” দশ লাখ টাকার জন্য নিজের বোনকে বিক্রি করে দিতে তোমার একটুও বাঁধলো না?”
অর্হিতার প্রশ্নের বিপরীতে তার ভাই অর্নিশ অবিচলিত গলায় বলল—
“বিক্রি বলছিস কেন? তোর বিয়ে ঠিক করেছি।”
“বিয়ে! একটা বিবাহিত, বাচ্চাওয়ালা পুরুষের সাথে নিজের কুমারী বোনের বিয়ের কথা ভাবতে তোমার একটুও খারাপ লাগল না?”
অর্নিশ ঠান্ডা স্বরে বলল—
“খারাপ লাগবে কেন? আর বিবাহিত পুরুষরা কি বিয়ে করে না? ছেলের অগাধ সম্পদ। তোর কোনো কিছুর অভাব হবে না।”
অর্হিতা গর্জে উঠে বলল—
“করব না আমি বিয়ে। একটা বিবাহিত ছেলেকে আমি কখনো বিয়ে করব না। চলে যেতে বলো তাদের।”
বসার ঘর থেকে অর্হিতার কর্কশ স্বর স্পষ্ট শুনতে পেল নায়েল। কিন্তু সে স্থির, নিষ্কম্প। নায়েলের পাশেই তার সাত বছরের মেয়ে পিউলী। অর্হিতার গলার স্বরে মৃদু কম্পন দিয়ে উঠল পিউলীর ছোট্ট হৃদপিন্ডটা। বাবার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইল। নায়েল চোখে হাসল। মেয়েকে আশ্বস্ত করল তার বাবা সবসময় তার সাথে আছে। ছোট্ট করে মেয়েকে বলল—
“বি অ্যা ব্রেভ গার্ল! নট টু ওয়ারি।”
পিউলী তার সরু, শুষ্ক অধর বিস্তৃত করল। প্রসন্ন সে। ভেতর ঘর থেকে হনহনিয়ে আসলো অর্হিতা। জ্বলন্ত চোখে নায়েলের দিকে চেয়ে খলবলিয়ে বলল—
“আপনার সাহস তো কম না! আপনি আবার এসেছেন? আমি তো বলেছি। হবে না এই বিয়ে।”
মুচকি হাসল নায়েল। ওঠে দাঁড়াল সে। পকেটে দুই হাত গুঁজে মুখমন্ডলে ভারী ভাব আনে। ভ্রূকুটি করে অর্হিতা। লোকটা লাগামছাড়া বেয়াদব! চোখের কোণে নিগূঢ় হাসল নায়েল। নিরুদ্বেগ গলায় বলল—
“ইটস ওকে। বিয়ে না হলে আমার টাকা ফেরত দিন। রাইট নাও।”
শেষের বাক্য এমনভাবে বলল থরথরিয়ে উঠল অর্হিতা। রাগে ফুঁসে উঠে বলল—
“ভাইয়া, ফিরিয়ে দাও তার টাকা।”
বসার ঘরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতার মামা, মামি। তাদের মেয়ে রূমঝুমও আছে। অর্নিশ অর্হিতার আপন ভাই। বাবা, মায়ের মৃত্যুর পর মামা বাড়িতেই থাকে তারা। অর্নিশ ছোটো একটা ফার্মে চাকুরী করে। স্বল্প বেতনে তার অভিলাষ বিস্তীর্ণ ! সে অভিলাষের পূর্ণতার জন্য নিজের বোনকে একজন বিপত্নীক পুরুষের সাথে দশ লাখ টাকার বিপরীতে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু এই বিয়ের ঘোর বিরোধী কনে নিজে। অর্হিতা কিছুতেই নায়েলকে বিয়ে করতে রাজি নয়।
বোনের মুখে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা শুনে কলিজা ঝাঁঝরা হয়ে গেল যেন অর্নিশের। কলের পুতুলের মতো বলল—
“টাকা নেই। ফ্ল্যাট কেনার জন্য অলরেডি বায়না করে ফেলেছি আমি। সামনে মাসেই উঠব। বাকিটা কিস্তিতে শোধ করব।”
ভাইয়ের কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল অর্হিতা। রাগে বিহ্বল হয়ে বলল—
“তুমি কী মানুষ! ভাই হয়ে কী করে পারলে এমনটা করতে? ঘৃণা হচ্ছে আমার।”
ছলছল করে উঠল অর্হিতার চোখ। তার ভাইটা এত লোভী কী করে হলো?
নায়েল নির্লিপ্ত হাসল। অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল—
“ওয়েল। আপনার কোনো বয় ফ্রেন্ড আছে মিস অর্হিতা?”
অর্হিতার রাগে যেন কেউ ঘি ঢেলে দিলো। গনগনে উত্তপ্তা ছড়িয়ে বলল—
“নেই। তা দিয়ে আপনার কী দরকার?”
তাচ্ছিল্য হাসল নায়েল। ফিচেল গলায় বলল—
“এই বয়সে এসেও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাতে পারলেন না?। ভেরি স্যাড! তো আর কী করার? জাস্ট গেট রেডি। বিয়েটা আজ-ই হবে। আর এ…খু…নি।”
অর্হিতা তার রাগের বিস্ফোরণ ঘটাল। দাপিয়ে উঠে বলল—
“আপনি বললেই হলো?”
নায়েল ধপ করে কাউচে বসল। ভীত পিউলীর দিকে চেয়ে তুচ্ছ গলায় বলল—
“দুই ঘণ্টা সময় দিলাম মি. অর্নিশ। হয় আমার টাকা ফেরত দিন না হলে কাজি ডেকে আনুন।”
অর্নিশ চকচকে গলায় বলল—
“আরে না, না। আপনি বসুন। আমি এখুনি কাজি ডেকে আনছি।”
অর্নিশ চলে যেতেই অর্হিতার মামা, মামি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। তারা নিশ্চুপ। কারণ, তাদেরকেও আলাদা করে টাকা দেওয়া হয়েছে।
অর্হিতা রাগে জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এই লোকটাকে ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। পরক্ষণেই তার অন্ত:করণে অমাবস্যা ছেয়ে যায়। এই বাড়ির মানুষগুলোতো তাকে বের করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। সে তো একটা খড়কুটো। তার কী কোনো দাম আছে?
,
,
,
আধাঘণ্টা যাবৎ বসে আছে নায়েল। অর্নিশ এখনো ফেরেনি। অস্তাভা সূর্যের টগবগে লাল রঙে রক্তিম হয়ে উঠেছে শেষ বিকেল। ধূসর পশ্চিমাদেশ তখন রঞ্জিত। ম্লান চোখে বাবার দিকে তাকাল পিউলী। নায়েল আদুরে গলায় বলল—
“খিদে পেয়েছে আমার অ্যাঞ্জেলের?”
পিউলী নৈঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল। নায়েল চোয়াল শক্ত করে। এই বাড়ির মানুষগুলোর গাফিলতির কারণে মেয়েটা তার না খেয়ে আছে এখনো। নায়েল ভারী গলায় ডেকে উঠে—
“তমাল! তমাল! ”
ড্রাইভার তমাল বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নায়েলের ভারী স্বরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে। ব্যগ্র গলায় বলল—
“জি স্যার।”
“গাড়িতে খাবার রাখা আছে। নিয়ে এসো।”
তমাল দ্রুত চলতে শুরু করে। ঘর থেকে বেরিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যে খাবার নিয়ে ফিরে আসে। পিউলীকে দিতেই ছোট্ট পিউলী নীরস হাসে। চোখ ভরা তার ক্লান্তি। নায়েলের বুক ভারী হয়। মেয়েটা আজ বিকেলে একটু ঘুমাতেও পারেনি।
অর্নিশ ফিরে আসে আরও মিনিট বিশেক পর। অর্হিতা কিছুক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজেই শান্ত হয়ে যায়। গত একমাস ধরে চলছে এই বিয়ের গুঞ্জন। আজ- ই সে জানতে পেরেছে নায়েল মোটা অঙ্কের টাকা ছড়িয়েছে তার জন্য। ভাইয়ের এমন লোভাতুর কর্মকান্ডে আর কিছু ভাবতে পারল না অর্হিতা। লোকটার দোষ দিয়ে কী লাভ? বউ মরেছে বলে তো আর সারাজীবন একা কাটাতে পারে না? আরও টাকার কুমির। টাকা ছড়ালেই মেয়ের অভাব হবে না। তবে অর্হিতাও ববিতা আর শাবানা নয়। মালালা ইউসুফজাইও নয় সে। সে অর্হিতা। ওই বাচ্চাওয়ালা, কচি মেয়ে বিয়ের করার সাধ করা লোকটাকে যদি নাকানিচুবানি না খাইয়েছে তাহলে সেও শাবানার মতো সেলাই মেশিন নিয়ে গার্মেন্টস খুলে ফেলবে। পড়ে ধীরে ধীরে বড়োলোক্স হয়ে যাবে।
রাগের মাথায় বিব্রতকর চিন্তা ভাবনার উদয় হচ্ছে শুধু। কিন্তু সব কথার শেষ কথা, বিয়েটা তাকে করতে হচ্ছে।
,
,
,
বিয়ে সম্পন্ন হয় নির্বিঘ্নে। নায়েল আগেই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে বসে আছে। বাড়ির কারো সাথে একটা কথাও বলেনি অর্হিতা। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। দরজা খুলেই ধপাস করে গাড়ির ভেতরে বসে সে। তমাল ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। তার মনে হলো কোনো প্রাচীন যুগের ডায়নাসোর হামলা করেছে তার গাড়ির উপর। ঠোঁট চিপে হাসল নায়েল। মেয়েটাকে রাগলে সাধারণের মাঝেই অসাধারন লাগে!
পিউলী বসেছে নায়েল আর অর্হিতার মাঝে। অর্হিতার পাশ থেকে দূরত্ব কমিয় এনে তার হাতটা ছুঁয়ে বলল—
“মামুনি!”
অর্হিতা নগ্ন রাগের বর্ষণ ঘটালো। শাসিয়ে উঠে বলল—
“এই মেয়ে, একদম আমাকে মামুনি বলবে না। সরে বসো।”
পিউলী ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। যেন এখনই কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে। তাকে কাছে টেনে নেয় নায়েল। বুকের বা’পাশে ঠেসে রেখে জোর গলায় বলে উঠে—
“তমাল, তোমার পাশের সিটে একটা খাম আছে। গিয়ে মিস. ওপস! সরি মিসেস অর্হিতার ভাইকে দিয়ে এসো। আর বলবে, আমি যেন তাদের কাউকে আমার বাড়ির আশেপাশে না দেখি। গো, ফাস্ট।”
রাগে অর্হিতার শরীর রি রি করে ওঠে। সহ্য হচ্ছে না এই লোকটাকে তার। এতটা জঘন্য মানুষ হয় কী করে!
নায়েল গুমোট শ্বাস ফেলল। তার মেয়ের মা প্রয়োজন। আর তার নিজের মেয়েকে প্রয়োজন। উদ্বিগ্ন নায়েল, নিজ জঠর থেকে জন্ম না দিয়েও কী কারো সত্যি কারের মা হওয়া যায়?
চলবে,,,
#জঠর
#পর্বঃ১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি