ছায়াকরী পর্বঃ৬

0
669

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

অনিতা দাঁড়িয়ে আছে। তার কপাল ঘামছে। চোখে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কণ্ঠ হতে খরখরে শব্দের সৃষ্ট হতে লাগল অচিরেই। তার শ্বাসের গতি এতটা যে, সেই শব্দে কোনো ঘুমন্ত মানুষ লাফিয়ে উঠবে! গলদেশের রগ ফুলে ফেপে উঠেছে। কোনো কিছুর শব্দ তাকে বিরক্ত করছে। অনিতার চোখের রং পরিবর্তন হতে লাগল। ঝট করে সে দেহভঙ্গিমা বদলায়। আর তৎক্ষণাৎ তার ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সফেদ রঙের লাল চোখের এক বিড়াল। অনিতা ভয়ে হেলে পড়ে পেছন দিকে। বিড়াল ধারালো নখের আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করতে থাকে তার গলদেশ। বিড়ালটি সুযোগ সন্ধানী হয়ে উঠে। যেকোনো সময় তার দাঁতের ঘাঁটি গেড়ে দেবে অনিতার মুখে। কিন্তু অনিতা তা হতে দিলো না। বিড়ালটি ককর্শ স্বরে ম্যাও ম্যাও আওয়াজে চিৎকার করে যাচ্ছে। অনিতা কিচেন ক্যাবিনেটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। তার মুখের ওপর হাতের আচ্ছাদন। অনিতা ভয়ংকর প্রাণীর মতো শব্দ উৎপন্ন করে তার কণ্ঠে। বিড়ালটি বিচলিত নয়। তাতেই বোধগম্য হয় তার, বিড়ালটি কোনো সাধারণ বিড়াল নয়। অনিতার গলদেশে থেকে টপকে পড়ছে লহুর ধারা। রঞ্জিত হলো তার পরিহিত জামা। হাতের উলটো পিঠে বিড়ালের আঁচড়ে উঠে গেল চামড়া। অনিতা নিজেকে ধাতস্থ করে এক হাতে মুখ ঢেকে রেখে অন্যহাতে বিড়ালটিকে এক ঝাঁপটা মারে। তাতে তার দীর্ঘ নখ গেঁথে যায় বিড়ালের কাধে। সে ছিটকে পড়ে। অনিতা ফুঁসে উঠে। উঠে দাঁড়ায় সে। দন্তপাটি বের করে বিশ্রী, ভয়ংকর ভঙিতে তাকায় বিড়ালটির দিকে। বিড়ালটির লাল চোখ নিভে যায়। অনিতা তার পা বাড়াতেই বিড়ালটি ছুটে পালায়। গর্জন করতে থাকে অনিতা। হাপড়ের মতো উঠানামা করতে থাকে তার বুক। সেই সাথে থরথরিয়ে যাচ্ছে পুরো দেহপিঞ্জর। অনিতার দুই কাধের দিক ফুলে উঠেছে। বুক চওড়া হয়ে পশমে আবৃত হয়েছে। কাধের দিক মুহুর্তেই সমান্তরাল হয়ে সেখানে পাখার সৃষ্টি হয়েছে। পা দুটো ধীরে ধীরে পালকে আবৃত হয়। হাঁটু পর্যন্ত পালকে আবৃত হয়ে পায়ের গোড়ালি চ্যাপ্টা হতে থাকে। তা রূপ নেয় পাখির চ্যাপ্টা পায়েরপাতার অনুরূপ। মাথাটা প্রসারিত হতে হতে পালকে আবৃত হতে থাকে। চোখ দুটো পালকের অভ্যন্তরের লুকিয়ে জ্বলে উঠে। অধরের পাল্লা সামনে দিকে প্রসারিত হয়ে শক্ত আবরণে ঢেকে বাকিয়ে যায়, যেমনটা তোতা পাখির ঠোঁট হয়। অনিতা সম্পূর্ণরুপে আবিষ্কৃত হয় এক বাজপাখির অবয়বে। তার জ্বলন্ত চোখ আর ধারালো ঠোঁট ফাঁক করে অদ্ভুত শব্দে ডেকে উঠে। পাখা ঝাপটাতেই ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দের তাল উঠে। এই ঠোঁটের সাহায্যে যেকোনো ছোটো আকৃতির পশুকে সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে।
,
,
,
দূরন্ত বিকেল! একটু পরেই গোধূলির মায়া গিলে নেবে নীলচে আকাশকে। ধূসরে জড়াবে তার শামিয়ানা। অংশুমালী হেলে পড়বে অম্বরের পশ্চিম বুকে। সূদুর তালগাছটার চূড়ায় দুটো পাখি দেখতে পাচ্ছে জেহেন। দিঘীর জলের কাছের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সে। পাখি দুটো বাতাসের তীব্রতায় ঝুলে আছে তালপাতায়। পদ্মদিঘীর টলটলে পানি। সহস্র পদ্মের দিকে সবুজ আঁখিবিশিষ্ট পুরুষটি চেয়ে আছে অনিমেষ। একটা চিল উড় যাচ্ছে অম্বরের বুকে। বক দাঁড়িয়ে আছে দিঘীর জলে। তার নিষ্পলক দৃষ্টি দিঘীর স্বচ্ছ জলের বুকে। যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারের ওপর!

টলটলে খালি পায়ে সিঁড়ির ধাপ ভেঙে নেমে আসে তোভিয়া। জেহেন পূর্বের ন্যায় নির্বিকার। সে অটল, অবিচল, অরব। জেহেনর অর্হিনিশ এই নির্লিপ্ততা বড্ড পোড়ায় তোভিয়াকে। তবুও সে প্রণয়ে ব্যাকুল। কখনো তো এই দুর্বোধ্য, খরা হৃদয়ের মানুষটির বুকে পদ্মফুল হয়ে ফুটবে সে!
জেহেনের পাশে এসে স্থির হয় তোভিয়া। সংকীর্ণ কণ্ঠে বলল—

“কী করছেন?”

জেহেন অনড় দৃষ্টি রাখল পদ্মদিঘীর জলে। সূর্যের ম্লান আলোকছটা পড়ছে ওপারের কোল ঘেঁষে। জেহেন ঠান্ডা স্বরে বলল—

“কিছু না।”

গ্রীবাভঙ্গি বদলালো জেহেন। তোভিয়ার দিকে নিরবধি প্রেমাত্মক চাহনি! তোভিয়ার চোখ হেসে উঠল। চোখের মনিতে উৎফুল্লতার ঝিলিক! ডাসা ডাসা চাহনি। জেহেন মুগ্ধ হয়, হয় সম্মোহিত! তোভিয়ার ভাসা ভাসা দুই চোখের পল্লব ছুঁইয়ে ফেলবে তার ভ্রূয়ের সীমান্ত। রক্তিম ওষ্ঠাধরে অমোঘ টান। ফেরাতে কী করে পারে জেহেন? পারে, তাকে পারতে হয়। নিজের অস্তিত্ব লুকাতে, নিজের সত্তাকে আড়াল করতে। এই মনোহারিণীর রূপে বিমোহিত, আসক্ত, উন্মত্ত হওয়ার পূর্বে তাকে বারংবার তার হিংস্র রূপকে ভাবতে হয়। তোভিয়ার ক্ষতি চায় না সে। এই পদ্মমহলের কোনো ক্ষতি চায় না। তবে বিব্রত, বিভ্রান্ত, উৎপীড়িত জেহেন। নিজেকে নিয়ে, নিজের দ্বৈতসত্তাকে নিয়ে। তার অন্তঃকরণে হাজার প্রশ্ন। কে সে? কী তার অস্তিত্ব? এই পদ্মমহলের সাথে তার কী সম্পর্ক? যদি সত্যিই এই পদ্মমহলের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থেকে থাকে, তাহলে তার এই দ্বৈতসত্তার কারণ কী?
জেহেন নজর সরায়। দেহভঙ্গিমা বদলায় অনুপলেই। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। তোভিয়া আবেগমিশ্রিত গলায় বলে উঠে—

“জেহেন!”

জেহেন চতুর্থ সিঁড়িতে পা রেখেছে। থমকে যায় সে। উৎকর্ণ হয়ে থাকে তোভিয়ার পরবর্তী বাক্য শোনার জন্য। তোভিয়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে আসে। জেহেনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল—

“চলে যাচ্ছেন কেন?”

জেহেন কাষ্ঠ গলায় বলল—

“সন্ধ্যা হতে চলেছে। মহলে যাও। আঁধার রাতে পদ্মমহলের নারীদের বাইরে থাকার নির্দেশ নেই।”

জেহেন পা বাড়াল। নিরুদ্বেগ চলা। স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তোভিয়া। আগমন ঘটল তেহজীবের। মৃদু ছন্দপতনে তোভিয়ার পাশ কেটে সিঁড়িতে পা ফেলে ফেলে নামছে আর শ্লেষমিশ্রিত গলায় বলছে—

“অপাত্রে দান, নয় বরদান
আঁখি মেলিয়া করো সত্যের সন্ধান।”

তোভিয়া স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেলে বলল—

“আমি তোমাকে সাবধান করেছি তেহজীব। মুখে লাগাম দাও।”

তেহজীব পদ্মদিঘীর জলের কাছে সিঁড়িতে নেমে গেল। হালকা করে জলের শীতল ছোঁয়া পায়ে মেখে বলল—

“পদ্মকুমারী, অবুঝ নও তুমি। বুঝে নাও নিজের ভাগ্য। ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙবে আমার, থামাতে পারবে না কেউ।”

“তেহজীব!”

কণ্ঠে রাগের বর্ষণ ঘটল তোভিয়ার। হেসে উঠল তেহজীব। ঘুরে দাড়াল সে তোভিয়ার দিকে। তার পেছনে বিস্তৃত জলরাশির পদ্মদিঘী। তেহজীব কপট বিনয়ী হয়ে বলল—

“ক্ষমা করবেন, পদ্মকুমারী। ক্রোধিত হবেন না। মতামত প্রকাশের অধিকার এই মানবেরও আছে। আপনাকে অবগত করলাম।
পাথরের বুকে জল খোঁজা আর পদ্মদীঘির বুক থেকে পদ্মফুলের অস্তিত্ব নিপাত করার মতো কঠিন আপনার এই একপাক্ষিক প্রণয়। ”

“হোক কঠিন।
‘The eyes those silent tongues of love’
—Miguel de Cervantes
আমি তা অনুভব করেছি। মনে রেখো। ”

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কমলা রঙের সূর্যটাকে গিলে নিচ্ছে রক্তিম আভা। একটু পরেই বিলীণ হয়ে যাবে তা কালচে নীলাভ অম্বরে।
তোভিয়া মহলের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করে। ঠিক কতখানি সময় তেহজীব দাঁড়িয়ে রইল তা ঠিক নেই। আকাশের বুকে লুপ্ত সূর্যের শেষাংস চোখে পড়তেই পদ্মদিঘির পাড় ছাড়ে সে। মানবহীন দিঘীর পাড়ের মোটা গাছটার ডাল থেকে মৃত্তিকার পাটাতনে পা রাখে ছায়াকরী। রূপ নেয় নারী অবয়বে। সে বিগলিত হাসল। নীলাক্ষী জ্বলজ্বল করছে। অস্পষ্ট স্বরে বলল—

“”হায় প্রেম! তোমাকে ভাবতে ভালো লাগে কিন্তু আসলে তুমি কি কঠোর! যন্ত্রণাময়!”

~ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (রোমিও ও জুলিয়েট)

চকিতে তাকাল ছায়াকরী। তার সামনে একটা বিড়াল উপস্থিত। ছায়াকরী গাঢ় মায়ায় হাসল। বিড়ালটি তার আলখাল্লায় নরমপিন্ডওয়ালা পা রাখল। ছায়াকরী পরম যত্নে তাকে কোলে তুলে নিল। পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল—

“কষ্ট হয়েছে তোমার তাই না? আজকের জন্য এতটুকুই। ওর আর স্পর্ধা হবে না এমন আচরণ করার।”

ছায়াকরী তার আঙুলের আলতো স্পর্শ আঁকে বিড়ালটির আঁচড়ের ক্ষততে। তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। বিড়ালটি আদুরে স্বরে সশব্দে ডাকে। ছায়াকরী তাকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে আদেশের সুরে বলল—

“আপাতত মহাচ্ছায়া জঙ্গলে অবস্থান করো। কিন্তু, ভুলেও জেহেনের দৃষ্টি সীমার কাছে আসবে না।”

বিড়ালটি তূরন্ত বেগে ছুটতে লাগল।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here