ছায়াকরী পর্বঃ৩১

0
345

# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেহেক। তার এলোমেলো, অস্থির দৃষ্টি। তবে তা নিম্নমুখী। তেহজীব তার সামনে মানব অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে সে। বজ্রকঠোর কণ্ঠে বলল—

“কী করছিলেন আপনি? আপনি বুঝতে পারছেন, আপনার এই মোহ আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে? ভেবেছেন একবার, আম্মি?”

ঢোক গিললেন মেহেক। নতমুখ উঁচু করলেন। ভীত গলায় বললেন—-

“আ…সলে…।”

তেড়ে এলো তেহজীব। দারাজ গলায় বলল—

“আপনি আসলেই নির্বোধ! একজন বুদ্ধিভ্রষ্ট নারী! আপনি ভালো করেই জানেন, জেহেন সাধারণ মানব নয়। ওকে সম্মোহন করা এতটা সহজ নয়, যেভাবে আপনি তোভিয়ার বাবাকে করেছেন।”

মেহেক নিশ্চল, অনুভূতিহীন। তার শিরদাঁড়া দৃঢ়। ভরাট চোখে চাইলেন তেহজীবের দিকে। মেহেকের অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তিনি তার চোখ থেকে নিঃসৃত অদৃশ্য আলোক শক্তিতে সামনে দাঁড়ানো যেকোনো মানুষকে সম্মোহিত করতে পারেন। যখন মানুষটি চেতন হারিয়ে তার প্রতি আসক্ত হয়, তখন সেই জীবন্ত মানুষের পাঁজর ভেদ করে তার হৃৎপিণ্ড বের করে আনে মেহেক। তাজা হৃৎপিণ্ড কচকচ করে চি/বি/য়ে ভক্ষণ করেন তিনি। এমনটাই করেছিল তোভিয়ার বাবার সাথে। তখন বেগমরাণির ক্রোধ থেকে মেহেককে বাঁচাতে ফারাজ তার সত্তার ব্যবহার করেন। ফারাজের মতে, তোভিয়ার বাবা তার সেই সত্তা সম্পর্কে অবগত হওয়ার দরুণ, তাকে হ/ত্যা করে তিনি।

নিজ রাজ্যের একজন উল্লেখযোগ্য সুন্দরী মেহেক। দাসীর ঘরে জন্ম হয়েও তিনি পেয়েছেন রাজ পদবী। ফারাজের নজরে এসে যান। বেগমরাণি ছেলের ইচ্ছে পূরণে, মেহেককে পুত্রবধূ করেন। কিন্তু, কথায় আছে না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে বোকা হয়। মেহেকও তেমন। তার সৌন্দর্যের বিশ ভাগের এক ভাগ বুদ্ধিও নেই তার মস্তিষ্কে। তাকে এখনো তেইশ বছরের যুবতী মনে হয়। তার এই সৌন্দর্য ধরে রাখার গুপ্ত কৌশল জানা ফারাজের। সুদর্শন, বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষদের তাজা হৃৎপিণ্ড ভ/ক্ষন করেন তিনি। জোহায়েরের হৎপিণ্ডও তৃপ্ত করেছে মেহেকের অন্ত:পুরকে। বাড়ন্ত জেহেনের প্রতিও তার লোভাতুর দৃষ্টি বহু বছর থেকে। কিন্তু কখনো সুবিধা করতে পারেননি। তিনি যতটা বেগমরাণিকে ভয় করেন ঠিক ততটা নিজ অভ্যাসে বিবশ।
জেহেনকে তাদের পরিকল্পনার জন্য এখনো জীবিত রাখা হয়েছে। তাই মেহেক তার ওপর জোর খাটাতে পারেন না। নিজের অভীপ্সাকে দমন করে তিনি। অন্যদিকে, চতুর জেহেন কখনো মেহেকের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকায় না। তার চাহনির তীক্ষ্মতা তাকে জানান দেয় অদূরের বিপদকে।

মেহেক ভার গলায় বললেন—

“আমি দুঃখিত!”

“আপনি….। বুঝতে পারছেন, কী হতো? জেহেন শুধু মানব নয়, তার অভ্যন্তরে পশু সত্তাও বিদ্যমান। ওকে বশ করা সহজ নয়। আপনাকে পূর্বেও সাবধান করেছি আমি।”

“ক্ষমা করো পুত্র!”

তেহজীব হিসহিসিয়ে যাচ্ছে। রাগের দমকে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মেহেক ব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন। নিজের পালঙ্কের ড্রয়ার থেকে একটা কৌটা বের করলেন। তেহজীব পালঙ্কের নরম গদিতে বসল। তুলোর মতো তুলতুলে অনুভূতি। তার পিঠ উন্মুক্ত করলেন মেহেক। জেহেনের করা ছু/রির আ/ঘা/ত তার পিঠে দগদগ করছে। সেখানে প্রলেপ দিলেন মেহেক। পলেই তা মিলিয়ে গেল। স্বাভাবিক হয়ে গেল তেহজীবের দেহের চামড়া। তেহজীবের দেহের কোনো ক্ষ/ত একদিনের বেশি স্থায়ী হয় না। তবে বিশেষ ঔষধের ব্যবহারে তা আরও কম সময় নেয়। চরম কর্কশ গলায় বলল তেহজীব—

“ভুল করেছেন আপনারা। জেহেন কোনোদিনও আপনাদের সঙ্গ দেবে না। ও কখনো তোভিয়াকে কৈরবরাজের হাতে তুলে দেবে না।”

“নিজের প্রাণের বিনিময়েও নয়?”

মেহেকের প্রশ্নে তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল তেহজীব। বক্র গলায় বলে উঠে তেহজীব—

“তাহলে সেদিন কেন ছেড়ে দিলেন ওকে?”

মেহেকে ছেলের সামনে বসলেন। গাঢ় গলায় বললেন—

“যুবরাজ মায়ং ধীরে ধীরে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হচ্ছেন। কোনো একসময় তিঁনি তার পূর্ণ ক্ষমতা সম্পর্কে জেনে যাবেন। সময়ের সাথে সাথে তাঁর ক্ষমতাও দ্বিগুন হবে। তাঁকে আমাদের একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কারণ, এখানে তিঁনি একা হলেও, মায়পুরীতে তিঁনি একা নন। কৈরবরাজ কেন আমাদের সাহায্য করবেন তা তোমার জানা। ঠিক একই কারণে, তিনি যুবরাজ মায়ং এর শরণাপন্ন হতে পারতেন। কিন্তু যুবরাজ মায়ং এই কাজে কখনো কৈরবরাজকে সাহায্য করবেন না। সেক্ষেত্রে, জেহেন আমাদের সাহায্য করবে। জেহেন আর তোভিয়ার মিলনেই মুক্তি পাবে কৈরবরাজ। জেহেনকে এইজন্যই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেদিন যদি বেগমরাণি ওকে পশুসত্তায় পরিণত না করত, তাহলে ওর মস্তিষ্ক থেকে ওই সত্য কিছুতেই মুছে ফেলা যেত না, আর না তোমার বাবা এই মহলে প্রবেশ করতে পারতেন।”

মেহেক থামলেন। তেহজীবের রাগের দীপ্ততা এখনো কমেনি। মেহেক ভাবুক চোখে তাকিয়ে বললেন—

“নুয়ায়ামকে কোনোভাবেই মায়াপুরীতে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। তার পূর্বেই কৈরবরাজের মুক্তির প্রয়োজন। কিন্তু….।”

তেহজীব গ্রীবাদেশ উন্নত করে চাইল। মেহেক ফের বললেন—

“তুমি যা করছ, তাতে ক্ষতির পরিমাণ আমাদের বাড়ছে, তেহজীব। তোভিয়া অভিশপ্ত। ওকে ফিরে যেতে কৈরবরাজের সাথে। জেহেনকে তার প্রাণ হা/রা/তে হবে। যেমনটা হয়েছিল রাজকুমার হিমালয়ের সাথে। তুমি যা ঘটিয়েছ তা যদি বেগমরাণি জানতে পারেন, তাহলে কী হবে জানো?”

তেহজীব উঠে দাঁড়ালেন। অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গমগমে গলায় বলল—

“আপনি তো জানেন আমি কে? আমাকে ছাড়া তার গতি নেই। আমি তার অনুরাগী নয়, আম্মি। বলে দেবেন বেগমরাণিকে।”

মেহেক অধর ফাঁক করে কিছু বলতে যাবেন, তার পূর্বেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল তেহজীব।
,
,
,
আবছা আলোতে সয়লাব জেহেনের কক্ষ। জানালর কপাট উন্মুক্ত। চন্দ্রিমার মিহি, স্নিগ্ধ কিরণ গ্রিল গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। মৃদু মলয়ের মাঝে নিহিত শীতলতার প্রচ্ছন্ন পরশ। জেহেনের প্রশস্ত বুকে তন্দ্রাচ্ছন্ন তোভিয়া। তার গাঢ় প্রশ্বাস ছিটকে পড়ছে জেহেনে বুকের শক্ত পাটাতনে। তার গলার কাছের শার্টের খানিকটা গুঁজে রয়েছে তোভিয়ার নিদ্রামগ্ন নিশ্চল হাতের মুঠে। তোভিয়ার দেহের অর্ধাংশের ভর জেহেনের ওপর। জেহেন চেয়ে আছে আধো আলোতে। তার গম্ভীর আঁখিজোড়া অনেকটা সময় ধরে নিষ্পলক। এক হাতে তোভিয়ার অবিন্যস্ত চুল হাতড়ে যাচ্ছে।

জেহেন পরাস্ত ! নিজের সাথে আর লড়তে পারছে না সে। ছোট্ট মেয়েটিকে আর কতবার ফিরিয়ে দেবে সে? অবুঝ নয় তোভিয়া। তবে কোথাও না বোঝার বিস্তর পরিচ্ছেদ। যখন থেকে নিজেকে পশু রূপে আবিষ্কার করেছে জেহেন, তখন থেকে মায়া কাটাতে শিখেছে সে। তা প্রবলরূপে তীব্র হয় যখন তার হৃদয় আর মস্তিষ্ক, সমানভাবে স্বীকার করে যে, সে এই মেয়েটিকে ভালোবাসে। তীব্রভাবে ভালোবাসে। আর তা খুব জঘন্যভাবে তার মন, মস্তিষ্ক আর হৃদয়কে উন্মাদ করে তুলেছে।

অতি সন্তর্পনে তোভিয়াকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে বালিশের ওপর তার মাথাটা রাখে জেহেন। নিদ্রায় বিভোর তোভিয়ার নিষ্পাপ আননে চেয়ে রইল সে। তোভিয়া নড়ে ওঠে। পরমুহুর্তে আরও প্রগাঢ় হয় তার ঘুম। তার ওপর ঝুঁকে থাকে জেহেন। নিচ্ছিদ্র চাহনিতে নিংড়ে নিতে থাকে প্রেয়সীর অপার মুগ্ধকর অভিরাম। ঘুমন্ত তোভিয়ার ওষ্ঠাধরের উষ্ণতা শুষে নেয় জেহেন। সমাহিত অঙ্গনার কায়াতে জঙ্গমতা নামে। তোভিয়া ঘুমের আবেশেই জেহেনকে বক্ষবন্দি করে। তার নারী অঙ্গে স্বামীর অবাধ বিচরণ অবাধ্য হওয়ার পূর্বেই তাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জেহেন স্বয়ং। সে উঠে বসে। চাদর টেনে দেয় তোভিয়ার শরীরে। তোভিয়া কাত হয়। আদুরে ছানার মতো হাঁটু কুজো করে বলয়াকৃতি ধারণ করে। জেহেন আলতো হাসে। আলুলায়িত চিকুরে ঢেকে গেছে তোভিয়ার মুখ। জেহেন আঙুলের সাবধানী চালনায় তার মুখটা দৃশ্যমান করে। তোভিয়ার ললাটে অধর ছোঁয়ায়। বিছানার কাছ থেকে সরে আসে জেহেন। ঘুমে বিভোর তোভিয়াকে এক ছোট্ট পাখির ছানা মনে হচ্ছে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে যে মায়ের বুকের উম খুঁজে বেড়ায়!

জেহেন কড়া শ্বাস ফেলল। তারপর বিড়াল পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি মেলে চলতে শুরু করে।
,
,
,
রাদিয়াত ভীতসন্ত্রস্ত। তার সামনে বসে আছে আরওয়া। তার নীলাক্ষী দুটো পরিচিত রাদিয়াতের। টিমটিমে আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরওয়ার মুখচ্ছবি। আরওয়া মেঝের বুকে দাম্ভিকতার সাথে বসে আছে। সে তার মিহি কণ্ঠে বলল—

“আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন রাদিয়াত। আমি সাফিজার কন্যা। আম্মিকে মনে আছে আপনার?”

রাদিয়াত অস্থির চোখে চেয়ে বললেন—

“তাকে তোমরা নিয়ে যেতে পারো। আমার তোভিয়ার কোনো ক্ষতি কোরো না। সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করেনি।”

আরওয়া স্নেহার্দ্র গলায় বলল—

“আমার আম্মিকে তাঁরা বন্দি করে রেখেছেন। আমাকে যুবরাজ মায়ংকে নিয়ে ফিরে যেতে হবে। তিঁনি আপনাদের কোনো ক্ষতি করবেন না। শুধু অসত্য, কপট আর ছলনাকারীদের বিনাশ করবেন।”

“তোমাকে এসব কে বলেছে?”

রাদিয়াতের কণ্ঠ কাঁপছে। তিনি ভীত। আরওয়া ঠান্ডা গলায় বলল—

“আমার আম্মি বলেছেন। তিনি আমাকে এখানে রেখে গেছেন। যুবরাজকে তাঁর আসন্ন সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। তাঁকে ছাড়া আমিও আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারব না। যদি তাই করি, তাহলে তাঁরা আমার আম্মিকে হ/ত্যা করবেন।”

চোখ বড়ো বড়ো করে চাইলেন রাদিয়াত। ভয়ে আড়ষ্ট গলায় বললেন—-

“কারা তোমরা? কেন এসেছ এখানে? কী সম্পর্ক এই মহলের সাথে তোমাদের?”

“তা আমার জানা নেই। আম্মি কেন জোবায়ের হাসনাতকে যুবরাজ মায়ং এর আশ্রয়স্থলের জন্য বেছে নিয়েছেন, তা আমাকে তিনি বলেননি। তবে, কোনো কারণ তো আছেই। যা হয়তো স্বয়ং জোবায়ের হাসনাত জানেন।”

“আমার তোভিয়া! ও পদ্মের ফুলের ন্যায় কোমল। আমার পদ্মকুমারীর কোনো ক্ষতি কোরো না তোমরা। তাকে রেহাই দাও এই জঘন্য খেলা থেকে। প্রয়োজনে আমার প্রাণ নিয়ে নাও।”

আরওয়া আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল—-

“তোভিয়ার ঢাল জেহেন। সে পদ্মকুমারীকে তার আসন্ন সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে। এই মহলের উত্তরাধিকার সে। তাকে রক্ষা করাও আমার কর্তব্য। ”

রাদিয়াত ঝরঝর করে কেঁদে বললেন—-

“সে স্বাভাবিক নয়।”

“জানি আমি। তবে সে ইচ্ছে করলেই…।”

ধড়াস করে দরজার কপাট খুলে গেল। এই মহানিশিতে রাদিয়াতের কক্ষে জেহেনের উপস্থিতি কোনোভাবেই কল্পনা করেনি আরওয়া। জেহেন ক্ষীপ্র গতিতে এগিয়ে আসতেই তূরন্ত বেগে উঠে দাঁড়ায় আরওয়া। ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকানোর পূর্বেই সরোষে বলল—

“আপনি ঠিক করেননি রাদিয়াত। এর জন্য আপনাকে মূল্য দিতে হবে।”

পাখি হয়ে জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড় গেল আরওয়া। জেহেন ভরাট কণ্ঠে ডেকে উঠে—-

“ছায়াকরী!”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here