#ধারাবাহিকগল্প
#জীবনের নানা রং
পর্ব-ছয়
মাহাবুবা বিথী
বুক ধুকপুকানি আর একরাশ টেনশন মাথায় নিয়ে শিউলি ওর বোন দুলাভাইয়ের সাথে রেস্টুরেন্টে জাবেদের সাথে দেখা করতে গেলো।শেফালীর কিনে দেওয়া থ্রীপিসটা শিউলি আজ পড়ে এসেছে।হালকা সাজে শিউলিকে ভালোই লাগছে।যদিও চেহারার মধ্যে চিন্তার ভাঁজ রয়েছে।
জাবেদ খাবার অর্ডার করে টেবিলে বসে শিউলিদের জন্য অপেক্ষা করছিলো।দূর থেকে জাবেদ শিউলির দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলো।মেয়েটা আসলেই বয়সে ওর থেকে বেশ ছোটো।সাত আট বছরের ছোটো তো হবে।মা যেহেতু ওকে পছন্দ করেছে তাই জাবেদেরও অপছন্দ করার উপায় নাই।আবেদ পাগল হওয়াতে জাবেদেই ওদের একমাত্র
অবলম্বন। সে জন্য কখনও ও বাবা মার অবাধ্য হয়নি। ওর এক বোন অস্টেলিয়া প্রবাসী। তুলি সবার ছোটো বোন। মাত্র এইচএসসি দিবে।
রমজান জাবেদের কাছে এসে বললো,
—-ভাই একটু দেরী হয়ে গেলো।
—-কোনো সমস্যা নেই।আপনি আর ভাবিও বসেন।
সরুপা বললো
—-না ভাই,আমরা অন্য টেবিলে বসি।তোমরা নিজেদের মধ্যে আলাপটা সেরে নাও।
ওরা দুজন সরে যাওয়ার পর প্রথম দর্শনেই জাবেদের শিউলিকে ভালো লেগে যায়।ওর দিকে তাকিয়ে দেখলো,ও মাথা নিচু করে বসে আছে।নিরীহ সহজ সরল শান্ত প্রকৃতির মেয়ে বলে মনে হলো।জাবেদ শিউলিকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-কেমন আছেন?
শিউলি বললো,
—-ভাল আছি।আপনি কেমনআছেন?
জাবেদ বললো,
—ভালো আছি।আপনার মনে হয় একটু অস্বস্তি লাগছে।কোনো ব্যাপার না একটু পরেই অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।আপনি ভাবছেন,আমি কি করে বুঝলাম।আপনার আগে আরও কয়েকটা মেয়ে দেখা হয়েছে।সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা।
ওর আসলে খুব লজ্জা লাগছে।জাবেদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।কোনো পাত্রের সাথে মিট করা এটাই ওর প্রথম।তারপরও শিউলি
এক পলক জাবেদকে দেখে নিলো।বেশ সুদর্শণ স্মার্ট চওড়া কাঁধ মাথা ভর্তি চুল পছন্দ করার মতই একজন মানুষ।গলার কন্ঠস্বর বেশ ভরাট।এর মধ্যে টেবিলে খাবার চলে আসলো।জাবেদ শিউলিকে খেতে বললো।
শিউলির আসলে একদম খেতে ইচ্ছে করছে না।বাড়িতে যে কি হচ্ছে কে জানে।সব মিলিয়ে ওর খুব অস্থির লাগছে।গলা দিয়ে কোন খাবার নামছে না।
জাবেদ খেতে খেতে শিউলিকে বলতে লাগলো,
—–আপনাকে আমার মা খুব পছন্দ করেছে।আমি আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাবা মার পছন্দেই বিয়ে করবো।মা যেহেতু পছন্দ করেছে তাই আমারো অমত নাই। আপনি নিশ্চয় জানেন আমার বড় ভাই পাগল।একবোন অস্টেলিয়া প্রবাসী আর সবার ছোট তুলি।ওদের নিয়েই আমার সংসার।বড় ভাই পাগল হওয়াতে আমার পরিবারের সবার একমাত্র অবলম্বন আমি।ওরা সুখে থাকলেই আমি সুখী। যদিও বাবা মার পছন্দে আমরা বিয়ে করছি তবুও দুজন দুজনকে জানার জন্য মাঝে মাঝে ফোনে একটু কথা বলা দরকার।
—-আপনি কিছুই খেলেন না।আপনার নিজের কথা তো কিছুই বললেন না।আমি একাই বকবক করে গেলাম।
শিউলি বললো,
—-বলার সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না।আজ না হোক অন্যদিন বলবো।আমার ফোন নাম্বারটা নিন।
মাগরিবের আযান হচ্ছে।রমজান আর সরুপা ওদের টেবিলে উঠে আসলো।রমজান বললো,
—জাবেদ আজকের মতো উঠি ভাই।
শিউলি সালাম দিয়ে জাবেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সরুপাদের বাসার পথে রওয়ানা হলো।
অনেক রাতে ফোনের শব্দে শেফালীর ঘুম ভাঙ্গলো।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত দুটো বাজে।মোবাইল স্কীনে শাহেদের নাম্বার ভেসে উঠলো।
—-হ্যালো মেজ আপা বাবা মারা গেছেন। আমি আর রমিজ ভাইয়া হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাসায় আসছি।
শেফালী সরুপা আর রমজানকে ফোন দিলো।ওর চাচা আর ফুফুকেও ফোন জানিয়ে দিলো।চারটার সময় শাহেদ লাশ নিয়ে চলে আসলো।ছ,টার মধ্যে আত্মীয় স্বজন সবাই বাড়ি চলে আসলো।কেউ আক্কাস মিয়ার বিয়ে করা বউয়ের খোঁজখবর করলো।সেদিন শুক্রবার ছিলো।জুম্মা নামাজের আগে দাফনের জন্য লাশ রেডী করা হলো।ওর দাদা চাচা সহ সমস্ত আত্মীয় স্বজন মিলে জানাযা পড়ে নামাজের আগে দাফন করা হলো।
বিরাট একটা ঝড় শেফালীদের পরিবারের উপর দিয়ে বয়ে গেলো।বেঁচে থাকতে যে মানুষটাকে সহ্য করা যেতো না মরে যাবার পর সেই মানুষটার জন্য অঝোরে এই পরিবারের সবার চোখের জল ঝরছে।
পানিকেও দুই ভাগ করা যায়।কিন্তু রক্তের বাঁধন কখনও ছিন্ন হবার নয়।
এই পৃথিবীতে রক্তের সম্পর্কের বাঁধন নাকি মজবুত হয়।কিন্তু কারো ক্ষেত্রে এই বাঁধন অনেক পলকা হয়।রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলো অনেক সময় সবচেয়ে বেশী আঘাত করে।হৃদয়টাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।প্রতিনিয়ত সেই ক্ষতের দাগ থেকে রক্ত ঝরে। তবুও ক্ষমা করে দিতে হয়।ক্ষমা করে দেওয়াটাই মনুষত্ব্যের লক্ষণ।মনুষত্ব্যকে যে ধারণ করে সেই তো পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারে।
শেফালী মায়ের পাশে গিয়ে বসে।তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আর বাবার হয়ে মার কাছে ক্ষমা চায়।রাহেলা বেগম শেফালীকে বলে,
—–তোর বাবাকে অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি।এই দুনিয়াটা বড় অদ্ভূত জায়গা।তোর বাবারও কষ্ট ছিলো।তার স্বভাবের জন্য বাবা ভাই বোন সন্তান কেউ তার পাশে ছিলো না। বড়ই নিঃসঙ্গতায় ভরা ছিলো তার জীবন।এই বাড়ি ঘর ছেলে মেয়ে সবই তো তার হওয়ার কথা ছিলো।এগুলি পাওয়ার সৌভাগ্য তার হলো না।তার সবকিছুই ভাগ্যের লিখনে আমিই ভোগ করলাম। সে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। এটাই তো উনার জীবনের সবচেয়ে বড় শাস্তি।
এমনি করে শেফালী শিউলি সরুপার মতো মেয়েরা চলার পথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।আবার মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে নতুন করে উঠে দাঁড়ায়।জিতে না ফেরা যুদ্ধ চালিয়ে যায়।একই রকম লড়াই হয়তো সবাই করে না।কিন্তু প্রতিটি নারীকেই তার জীবনের ময়দানে যুদ্ধ করেই ঠিকে থাকতে হয়।
রাতে জাবেদ শিউলিকে ফোন দিয়ে সমবেদনা জানায়।জাবেদের বাবা মাও রাহেলা বেগমকে ফোন দিয়ে সমবেদনা জানায়।
এর মাঝে জাবেদ ওর বাবা মা সহ এসে শিউলিকে আংটি পড়িয়ে দেয়।রমজান সরুপা সহ শিউলির চাচা ফুফুরা কুমিল্লা গিয়ে জাবেদকে আংটি পড়িয়ে আসে। মাঝে মাঝে জাবেদ আর শিউলির সাথে ফোনে কথা হয়।জাবেদ শিউলিকে বলছিলো শ্বশুর বাড়ি থেকে ও কিছুই নিবে না।ঘরোয়াভাবে শিউলিকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। শোকের চল্লিশদিন পার হয়ে গেলে উভয়পক্ষের মুরুব্বিদের সাথে নিয়ে জাবেদ শিউলীকে বিয়ে করে নিয়ে যায়।
কুমিল্লায় জাবেদের বাড়ি পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়।শিউলির সাথে রাশেদও বিয়ে বাড়িতে এসেছে।শিউলি বাসর ঘরে জাবেদের অপেক্ষায় বসে আছে।এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়।জাবেদ ঘরে এসে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।তারপর শিউলিকে ওজু করে আসতে বলে এবং দুজনে মিলে আল্লাহপাকের কাছে দুই রাকাত শোকরানার নামাজ আদায় করে নিজেদের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য আল্লাহপাকের কাছে মোনাজাত করে।
শিউলির ননদ তুলি এসে বিয়ের শাড়ি চেঞ্জ করে পড়ার জন্য একটা সুতি শাড়ি দিয়ে যায়।শিউলি বাথরুমে গিয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে আসে।জাবেদও ফ্রেস হয়ে আসে।শিউলি জড়সড় হয়ে খাটের কোনায় বসে আছে।জাবেদ শিউলির অবস্থা বুঝতে পারে।তাই নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য শিউলিকে বলে
—–অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছো।সারাদিন অনেক ধকল গেছে।শুয়ে পড়ো।তারপর শিউলির পাশে গিয়ে বসে অধোরের ছোয়ায় অধরকে রাঙ্গিয়ে দেয়। শিউলির বুকের গহীনে এক অদ্ভূত শিহরণে পাড় ভেঙ্গে যায়।
চলবে