ছায়াকরী পর্বঃ৩৯

0
466

# ছায়াকরী
# পর্বঃ৩৯
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

বিছানায় শুয়ে আছে অনিতা। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। বিছানা থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তেহজীব আর মেহেক। তেহজীব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—

“বেঁছে আছে তাহলে! আমি তো ভেবেছিলাম…।”

মেহেক ধমকে উঠলেন। কটকট করে বললেন—

“বোন হয় তোমার। ”

তেহজীব বাঁকা হেসে বলল—

” ওকে কেন নিয়ে এসেছিলেন এখানে? নুয়ায়াম ছিল বলে বেঁচে গেল আজ। নাহলে আজই ওর শেষ দিন হতো।”

অনিতার হতপ্রায় অবস্থা হয়েছিল। জেহেন যখন নুয়ায়ামকে দেখে সরে এসেছিল, তখন অনিতার মুখে এক ধরনের বিষাক্ত গাছের ফলের গুড়ো দিয়েছিল। হুটোপুটি করে যখন অনিতা পালিয়েছিল, সে সময়ে মুখের লালার সাথে কিয়ৎ অংশ সে গিলে ফেলেছিল। তা ভেতরের যেতেই তার পেটের ভেতর দলিয়ে মলিয়ে ফেলল। আর শুরু হলো বমি। আপাতত কিছুদিন তাকে বিছানায় কাটাতে হবে।

মেহেক হালকা গলায় বললেন—

“আমাদের জন্যই ওকে নিয়ে আসা হয়েছে।”

“তাহলে এখন খেয়াল রাখুন আপনার সহোদরার কন্যার। এরপর যখন জেহেনের সামনে পড়বে বেঁচে ফিরলেই হয়। জেহেন আমাদের সবার সম্পর্কে জেনে গেছে। সাবধান হোন আম্মি!”

মেহেক ঝলসে উঠে বলল—

“বড্ড বাড় বেড়েছে এই জেহেন! মেয়েটার কী অবস্থা করেছে!”

অনিতার গলা ফুলে উঠেছে। জেহেনের হাতের চাপ তার তুলতুলে মাংস হজম করতে পারেনি।
,
,
,
তারকাখচিত আকাশের দিকে চেয়ে আছে জেহেন। কৃষ্ণ চাঁদোয়া ভেদ করে জেগে থাকা উদ্ভাসিত চন্দ্রের আশেপাশে তারাদের গূঢ় বার্তালাপ চলছে। সমীরণে মন্থরতা। নিস্তব্ধ, নির্বাক ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। খানিক সময় বাদে তার পাশে এসে দাঁড়াল নুয়ায়াম। বাউন্ডারি দেয়ালের সাথে কটিদেশ ঠেসে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল সে। দুই ভাই একে অন্যের বিপরীতে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। নুয়ায়াম শব্দ করে শ্বাস ফেলল। ছোট্ট করে বলল—

“তোভিয়ার সাথে তুমি খুশি নও?”

জেহেনের মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না। সে শূ্ন্যে ছেড়ে রাখা দুই হাত পকেটে পুরে নিয়ে বলল—

“তোভিয়া তোমাকে কিছু বলেছে?”

নুয়ায়াম অবলীলায় বলল—

“না।”

জেহেন ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রূকুটি করে বলল—

“তাহলে তোমার এমন কেন মনে হলো?”

“ও কাঁদছিল।”

জেহেন বিস্মিত হলো। একটু আগে যখন এখানে তোভিয়া ছিল, তখন তো নুয়ায়াম ছিল না। তাহলে সে কী করে জানল?
জেহেনের চাহনির বিপরীতে নুয়ায়াম তার দিকে চেয়ে সহজ হেসে বলল—

“আমার বোন তোমাকে খুব ভালোবাসে জেহেন।”

“জানি আমি।”

“তাহলে?”

জেহেন নিরুত্তর। পরিবেশ শান্ত হলো। কেউ কথা বলল না। দুই বিপরীতমুখী মানুষ তাদের নিজেদের ভাবনায় ডুবে গেল। হতাশ শ্বাস ফেলে মৌনতা ভাঙল নুয়ায়াম—

“তোমাকে কিছু বলার ছিল আমার।”

“শুনছি আমি।”

জেহেনের প্রশ্রয় পেয়ে বলল নুয়ায়াম—

“আজকাল আমার সাথে অদ্ভুত কিছু ঘটছে।”

“যেমন?”

জেহেন কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়াই বলল। কারণ, সে জানেও কিছুটা। কিন্তু এই মুহূর্তে তোভিয়ার বিষণ্ণতার উত্তর খুঁজছে সে। মেয়েটা কাঁদল বেশ সময় ধরে। কতগুলো প্রশ্নও করল। যা ছিল তাদের একান্ত কিছু। উত্তর দিলো না জেহেন। সে নির্বিকার চেয়ে ছিল পদ্মদীঘিতে। যেন মনে হলো, পদ্মদীঘির ওই ভরাট জলে তোভিয়ার চোখের জল মিশে গেছে।

নুয়ায়াম বলল—

“এই যে কিছু সময় পূর্বে তোভিয়া এখানে ছিল, আমি ছাদে এসেই তা বুঝতে পেরেছি। আজকাল এমনটা প্রায়ই হয় আমার সাথে। দুপুরে তুমি অনিতার সাথে কী করছিল বসার কক্ষে?
অনিতা ছিল সেখানে তাই না?”

জেহেন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চাইল নুয়ায়ামের দিকে। নুয়ায়ামের চোখ দুটো হলুদ হয়ে আছে। ক্রমশ তা লালাভ হতেই জোর গলায় বলল জেহেন—

“নুয়ায়াম!”

হুশ ফিরল নুয়ায়ামের। সে বিভ্রম নিয়ে বলল—

“কী?”

“আর কিছু?”

নুয়ায়াম হালকা হেসে বলল—

“তোমার আমার কথা বিশ্বাস হয়নি?”

“হয়েছে।”

“তাহলে?”

“অবাক হইনি।”

নুয়ায়াম ভ্রূ-বিলাস করে বলল—

“কেন?”

“এমন অনেক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তোমার।”

নুয়ায়াম হেসে ফেলল। জেহেনও শব্দ ছাড়া গা দুলিয়ে হাসল। নুয়ায়াম বলল—

“আমি কী মানুষ নই?”

মজা করে করা নুয়ায়ামের এই প্রশ্নের জবাব দিলো না জেহেন। সে সরু চোখে তাকাল নুয়ায়ামের দিকে। নুয়ায়ামের অধরে প্রসন্নতার হাসি। অবিমিশ্র, পবিত্র, শুদ্ধ। সিঁড়িঘরের ওপরে বসে থাকা ছায়াকরীকে দেখল জেহেন। অধরে ঝোলালো ফিচেল হাসি। দুষ্ট কণ্ঠে বলল—

“তোমার সেই রমণীর কী খবর?”

নুয়ায়াম চট করে ধরতে পারল না। সে কৌতূহল নিয়ে বলল—

“কোন রমণী?”

“আরওয়া।”

নুয়ায়াম স্নিগ্ধ হাসল। দিল খুলে বলল—

“মেয়েটা ভয়ংকর সাহসী! কিন্তু, ওরা কেন জঙ্গলে থাকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”

জেহেন চমৎকার হেসে বলল—

“পশুরা জঙ্গলেই থাকে।”

“মানে?”

জেহেন থেমে গেল। প্রসঙ্গ পালটাতে বলল—

“শুধু কী ভালো লাগা না কী তার নাম ভালোবাসাও?”

নুয়ায়াম মোলায়েম হাসল। ঘুরে দাঁড়াল সে। বাউন্ডারি দেয়ালে হাত দিয়ে চাইল পদ্মদীঘিতে। টলটলে পানিতে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। ফুটে থাকা শত শত পদ্মফুলের বাহার। নুয়ায়াম গাঢ় স্বরে বলল—

“ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”

” সাহায্যের প্রয়োজন?”

“হুম।”

অকপটে বলল নুয়ায়াম। জেহেন নরম গলায় বলল—

“কী করতে হবে আমাকে?”

“আমার বোনকে মন থেকে মেনে নাও।”

জেহেন পকেট থেকে হাত বের করল। হাতের তাপ বাইরের পরিবেশ থেকে ভিন্ন। জেহেন গম্ভীর গলায় বলল—

“বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে যাব? হিসেবে ভগ্নিপতি আমি তোমার। তবে ভাই হয়ে যাব। আম্মি যেহেতু অসুস্থ, আমিই না হয় তোমার অভিভাবক হলাম।”

নুয়ায়াম আপত্তি করে বলল—

“তেমন কিছু নয়। সময় দাও। কাকা ফিরে আসুক। দাদাজান সুস্থ হোক। আম্মি ঠিক হোক। বেগমরাণিকে জানাতে হবে তো!”

জেহেন আলতো গলায় বলল—

” এত সময় পাবে তুমি? প্রিয়তমাকে নিজের করতে এত সময় নিয়ো না নুয়ায়াম। হয়তো সে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছে। তুমি হাত বাড়াবে বলে।”

নুয়ায়াম লাজুক হেসে বলল—

“উহু। তার মনে আদৌ সেই অনুভূতি আছে কি না আমার জানা নেই। তবে আমিও বিভ্রান্ত। তা আসলেই ভালোবাসা না কী ভালো লাগা, বুঝতে আমার সময় প্রয়োজন।”

আচমকা দমকা হাওয়া বইল। নুয়ায়ামের চোখের পল্লব মিশে যাচ্ছে। সে তাড়া দিয়ে বলল—

“ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। নিচে চলো।”

হাওয়ার বেগ বাড়ছে। তার সাথে বাড়ছে মেঘের গর্জন। নুয়ায়াম আবারও তাড়া দিলো জেহেনকে। কিন্তু জেহেন অসম্মতি দিলে সে একাই নিচে নেমে আসে। ছায়াকরী এসে দাঁড়ায় তার মানব অবতারে। জেহেন উদাস গলায় পদ্মদীঘিতে চোখ আবদ্ধ রেখে বলল—

“আর কতো?”

“আপনাকে আরও ধৈর্য ধরতে হবে জেহেন। চারগুন সহনশীল হতে হবে।”

জেহেন বিদ্রুপপূর্ণ হেসে বলল—

“তেহজীব আমার সহোদর নয়। তাহলে আমার বাবা কী করে ওর বাবা হতে পারে?”

“তার উত্তর আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে।”

“আমার বাবা বেঁচে আছে তো আরওয়া?”

আরওয়া নিশ্চুপ। তার দিকে সতেজ চোখে তাকাল জেহেন। হাওয়ার দমকে আরওয়ার আলখাল্লা উড়ছে। তার অবিন্যস্ত চুল, স্থির দৃষ্টি, অনড় ভঙ্গি। জেহেন চোখের কোটর নমনীয় রেখে বলল—-

“আমার মুক্তি আছে তো আরওয়া?”

আরওয়া দুর্বোধ্য হাসল। জেহেনের গা কেঁপে উঠল। মেয়েটাকে আজ প্রথম হাসতে দেখল সে। আরওয়া রহস্য করে বলল—

“সত্যের পথে থাকতে হবে আপনাকে। সত্যকে ভালোবাসতে হবে। অন্যায়কে প্রতিহত করতে ন্যায়ের পক্ষে লড়তে হবে। মৃত্যুর পরোয়া আমাদের দ্বিধান্বিত করে। আপনাকে আপনার পথ খুঁজে নিতে হবে। হয়তো তাতেই আপনার মুক্তি।”

চকিতে খলবলিয়ে উঠল জেহেন। ক্রোধান্ধ হয়ে বলল—

“কেন সরাসরি জবাব দিচ্ছ না আমার প্রশ্নের?”

রাগের তোড়ে দু’কদম সামনে এগিয়ে যায় জেহেন। আর পিছিয়ে যায় ছায়াকরী। সে অবারিত গলায় বলল—

“আপনাকেই আপনার গন্তব্য বেছে নিতে হবে। যদি তা সত্যের হয় তবে আমাকে আপনি একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাবেন। এর বেশি আমার জানা নেই। সত্য যুগ-যুগান্তর ধরে পুরস্কৃত। ন্যায়ের জয় সর্বত্র। আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে জেহেন।
আর একটা কথা, আমি শুধুই যুবরাজের ছায়াকরী। এর বেশি প্রত্যাশা করার আদেশ নেই আমার।”

চট করেই পাখি হয়ে যায় আরওয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জেহেন। ঝপঝপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। জেহেন ব্যস্ত হয়ে পা চালালো।
হাওয়ায় মিশে থাকা তেহজীবের অবয়ব দৃশ্যমান হলো। ক্ষুব্ধ সে।
,
,
,
ব্যালকনির দরজা, কক্ষের জানালা বন্ধ করছে তোভিয়া। ভারী বর্ষণ হবে আজও। ঝলমলে আলোতে তোভিয়ার অশান্ত, ব্যাকুল আননে চোখ ঘুরাচ্ছে জেহেন। তাকে দেখেও না দেখার ভান তোভিয়ার। কক্ষের দরজা লাগিয়ে দিলো জেহেন। জানালাগুলো বন্ধ করে তার পর্দা টেনে দিয়েছে তোভিয়া। ছড়ানো, উলুথুলু চুলে কোনো রকম হাত খোঁপা করে পা চালাতেই তার পথ রোধ করল জেহেন। থমকে গেল তোভিয়া। জেহেন নির্মল হাসল। আলগোছে তোভিয়ার খোঁপা খুলে দিতেই ঝরঝর করে তার নিতম্বদ্বয় ঢেকে ফেলল চুলের গোছা। তোভিয়া নির্বাক চোখে চেয়ে আছে। জেহেনে মায়াময় চাহনিতে হাত দিয়ে তোভিয়ার মুখের ওপর থাকা চুল সরিয়ে তার ললাটে চুমু আঁকল। শিউরে উঠল তোভিয়ার নারীসত্তা। সে শ্বাস আটকে বলল—

“কিছু বলবেন?”

জেহেন মধুমাখা হাসিতে বলল—

“উহু।”

“তাহলে যেতে দিন।”

“উহু।”

চোখের কোটর কুঞ্চন করে চাইল তোভিয়া। ভাসা কণ্ঠে বলল–

“সরে দাঁড়ান।”

“উহু।”

তোভিয়া রোষ নিয়ে বলল—

“সমস্যা কী আপনার।”

“নেই।”

রাগে রি রি করছে তোভিয়ার দেহ। অকস্মাৎ আঁধার ফেড়ে উঁকি দেওয়া সোনালী সূর্যের মতো তাকে বুকে টেনে নিল জেহেন। নিচ্ছিদ্র আশ্লেষে ওষ্ঠাধরের জল শুঁষে নিল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—

“তোমাকে আমার কিছু বলার আছে তোভিয়া।”

জেহেনের বক্ষস্থলে সমাহিত তোভিয়া যেন অন্য জগতে। ঝিরিঝিরি করে ঝরে পড়া শীতের সকালে শিশিরের মতো জেহেনের গাঢ় ছোঁয়া তাকে সিক্ত করল। সে উন্মাদ হলো প্রেম প্রশ্রয়ে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here