ছায়াকরী পর্বঃ৩৭

0
367

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৩৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

তোভিয়ার কলহাস্য শুনতে পাচ্ছে জেহেন। বসারকক্ষের কাউচে বসে তেহজীবের সাথে দাবা খেলায় মত্ত সে। সিঁড়ি বেয়ে ধীরগতিতে নামছে জেহেন। তার গাঢ় দৃষ্টি তাদের দুইজনের দিকে। তেহজীব মনোযোগ সহকারে খেলছে। তারা দুইজন দাবার বোর্ডে এতটাই মগ্ন যে, জেহেনের উপস্থিতি বুঝতে পারিনি। তবে আপাত দৃষ্টিতে তা হলেও তেহজীবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সপ্রতিভ। সে জেহেনের উপস্থিতিতে কোনো প্রতিক্রিয়া করল না।
তোভিয়া বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সাদা রঙের দণ্ডায়মান গুটিগুলোর দিকে। সে ভাবছে। তার ভাবনার অবসান ঘটাল জেহেন। তোভিয়ার হয়ে রাজাকে এগিয়ে দিলো। খিলখিল করে হেসে ওঠে তোভিয়া।নিজের জয়ে তার চোখে-মুখে ঝর্ণার বেগে খুশি ছুটছে। তোভিয়া সটান উঠে দাঁড়াল। ওপাশে হাত বাড়িয়ে তেহজীবের হাত ধরে বলল—

“চলো, এবার।”

জেহেন প্রশ্ন ছুড়ল—

“কোথায় যাচ্ছ তোমরা?”

“আপনাকে কেন বলব? বলব না। তেহজীব চলো। তুমি কথা দিয়েছ।”

তেহজীব কথা বলল না। তার স্থির, গম্ভীর, ভাবুক দৃষ্টি জেহেনের দিকে। তোভিয়া টেনে নিয়ে যাচ্ছে তেহজীবকে। প্রাণহীন মানবের মতো তার পেছনে যাচ্ছে তেহজীব। জেহেন অধর ছড়িয় শ্বাস ফেলল।

মহলের বাইরে এসে তেহজীবে কানে চাপা স্বরে বলল তোভিয়া—

“আমি নিশ্চিত ও এখান কোথাও আছে। ”

তেহজীব কৌতূহল নিয়ে বলল—

“তুমি কী করে বুঝলে?”

“আরে, কাল রাতে জোরালো বর্ষণ হয়েছে। এ সময় এরা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। ওরা তো শীতলতা পছন্দ করে।”

তেহজীব ছোট্ট করে হেসে বলল—

“তুমি নিশ্চিত?”

“অবশ্যই। ও আমাদের মহলের আশেপাশেই আছে। দেখছ না মাটি নরম, ও যদি এখান দিয়ে যায়, তাহলে ওর দেহের ছাপ থাকবে। মনোযোগ দিয়ে দেখো।”

ভারী বর্ষণে ঘাসে আচ্ছাদিত ভূতল নরম হয়ে আছে। ঘাসের ওপর চিকচিক করছে বৃষ্টির কণা। তাতে সোনালী রোদের লুকোচুরি। মহলের দেয়াল আর্দ্র। গাছপালা মিইয়ে আছে। ঝড়ো বৃষ্টিতে তারা হতপ্রায়। রোদের তাপ তাতে প্রাণ সঞ্চারণ করছে। তোভিয়া সাবধানে পা ফেলছে। তার ধারণা, মহলের আশেপাশেই কোথাও ঘাপটি মে/রে আছে বিশালাকার সা/পটি। তেহজীব হাসল। কারণ, সে ভালো করেই জানে, যাকে তোভিয়া খুঁজে চলছে তাকে সে পাবে না। কারণ, তার অবস্থান মহলের ভেতরেই, বাইরে নয়। আধ ঘণ্টা ব্যয় করে পুরো মহলের চারধারে দেয়াল ঘেষা জায়গাটুকু পরখ করল তারা দুইজন। তোভিয়া ভেবেছিল, যদি কোনো গর্ত খুঁজে পাওয়া যায়! কিন্ত তা হলো না। তোভিয়া জোরপূর্বক তেহজীবকে বাগানে নিয়ে গেল। সেখানেও খুঁজে দেখল সা/পটির অস্তিত্ব। কিন্তু হতাশ হলো সে। তেহজীব মৃদু হেসে বলল—

“আরও কোথাও দেখবেন পদ্মকুমারী? ”

ঘর্মাক্ত তোভিয়ার মুখের ওপর সূর্যের তীর্যক রশ্মি গলে পড়ল। তার দীর্ঘ আঁখিপল্লবের নিচে মারবেলের মতো ঝকঝকে দুই চোখ, সরু নাসিকার ডগায় জমা মুক্তোর মতো ঘাম ঝিকমিক করছে। গালের উঁচু জায়গাটা রোদ্রতাপে লাল হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের ভাঁজে শুষ্কতা। কপালে জমা ঘাম হাতের উলটো পাশ দিয়ে মুছে নিষ্প্রভ কণ্ঠে অনুরোধ করে বলল—

“একটু দীঘির পাড়েও দেখে আসি।”

তেহজীব দ্বিরুক্তি করল না। মেয়েটার চোখের এই খুশির ঝলক অনেকদিন এতটা নিকট থেকে দেখা হয় না তার। দীঘির পাড়ে এসেই পানির দিকে চেয়ে রইল তোভিয়া। তারপর উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল—

“তুমি ওই দিকটায় দেখো, আমি এই দিকটায়। ভালো করে খুঁজবে। দেখেছ, দীঘির পাড়ের মাটি এখনো ভেজা। ছায়ার কারণে রোদ আসেনি। সাপটা যদি দীঘিতে লুকিয়ে থাকে… এই, তাই হবে। এত বিশাল সাপ তো আর গর্তে থাকতে পারে না। ও নিশ্চয় দীঘিতে থাকে। তুমি জানো, প্রায়ই দীঘিতে আমি বুদবুদ দেখতে পাই। আমি নিশ্চিত, এসব ওই বিশ্রী, বিদঘুটে সাপটার কাজ। তাড়াতাড়ি দেখো, বেগমরাণিকে বলে মানুষ নামাতে হবে পদ্মদীঘিতে। এই সাপ না জানি কাকে খেয়ে ফেলে!”

হো হো করে হেসে উঠল তেহজীব। তোভিয়া ভ্রূ নাচিয়ে তিক্ত কণ্ঠে বলল—

“হাসছ কেন? আমি কী হাসির কিছু বলেছি?”

তেহজীব হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বলল—

“দং/শন করার পরিবর্তে খেয়ে ফেলবে?”

“আরে সা/পটা কী এত ছোটো না কী? তুমি তো দেখো নি। ওর লেজটা ছিল দোতলায়, আর মাথা সিঁড়ির নিচের দিকটায়।”

তেহজীব গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে সামনের দিকে ঝুঁকে যায় সে। তোভিয়া গাল ফুলিয়ে বলল—

“তোমার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?”

তেহজীব পেটে হাত চেপে রেখে হাসি থামাল। শ্বাস টেনে টেনে বলল—

“হচ্ছে, হচ্ছে পদ্মকুমারী। আপনার কথা বিশ্বাস হবে না!”

” তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? দ্রুত শুরু করো।”

“জি, করছি।”

তোভিয়া একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিল। তবে তা শুষ্ক নয়। বৃষ্টির পানিতে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। তোভিয়া সেই ডাল দিয়ে ঝোপঝাড় ফাঁক করে দেখছে।তেহজীব এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে নামলো। তারপর একবার সিঁড়ির বামদিকে গিয়ে দেখল, আরেকবার ডানদিকে গিয়ে। তোভিয়া নিচের দিকে এলো না। সে ওপরের দিকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঝোপঝাড় খুঁজতে লাগল। পানির কাছাকাছি সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল তেহজীব। তারপর পেছন ফিরে তোভিয়ার দিকে তাকাল। মেয়েটা উদ্ভ্রান্তের মতো একটা মরিচিকাকে খুঁজে যাচ্ছে।

তেহজীবের মনকুঠির সহসা তীব্র মনঃকষ্টে কেঁপে ওঠে। মেয়েটাকে সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে। সে ইচ্ছে করলেই তোভিয়াকে নিয়ে এখান থেকে তার রাজ্যে ফিরে যেতে পারে। তোভিয়ার মস্তিষ্ক থেকে এই পৃথিবীর সকল স্মৃতি মুছে দিতে পারে। নতুন জগত তৈরি করত পারে। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী! তাকে যে করেই হোক তার রাজ্য বাঁচাতে হবে। নুয়ায়ামকে হ/ত্যা করতে পারলে হয়তো তার সিংহাসন নিশ্চিত হবে। কিন্তু তাতেও সব কিছুর সমাধান হবে না। কারণ, মায়াপুরীর বাকি অধিবাসিগণ এত সহজে পরাজয় মানবে না। তাদেরকে পরাজিত করতে হলে তাকে যুদ্ধে অবতরণ করতেই হবে। হতে পারে সে তার রাজ্য হারালো, হারালো তার প্রিয়জন।
আবার, এখানেও তোভিয়াকে সে পাবে না। যদি সে জেহেনকে হ/ত্যা করে তোভিয়াকে নিজের করে নেয়, তাহলে নুয়ায়াম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাবে। এবং প্রতিশোধ নেবে যা তার সাথে ঘটেছে তার পক্ষে। এতেও নিজেদের অস্তিত্ব বিপণ্ণ হতে পারে, তা তেহজীব জানে। আর সেজন্যই চেয়েও সে কিছুই করতে পারছে না। তোভিয়া তার কোনোদিনও হওয়ার নয়। তার রাজ্য যে বিশ্বাসঘা/তকতা করেছে মায়াপুরীর সাথে তা মায়াপুরীর কেউ ভুলবে না। তেহজীবের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস।

সে ঘুরে দাঁড়াল। পদ্মদীঘির স্বচ্ছ, টলটলে পানিতে ফুটে থাকা পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

আড়াল থেকে সবটা দেখল ছায়াকরী। সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, তেহজীব আর যাই করুক তোভিয়ার কোনো ক্ষ/তি করবে না। তাই সে মহলের উদ্দেশ্যে পাখা ছড়াল।
,
,
,
জেহেন কিছু ভাবছে। পকেটে হাত গুজে বসারকক্ষে পায়চারী করছে দুই ঘণ্টা যাবৎ। তার মস্তিষ্ক জুড়ে হাজারো প্রশ্নের কলকলানি। যার কোনো উত্তর নেই। সে আওয়াজ করে ডাকল—

“অনিতা! অনিতা!”

সিঁড়ির নিচের দিকটায় অনিতার কক্ষ। সে ধীর পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। জেহেনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল—

“আমাকে ডেকেছেন?

জেহেন চোখে হেসে বলল—

“হ্যাঁ।”

জেহেন দু’কদম হেঁটে এসে অনিতার সন্নিকটে দাঁড়াল। অনিতার হাত ধরল সহজ ভঙ্গিতে। অনিতা হকচকিয়ে যায়। আড়ষ্ট চোখে চেয়ে রইল। জেহেন স্মিত হেসে বলল—

” এসো।”

কাউচের কাছে নিয়ে দাঁড় করালো অনিতাকে জেহেন। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল—-

“বসো।”

অনিতা পুতুলের মতো আচরণ করছে। জেহেন যেভাবে বলছে সেভাবেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার কথা মতো কাজ করছে। জেহেন দুই পা ভাঁজ তার ওপর ভর দিয়ে বসল। জেহেনের হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় অস্থির হয়ে উঠল অনিতার হৃৎপ্রকোষ্ঠ। সে বিমোহিত চাহনিতে সবুজ চোখের মানবটিকে দেখছে। জেহেন মায়াবী গলায় বলল—

“তোমার হাতের কী অবস্থা?”

অনিতা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল জেহেনের দিকে। তার চোখের দর্পণে উড়তে লাগল রঙিন প্রজাপতিরা। জেহেনের সাথে তার কোনো শত্রুতা নেই। অকারণেই এই পুরুষটিকে তার ভালো লাগে। অনিতা প্রায়ই জেহেনকে একান্তভাবে দেখার জন্য তার কক্ষে যেত। অশান্ত, অধৈর্য জেহেনের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল রাখা বড্ড কষ্টকর। অনিতা ছোটোবেলা থেকে এখানে আছে। জেহেনের পশু সত্তা সম্পর্কে জেনেও তার প্রতি একপ্রকার মুগ্ধতায় আবিষ্ট সে। তাই এত কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষটিকে দেখে অনিতার সমস্ত চিন্তা-চেতনা এলোমেলো হয়ে গেল।

জেহেন অনিতার হাতের কনুইয়ের দিকটা দেখে বলল—

“আরে, এ তো চমৎকার ব্যাপার! তোমার ক্ষত তো খুব দ্রুত সেরে উঠছে! আর আমাকে দেখো, তোভিয়ার দেওয়া সাধারণ নখের আঁচড়ও এখনো দগদগে।”

অনিতা কিছু বুঝল না। জেহেন তার পকেট থেকে পালক দুটো বের করে কাউচের সামনের ছোটো টেবিলটার ওপর রাখল। অনিতা হতভম্ব। চোখ দুটো যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে! জেহেন শীতল গলায় বলল—

“আম্মির কক্ষের ব্যালকনিতে কী করছিলে তুমি?”

অনিতার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে দ্রুত উঠে যেতে চাইল। কিন্তু তার হাত চেপে ধরে রেখেছে জেহেন। মাথা উঁচু করে চাইল অনিতার দিকে। অনিতার শান্ত দুই চোখ অসহিষ্ণু। জেহেন নাক কুঁচকে হিসহিসিয়ে বলল—

“কে বলেছে তোমাকে এসব করতে? কার কথায় তুমি আম্মির ওপর নজর রাখছিলে?”

ঢোক গিললেন মেহেক। তিনি আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। থরথর করে কাঁপছে তার দেহ।

অনিতা যখন বুঝতে পারল বিপদ সন্নিকটে তখন সে তার হাত বাড়াল। তার নখের অগ্রভাগ দীর্ঘ হলো, যা দেখতে ধারালো ছু/রির ফলার মতো। তদ্দণ্ডে জেহেন অনিতার সেই হাত চেপে ধরে। একহাতে অনিতার গলা অন্যহাতে অনিতার হাত। অনিতা কাউচে হেলে পড়ে।জেহেন অনিতার ধারালো নখওয়ালা হাত নিজের হাঁটুর নিচে চেপে রাখল। একহাতের পরাজয়ে অনিতা অন্যহাতে জেহেনকে আঘা/ত করতে চায়। জেহেন ঝুঁকে আছে অনিতার ওপর। সে চট করে অনিতার অন্য হাত কাউচের সাথে লেপ্টে রেখে নিজের একাংশের ভর দিয়ে চেপে রাখে। অনিতা হাসফাস করছে। তার চোখের পল্লব প্রশস্ত। জেহেন ক্রোধিত গলায় বলল—

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও অনিতা। কে বলেছে তোমাকে এসব করতে? আমি ভালো করেই জানি তুমি কে। কেন করছ এসব?”

অনিতার চোখের রং পালটে গেছে। তার জিব বেরিয়ে এসেছে বাইরে। মেহেক গাল ফুলিয়ে নিঃশ্বাস আটকে বেগমরাণির কক্ষের দিকে ছুটে গেলেন। অনিতা বুদ্ধি করে জেহেনের হাঁটুর নিচে চেপে রাখা হাত ঘুরিয়ে ফেলল। হাঁটুর নরম জায়গার অবস্থান টের পেতেই নিজের অপার্থিব শক্তির বলে ধারালো নখ বের করল। তা গিয়ে বিঁধল জেহেনের হাঁটুর নরম মাংসে। জেহেন আরও দৃঢ় করল হাতের চাপ। ব্যথাকে উপেক্ষা করে ক্ষীপ্র চোখে তাকিয়ে রইল। আচমকা ছায়াকরী উড়তে লাগল মহলের সিলিং সংলগ্নে। সেদিকে তাকাতেই জেহেন দেখতে পেল, করিডর দিয়ে শার্টের হাতা ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে আসছে নুয়ায়াম। জেহেন ঝট করে সরে এলো অনিতার কাছ থেকে। অনিতা সেকেন্ড ব্যয় করল না। ছুটলো সে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here