# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
একদৃষ্টিতে আরশি পানে চেয়ে আছে নুয়ায়াম। তার কক্ষে জ্বলছে উজ্জ্বল বাতি। সেই তীব্র আলোর রেশে প্রকটভাবে ধরা দিচ্ছে তার বক্ষ পাটাতনের লালাভ আঁচড়ের দাগ। না, কারো নখের আঁচড় নয়। মাঝে মাঝে প্রকটিত হয় এই দাগ, আবার মিলিয়ে যায় চামড়ার মোহজালে। এই নিয়েই উদ্বিগ্ন নুয়ায়াম। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তা তার বোধগম্য নয়। নুয়ায়াম দেখতে পাচ্ছে, বুকের ওপর এবড়ো-থেবড়ো আঁচড়ের দাগ ঈষৎ ফুলে উঠেছে। যন্ত্রণা হচ্ছে যৎকিঞ্চিৎ। নুয়ায়াম চোখের পাল্লা আটকে দিলো। কিঞ্চিৎ সময় বাদেই উধাও হলো সমস্ত যন্ত্রণা আর তার ছাপ।
নুয়ায়াম আঁখিপল্লব মেলে তাকাল। তার রোমশহীন প্রশ্বস্ত বক্ষস্থলে কোনো দাগ নেই। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে তার চোখের রং। হলুদাভ কোটরে কমলা রঙের মনি। ছোট্ট ক্ষুদ্র কালো গহ্বর দেখে হকচকিয়ে উঠে সে। ভয়ে গা কাটা দিয়ে উঠে তার। নিজেকে অপার্থিব মনে হচ্ছে ! চোখের এই দোষ দূর করতেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল নুয়ায়াম। তবে ফলাফল শূন্য। ডাক্তার বলেছে তার চোখে কোনো সমস্যা নেই। নিজ সমস্যায় জর্জরিত নুয়ায়াম সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
মিহি ডাক ভেসে এলো তার কানে। চোখের রং স্বাভাবিক হলো। নুয়ায়াম চোখের কোটর ঘুরিয়ে দেখল। শব্দের উৎস খুঁজে চলছে। পেয়েও গেল। জানালার গ্রিলের ফাঁকের পাটাতনে বসে আছে নীলাক্ষী পাখিটি। নুয়ায়াম নরম হাসল। একটু একটু করে পা বাড়িয়ে জানালার কাছে এসে স্থির হয়। আলতো হেসে দুই হাঁটুতে দুই হাতের ভর ফেলে কুঁজো হয়। পাখিটি লেজ নাড়িয়ে একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশ তাকায়। নুয়ায়াম দৃষ্টি ফেলে বাইরে। পূর্ণ চাঁদের হাসি খেলে উঠেছে। মৃদু সমীরণে মেখে আছে পেলব শীতলতা। তিমিরে আচ্ছাদিত বসুমতি রহস্যে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। আঁধার কাটিয়ে তরতর করে আসা সেই আওয়াজের মালিক কে তা নুয়ায়াম জানে না।
সে প্রফুল্ল হয়। পাখিটির কর্মকাণ্ড দেখে চট করে প্রশ্রয়ের হাসি ঝোলায় অধরে। পাখিটি তার ডানা ছড়িয়ে আচ্ছাদন দিয়ে রেখেছে এক দলা পিঁপড়ার দলকে। পিঁপড়াগুলো কিছু একটা খাচ্ছে। বাতাসের তোড়ে যেন তারা উড়ে না যায়, তার জন্য পাখিটির এই প্রয়াস। নুয়ায়াম স্নিগ্ধ হাসল। উৎফুল্ল চোখে চেয়ে থেকে পাখিটির কর্মকাণ্ড দেখছে। কিছু সময় পর পিঁপড়ার দলটি পিলপিল করে হাঁটা শুরু করল। পাখিটি ডানা সংকুচিত করে। মাথা উচিয়ে তার রক্তিম ঠোঁট বাড়িয়ে নুয়ায়ামের দিকে তাকাল। নুয়ায়াম মুচকি হেসে আঙুলের সাহায্যে পাখিটির ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। পাখিটি তুষ্ট হয়। আচানক পাখিটির ঠোঁটর কাছে নিজের ওষ্ঠাধর বাড়িয়ে নেয় নুয়ায়াম। পাখিটি তটস্থ হয়ে নুয়ায়ামের কাধে চড়ে বসে। সোজা হয় নুয়ায়াম। কাধ থেকে হাতের তালুতে নিয়ে আসে পাখিটিকে। নুয়ায়ামের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে প্রতীত হয়, পাখিটির দেহ থেকে অদ্ভুত ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। মাদকতায় বিভোর হয় নুয়ায়াম। পাখিটির গায়ে হাত বুলাতে থাকে। নুয়ায়ামের মনে হচ্ছে সে তুলোর ভাঁজে হাত গলিয়ে দিয়েছে!
সে অতিশয় নম্রভাবে আদরে মাখামাখি কণ্ঠে বলল—
“আজ থেকে তোমার নাম ছায়াকরী। যে অন্যকে ছায়া দেয়। এই যে একটু আগে, পিঁপড়াদের তুমি ছায়া দিলে, তাদের সাহায্য করলে, ভবিতব্য বিপদ থেকে রক্ষা করলে; তাই তুমি তাদের ছায়াকরী। অবশ্য তোমাকে দেখে আমার মেয়েই মনে হচ্ছে।”
মিষ্টি করে হাসে নুয়ায়াম। সে এমনভাবে কথা বলছে, যেন পাখিটি তার প্রতিটি কথা শ্রবণ করছে!
হ্যাঁ, করছে। নীল চোখের শুভ্র পাখিটির ভেতরে জাগ্রত সে ঐন্দ্রজালিক সত্তা নুয়ায়ামের প্রতিটি কথা, স্পর্শে আন্দোলিত হচ্ছে। তাই সে তার ঠোঁটের ছোয়া নিতে আপত্তি করে। নুয়ায়ামের উন্মুক্ত বক্ষ পাটাতন, তার কথার বলার ভঙ্গিতে সে ব্রীড়িত, সংকুচিত। নুয়ায়াম তার নাকের ডগার আলতো ঘষা দেয় পাখিটির তুলতুলে শরীরে।
,
,
,
সুবিশাল বসার কক্ষে আগমন ঘটে তোভিয়ার। এর একপাশে লম্বাকৃতির খাবার টেবিল। ঠিক তার পেছনের দিকে ড্রয়িং স্পেস যেখানে দু’জোড়া কাউচ রাখা সাথে একটা ডিভান। বসার কক্ষের সুবিশালতাই এর সৌন্দর্যের অন্যতম কারণ। কক্ষটির মাঝ বরাবর মহলের সদর দরজা। কারুকাজ খচিত প্রকাণ্ড সফেদ রঙের দরজাটি বেশ পুরু। কক্ষের ওপাশটায় রান্নাঘর। দোতলার সিঁড়ির নিচটায় অনিতার শয়নকক্ষ। খাবার টেবিলের এপাশে দোতলার করিডরের নিচের দিকে বেগমরাণির। তার পাশেই জোহায়েরের।
কাউচে আগে থেকেই বসে আছে তেহজীব। তোভিয়া শঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে—-
“তুমি! ঘুমাওনি এখনো?”
তেহজীব কাউচে বসে ছিল এলোথেলো হয়ে। গুছিয়ে বসে বলল—-
“না।”
“কেন?”
“তোমার জন্য।”
তোভিয়া ব্যস্ত কণ্ঠে বলল—
“কাকি আম্মি ঘুমিয়েছেন?”
“হুম।”
তোভিয়া বিরক্ত হলো। খনখনে স্বরে বলল–
“তাহলে তুমি জেগে আছ কেন?”
তেহজীব প্রাণবন্ত হেসে বলল—
“ভাইয়ার কক্ষে ছিলে?”
“হ্যাঁ।”
তোভিয়ার গলদেশের ক্ষত জায়গায় দৃষ্টিপাত ঘটে তেহজীবের। ক্ষুণ্ণ গলায় বলল—
” এই ধরিত্রীর সকল ব্যাধির মহাব্যাধি প্রণয়ব্যাধি। তুমি তার মহৌষধ ভেবে নিয়েছ জেহেনকে! কবে দূর হবে তোমার এই বিভ্রম! কবে বেরিয়ে আসবে এই মহামোহ থেকে?”
তোভিয়া অবিচলিত কণ্ঠে ঘোষণা করল—
“প্রণয়ব্যাধি বসুমাতার নিঁখুত সেই ব্যাধি যা শুদ্ধ, অবিবিশ্র, পবিত্র। যার ছোঁয়ায় প্রেমোদ্গম ঘটে দুটো শুষ্ক হৃদয়ে, প্রাণ সঞ্চারণ হয় ঊষর ভূমিতে, যার আশ্লেষে জীবন্মৃত ব্যক্তি খুঁজে পায় জীবনোপায়; জেহেন আমার তদ্রূপ ব্যাধি। সেই ব্যাধির একনিষ্ঠ মহৌষদ জেহেন স্বয়ং। ”
তেহজীব স্থিমিত রাগ সংগোপনে রেখে বলল—
“ভুল করছ। ভাইয়া কখনো তোমার নয়।
” আমিও তোমার নই।”
“আমি আশা ছাড়ছি না।”
“আশাহত হতে হবে তোমায়।”
“জোর করতে পারি।”
তোভিয়া চোখের পাল্লা প্রশ্বস্ত করে তাকাল। তেহজীব মোলায়েম দৃষ্টিতে ঈক্ষমাণ। অধরের ভাঁজে মধুমিশ্রিত হাসি টেনে বলল—
“পদ্মকুমারী, ক্রোধিত হবেন না। এই মানব, আপনার প্রতিক্ষায় থাকবে। আপনি ফিরে আসবেন।”
তোভিয়া স্বর ভারী করে বলল—
“ফিরে আসার আশা তার জন্য রাখতে হয় যে ছিল কোনো কালে। আমি কখনো তোমার নই তেহজীব। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে যাও। বেগমরাণি জানতে পারলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু হবে।”
তোভিয়া তার অসহিষ্ণু অন্তঃকরণ নিয়ে পা বাড়ায়। এক উষ্ণ, অসহনীয় চাহনিতে স্বগতোক্তি করে তেহজীব—
“পদ্মকুমারী, মিথ্যের মায়াজালে আবদ্ধ তুমি। যেদিন দৃষ্টি মেলে সত্য অবলোকন করবে তোমার ওই দীর্ঘ পল্লবের আঁখিদ্বয় সেদিন বুঝবে। মিথ্যে ছিল না আমার প্রণয়।”
,
,
,
মহানিশাতে ডেকে যাচ্ছে নিশাচর প্রাণীরা। তন্দ্রায় নিমজ্জিত পুরো পদ্মমহল। শুভ্র পাখিটি তার জ্বাজল্যমান নীল নেত্রযুগল মেলে ধরে চেয়ে আছে ঘুমন্ত নুয়ায়ামের দিকে। নীলাভ বাতির ক্ষীণ আলোতে ঘুমন্ত নুয়ায়ামের মুখচ্ছবিতে ভেসে উঠেছে অমোঘ, ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ! পাখিটির এখন নাম হয়েছে। ছায়াকরী! যে ছায়া করে। এই পদ্মমহলের ছায়াকরী সে। কতগুলো হিংস্র চোখ আর তাদের লোভাতুর দৃষ্টি থেকে পদ্মমহলের উত্তরাধিকারকে রক্ষা করবে সে। আরও একজনকে রক্ষা করবে সে। যার জন্য তার জন্ম!
ছায়াকরী সপ্রতিভ হলো। কিছু একটার শব্দ নৈঃশব্দ্যে তার কর্ণরন্ধ্রে বিঁধে গেল। জানালার গ্রিলে চড়ে বসল সে। ব্যলকনির বাউন্ডারিতে উড়ে গেল। দাঁড়িয়ে কুটকুট শব্দ করছে।
কালো রঙের গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। জেহেনের আঁখিযুগল ভয়ংকর রকম উজ্জ্বল। মহলের ফটক থেকে গাড়িটি বেরিয়ে যেতেই, উড়ে আসা ছায়াকরীর দেহ নীল রঙের ধোঁয়ার বলয়ে রূপ নিল। তা ভূপাতিত হতেই দৃশ্যমাণ হলো নীল চোখের এক অলোকসুন্দরী!
সে উঠে দাড়াল। চেয়ে রইল অনিমেষ। ছায়াকরী তার মিহি কণ্ঠে বলে উঠে—
“আপনার অস্তিত্ব সকলের সম্মুখে আসতে চলেছে জেহেন। অপেক্ষা করুন। এই পদ্মমহলের ওপর যাদের কালো ছায়া সহস্র দিবস ধরে ওঁৎ পেতে আছে, তার সমাপ্তি ঘটবে এবার।
যুবরাজ মায়ং স্বয়ং তাদের কাল হয়ে দাড়াবে। সত্য- মিথ্যার প্রভেদে আপনি কাকে বেছে নেবেন জেহেন?
আপনার উত্তর, আপনার প্রাণ বাঁচাবে!”
চলবে,,,