ! নাকের ডগায় বিরক্তি লেপ্টে গেল জেহেনের। মেহেক তার দীঘল কালো রেশমি চুলে চিরুনি চালাচ্ছেন। লাল চন্দন কাঠের তৈরি ড্রেসিং টেবিল। কারুকাজ খচিত কাঠের মাঝে থাকা স্বচ্ছ আরশিতে নিজেকে দেখে পুলকিত মেহেক। তিনি ঝলমলে হেসে বললেন—
“কিছু বলবে?”
জেহেন ভেতরে প্রবেশ করলেও বেশিদূর এগিয়ে আসেনি। অনেকটা দূরত্ব নিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার শিড়দাঁড়া দৃঢ়, বুকের ছাতি ফুলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো ছেড়ে রাখা, নত মস্তিষ্ক। বিনয়ীভাব তার বলিষ্ঠ দেহে। সে নরম কণ্ঠে বলল—
“তেহজীব কোথায়?”
মেহেক দর্পণে নিজেকে দেখলেন। তার রঙধনু রাঙা চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর। যে কাউকে সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে। জেহেন কখনো মেহেকের চোখের দিকে তাকায় না। অস্বস্তি হয় তার। যখনই সে মেহেকের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকায়, তার মনে হয় ওই চোখ হতে কিছু একটা নিঃসৃত হয়ে তাকে বিবশ করে দিচ্ছে। মেহেকের অধরের ওই হাসিও সহ্য হয় না জেহেনের। মা বলে সে কখনো ডাকেনি মেহেককে। অন্য সকলের মতো তাকে ছোটো বেগম বলেই সম্মোধন করে।
মেহেক উঠলেন। ছোটো ছোটো পা ফেলে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন জেহেনের কাছে। তার পরিহিত শাড়িতে বাঙালিয়ানা ছাপ। কুচি ছাড়াই পরেন তিনি। তার নিঁখুত দেহসোষ্ঠবে সেই শাড়ির সুবিন্যস্ত সাজ, তাকে দ্বিগুন মোহনীয় করে। কুচকুচে ঘন পল্লবে আবৃত চোখ দুটোতে সে জেহেনকে দেখছে। জেহেনের নিম্নমুখী আনন। তবুও তার কর্ণরন্ধ্রে রিনিঝিনি করে ভেসে আসছে মেহেকের চুড়ি, নুপূরের মাতাল শব্দ। আর তীব্র হচ্ছে সেই অস্বাভাবিক, দুর্বোধ্য ঘ্রাণ!
জেহেনের কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে থামলেন মেহেক। সুডোল কণ্ঠে বললেন—
“তেহজীব তো মহলে নেই।”
“কোথায় গেছে সে?”
“ভাইয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে?”
চকিতে মাথা তুলল জেহেন। মেহেকের অধরের সে হাসি, চোখের তীক্ষ্মতা, মুখশ্রীর জৌলুসতা আচানক জেহেনকে বিচলিত করল। সে চোখ নামিয়ে নিল। জেহেন পূনরায় বলল—
“তেহজীব কোথায় ছোটো বেগম?”
মেহেক আলতো হেসে বললেন—
“সে দীঘাগড় গেছে । তোমার বাবার এক বন্ধু থাকেন সেখানে। তিনি কিছুদিন পূর্বেই ফিরে এসেছেন। জুহায়ের কিছু পাঠিয়েছেন। তাই আনতে গেছে তেহজীব।”
“আমাকে বলেননি কেন?”
“তুমি তো ব্যস্ত। নতুন বিবাহ হয়েছে তোমার। অর্ধাঙ্গীনিকে সময় দেওয়া প্রয়োজন।”
দাঁতে দাঁত চেপে ধরল জেহেন। তার মাথার দুইপাশের রগ ফুলে উঠল। তিরিক্ষি হলো চাহনি। খরখরে গলায় বলল—
“বাবা কি ভুলে গেছেন যে তার একটি নয়, দুটো ছেলে! আমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজন বোধ করছেন না তিনি?”
মেহেক শান্ত গলায় বললেন—
“তোমার কি খুব রাগ হচ্ছে?”
“সেটা কি অসম্ভব কিছু?”
মেহেক নির্মল হেসে বললেন—
“তিনি কেন গেছেন, তাতো আমার জানা নেই। তবে ফিরে এলে তুমি তাকে এ প্রশ্ন করতে পারো।”
“আপনি তাকে শীঘ্রই ফিরে আসতে বলুন।”
“আমার কথা কি তিনি শুনবেন?”
জেহেন তীব্র মনঃকষ্ট নিয়ে বলল—
“কেন শুনবেন না? এখন তো আপনারাই তার সব।”
মেহেক অধর কোণে হেসে বললেন—-
“তুমিও তার পুত্র।”
“তিনি কী তা মানেন?”
মেহেক জবাব দিলেন না। জেহেনের চোখে-মুখে আ/গু/ন ঝরে পড়ছে। তার সবুজ আঁখিদ্বয় কঠোর, অবোধ্য হয়ে উঠল। রাগে তার বুকের পাঁজর কেঁপে উঠছে। তবে বাইরে সে শীতল। মেহেক আরেকটু কাছে এলেন। জেহেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন—
“তিনি অতি শীঘ্রই ফিরবেন। চিন্তা করো না।”
জেহেনে ফুঁসে যাচ্ছে। মেহেক নির্দ্বিধায় তার হাত জেহেনের কাঁধ থেকে ক্রমশ বুকের দিকে নামিয়ে আনতে গেলেই সহসা এক ঝটকা হাওয়া জানালার কপাট নাড়িয়ে দেয়। জেহেন চট করে মাথা তুলে তাকাল সেদিকে। তার দৃষ্টি গভীর হলো। ভয়ে তটস্থ হয়ে মেহেক বললেন—
“তোমার কী আর কিছু বলার আছে?”
জেহেন চোখ সরাল না। সে অনিমেষ চেয়ে রইল। তার চোখে দুর্দমনীয় কৌতূহল। কিছু একটা ছিল এখানে যা তার অগোচরে রয়ে গেল। জেহেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—
“আসি আমি। ”
“হুম।”
জেহেন কক্ষ থেকে বের হতেই কপাট বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল সে। বুকে উচাটন নিয়ে সামনে তাকাল। তার জানালা দিয়ে তূরন্ত বেগে এক ঝটকা বাতাস ঢুকে বিছানার ওপর ঘুরতে লাগল। যেন কোনো ঘূর্ণিঝড়! শো শো শব্দে উন্মাদ করে তুলছে কক্ষের নীরবতাকে। সেই মলয়ের ঘূর্ণন থেকে দৃশ্যমান হলো তেহজীব। তার চোখ দুটো জ্বলন্ত। মায়ের দিকে বিরূপ দৃষ্টিকে তাকাতেই মেহেক কেঁপে ওঠে। তেহজীব অবিশ্বাস্য গলায় দাপিয়ে উঠে বলল—
“কী করছিলেন আপনি ওর সাথে? আপনাকে আমি পূর্বেই সাবধান করেছি। আপনি….।”
নিজের গলায় আসা শব্দ পূনরায় গিলে নিল মেহেক। তার কোমল কায়া থরথরিয়ে যাচ্ছে। তেহজীবের চোখের কোটর মুহুর্তেই হলুদ রঙে ছেয়ে গেল। সেখানে স্পষ্টত হতে লাগল লালাভ মনি। তার খিঁচে রাখা মুখ ধীরে ধীরে কাঠামো বদলাতে লাগল। হাত দুটো প্রশস্ত হয়ে তা পালকের আচ্ছাদিত হলো। গলদেশ থেকে কটিদেশ পর্যন্ত ফুলে উঠে সেখানে আবিষ্কৃত হলো গুচ্ছ গুচ্ছ পালকের সমাবেশ। মানব আকৃতির পা দুটো সরু হয়ে নিম্নাংশ চওড়া হয়ে সেখানে স্পষ্ট হলো সরু আঙুল বিশিষ্ট পা। শাণিত ঠোঁট, লাভা গলিত চাহনি, আর তার সমুদ্র সমান আক্রোশে মেহেক স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজের পায়ে ভর করে বৃহদাকার পাখা দুটো ঝাপটাতে লাগল ইগল রূপের তেহজীব। ক্রোধে ফেটে পড়ে মেহেকের কাছে উড়ে আসতেই তার পাখার ঝাপটানিতে পালঙ্কের চারধারে টাঙানো সাদা রঙের পর্দা ছিড়ে মেঝের পাটাতনে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
চলবে,,,