জীবনের জলছবি (পর্ব ১৫)

জীবনের জলছবি
পর্ব ১৫

গত তিন বছর ধরেই এই চলছে, না নিজে একবারের জন্যও যেতে পেরেছে, না তনু শেষ পর্যন্ত আসতে পেরেছে শিলিগুড়ি তে। অথচ খুব জোর দেখিয়ে বলেছিলো চলে আসার সময়, এবার আমি যাবো, কিন্তু সেটা কথার কথা হয়েই রয়ে গিয়েছে শুধু।

এদিকে স্কুল শেষে এখন কলেজে উঠে গেলো টুসি। কিন্তু আজ পর্যন্ত একবার দিদিমার অসুখের খবর শুনে শুধু মা একা গিয়ে ঘুরে এসেছিলো, পরীক্ষা সামনে বলে ওর আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। গত প্রায় তিন বছর ধরে ভরসা বলতে প্রতি শুক্রবার কলেজ থেকে ফেরার পথে ফোন।

তাও এতটাই এস টি ডি বিল হয় যে একটা বা দুটো কথার পরই রেখে দিতে হয়। কারণ প্রতিবার ফোন টা টুসি কেই করতে হয় তনুর বন্ধুর দোকানে, তনুর পক্ষে তো আর করা সম্ভব নয় কোনো মতেই।
রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে আর কতটুকুই বা জমানো সম্ভব টুসির পক্ষে, মা তো আর এক্সট্রা টাকা দেয়না ওর হাতে।

তবু এইভাবেই চলছিলো সব কিছুই। সেই একঘেয়ে কেমন আছো, আর ভালো আছি মার্কা কথা বার্তা। সেদিন কিন্তু অন্যরকম হলো, ফোন ধরেই তনু বললো

একটা জরুরী কথা বলার ছিলো টুসি। কয়েকদিন ধরে বলবো ভাবছিলাম বলা হয়ে উঠছিলো না। আমি একটা চাকরি পেয়েছি ব্যাঙ্গালোরে, আপাতত এক বছরের ট্রেনিং, ফোন তো থাকবে না আর তাই যোগাযোগ করা সমস্যা হয়ে যাবে। সেইজন্য আর আমাদের খুব বেশি কথা হবে না মনে হয়।

টুসি আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল একদম প্রথমে, ওফ্, ওর কতদিনের ইচ্ছা এই প্রথম সফল হবার দিকে এক ধাপ এগোল, মনে মনে ভাবছিল ও। কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা হলো কি ভাবে যোগাযোগ করবে এবার তবে, কোথায় বা যোগাযোগ করবে ও। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো, এবার কি করবে বুঝতে পারছিলো না ও।

কি হবে তাহলে? কোনো উপায় নেই!

একটু হতাশ গলায় বললো টুসি।

কি করবো বলো, অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় তো দেখছি না এখন আর। যদি তোমার মনে হয় তুমি সেটা পারবে না, তাহলে ভেবে দেখতে পারো, আমি তোমাকে আটকাবো না,

কেমন যেন একটা নিস্পৃহ গলায় বললো তনু, টুসি অবাক হলো।

এ আবার কি কথা, আমি তো এরকম কিছু ভাবিনি, উল্টে তুমি চাকরি পেয়েছ শুনে খুশিই হয়েছিলাম। এখন এসব কথা আসছে কেনো! আমার তো মনে হচ্ছে তুমিই ভাবছো এগুলো,

একটু ক্ষোভের গলায় বললো ও, ওর সত্যি মনে হচ্ছিলো তনু যেনো কেমন ওকে এড়াতে চাইছে! তনু ওর কথার কোনো উত্তর দিলো না, প্রতিবাদও করলো না কিছু, টুসি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিল।

টিউশন ব্যাচ এ ঢুকে সোমা কে বললো কথাগুলো, ওর কি তনুর চাকরি পাওয়ার জন্যে খুশি হওয়া উচিত নাকি পরবর্তী তে কি হতে চলেছে সেটা ভেবে দুঃখ পাওয়া উচিত সেটা বুঝতে পারছিলো না। তনু কি সত্যি ওকে এড়াতে চাইছে!

আরে ওকে বলনা তোকে ওর অফিসের নম্বরটা দিয়ে দিতে, তাহলেই তো হয়ে গেলো। ওকে আমার নম্বরটা দিয়ে দে আর বলে দে আমার বাড়িতে ফোন করে অফিসের নম্বর টা জানিয়ে দিতে। জাস্ট একবারই করবে তো তোকে একটা নম্বর দেবার জন্য, আমাকে বলে দিতে বলবি, আমি একবারের জন্য বাড়িতে ম্যানেজ করে নেব,

সোমা বললো। মেয়েটা খুব হাসি খুশি, ওর সঙ্গে টুসির বন্ধুত্ব টা একটু অন্যদের থেকে বেশিই। এতো সহজ সমাধান তো ওর মাথায় আসেনি আগে! টুসি খুশি হলো, তনু তো এবার চাইলেই নিজের অফিসের নম্বর টুসি কে দিতে পারে, এরপর না হয় ওই করবে আবার আগের মতই। একবার ফোন করে আসার পরে আর টাকা ছিলো না টুসির, সেটাও দিলো সোমা,

যা, নম্বর টা দিয়ে আয় ফোন করে, তুই যা! এরপর সারাদিন মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াবি,

হেসে বললো সোমা, টুসি সত্যি খুশি হলো, সোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পরে ওকে অনেকটাই মাম এর মতো লাগে টুসির। ওর সঙ্গে ও অনেক কথা শেয়ার করতে পারে যা অন্য দের সঙ্গে পারে না। টুসি জানে এই নিজেদের বাড়ির ফোন নম্বর দেওয়ার জন্যে ওকে যথেষ্ট ঝামেলায় পড়তে হবে বাড়িতে, তবু টুসির জন্যে এটা ও করলো ভেবে কৃতজ্ঞ হচ্ছিলো টুসি।

এবার ফোন করতে গিয়ে আর তনু কে পেলো না টুসি, ও চলে গেছে জানালো ওর বন্ধু।

ও এলে এই ফোন নম্বর টা দিয়ে দিও প্লিজ,

তনু কে না পেয়ে ওকেই বললো টুসি, ছেলেটা হাসলো,

কেনো? আমার দোকানে ফোন করতে অসুবিধা হচ্ছে কিছু?

না না, এতদিন তাই তো করতাম, কিন্তু এখন ও চলে যাবে তো, তোমাকে করে আর ওকে পাবো না তো!

হাসিমুখেই বললো টুসি, ছেলেটা চুপ করে গেলো, টুসি বুঝলো ও একটু ক্ষুব্ধ হয়েছে, এত বছর ধরে ওর দোকানেই তো ফোন করে আসছে ও। আর বেশি কিছু বলতে চাইলো না টুসি, এমনই ও সোমা র কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছে, বেশি বিল উঠে গেলে মুশকিলে পড়ে যাবে ও।

এরপরে প্রায় মাস দেড়েক হতে চললো তনুর কোনো খবর নেই আর। সোমা র কাছে রোজ খবর নেয়, নাহ! কোনো ফোন আসেনি তনুর। প্রতিদিনই ও আশা করে আজ নিশ্চয়ই কোনো খবর থাকবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়েই ফিরতে হয়। ক্রমশ ধৈর্য হারাচ্ছিলো ও। কিন্তু কি করা যেতে পারে, যদি না তনু নিজে থেকে যোগাযোগ করে ওর সঙ্গে।

ইদানিং বেশ কিছুদিন ধরেই তনু যেনো ওর সঙ্গে খুব বেশি কথা বলতে চায় না, মনে হচ্ছে টুসির। মাঝে মাঝেই কোনো কোনো সপ্তাহে ও বন্ধুর দোকানে আসেনা ঠিক সময়ে। যদিও বা আসে সেরকম ভাবে কথা বলেনা টুসির সঙ্গে। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছা করে কারণ টা জানতে চাইবে ওর মামাতো দাদার কাছে। কিন্তু যেহেতু তনু কোনোদিনই চায়নি ওর দাদা জানুক, সেহেতু আজ পর্যন্ত দাদা কে বলা হয়নি আর।

তাই কোন অজুহাতে জিজ্ঞেস করবে তনুর কথা সেটা বুঝতে পারেনা টুসি। তনু কি আর ওকে ভালোবাসে না! এই কথা টা মাঝে মাঝেই মনে হয় ওর। না হলে এতদিনেও একবারের জন্যেও ওর অফিসের নম্বরটা সোমাকে দিতে পারলো না কেনো!

মন টা খুব অশান্ত হয়ে আছে সেই থেকেই। না দেখা, না কথা, কতদিন এরকম ভাবে চলতে পারে কোনো সম্পর্ক! আগে না হয় কোনো সুযোগ ছিলো না, তাই বাধ্য হয়েছিলো ওরা, এখন তো তা নয়, এখন ইচ্ছা করলেই তো ফোন করতে পারে তনু, তাহলে কেনো করছে না! এসব ভাবতে ভাবতেই রাস্তা পার হচ্ছিলো টুসি।

হটাৎ অনেক লোকের চিৎকারে চমকে উঠে টুসি দেখলো একটা বাসের ঠিক একদম সামনে দাঁড়িয়ে ও। ঠিক কোর্টের পাশেই বাস স্ট্যান্ড, আচমকাই একটা বাস টার্ন নিতে গিয়ে ওর ওপর উঠে যাচ্ছিলো প্রায়। ঠিক কি করা উচিত সেই মুহূর্তে বুঝতে না পেরে কেমন যেন থতমত খেয়ে একদম মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো ও।

জাস্ট একদম গায়ের সামনে এসে ব্রেক টানলো বাস টা। বাসের পেছনের দিকটা অল্প ছুঁয়ে গেলো ওকে, ওই ধাক্কাতেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল টুসি। লোকজন হই হই করে ছুটে এসে মাটি থেকে টেনে তুললো ওকে। চোট খুব বেশি লাগেনি, তবে একটু কেটে গেছে হাত টা আর নাক থেকে পড়া রক্ত টা বন্ধ হচ্ছিলো না কিছুতেই।

একজন এগিয়ে এসে ওর হাতে ব্যাগ টা তুলে দিলো। খুব লজ্জা লাগছিলো, কোনো মতে ওখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলো ও। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা বাক্যগুলো আরও অস্বস্তি দিচ্ছিলো টুসি কে।

কিন্তু রক্ত বন্ধ না হওয়ায় কিছু লোক ওকে ছাড়তে চাইলো না, পাশেই হসপিটাল, জোর করে এমার্জেন্সি তে টুসি কে ঢোকালো লোকগুলো। টুসি যেতে চাইছিলো না, বারবার বলছিলো ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ওরা শুনলো না। নাক বেয়ে গড়িয়ে আসা রক্ত টা বন্ধ করার চেষ্টায় একটা রুমাল মুখের ওপর চেপে ধরে ছিলো ও।

নার্স এগিয়ে এসে বললেন,

রুমাল টা মুখ থেকে নামাও, তবে তো স্যার দেখবেন।

শুনে মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে দিলো ও, রুমাল টা মুখ থেকে নামিয়েই দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো টুসি, তপু দা! এতক্ষনে রুমাল নামানো রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলো তপুও, টুসি!
ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here