ছায়াকরী পর্বঃ৩২

0
399

# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাদিয়াত অসাড় ! তার কণ্ঠ থেকে কথা হারিয়ে গেছে। তিনি নিশ্চল, নিষ্কম্প, নিথর চোখে চেয়ে আছেন। জানালার কপাট ধরে রাগের উদগিরণ ঘটায় জেহেন। ফিরে আসে পালঙ্কে বসে থাকা রাদিয়াতের কাছে। জেহেন হাঁটু মুড়ে বসল তার সামনে। অনুতপ্ততার সাথে মাথা নত করে বলল—

“ক্ষমা করবেন আম্মি! আমার আসতে বিলম্ব হলো।”

রাদিয়াত আদরমাখা হাত রাখলেন জেহেনের মাথায়। অনায়ত চোখে চেয়ে নরম কণ্ঠে বললেন—

“এতে তোমার দোষ নেই। আমার তোভিয়া কোথায়?”

জেহেন মাথা তোলে। মাথা থেকে আদবের সাথে রাদিয়াতের হাত নিয়ে তাতে চুমু খেয়ে বলল—

” তোভিয়া ঘুমাচ্ছে। আমার ভুল হয়েছে আম্মি।”

রাদিয়াত সপ্রতিভ হলেন। কক্ষের মধ্যে চোখ বুলিয়ে চাপা স্বরে বললেন—

“ও সাফিজার কন্যা। যখন নুয়ায়ামকে এই মহলে নিয়ে আসা হয়, তখন সাফিজা এসেছিলেন বাবার সাথে। সাফিজা নিজেও কোনো মানবী ছিলেন না। সারাক্ষণ নুয়ায়ামের আশেপাশে উড়ে বেড়াতেন। বাবা বলেছিলেন, তিনি পাখিটিকে মহাচ্ছায়া জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছেন পোষ মানাতে। একদিন যখন আমি নুয়ায়ামকে বিছানাতে শুইয়ে ওর জন্য দুধ আনতে গিয়েছিলাম, সেদিন কক্ষে প্রবেশ করে আমি প্রথম সাফিজাকে দেখি। সেদিনই আমি জানতে পারি, নুয়ায়াম কোনো মনুষ্য নয়।”

জেহেন অতীব আকর্ষণের সাথে শ্রবণ করছে সব। সে বলল—

“সাফিজা কোথায় এখন?”

“কারা যেন সাফিজাকে বন্দি করে রেখেছে। তারা বলেছে, যদি নুয়ায়ামকে ফিরিয়ে নিতে না পারে তাহলে সাফিজার মুক্তি নেই। ছায়াকরী নুয়ায়ামকে তার রাজ্যে ফিরিয়ে নিতে এসেছে।”

জেহেন কৌতূহলী গলায় বলে উঠে—

“যদি তাই হয়, তাহলে নুয়ায়াম সাধারণ কেউ নয়। সেই সত্ত্বেও নুয়ায়াম স্বয়ং কেন নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না? কোথা এসেছে তারা? আর আমাদের মহলেই কেন? তাহলে আমি কে? আর যারা এই মহলে আছেন তারা কে? আমাকে কেউ কেন হ/ত্যা করতে চায়? ছায়াকরী যদি নুয়ায়ামের জন্য এখানে এসে থাকে, তাহলে ও কেন আমাকে বারবার রক্ষা করছে? কীসের স্বার্থে? আমি কী তাহলে এই মহলের কেউ নই?”

রাদিয়াত অধৈর্য হয়ে বললেন—

“ও বলল তুমিই এই মহলের উত্তরাধিকারী। তাহলে তেহজীব? তেহজীব কে? তাহলে কী তেহজীবও…..!”

থেমে গেলেন রাদিয়াত। ভয়ে, বিস্ময়ে তিনি যেন চৈতন্য হারাবেন। তার কণ্ঠে উষরতা। জিব লেগে যাচ্ছে। জেহেনের মস্তিষ্কে এক অভাবিত প্রশ্নের উদয় হলো। সেই ইগলের রক্তচক্ষু তার মানসলোকে জ্বলজ্বল করে উঠেছে। তার মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠল। কোনোভাবে সেই ইগল তেহজীব নয়তো? জেহেনের কর্ণরন্ধ্রে একটা অস্পষ্ট শব্দ আলোড়ন তুলল। তা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ধুম ধরে বসে রইল। শব্দ কোথা থেকে আসছে তার প্রতীতি হতেই জেহেন ঝুঁকে যায় রাদিয়াতের কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বলল—

“আপনি কথা বলতে থাকুন আম্মি।”

কেঁপে উঠলেন রাদিয়াত। তার কানের পাশ দিয়ে চকিতে নেমে এলো উষ্ণ জলের স্মিত ধারা। চোখের পাতা কাঁপছে, অধরে অনুরণন। জিব ভার হয়ে আসছে। জেহেন চোখ বন্ধ করে আবার মেলে ধরে তাকে ইশারা করল। রাদিয়াত ধীর গলায় কথা বলতে লাগলেন। অতি সন্তর্পণে উঠে দাঁড়ায় জেহেন। নিশব্দে পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকে রাদিয়াতের ব্যালকনির দিকে। নিজের শ্বাসক্রিয়াও মন্থরগতিতে চলছে জেহেনের। রাদিয়াতের গলা কাঁপছে, জমে যাচ্ছে তার কথা। দলা পাকিয়ে গলায় বিঁধে যাচ্ছে ভয়ের কাঁটা। তিনি অতি সাবধানে ঘাড় বাকিয়ে জেহেনকে দেখলেন। জেহেন সাবধানে পা ফেলে রাদিয়াতের পালঙ্কের সাথে লেপ্টে ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ থেমে শ্বাস ফেলল সে। ব্যালকনি থেকে আসা আওয়াজ প্রকট হচ্ছে। জেহেন লম্বা একটা শ্বাস নিজের ভেতরে টেনে নিয়ে তুরিতে দরজা পেরিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো। ব্যালকনির গ্রিলে তখন দাঁড়িয়ে আছে একটা বাজপাখি। জেহেন তার দুই হাত দিয়ে বাজপাখিটিকে ধরতে গেলেই, পাখিটি তৎক্ষণাৎ ঝটপট শব্দ করে। কিন্তু জেহেন তার পাখা মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। তাই বাজপাখিটি ডানা ঝাপটিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারল না। সাধারণ মানবীয় শক্তিতে জেহেনের পক্ষে তাকে প্রতিরোধ করে রাখা সম্ভব হয়নি। জোরালো ডানার আঘাত মুখের ওপর লাগতেই জেহেনের মুষ্টিবদ্ধ হাত দুর্বল হয়। দুটো পালক তার হাতে ফেলে রেখেই হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে উড়িয়ে নিয়ে চলে বাজপাখিটি। চোখ-মুখ বিকৃত করে জেহেন। চাঁদের অবাধ প্রভায় বাজপাখিটিকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। জেহেন নিশ্চিত হলো। এই মহলে কেউ স্বাভাবিক নয়। সবারই তার মতো দুটো রূপ। এখন তাকে সেই মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে, কারা নিজেদের আরেক রূপ লুকিয়ে রেখেছে তার অগোচরে।

হাতে থাকা পালকের দিকে অনিমেষলোচনে তাকাল জেহেন। ফেলল না সেগুলো। যত্নের সাথে পকেটে রাখল। কক্ষে ফিরে আসতেই পালঙ্কের ওপর থেকে ত্রস্তে নেমে আসেন রাদিয়াত। আতঙ্কিত গলায় বললেন—

“কে এসেছিল?”

জেহেন গম্ভীর স্বরে বলল—

“আপনি ঠিক বলেছেন আম্মি। এই মহল তোভিয়ার জন্য নিরুপদ্রব নয়। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুর্বোধ্য সব চরিত্র। মুখোশের আড়ালে তাদের দ্বিতীয় সত্তা। দুর্ভেদ্য এক মায়াজাল! বিধ্বংসী লালসা! ”

রাদিয়াত আচমকা ভেঙে পড়লেন। ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের মতো সমূলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জেহেনের ওপর। যমুনার দরিয়া বইয়ে বললেন—

“আমার তোভিয়া…আমার পদ্মকুমারীকে ওরা মেরে ফেলবে!”

রাদিয়াতকে নিজের কাছ থেকে আলগা করল জেহেন। মাতৃকায়ার ললাটে অতলান্ত প্রেম নিয়ে চুমু এঁকে বলল—

“আপনি চিন্তিত হবেন না, আম্মি। আমি তোভিয়ার ছায়াকর। ওর কোনো ক্ষতি হবে না। যে দায়িত্ব আপনি আমাকে দিয়েছেন, তার প্রতিপালন করব আমি।”

রাদিয়াতের চিন্তাকুলিত অন্তঃকরণ ধাতস্থ হয়। চোখের প্রস্রবণ মুছে নিয়ে বললেন—

“সবার আগে বাবাকে বের করে আনতে হবে বেগমরাণির বন্দিদশা থেকে। তিনি সব জানেন। ”

জেহেন চোখের পলক ফেলে ধনাত্মক স্বরে বলল–

“জি। বাবা ফিরে আসুক। আমি বেগমরাণির সাথে কথা বলব। দাদাজানকে সুস্থ করে তুলব। আপনি এসব নিয়ে চিন্তিত হবেন না।”

রাদিয়াতের ক্রন্দনে বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে দীর্ঘ সময় বাদে এক চিলতে হাসির রঙিন রেখা অঙ্কিত হয়। ঠিক সে সময় অধর বিস্তৃত করে নিজের খুশি ব্যক্ত করতে চাইল জেহেন। কিন্তু তার পূর্বেই তোভিয়ার আর্ত চিৎকারে মহল জুড়ে নিস্তব্ধতায় অদৃশ্য ঝড়ের মাতম শুরু হলো। সেকেন্ড ব্যয় না করেই তূরন্ত বেগে পা চালায় জেহেন। রাদিয়াত বের হলেন না। তিনি চটজলদি কক্ষের দরজা, জানালা সব বন্ধ করে দিলেন।

করিডর দিয়ে একপ্রকার ছুটেই এসেছে জেহেন। অস্পষ্ট আলো এখন উজ্জ্বল। মহলের কাণায় কাণায় এখন উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। নিচ থেকে চিবুক উঁচিয়ে করিডরের দিকে আনম্র ভঙ্গিতে চেয়ে আছে অনিতা। তার চোখে- মুখে নির্লিপ্তভাব। তোভিয়ার চিৎকারে সে মহলের কৃত্রিম বাতি জ্বালিয়ে দেয়। জেহেন করিডরে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেল। স্থির দাঁড়িয়ে থাকা অঙ্গনার দেহে কম্পন। চোখের পল্লব প্রশস্ত, হৃদয় থমকে দেওয়া অভিব্যক্তি। তোভিয়া কাঁপছে। তার বদ্ধদৃষ্টিতে আবদ্ধ থাকা নেত্রযুগল দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কাঁধের আঁচল খসে পড়বে বলে! দীর্ঘ কুন্তলের অবাধ্যতা লেপ্টে আছে চোখে -মুখে। অপ্রকৃতিস্থের মতো মনে হচ্ছে তাকে জেহেনের কাছে। শাড়ির আঁচল বুক থেকে খসে পড়ার পূর্বেই তাকে বক্ষ:স্থলে চেপে ধরে জেহেন। আদুরে গলায় বলল—

“কী হয়েছে তোভিয়া? তুমি এখানে কেন?”

তোভিয়া সাড়া দিলো না। জেহেনের মনে হলো সে কোনো নিথর দেহকে আলিঙ্গন করেছে, যাতে প্রাণ নেই। কিন্তু জেহেনের পুরুষ দেহ অনুভব করছে যোষিতার পেলব অঙ্গের নিগূঢ় অনুরণন। তোভিয়া বাকহীন চোখ এখনো নিষ্পলক। সে সিঁড়ির দিকে চেয়ে আছে। যেন কোনো মৃ/ত ব্যক্তিকে হেঁটে যেতে দেখেছে সে।
নুয়ায়াম তদ্দণ্ডে সেখানে পৌঁছাতেই অপ্রস্তুত হলো। সে চাহনি সরিয়ে আমতা গলায় বলল—

“তো..তো…তোভিয়ার কী হয়েছে?”

জেহেন তখনো তোভিয়াকে নিজ বাহুডোর থেকে আলগা করেনি। বরঞ্চ আরো জোরালো বন্ধনে তাকে পিষে ধরে বলল—

“তুমি যাও। তোভিয়ার কিছুই হয়নি। আমি আছি এখানে।”

নুয়ায়াম দাঁড়াল না। তার চোখ জুড়ে ঘুমের পসরা সাজিয়েছে ঘুমপরীরা। তোভিয়া এখনো ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জেহেন ঘাড় বাকিয়ে করিডর থেকে নিচের দিকে তাকাল। অনিতার সাথে চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে সেখান থেকে সরে গেল। জেহেন আড়ষ্ট, অসাঢ় তোভিয়াকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে।

মেঝের দিকে নিমেষহীন চোখে চেয়ে আছে তোভিয়া। তার অবিন্যস্ত চুলের বহরে ঢেকে গেছে মুখ। জেহেন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। তোভিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল সে—-

“বাইরে কেন এসেছিলে তুমি?”

তোভিয়া জবাব দিলো না। সে নির্বিকার, পলকহীন। জেহেন সপ্রতিভ গলায় ফের বলল—

“প্রশ্ন করেছি আমি।”

ঝট করে তাকাল তোভিয়া। তার পদ্মের ন্যায় সুডোল আঁখিদুটোতে ঝড়ের তান্ডব। ভেজা পক্ষ্মচ্ছেদ বিস্তৃত করে বলল—

“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”

“এটা আমার প্রশ্নের জবাব নয়।”

“আমি বাধ্য নয়।”

অসহনীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় তোভিয়া। তার কণ্ঠের তাপে জেহেন যেন বিস্ময়ের সাগরে ডুবে গেল। অসহিষ্ণু দৃষ্টিতে চেয়ে বলে উঠে জেহেন—-

“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?”

তোভিয়া তার পূর্বের তেজে অটল। কটমট করে তাকিয়ে ফুঁসে উঠে বলল—

“কোথায় ছিলেন আপনি? কেন আমাকে একা রেখে বাইরে গিয়েছিলেন?
জবাব দিন জেহেন।”

তোভিয়ার অনাবিষ্কৃত রাগের প্রকটরূপ জেহেনকে ভেতর থেকে তোলপাড় করে দিচ্ছে। ভয়ং/কর, হৃদমোহিনী, হারিণীর এই রণরূপ জেহেনের ভাবনাতীত। জেহেন শান্ত গলায় বলল—

“আম্মির কাছে গিয়েছিলাম।”

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল তোভিয়া। রাগের বিস্ফোরণে তার দেহ থরথরিয়ে যাচ্ছে। শ্বাসের মাত্রা বেড়েছে, তাতে অস্ফুট আওয়াজ হচ্ছে। চাপা গলায় রাগে দলিত হয়ে বলে উঠে তোভিয়া—

“আপনি জানেন কী হচ্ছে এই মহলে? কী ছিল ওখানে?”

জেহেন সংকীর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল—

“কী দেখেছ তুমি?”

“ওখানে একটা বীভ/ৎস, ভয়ং/কর সা/প দেখছি আমি। একটা কালো বর্ণের বিশালকৃতির সা/প। যা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। আ…প…আ..প আপনি জানেন না জেহেন, ওই সাপ কতটা বিশাল ছিল! ওর মুখটা…।”

তোভিয়া আর কিছু বলতে পারল না। শ্বাসকষ্ট রোগীর মতো শ্বাস টানতে লাগল। জেহেন অধৈর্য গলায় বলল–

“তোভিয়া! আমার কথা শোনো।”

আচানক ঢলে পড়ল তোভিয়া। জেহেন ছুটে গিয়ে তাকে বুকে আগলে নিল।
নিশ্চেতন, চেতনাহীন তোভিয়ার ভয়ে ফ্যাকশে হয়ে যাওয়া মুখটাতে কী অমোঘ মায়া তা জেহেনের হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি কম্পনে মাদল বাজাতে শুরু করেছে। নারী অঙ্গের অস্থির করা মাদকতা তার হৃদপ্রকোষ্ঠে চুকচুক করে প্রবেশ করছে। জেহেন বিমোহিত, বিবশ!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here