# ছায়াকরী
# পর্বঃ৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
কৃষ্ণাভ অম্বরে নিষ্কম্প দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেহেন। মৃদু শীতল বাতায়নে সে নিরুত্তাপ। তারকারাজিরা আজ হাসছে মিটিমিটি। বিধু জাগ্রত তার স্বমহিমায়। দূরের মহাচ্ছায়া জঙ্গল ধরা দিচ্ছে নিচ্ছিদ্র আঁধার জগতের কুহক হয়ে।
চকিতে ঈষৎ কেঁপে উঠে জেহেন। তার কাধে হাত রেখেছে নুয়ায়াম। জেহেন সচেতন হয়ে পেছনে ফিরল। অপ্রভ চাহনিতে চেয়ে নিষ্প্রাণ স্বরে বলল—
“কিছু বলবে?”
নুয়ায়াম চোখে হাসল। ঝরে পড়ল তার নরম দৃষ্টিতে উচ্ছলতা। মৃদু গলায় বলল—
“তোভিয়া তোমাকে পছন্দ করে।”
জেহেন অনায়তন গলায় বলল—
“জানি।”
নুয়ায়াম জেহেনের আরেকটু কাছে এগিয়ে এলো। তার কাধে দুর্বল চাপড় বসিয়ে বলল—
“তোভিয়া তোমাকে ভালোবাসে। এই বিয়ের সম্মতি স্বয়ং বেগমরাণি দিয়েছেন। তিনি নিশ্চয় ভুল সিদ্ধান্ত নেননি?”
“তোভিয়া ভুল করছে।”
“ভালোবাসা ভুল হয় না।”
জেহেন নির্লপ্ত ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে যায়। পিছু ফেলে যাচ্ছে একরাশ দ্বিধা আর প্রশ্ন। নুয়ায়াম প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে রইল। যামবতীর এই তমসায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ছাদের পাটাতনে নুয়ায়াম। সিঁড়িঘরের দ্বার প্রান্ত পৌঁছাতেই থমকে যায় জেহেন। দেহভঙ্গিমা বদলায়। সাবধানী গলায় বলল—
“এর জন্য না পরবর্তীতে তোভিয়াকে অনুতপ্ত হতে হয়! সব ভুল শুধরে নেওয়া সম্ভব হয় না।”
ছোটো ছোটো পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে জেহেন।
,
,
,
দোতলা করিডরের কাছের সিঁড়িতে পৌঁছাতে জেহেন সতর্ক হয়। নিচের সিঁড়িতে এক পা ওপরের সিঁড়িতে এক পা রেখেই সে দমে যায়। জেহেনের এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। সে অন্ধকারেও সামনের ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিত করতে পারে। অদৃশ্য কোনো সত্তাও তার দৃষ্টিগোচর হয়। অত্যন্ত সুক্ষ্ম শব্দও তার কর্ণরন্ধ্রে ঝড় তোলে। তার শ্বসন ক্ষমতাও তীব্র। কোনো কিছুর সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর ঘ্রাণও তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে কড়া নাড়ে। জেহেনের মস্তিষ্কে প্রতীত হয় এক তীক্ষ্ম, মিষ্টি, ধাতব পদার্থের ঝংকার। মেপে মেপে পা ফেলে করিডরে পদার্পন করে সে। চকিতে উলটো হয়ে কারো চোয়াল চেপে ধরে জেহেন। উহু, অসতর্কতায় নয়, ইচ্ছে করেই করে সে। ব্যক্তিটি তার অপরিচিত নয়। তার দেহের ঘ্রাণই তাকে পরিচিত করে তুলেছে জেহেনের কাছে। তোভিয়া বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে। আলোয় উদ্ভাসিত পরিবেশে তোভিয়ার ভয়ভীত দৃষ্টি জেহেনকে নরম করে। হাত সরায় সে। পেছনে হেলে থাকা গ্রীবা সোজা করে তোভিয়া। মুক্ত শ্বাস ফেলে অসহায় চাহনিতে আবদ্ধ করে জেহেনের গম্ভীর মুখ। জেহেন ভারী স্বরে বলল–
“এভাবে অতর্কিতে আমার সামনে আসবে না।”
নীরব তোভিয়া। ছলছল আঁখিতে উপচে এলো জোয়ার।
,
,
,
“কেমন আছ পদ্মকুমারী?”
মেহেকের করা প্রশ্নে তোভিয়া সহজ গলায় প্রত্যুতর করে—
“ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”
মেহেক সুন্দর করে হাসলেন। তার হাসিতে ঝিলমিল করে উঠল দন্তপাটি। মেহেক সাজতে পছন্দ করেন। রং পছন্দ করেন। তার পুরো শরীরে শোভা পায় নানা বর্ণের রঙ। তার দীঘল কালো কুন্তলে শোভা পায় হীরের তৈরি চুলবন্ধনী। গলায় জড়োয়ার হার। কানে বড়ো বড়ো ভারী দুল। মাথার ওপর ছোট্ট হীরে খচিত তাজ। পায়ের নুপূর থেকে শুরু করে মাথার তাজ পর্যন্ত সমস্ত অলঙ্কারে নিজেকে সুসজ্জিত রাখেন মেহেক। তার ঘরে সব সময় ফুলের ঘ্রাণ। কাঁচা ফুলের কৃত্রিম আবাস গড়ে তুলেছেন তিনি তার কক্ষে।
লাল ওষ্ঠাধর নাড়িয়ে বললেন—
“আমি ভালো আছি।”
হাতে তার কাজলের কৌটা। তা থেকে আঙুলের ডগায় এক চিলতে কাজল নিয়ে চোখে ঘষে বললেন—
“কেমন হয়েছে বলো তো?”
তোভিয়া নরম হেসে বলল—
“সুন্দর!”
“ধন্যবাদ। তুমি কী কিছু বলতে চাও? আমার ঘুম পাচ্ছে। ”
“বেগমরাণি আমার আর জেহেনের বিবাহের সম্মতি দিয়েছেন। আপনি তাতে অসন্তুষ্ট তো নন?”
একগাল হেসে ফেললেন মেহেক। আরশির সামনে থেকে সরে এসে মিহি গলায় বলল—
“বেগমরাণি যখন বলেছেন, তাতে আমার কেন আপত্তি থাকবে? সুখী হও! প্রার্থনা করি।”
“ধন্যবাদ, কাকি আম্মি। আমি তাহলে আসি।”
“শুভরাত্রি।”
“শুভরাত্রি।”
মেহেকের কক্ষ থেকে বের হয় তোভিয়া। মেহেকের তন্দ্রালুভাব! পালঙ্কের কাছে যেতেই অস্পষ্ট কণ্ঠ—
“আম্মি!”
মেহেক জাগ্রত হলেন। নিদ্রা পরিরা পালিয়ে গেল। তেহজীবকে দেখে হাসলেন। তেহজীব ভেতরে এসে দাড়াল। তার কণ্ঠ নরম হলেও চোখে ক্ষুব্ধভাব। মেহেক বুঝতে পারলেন। ছেলেকে শুধালেন—
“কিছু বলবে?”
তেহজীব ভনিতা না করেই বলল—
“আপনারা এই বিবাহের জন্য সম্মতি কেন দিয়েছেন? আপনাদের কী মনে হয়, জেহেনের সাথে বিবাহ হলে ভবিতব্য যুদ্ধে আপনারা লড়াইবিহীন জয়লাভ করবেন?”
মেহেক তার দীর্ঘ রেশম কালো চুলে চিরুনি চালিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে বললেন—
“বেগমরাণি যা করেছেন, ভেবে চিন্তে করেছেন। তার বিরোধিতা তুমি করবে না।”
“ভুল করছেন আপনারা। তোভিয়াকে আমি ভালোবাসি। আপনারা যে কারণবশত এই বিবাহে সম্মতি দিয়েছেন, জেহেন যদি সেই কারণ উৎঘাটন করতে পারে, তাহলে তা কারো জন্যই সুখকর নয়। না জেহেন আপনাদের ছাড়বে, না সেই কয়েক শতবছর পর্যন্ত জীবিত থাকা সত্তা। যিনি আজও তার রাজ্যের রাণির জন্য অপেক্ষা করে আছেন।”
মেহেক সন্দিহান চোখে চেয়ে বিচলিত গলায় বললেন—
“সব জেনেশুনে তুমি কী করে ভালোবাসতে পারো তোভিয়াকে?”
“জানি না। ওকে আমার চাই।”
মেহেক হেসে ফেললেন। তার চোখ দুটোতে জ্বলে উঠল বিভিন্ন রং। যেমনটা রঙধনু হয়। তিনি বক্র স্বরে বললেন—
“জেহেনকে তার মৃত্যু ডাকছে। তোভিয়ার সাথে তার এই বিবাহ; মৃত্যুর পূর্বাভাস। আমরা তোমার ক্ষেত্রে তা হতে দিতে পারি না।”
উগ্র হয়ে উঠল তেহজীব। রুষ্ট স্বরে বলল—-
“তার পূর্বেই জেহেন তোভিয়াকে নিজের করে নেবে। আমি তা সহ্য করতে পারব না।”
“তেহজীব! লাগাম দাও। তুমি জানো, কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ?”
“আম্মি, তোভিয়াকে আমার চাই। এই বিবাহ বন্ধ করুন। জেহেন যেন কোনোভাবেই তোভিয়ার কাছে যেতে না পারে। তাহলে কিন্তু আমি আপনাদের সাথে নেই।”
মেহেক দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বললেন—
“রাজকুমার হিমালয়ের পরিণতি তুমি ভুলে গিয়েছ? কী হয়েছিল তার সাথে? শেষ জীবনে কালকুঠরিতে তাকে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়। তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু হবে জেহেনের সাথে! ভয়ংকর ! আমার একমাত্র পুত্র তুমি। আমরা কেউ তোমার ক্ষতি চাই না। ভুলে যাও ওই অভিশপ্ত কন্যাকে। তোমার বাবা ফিরবে। তিনি জানতে পারলে কষ্ট পাবেন। আমরা অন্য কাজে এসেছি তেহজীব। প্রেম, ভালোবাসা, পরিণয়ের জন্য অনেক সময় পাবে। এখন এসব ভাবার সময় নয়। আমাদের হাতে সময় খুব কম।”
তেহজীবের অশান্ত অন্তঃকরণ শান্ত হলো না। জেহেনকে তোভিয়ার পাশে ভাবতেই তার পুরুষালী দীর্ঘকায় দেহ খটমটিয়ে উঠে। তার আকাঙ্ক্ষীত নারীটির অঙ্গে অন্য কারো ছোঁয়া সে মেনে নিতে পারবে না। কিছুতেই না।
,
,
,
রাতের মধ্য প্রহর। আচানক তন্দ্রা ছুটে গেল তোভিয়ার। সে উঠে বসল। কক্ষ জুড়ে মৃদু বাতির অনুজ্জ্বল আলোর ভেলা। মস্তিষ্ক ঝিমঝিম করছে। পাশ টেবিলের ওপর পানির জগ রাখা। তোভিয়া কাত হলো। গ্লাসে পানি ঢেলে পান করল। মুক্ত শ্বাস ফেলল সশব্দে। পায়ের কাছ থেকে ভারী চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রাখল। ভালো লাগছে না তার। ধীর পায়ে ব্যলকনিতে এসে দাড়াল। কৃষ্ণ চাঁদোয়ায় জেগে আছে চন্দ্রাবতী। ঝরে পড়ছে তার অবিরাম কিরণ। নিস্তব্ধ পদ্মনগর ঘুমন্ত মনুষ্যে সয়লাব। ডেকে যাচ্ছে নিশাচরদের দল। চকিতে ভ্রূ বাঁকায় তোভিয়া। সে দেখতে পেল কালো রঙের গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে লোহার ফটক দিয়ে। চিনতে ভুল হলো না। জেহেনের গাড়ি।
সে বিস্মিত হলো। এই রাতের মধ্য প্রহরে কোথায় যাচ্ছে জেহেন? আর কেন যাচ্ছে?
চলবে,,,