ছায়াকরী পর্বঃ৫

0
486

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

শুভ্র, স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ প্রভাত। পদ্মমহলের শুভ্রতায় ঢলে পড়েছে উষাপতির সোনা গলা রোদ। চুকচুক করে মেখে দিচ্ছে গহন ছোঁয়া। চূড়ায় থাকা স্থির পদ্মে সূর্যের তেরছা নরম আভা আলতো সংসর্গে জাগিয়ে তুলছে তাকে। নরম রোদের সাথে মন্থর অনিলের সংমিশ্রণে ব্রীড়িত সে। তার বুকের মাঝে গোলাপি কেশর যেন জীবন্ত!
রাতের আঁধার পেরিয়ে নতুন দিনের সূচনা। টলটলে পদ্মদিঘীতে সারাবছর পদ্ম ফুটে থাকে। অযুত পদ্মফুলের সমারোহে দিঘীর পানি সূর্যের মুখ দেখতেও কাতর হয়ে ওঠে।

নুয়ায়াম খাচ্ছে। তার কাধেই বসে আছে ছায়াকরী। ছায়াকরীর নীলাক্ষী কিঞ্চিৎ সময় পরপর জ্বলে উঠে। তার অস্থির চাহনি জেহেনের প্রতিক্ষায়!

তেহজীব খাবার সামনে নিয়ে নির্নিমষ চেয়ে আছে তোভিয়ার দিকে। তোভিয়ার ম্লাণ মুখচ্ছবি। সকালে জেহেনের কক্ষে গিয়ে তাকে না পেয়ে ভারাক্রান্ত হয় অন্তঃকরণ। তার দীর্ঘপল্লব সিক্ত। একে অপরের সাথে লেগে গিয়েছে। পলক ফেলতেই তা সোজা বিঁধে তেহজীবের চোখের দর্পণে। তেহজীব সরল দৃষ্টি রেখে বলল—

“তুমি খাবে না?”

তেহজীবের প্রশ্নে নুয়ায়ামের ধ্যান ছুটল। সে জানে তোভিয়া এখন খাবে না। জেহেনের খাওয়ার পর খাবার মুখে তুলবে তোভিয়া। বোনের দিকে তাকিয়ে বলল—

“জেহেন কোথায়?”

তোভিয় ধরা গলায় বলল—

“কক্ষে নেই।”

নুয়ায়াম তেহজীবের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল–

“কোথায় গেছে?”

তেহজীব সোজা উত্তর দিলো—

“আমি জানি না।”

“ছোটো বেগম জানেন?”

“ভাইয়া কী আম্মির সাথে কথা বলেন?”

নুয়ায়াম নিশ্চুপ হলো। জেহেন মহলে খুব কম সময় থাকে। জেহেন আর তার বাবা হঠাৎ করে একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। কোথাও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ছেলে আর স্বামীর শোকে জেহেনের মা ইহলোক ত্যাগ করেন। কয়েক বছর যেতেই ফিরে আসেন জেহেনের বাবা। জেহেনকে নিয়েই তিনি ফিরে আসেন। কিছুদিন স্ত্রীর মৃত্যুর শোকে বুঁদ হয়ে থাকেন। আচানক একদিন মহলের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেন তেহজীবের মাকে। মহলের সকলে আপত্তি করলেও ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। একসময় জন্ম হয় তেহজীবের। আশ্চর্যের বিষয় হলো জেহেন। হারিয়ে যাওয়ার আগের জেহেন আর ফিরে আসার পরের জেহেনের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। তার চালচলন, স্বভাব, ভাবভঙ্গি সব বদলে গেল। বদলে গেল তার চোখের রং। এই চোখের রঙের জন্য সবাই বিভ্রান্ত ছিল। ডাক্তার দেখানো হলে বলেন, তিনি কিছু আঁচ করতে পারছেন না। তবে এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাননি জেহেনের বাবা। জেহেনকে নিয়ে তার বাবা আর নুয়ায়ামের বাবার সাথে মত বিরোধ দেখা দেয়। নুয়ায়ামের বাবা কিছুতেই জেহেনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। জেহেনের চোখের রঙের পরিবর্তনের কারণও তার ভাই জানাতে অপারগ। এই নিয়ে বছর জুড়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে নীরব অভিমান চলে। তারপরই হঠাৎ মৃত্যু ঘটে নুয়ায়ামের বাবার। তখন থেকেই জেহেন আর নুয়ায়ায় সুপ্ত রাগ পুষে রেখেছে একে অন্যের মনকুঠিরে।

চকিতে তিন জোড়া চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকাল। মহলে প্রবেশ করেছে জেহেন। উদ্ভ্রান্তের মতো সিঁড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে সে। তার পেছন পেছন ছুটে যায় তোভিয়া। কণ্ঠ ভার করে বলল—

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

পায়ের চলা থমকে দেয় জেহেন। কিন্তু পেছন ফিরল না। তোভিয়া অধিকার নিয়ে বলল—

“কথা বলছেন না কেন? কোথায় ছিলেন আপনি?”

“কাজে।”

জেহেনের কঠোর উত্তর। তোভিয়া অভিমান ঝেড়ে ফেলল। সহজ গলায় বলল—

“খেতে আসুন।”

“আসছি।”

দপদপ করে সিঁড়িতে পা ফেলে ওপরে চলে যায় জেহেন। তোভিয়া চকিত হয়। জেহেনের জুতোর ছাপ পড়েছে সিঁড়ির অরঞ্জিত বুকে। অস্পষ্ট ছাপ! তোভিয়া দুই সিঁড়ি ওপরে উঠে ঝুঁকে সেই ছাপ থেকে হালকা ধুলো আঙুলের ডগায় মাখে। একটু স্যাঁতসেঁতে মনে হলো তার। বৃষ্টির দিন তো নয়! তাহলে মাটি ভেজা কোথায়?

নুয়ায়াম বসে আছে। তার জন্য কী একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়েছে তোভিয়া। তা রান্নাঘরে রাখা আছে। অনিতা গোল সাদা পেয়ালাতে মিষ্টি জাতীয় কিছু একটা নিয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে আসছে। সেই মিষ্টি জিনিস থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে নুয়ায়াম আর তেহজীবের নাসিকাতে। তারা উদগ্রীব হয়ে আছে। তোভিয়া ভাইয়ের চোখের ঝলকানি দেখে অতিশয় প্রসন্ন। কিন্তু বিধিবাম! অনিতা খাবার টেবিলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ছায়াকরী উড়ে গিয়ে বিভ্রান্ত করে ফেলে অনিতাকে। অনিতা টাল সামলাতে পারেনি। হাত থেকে ছিটকে পড়ে মেঝেতে বাটি। সকলের অজান্তে জ্বলে উঠে অনিতার চোখ। অদ্ভুত খরখরে শব্দ বের হয় তার কণ্ঠনালী থেকে। অচিরেই নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলে অনিতা। তোভিয়া বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। নুয়ায়াম চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে। তেহজীব গম্ভীর দৃষ্টিতে দেখছে অনিতাকে। অনিতা ভয়ে ঢোক গিলে মাথা নুইয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় নিচে এসে দাড়ায় জেহেন। পরিস্থিতি বুঝতে অনুপল ব্যয় করে সে। ছায়াকরী এদিক- ওদিক উড়ে এসে আবার নুয়ায়ামের কাধে বসে। কিন্তু তার চোখের জ্বাজল্যতা ধরা দিলো জেহেনের চোখে। জেহেন নিরুত্তাপ হয়ে দাড়িয়ে আছে। রুষ্ট গলায় বলে উঠে তোভিয়া—

“অনিতা! কাজ করার সময় তোমার ধ্যান কোথায় থাকে? কী করেছ তুমি?”

ভয় জড়ানো কণ্ঠে প্রত্যুক্তি করে অনিতা—

“ক্ষমা করবেন ছোটো মালকিন। আমি দেখতে পাইনি।”

“চুপ করো তুমি। একটা কাজও ঠিকভাবে করতে পারো না। কেন? কোথায় থাকে তোমার মনোযোগ?”

অনিতা মাথা নিচু করে রইল। কোনো জবাব খুঁজে পেল না সে। জেহেন গাঢ় স্বরে বলল—

“ভুলের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। ওকে যেতে দাও। ভাইয়ের জন্য দ্বিতীয়বার খাবার তৈরিতে তোমার সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”

তোভিয়া শান্ত হলো। জেহেনের কণ্ঠে শীতল হলো তার খসখসে মন। অনিতা প্রস্থান করল সেই স্থান। দুইজন ভৃত্য এলো। তারা চটজলদি পরিষ্কার করে ফেলল মেঝে। জেহেন চেয়ার টেনে বসল। বসল নুয়ায়াম ও তেহজীব। জেহেন তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে বলল—

“দোষটা যার হোক, কথা শুনতে হবে মহলের ভৃত্যদের । তোমার সহকারিণী বলে কী তার নিজস্ব মতামত নেই? হুকুমজারি করাই কী শুধু মালিকের অধিকার?”

তোভিয়া নিস্পৃহ গলায় বলল—

“আপনি কী বলতে চাইছেন?”

“দোষটা কার ছিল?”

তোভিয়া বিভ্রম নিয়ে চাইল ছায়াকরীর দিকে। তারপর নজর ফিরিয়ে জেহেনের দিকে। অনুচ্চ গলায় বলল—

“ও একটা পাখি ছাড়া কিছুই নয়।”

“তাহলে দোষ অনিতারও নয়। ”

“আমি দুঃখিত।”

জেহেন মাথা নুয়ালো। খাবারের দিকে তাকিয়ে অতুষ্ট হলো। হরিণের কাঁচা মাংসের রসালো স্বাদ লেগে আছে তার গলায়। এখন এসব সেদ্ধ মাংস তার মুখে রুচবে না। অতি যত্ন করে আজ খাবার সাজিয়েছে তোভিয়া। ভালো করে সেদ্ধ করা মাংসের ওপর হালকা মসলা ছিটিয়ে দিয়েছে। সাথে ছড়িয়ে দিয়েছে কুচি করা পেঁয়াজ ভাজা। একপাশে লেটুস পাতার ওপর দু’গাছি ধনেপাতা। কিন্তু জেহেনের মন টানল না। উঠে পড়ল সে। তোভিয়া ব্যগ্রতা নিয়ে বলল—

“না খেয়ে উঠে পড়লেন কেন?”

“ইচ্ছে করছে না।”

দাড়াল না জেহেন। নিজের কক্ষের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here